য়াবৎ স্হাস্যন্তি গিরয়ঃ সরিতশ্চ তাবদ্ মহীতলে ৷৷
তাবদ্ রামায়ণকথা লোকেষু প্রচরিষ্যতি।
( আদিকাণ্ড: ২/৩৬ )
লৌকিক
সংস্কৃত ভাষায় দিব্য রাম কথার শ্রোতস্বিনী প্রবাহিত করে কোটি-কোটি
হৃদয়ে অমৃতত্ত্ব প্রদানকারী মহর্ষি বাল্মীকি আমাদের সকলের বন্দনীয় ।
সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন, শিক্ষা, রাজনীতি আদি বিবিধ বিষয়ে মহর্ষি
বাল্মীকি মনোহারী চিত্রণ করেছেন ।
আর্যাবর্তে আজও কোটি-কোটি ধর্মপ্রাণ রামভক্তগণ রামায়ণে বর্ণিত অমৃতময় রামরাজ্যের কামনা করেন ।
প্রাচীনকালে
রাজনীতি শব্দের প্রয়োগ তথা প্রচলন ছিলো না, সর্বত্র রাজধর্ম শব্দেরই
প্রয়োগ তথা প্রচলন ছিলো । রাজধর্মে ন্যায় এবং দণ্ড-ব্যবস্থা অত্যন্ত
মহত্ত্বপূর্ণ স্থান দেওয়া হতো ।
সভ্যতার বিকাসের সাথে সমাজে ন্যায় এবং দণ্ড-ব্যবস্থারও বিকাস হয়েছে ।
প্রাচীনকাল
থেকেই রাজাকে ধর্ম এবং নিয়মের সংরক্ষণ হিসেবে মানা হয় এবং মর্যাদা
অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তাকে দণ্ড প্রদানের অধিকার দেওয়া হয়েছে । মহর্ষি
মনু অনুসারে প্রজাপতি প্রজাগণের রক্ষা হেতু রাজার সৃষ্টি এবং তার
সহায়তার জন্য দণ্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন । রামায়ণ কালীন আর্যাবর্তেও
ন্যায় এবং দণ্ড-ব্যবস্থা সমুচিত রূপে প্রয়োগ করা-ই রাজার প্রমুখ
কর্তব্য তথা পারলৌকিক সমৃদ্ধির সাধন হিসেবে মান্যতা দেওয়া হতো ।
প্রমাণ –
অপরাধিষু য়ো দণ্ডঃ পাত্যতে মানবেষু বৈ। স দণ্ডো বিধিবন্মুক্তঃ স্বৰ্গং নয়তি পার্থিব ।।
( উত্তরকাণ্ড: ৭৯/৯ )
অপরাধী মানুষদের ওপর যে দণ্ড প্রয়োগ করা হয়, সেই বিধিপূর্বক প্রদত্ত দণ্ড রাজাকে স্বর্গলোকে পৌঁছে দেয়।
অতঃ
নিষ্পক্ষ ন্যায়ের প্রয়োগ তথা দণ্ড প্রদান করা রাজার প্রমুখ কার্য ।
রাজাকেই ন্যায়ের স্রোত হিসেবে মান্যতা দেওয়া হতো এবং প্রারম্ভিক তথা
অন্তিম ন্যায়ালয় প্রজাগণের জন্য রাজাই ছিলেন ।
স্মৃতি
বলে রাজা একা ন্যায় প্রয়োগ করতে পারবে না । তার প্রজাগণের সহায়তায়
ন্য্যায় প্রয়োগ করা উচিত । মনু এবং যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির অনুসারে রাজার
কর্তব্য বিনা আড়ম্বরপূর্ণ বস্ত্র পরিধান কারী বিদ্বান, ব্রাহ্মণগণ এবং
মন্ত্রিগণের সহিত ন্যায়কক্ষে প্রবেশ করা উচিত তথা তাকে ক্রোধপূর্ণ
মনোভাব এবং লোভ-লালসা পরিত্যাগ পূর্বক ধর্মশাস্ত্রে বর্ণিত নীতিমালার
অনুযায়ী ন্যায় প্রয়োগ করা উচিত রামায়ণ কালেও উপর্যুক্ত মান্যতার
