প্রতিটি
সংস্কৃতিতে শরীর, মন, বুদ্ধি এবং আত্মার শুদ্ধি তথা বিকাশের জন্য বিভিন্ন
প্রকারের সংস্কারের বিধান করা হয় । জগতের একমাত্র নিত্য ধর্ম ,
পুরাতাত্ত্বিক বিচারে সর্ব প্রাচীন এবং সুসংস্কৃত সনাতন ধর্ম নিজের প্রতিটি
সদস্যের জন্য যেই সংস্কারগুলোর ব্যবস্থা করছে , তার মধ্যে যজ্ঞোপবীতের
বিশেষ মহত্ত্ব রয়েছে । মানুষ্যযোনী অন্য প্রাণীদের থেকে শ্রেষ্ঠ মানা হয়
কারণ কর্তব্য তথা ধর্মের প্রতি মানুষের মধ্যে যেমন উত্তরদায়িত্বের ভাবনা
জাগ্রত হয় তেমনটা অন্য প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় না। সংসারে জন্ম নিয়েই
মানুষ অনেক ঋণে আবদ্ধ হয় ।
তাঁর
প্রথম ঋণ জন্মদাতা মাতা পিতার নিকট যাঁরা তাকে জন্ম দিয়েছে, যজ্ঞোপবতীতের
প্রথম সূত্র ধারণকর্তাকে 'পিতৃঋণ'এর কথা সর্বদা স্মরণ করায় । যজ্ঞোপবীত
গ্রহণ করার সময়ে আমাদের এটি মনে রাখতে হবে যে যেই মাতা-পিতা আমাদের জন্ম
দিয়েছেন আমরা তাদের সেবা করে তথা তাদের বলা আদর্শের উপর চলবো।
যজ্ঞোপবীতের
দ্বিতীয় সূত্র 'আচার্যঋণ' থেকে মুক্ত হওয়ার সূচনা প্রদান করে। যদিও আমাদের
স্থুল শরীর আমাদের পিতা-মাতা দ্বারা প্রদত্ত, তবুও যে আচার্যের চরণের
নিকট বসে আমরা বিদ্যাভ্যাস করেছি, নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের বৃদ্ধি
করেছি তথা বিভিন্ন শাস্ত্রগুলোর জ্ঞানলাভ করেছি , সেই আচার্যের কাছে
ঋণমুক্ত হওয়াটাও আমাদের কর্তব্য। সনাতন সংস্কৃতিতে আচার্যকে সর্বদা
সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে । ভগবান রাম যদি মহর্ষি বসিষ্ঠ এবং
বিশ্বামিত্রের মতো গুরুদের নির্দেশনা লাভ না করতেন তাহলে আমাদের জন্য তারা কী শিক্ষা স্থাপন করতেন ? একইভাবে যোগেশ্বর
শ্রীকৃষ্ণের গুরু আচার্য সান্দীপনি, আর্য সাম্রাজ্যের সংস্থাপক সম্রাট
চন্দ্রগুপ্তের গুরু আচার্য চাণক্য তথা হিন্দুপদপাদশাহীর আদর্শ
বাস্তবায়নকারী শিবাজী মহারাজের গুরু সমর্থ স্বামী রামদাসের মতো আচার্যরা
বৈদিক আর্য সংস্কৃতিকে সর্বদা বাঁচিয়ে রেখেছেন ।
এই যুগের মহান্ যুগপুরুষ স্বামী
দয়ানন্দ তিনি তাঁর আচার্য দণ্ডী বিরজানন্দের ঋণ থেকে ঋণমুক্ত হওয়ার জন্য
নিজের জীবনকে আহুতি দিয়ে দিয়েছন এবং ধর্ম, সমাজ তথা রাষ্ট্রে এক অনন্য
বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন । যজ্ঞোপবীতের তৃতীয় সূত্র সেই প্রাচীন ঋষিদের থেকে
ঋণমুক্ত হওয়ার সংকেত প্রদান করে, যারা বেদ মন্ত্রের নিহিত তত্ত্বসমূহকে
ঋতম্ভরা প্রজ্ঞার দ্বারা সাক্ষাৎকার করেছিলো এবং যারা ধর্মের স্বরূপকে
জানতেন । জগতের কল্যাণের জন্য পরমাত্মা দ্বারা প্রদত্ত বৈদিক জ্ঞানকে
পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছানোর কাজ শুধুমাত্র এই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরাই করেছিলেন । গৌতম, কপিল, কণাদ, ব্যাস, জৈমিনি, পতঞ্জলি, বসিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র,