প্রয়োগ হতো সর্বত্র এবং শাস্ত্র সম্মত নীতি অনুসারে অপরাধীকে দণ্ড
প্রদাষ করা হতো । কিষ্কিন্ধা কাণ্ডে ভগবান শ্রীরাম বালীকে বলেছিলেন –
আর্য়েণ মম মান্ধাত্রা ব্যসনং ঘোরমীপ্সিতম্। শ্রমণেন কৃতে পাপে য়থা পাপং কৃতং ত্বয়া৷৷
( কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড. ১৮/ ৩৬ )
প্রাচীনকালে আপনার ন্যায় অপরাধ করেছিলেন জনৈক শ্রমণ। আমার পূর্বপুরুষ মান্ধাতাও তাঁর প্রতি কঠোর শাস্তিবিধান করেছিলেন।
অন্য
বিবিধ স্থলেও পরম্পরায় রাজা দ্বারা স্থাপিত রাজধর্ম অনুসারে ন্যায়
শাসন প্রয়োগের উল্লেখ রামায়ণে উপলব্ধ । সেই সময়কালে যদি উচ্চ জ্ঞানী
কোনো ব্যক্তিও নির্বোধ হয়ে, কর্তব্য-অকর্তব্য জ্ঞান হারিয়ে
কুমার্গে গমন করতো তা তাকে ন্যায় সঙ্গত দণ্ড প্রদানের আবশ্যকতা ছিলো ।
এই বিষয়ের স্পষ্ট সংকেত ভরতের প্রতি শত্রুঘ্ন'র প্রয়োগকৃত বচন দ্বারা
স্পষ্ট পরিলক্ষিত, যখন রাজা দশরথ এক নারীতে বশীভূত হয়ে কুমার্গে আরূঢ়
হয়ে গিয়েছিলেন তখন ন্যায় এবং অন্যায়ের উপর বিচার করে তাঁকে প্রথমেই
দণ্ড প্রদান করা আবশ্যক ছিলো । সহায়ক রূপেও রাজা যোগ্য ন্যায়াধীশগণ
দ্বারা সুস্পষ্ট বিচার ব্যতীত বিনা অভিযুক্তকে দণ্ড প্রদানের অনুমতি ছিলো
না, কেননা সমাজে এই প্রথার প্রচলন ছিলো যে, নিরপরাধ হওয়ার পরও যাদের
উপর মিথ্যা দোষ আরোপ করে দণ্ড দেওয়া হতো, সেই নিরপরাধের অশ্রুধারা
পক্ষপাত পূর্ণ শাসনকর্তা রাজার পুত্র, ধন, ঐশ্বর্য আদিল বিনাশের কারণ হতো
। রাজার কর্তব্য ছিলো, ভ্রষ্ট ন্যায়াধীশ বা অন্য কোনোরূপ কারণে
কুমার্গে গমনকারী কোনো অপরাধী ব্যক্তি ন্যায়ের হাত থেকে যেনো রক্ষা না
পায় । অসহায় দরিদ্র এবং সাধন সম্পন্ন ধনী এই দুই শ্রেণীর মাঝে নিষ্পক্ষ
হিসেবে অবস্থান করাই রাজারই কর্তব্য ছিলো ।
এ বিষয়ে রামায়ণ হতে কিছু প্রমাণ –
তাং সত্যনামাং দৃঢ়তোরণার্গলাং গৃহৈর্বিচিত্রৈরুপশোভিতাং শিবাম্।
পুরীময়োধ্যাং নৃসহস্ৰসংকুলাং শশাস বৈ শত্রুসমো মহীপতিঃ ৷৷
( আদিকাণ্ড: ৬/২৮ )
‘ইন্দ্রের
ন্যায় [মহাতেজস্বী] মহাবাজ দশরথ, বিচিত্র বর্ণময় গৃহশোভিত সহস্র সহস্র
নরনারী পরিপূর্ণ দৃঢ় অর্গলবদ্ধ তোরণযুক্ত কল্যাণময়ী সার্থকনাম
অযোধ্যাপুরীকে পালন করতেন।
বলবান্ বীর্য়সম্পন্নো লক্ষ্মণো নাম যোऽপ্যসৌ।
কিং ন মোচয়তে রামং কৃত্বাপি পিতৃনিগ্রহম্॥
( অযোধ্যাকাণ্ড. ৭৮/৩ )
যে বলশালী লক্ষ্মণ বীর্যবান বলে সুপরিচিত, তিনি পিতাকে নিগৃহীত করেও কেন রামকে বনগমন থেকে নিবৃত্ত করতে পারলেন না ?