কশ্যপ, ভরদ্বাজ, অত্রি, নারদ ইত্যাদি সহস্র ঋষিরা মানুষ জাতির কল্যাণের
জন্য জ্ঞানের যে প্রখর জ্যোতিকে প্রজ্জ্বলিত করেছেন, তা আজ পর্যন্ত
প্রজ্বলিত করে রাখা এবং তা ভবিষ্যতেও একইভাবে উদীপ্ত রাখার জন্য যখন
যজ্ঞোপবীতধারী ব্রহ্মচারী প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে তখন ঋষি ঋণ থেকে ঋণমুক্ত
হওয়ারই বিনীত প্রচেষ্টা করে।
বৈদিক সামাজিক ব্যবস্থাতে ব্রাহ্মণ,
ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যকে দ্বিজ বলা হয়েছে । এটির অভিপ্রায় হলো এই যে যদি
মানুষের একটি জন্ম তার মাতার গর্ভে হয় তাহলে নিজের আচার্যের সমীপে উপস্থিত
হয়ে তথা উপনয়ন সংস্কারে সংস্কৃত হয়ে নতুন জন্ম লাভ করে । এই সংস্কারের
পরেই সে দ্বিজের সংজ্ঞা প্রাপ্ত হয় । কিন্তু এটির অর্থ এই নয় যে শুধু এই
তিন বর্ণের সন্তানদেরই যজ্ঞোপবীত গ্রহণের অধিকার রয়েছে। অধিকার তো সকলের
আছে কেননা যজ্ঞোপবীত গ্রহণ করার পরেই তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মানসিক
বিকাশের প্রক্রিয়া শুরু হতো । মধ্যকালে যজ্ঞোপবীতের প্রচলন সমাজের কিছু
ব্যক্তিবর্গ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । কিছু জাতি তো বিবাহের একদিন
আগে যজ্ঞোপবীতের বিধান সম্পাদিত করতে শুরু করে দেয়, যেখানে যজ্ঞোপবীত এবং
বেদারম্ভ দুইটি সংস্কার যুগপৎ অর্থাৎ একের পর অন্যটি হওয়া উচিত । স্ত্রী
এবং শূদ্র যজ্ঞোপবীতের জন্য অনধিকারী বিবেচিত হয়, যেখানে প্রাচীন ইতিহাস [
https://www.agniveerbangla.org/2018/02/blog-post_3.html
] দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে সেই যুগে নারীরাও যজ্ঞোপবীত গ্রহণ করতেন ।
প্রয়োজনীয় কথা হলো এটি যে মানুষের সর্বাঙ্গীন উন্নতির প্রতীক যজ্ঞোপবীতের
পুনঃপ্রচার হোক, যেনো আমরা নিজের সর্ববিধ উন্নতির প্রতি সচেতন হয়ে আর্যোচিত
কর্তব্য কর্মের পালন করতে পারি। যজ্ঞোপবীত সম্বন্ধে প্রাচীন কর্মকাণ্ডীয়
গ্রন্থ পারস্কর গৃহ্যসূত্রে যে বাক্য পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ—
ও৩ম্ যজ্ঞোপবীতং পরমং পবিত্রং প্রজাপতের্যৎস হজং পুরস্তাৎ । আয়ুষ্যমগ্র্যং প্রতিমুঞ্চ শুভ্রং যজ্ঞোপবীতং বলমস্তু তেজঃ । যজ্ঞোপবীতমসি যজ্ঞস্য ত্বা যজ্ঞোপবীতেনোপনহ্যামি । [ পার০ গৃ০ ২।২।১১]ভাবার্থঃ পরমপবিত্র নির্মল যজ্ঞোপবীত পরমাত্মার সহোৎপন্ন, আয়ু, তেজ ও বল প্রদান করে । তুমি যজ্ঞোপবীত, তোমাকে ধারণ করছি ।
এখানে,
যজ্ঞোপবীতকে পরম পবিত্র বলা হয়েছে। যার মানে হলো এটি সকলের জন্য অবশ্যই
ধারণ করার যোগ্য । নিজ-কর্তব্যের প্রতি প্রেরণাদানকারী হওয়ার কারণে একে
পবিত্র মনে করাটাই উচিত । বস্তুতঃ এই যজ্ঞোপবীতকে প্রজাপতি ব্রহ্মাই
উৎপন্ন করেছেন । অভিপ্রায় হলো, মানুষকে তাদের কর্তব্য পালনের উপদেশ স্বয়ং