পূর্বমেব তু বিগ্ৰাহ্যঃ সমবেক্ষ্য নয়ানয়ৌ।
উৎপথং য়ঃ সমারূঢ়ো নার্যা রাজা বশং গতঃ ৷৷
( অযোধ্যাকাণ্ড. ৭৮/৪ )
রাজা
যে এক নারীর বশীভূত হয়ে বিপথে চালিত হয়েছেন, পূর্বেই ন্যায়-অন্যায়
সম্যক্রূপে বিচারপূর্বক রাজাকে (বিপথ থেকে সরিয়ে আনার জন্য) নিগৃহীত করা
উচিত ছিল।
কচ্চিদার্য়োऽপি শুদ্ধাত্মা ক্ষারিতশ্চাপকর্মণা।
অদৃষ্টঃ শাস্ত্রকুশলৈর্ন লোভাদ্ বধ্যতে শুচিঃ।। ৫৬
গৃহীতশ্চৈব পৃষ্ঠশ্চ কালে দৃষ্টঃ সকারণঃ। কচ্চিন্ন মুচ্যতে চোরো ধনলোভান্নরর্ষভ।। ৫৭
বাসনে কচ্চিদাঢ্যস্য দুর্বলস্য চ রাঘব ।
অর্থং বিরাগাঃ পশ্যন্তি তবামাত্যা বহুশ্রুতাঃ ॥ ৫৮
য়ানি মিথ্যাভিশস্তানাং পতন্ত্যশ্রূণি রাঘব।
তানি পুত্ৰপশূন্ ঘ্নন্তি প্ৰীত্যৰ্থমনুশাসতঃ ৷৷ ৫৯
( অযোধ্যাকাণ্ড: ১০০/ ৫৬ - ৫৯ )
কোনও
শুদ্ধচিত্ত সজ্জন মিথ্যা অপবাদে দোষী সাব্যস্ত হলে, কোনও বিচারশাস্ত্রকুশল
সজ্জন দ্বারা তাঁর দোষ অপ্রমাণিত হলেও লোভবশত তাঁর দণ্ডবিধান করো না তো ?
।। ৫৬
‘হে
নরশ্রেষ্ঠ ! যে ব্যক্তি চুরি করার সময় ধরা পড়েছে, (জিজ্ঞাসার উত্তরে
চুরির কথা) স্বীকারও করেছে, এমনকী তাকে চুরি করতে দেখা গেছে—অর্থের
বিনিময়ে উৎকোচ গ্রহণ করে এমন চোরকে চুরির দায় থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়
না তো ! (উৎকোচগ্রাহী এমন অসাধু কর্মচারী তোমার রাজ্যে নেই তো) ! ।। ৫৭
‘হে
রঘুকুলভূষণ ! শক্তিমান ধনী ও দুর্বল দরিদ্রের মধ্যে বিবাদের বিচারে তোমার
সুবিদ্বান অমাত্যগণ (বিচারকগণ) অর্থলোভ ত্যাগ করে নিরপেক্ষ বিচার করেন তো?
।।৫৮
হে
রাঘব ! আত্মপ্রীতির জন্য নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও মিথ্যা অভিযুক্তের প্রতি
শাসনহেতু উক্ত অভিযুক্তের অশ্রুধারা ওই শাসকের সন্তান ও পালিত পশুকে ধ্বংস
করে।। ৫৯
তৎকালীন
সমাজে রাজার প্রধান কর্তব্য ছিলো, তিনি এমন নীতির ব্যবস্থা করুক
যেনো সর্বপ্রকার অভিযোগকারীর প্রত্যেকেই ন্যায়ালয়ে সুবিচার পেতে পারে ।
ভগবান শ্রীরামের শাসনকালে এরূপ সুব্যবস্থা ছিলো যে, প্রজাগণ সর্বদা নিষ্পক্ষ এবং তাৎককালীক ন্যায় প্রাপ্ত হতো ।
সর্বং মুদিতমেবাসীৎ সর্বো ধর্মপরোऽভবৎ। রামমেবানুপশ্যন্তো নাভ্যহিংসন্ পরস্পরম্ ॥ ( যুদ্ধকাণ্ড. ১২৮/১০০ )
সকলে সদা আনন্দে থাকত এবং ধর্মাচরণ করত। শ্রীরামচন্দ্রের শাসনে একে অন্যকে হিংসা করত না।
দৃশ্যতে ন চ কার্য়ার্থী রামে রাজ্যং প্রশাসতি । ( উত্তরকাণ্ড. ৫৯ /(১) /১০ )
শ্রীরামের শাসনকালে দরবারে কখনও কোনো অভিযোগকারী ছিল না ।
পাপ এবং পুণ্যের দৃষ্টিকোণ দ্বারা ন্যায় এবং দণ্ড সম্বন্ধে যেসব মান্যতা ছিলো –
রাজভির্ধৃতদণ্ডাশ্চ কৃত্বা পাপানি মানবাঃ ।
নির্মলাঃ স্বর্গমায়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো য়থা॥
শাসনাদ্ বাপি মোক্ষাদ্ বা স্তেনঃ পাপাৎ প্রমুচ্যতে। রাজা পাপস্য তদবাপ্নোতি কিল্বিষম্৷৷
( কিষ্কিন্ধাকাণ্ড. ১৮/৩১,৩২ )
মানুষেরা
পাপ করলে রাজারাও দণ্ডবিধান করেন, তার ফলে তাঁরা সুকৃতীকারী সন্ন্যাসীদের
ন্যায় নির্মল স্বর্গে গমন করেন। অপরাধী যদি অপরাধ করেও শাস্তি থেকে মুক্তি
লাভ করে সেক্ষেত্রে রাজাও পাপের ফলভাগী হন।
বাল্মীকি রামায়ণের উক্ত শ্লোকদ্বয়ের ন্যায় মনুস্মৃতিতেও বিদ্যমান –
শাসনাদ্বা বিমোক্ষাদ্বা স্তেনঃ স্তেয়াদ্বিমুচ্যতে।
অশাসিত্বা তু তং রাজা স্তেনস্যাপ্নোতি কিল্বিষম্।। ৩১৬।।
রাজভিঃ কৃতদণ্ডাস্তু কৃত্বা পাপানি মানবাঃ।
নির্মলাঃ স্বর্গমায়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো যথা।। ৩১৮৷৷
( মনুস্মৃতি: ৮/ ৩১৬, ৩১৮ )
অনুবাদঃ
রাজা ঐ সুবর্ণচোরকে উক্ত মুষল প্রভৃতির দ্বারা আঘাত করলে কিংবা তাকে
দয়াপরবশ হয়ে ছেড়ে দিলে সেই সুবর্ণচোর চৌর্যজনিত পাপ থেকে মুক্ত হবে। (
রাজা যদি বোঝেন, চোরকে মুক্তি দিলে সে শুদ্ধিলাভ করবে, তাহলে তাকে শাসন না
করার জন্য রাজার কোনও দোষ (পাপ) উৎপন্ন হবে না ) । কিন্তু রাজা যদি চোরকে
শাসন না করেন, তাহলে তিনি নিজেই চোরের পাপে লিপ্ত হন। ৩১৬৷৷
মানুষেরা
পাপ করে যদি রাজার দ্বারা প্রদত্ত দণ্ড ভোগ করে তাহলে তারা, ধার্মিকগণ
যেমন নির্বাধে স্বর্গে গমন করেন, সেইরকম নিষ্পাপ হয়ে স্বর্গে গমন করেন।
৩১৮৷৷
দণ্ড প্রদানে রাজা জ্ঞানশূন্য হয়ে পাপকর্ম করলে তার ফল ভোগ করেন –
অন্যৈরপি কৃতং পাপং প্ৰমত্তৈৰ্বসুধাধিপৈঃ।