পরমাত্মাই দিয়েছেন এবং যজ্ঞোপবীতের এই তিনটি সূত্র একজন ব্যক্তির পিতৃ,
আচার্য তথা ঋষি ঋণ হতে ঋণমুক্ত হওয়ারই প্রতীক । এটি শুভ্র, স্বচ্ছ এবং
পবিত্র; যজ্ঞোপবীত ধারণকারীর আয়ু, বল তথা তেজকে বৃদ্ধি করে । পুনঃ
প্রতিজ্ঞা করে, যজ্ঞোপবীত গ্রহণকারী বলছে যে - আমি তোমাকে (যজ্ঞোপবীতকে)
যজ্ঞের মর্যাদার পালন করার জন্য, যজ্ঞ করার জন্য প্রতীকী রূপে ধারণ করতেছি ।
উপরে
উল্লেখিত বাক্যের ভিত্তিতে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে এই সূত্র
ধারণকারীকে সর্বদা চেষ্টা করতে হবে যেনো তাঁর জীবন পবিত্র হয়ে উঠে । তাঁর,
মন, কথায়, কাজে এক হোক তথা সকল প্রকারের অপকর্ম থেকে বিরত হোক । যে
ব্যক্তি ব্রহ্মচর্য আশ্রমের শুরুতেই যজ্ঞোপবীত ধারণ করেন তিনি প্রথম
আশ্রমেই তাঁর পুরো সময় বেদাদি শাস্ত্র পঠন, পাঠন, শ্রবণ, মনন এবং চিন্তনে
ব্যয় করেন, পরবর্তীতে তাঁর গৃহস্থ জীবনও সংযম এবং আর্যোচিত জীবন আদর্শে
পরিপূর্ণ হয় । এমন সংযমশীল ব্যক্তি তাঁর শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক
তথা আত্মিক বলের বিশেষ বৃদ্ধির জন্য নিরন্তর প্রযত্নশীল থাকে । তাই তাঁর
দীর্ঘ জীবনের প্রাপ্তি হয় এবং তৃতীয় বানপ্রস্থ আশ্রমেও তিনি যজ্ঞোপবীত
গ্রহণের সময় নেওয়া প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়
জনকল্যাণে তথা জনশিক্ষায় । কিন্তু যখন তিনি জগতের সকল বন্ধন এবং আসক্তিকে
ত্যাগ করে পূর্ণ বৈরাগ্যবোধ তথা সকলের কল্যাণ এবং হিত-চিন্তনের ভাবনায়
সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তখন তাঁর এই বাহ্য প্রতীকের প্রয়োজন পড়ে না । এই
অবস্থায় তিনি শিখা এবং পৈতা বিসর্জন করেন । যজ্ঞোপবীত সম্পর্কিত কিছু নিয়ম
পালনযোগ্য নিম্নরূপ:-




( অ ) যজ্ঞোপবীত ধারণকারীর নিজের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিও উত্তরদায়িত্ব রয়েছে। তাদের বিকাশের তাঁর অবদান রাখতে হবে।
( আ ) দেব, ঋষি এবং বিদ্বানদের সেবা অবশ্য কর্তব্য।
(
ই ) যজ্ঞোপবীতধারীর মানসিক ভাবনার , হৃদয়ে উৎপন্ন অনুভূতির তথা বাহ্য
কর্মের শুদ্ধি এবং পবিত্রতাকে সর্বদা সর্বশ্রেষ্ঠতা প্রদান করা উচিত ।
(
ঈ ) ঈশ্বর, জীব এবং প্রকৃতি এই তিন অনাদি তত্ত্বের প্রতি মানুষের কর্তব্য
সম্পূর্ণরূপে পালন করা উচিত । সেই প্রকৃতির পদার্থের যথোচিত ব্যবহার করা
উচিত, অন্য জীবসমূহের কল্যাণ কামনা করে নিজের আত্মাকে উন্নত করা উচিত তথা
বিধাতা ঈশ্বরের প্রতি নিজের ভক্তিতে কোনো স্বল্পতা আসতে না দেওয়া ।
( উ ) যজ্ঞোপবীতকে স্বচ্ছ রাখা, মলিনতা এবং অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করা আবশ্যক ।
(
ঊ ) মল-মূত্র বিসর্জনের সময় যজ্ঞোপবীত কানে আটকে রাখা প্রয়োজন, যেনো তাঁর
শরীরের নিচের অংশ পর্যন্ত না পৌছায় এবং অপবিত্র না হয় । এটিই হলো এটির
মহত্ত্ব ।
॥ও৩ম্॥