প্রায়শ্চিত্তং চ কুৰ্বন্তি তেন তচ্ছাম্যতে রজঃ।।
( কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড. ১৮/৩৪ )
অন্যান্য রাজারাও উন্মত্ত হয়ে পাপকর্মে রত হলে প্রায়শ্চিত্ত করেন। তার দ্বারা তাঁদের পাপ লাঘব হয়।
দণ্ড প্রদানে রাজার অবশ্য কর্তব্য ন্যায়োচিত তথা পক্ষপাত রহিত । একজনের অপরাধের জন্য বহুজনকে শাস্তি প্রদান অনুচিত –
নৈকস্য তু কৃতে লোকান্ বিনাশয়িতুমর্হসি ॥
( অরণ্যকাণ্ড. ৬৫/৯ )
অতএব একজনের অপরাধের জন্য বহুজনের বিনাশ আপনি করতে পারেন না ।
রাজাগণের কর্তব্য অপরাধ অনুসারেই সমুচিত দণ্ড প্রদান তথা কোমল স্বভাব, শান্ত প্রকৃতির হৃদয় অধিকারী হওয়া –
য়ুক্তদণ্ডা হি মৃদবঃ প্রশান্তা বসুধাধিপাঃ।
সদা ত্বং সর্বভূতানাং শরণ্যঃ পরমা গতিঃ ।।
( অরণ্যকাণ্ড. ৬৫/১০ )
রাজারা
হবেন কোমল স্বভাবের ও প্রশান্ত চিত্ত, তাঁরা অপরাধীর অপরাধের গুরুত্ব
বিচারে যথোপযুক্ত দণ্ড বিধান করবেন ; আর আপনি তো সর্বদাই সকল প্রাণীর
আশ্রয়স্থল এবং তাদের পরমগতি।
কিষ্কিন্ধাকাণ্ডে ভরতের কর্তৃক ধর্মভ্রষ্ট পুরুষকে দণ্ড প্রদানের বর্ণনা রয়েছে —
গুরুধর্মব্যতিক্রান্তং প্রাজ্ঞো ধর্মেণ পালয়ন্
ভরতঃ কাময়ুক্তানাং নিগ্রহে পর্য়বস্থিতঃ।।
( কিষ্কিন্ধাকাণ্ড. ১৮/২৪ )
বিদ্বানরাজ ভরত ধর্মভ্রষ্ট ব্যক্তিকে দণ্ডবিধান করেন এবং ধার্মিককে পালন করেন। কামাসক্ত পুরুষকে তিনি নিগৃহীত করেন।
অরণ্যকাণ্ডে মাতা সীতাকে রাবণ অপহরণের সময় সীতা বিলাপ করতে করতে ভগবান শ্রীরামকে দুর্বিনীতদের শাসনকর্তা নামে অভিহিত করেন –
ননু নামাবিনীতানাং বিনেতাসি পরন্তপ ।
কথমেবংবিধং পাপং ন ত্বং শাধি হি রাবণম্।।
( অরণ্যকাণ্ড. ৪৯/২৬ )
হে শত্রুতাপন আর্যপুত্র ! আপনি দুর্বিনীতদের শাসনকর্তা হয়েও এইরকম পাপী রাবণকে শাসন করছেন না কেন ?
যুদ্ধকাণ্ডে ভগবান শ্রীরাম রাবণকে বলেন তিনি অপরাধীদের যথাযোগ্য ন্যায় দণ্ড প্রদানকারী শাসক –
য়স্য দণ্ডধরস্তেऽহং দারাহরণকর্শিতঃ।
দণ্ডং ধারয়মাণস্তু লঙ্কাদ্বারে ব্যবস্থিতঃ ।।
( যুদ্ধকাণ্ড: ৪১/৬৪ )
আমি
দণ্ডধারী শাসক। আমার স্ত্রীকে অপহরণ করে আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। এই
কারণে আপনাকে দণ্ড দেবার জন্য আমি লঙ্কা দ্বারে উপস্থিত হয়েছি।
দণ্ডিত ব্যক্তি কখনই দণ্ডের হাত থেকে রেহাই পায় না –
অপ্যেব দহনং স্পৃষ্ট্বা বনে তিষ্ঠন্তি পাদপাঃ। রাজদণ্ডপরামৃষ্টাস্তিষ্ঠন্তে নাপরাধিনঃ৷৷
( যুদ্ধকাণ্ড: ২৯/১২ )
দাবানল স্পর্শ করলেও বনের বৃক্ষরা জীবিত থাকতে পারে, কিন্তু রাজদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তি কখনো বেঁচে থাকতে পারে না।
সৎ, ন্যায় দণ্ড প্রদানকারী ব্যক্তি এবং দণ্ডিত ব্যক্তি কখনোই তাদের কৃতকর্মের জন্য আফসোস করেন না –
দণ্ড্যে য়ঃ পাতয়েদ্ দণ্ডং দণ্ড্যো য়শ্চাপি দণ্ড্যতে।
কার্যকারণসিদ্ধার্থাবুভো তৌ নাবসীদতঃ৷৷
( কিষ্কিন্ধাকাণ্ড. ১৮/৬১ )
দণ্ডনীয় পুরুষের যিনি দণ্ডবিধান করেন এবং যিনি দণ্ডিত হন, কার্যকারণ সিদ্ধির জন্য তাঁরা কখনোই অবসন্ন অর্থাৎ দুঃখিত হন না।
রামায়ণ কালীন সময়ে ফাঁসি কার্যকর করা হতো প্রাতঃকালে ।
সুন্দরকাণ্ডে,
সীতা মনে করেছিলেন যে দুই মাস পূর্ণ হলে রাক্ষস রাবণ আমাকে সেইভাবে
মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে যেভাবে রাত শেষ হলে চোরকে হত্যা করা হয়।
দুঃখং বতেদং ননু দুঃখিতায়া
মাসৌ চিরায়াভিগমিষ্যতো দ্বৌ।
বদ্ধস্য বধ্যস্য য়থা নিশান্তে রাজোপরোধাদিব তঙ্করস্য ৷৷
( সুন্দরকাণ্ড. ২৮/৭ )
আমি
অতিশয় দুঃখিনী। আমার প্রতি রাবণকর্তৃক নির্দিষ্ট দুই মাস পর্যন্ত সময়
শীঘ্রই সমাপিত হবে। রাজার আদেশে রাত্রিশেষে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত বন্দী
তস্করের ন্যায় আমার অবস্থা।
রামায়ণে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বিষয়েও বিবিধ শ্লোক উপলব্ধ –
উপাংশুদণ্ডেন হি মাং বন্ধনেনোপপাদয়েৎ। শঠঃ ক্রূরো নৃশংসশ্চ সুগ্রীবো রাজ্যকারণাৎ ।। ১০ ।।
বন্ধনাচ্চাবসাদান্মে শ্রেয়ঃ প্রায়োপবেশনম্ ।
অনুজানন্তু মাং সর্বে গৃহং গচ্ছন্তু বানরাঃ। ১১ ।।
( কিষ্কিন্ধাকাণ্ড. ৫৫/১০, ১১ )
সুগ্রীব শঠ, ক্রূর এবং নির্দয়। রাজ্যের জন্য তিনি আমাকে গুপ্ত দণ্ড দিয়ে চিরকালের জন্য বন্দি করে রাখবেন। ১০।।
আমার
পক্ষে বন্ধনজনিত অবসাদ অপেক্ষা অনশনে প্রাণত্যাগ করাই অধিক মঙ্গলকর। হে
বানরগণ ! আপনারা সকলে আমাকে অনুমতি দিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করুন। ১১।।
রামায়ণে শ্বাসরোধ করে হত্যা করারও উল্লেখ রয়েছে –
ততস্তু প্রঘসা নাম রাক্ষসী বাক্যমব্রবীৎ ।
কণ্ঠমস্যা নৃশংসায়াঃ পীড়য়ামঃ কিমাস্যতে।
( সুন্দরকাণ্ড. ২৪/৪১ )
তদনন্তর প্রঘসা নামক রাক্ষসী বলে উঠল—“আমরা কেন অপেক্ষা করছি, এসো, এই নিষ্ঠুর নারীর গলা টিপে মারি " ।
অশোকবাটিকায় অবস্থানকালে মাতা সীতা বিলাপ করতে করতে তৎকালীন বিবিধ দণ্ডের কথা বলেছেন –
ছিন্না ভিন্না প্রভিন্না বা দীপ্তা বাগ্নৌ প্রদীপিতা।
রাবণং নোপতিষ্ঠেয়ং কিং প্রলাপেন বশ্চিরম্।।
( সুন্দরকাণ্ড. ২৬/১০ )
(
রাক্ষসীগণ !) তোমরা যদি আমাকে কাটো, চিরে ফেলো, টুকরো-টুকরো করে দাও,
আগুনে তপ্ত কর কিংবা পুড়িয়ে দাও, তবুও আমি কিছুতেই রাবণকে স্বীকার করব
না। এতক্ষণ ধরে তোমাদের প্রলাপ করা বৃথা !
উপর্যুক্ত
শ্লোকসমূহ দ্বারা রামায়ণের সময়কালীন আর্যাবর্তে প্রচলিত বিভিন্ন ন্যায়
এবং দণ্ডব্যবস্থা সমন্ধে স্পষ্ট বর্ণন পরিলক্ষিত ।
– বিদুষাং বশংবদঃ
নমস্কার