দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







রবীন্দ্রনাথের দাদু দ্বারকানাথ কি ৪৩টা বেশ্যালয়ের মালিক ছিলেন ?

সত্যান্বেষী
0

 


  • গবেষকের ভ্রান্তি: দ্বারকানাথ ঠাকুরের পতিতাপল্লী

    লিখেছেন - কৃষাণু নস্কর [Krishanu Naskar]

এই লেখার মূল উদ্দেশ্য একটি দ্বারকানাথ ঠাকুর বিষয়ক একটি তথ্যের সঠিকতা বিচার। প্রয়োজনীয় বইপত্র যা ব্যবহার করা হয়েছে সবগুলো প্রথমেই উল্লেখ করা হলো। প্রথমেই এটা দেওয়ার কারণ লেখার মধ্যে যাতে সহজেই reference দিতে পারি। কোনো তথ্যের পরে reference রূপে দুটো সংখ্যা থাকবে যার প্রথমটি নীচের তালিকায় থাকা বই বা পত্রিকার ক্রমিক আর দ্বিতীয়টি সেই বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা। যেমন (৩, ১২৩) হলে তৃতীয় সূত্রে উল্লিখিত বইয়ের ১২৩ পৃষ্ঠা দেখতে হবে।
 
১) ডার্লিং ডোয়ার্কি - রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রকাশক - শংকর মণ্ডল ২০১৮)
২) তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা - ১৮৪৮ শক (1926)
৩) UNDER THE RAJ : PROSTITUTION IN COLONIAL BENGAL by SUMANTA BANERJEE (Monthly review press, 1988)
৪) Calcutta: Myths and History - S.N. Mukherjee ( Subarnarekha 1977)
৫) Essays in Urban History - S.N. Mukherjee ( Subarnarekha 1993)
৬) সমকালীন ষষ্ঠ বর্ষ (১৩৬৫)
৭) রবিজীবনী ১ম খণ্ড - প্রশান্তকুমার পাল (ভুর্জপত্র)
৮) Modern History Of The Indian Chiefs Raja and Zamindar Part 2 - Loke Nath Gosh (Calcutta 1881)
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা দ্বারকানাথ ঠাকুর সেকালের কলকাতা তথা বঙ্গদেশের একজন প্রধান ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তি ছিলেন তা আমরা অনেকেই জানি। বিভিন্ন রকমের ব্যবসা ছিল তাঁর। কিন্তু এই বিভিন্ন ব্যবসার মধ্যে একটি ব্যবসা কি ছিল পতিতালয়ের ব্যবসা? তিনি কি কলকাতা শহরের মধ্যেই একটি পতিতালয়ের মালিক ছিলেন বা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
 
প্রশ্নটা উঠছে কারণ বর্তমানে বেশ কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তি এমন অভিযোগ করেছেন। এবং এই সূত্র ধরে অন্য কিছু স্বঘোষিত রবীন্দ্র গবেষক (?) অভিযোগ করেন যে ঠাকুর পরিবারের একসময় রোজগারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল এই বাঈজী ও বেশ্যাদের নিয়ে, যে টাকায় ঠাকুরবাড়ির সব সদস্যদের মতন রবীন্দ্রনাথও পরজীবীর মতন খেয়ে পরে দিনানিপাত করেছেন আজীবন !! সত্যিই তো, এমন ভয়ংকর অপরাধ যিনি করেছেন তাঁকেই কিনা আমরা "কবিগুরু" বলে সম্মান করি !!
 
সুতরাং এ অভিযোগের সারবত্তা খতিয়ে দেখা জরুরি মনে হলো। এই অভিযোগটির উৎস খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল ছিল কারণ বর্তমানে Google এ "দ্বারকানাথের বেশ্যালয়" শব্দবন্ধ উল্লেখ করে search করলেই উঠে আসে প্রচুর ব্লগের আন্তর্জাল ঠিকানা যেখানে এই কথাটি লেখা আছে ঠিক এভাবে, "....দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার একটি এলাকায় প্রায় তেতাল্লিশটি বেশ্যালয়ের মালিক ছিলেন। " বা এভাবে " রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথের কলকাতা নগরীতে ৪৩টা বেশ্যালয় ছিলো।" 
 
তো এইসব লেখার তথ্যসূত্র কি? দু-তিনটি সূত্র দেখা যায় ঘুরেফিরে সবজায়গায় দেওয়া।
  1. সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী, ১৯৬২, পৃ.৩৫৮-৬০
  2. এ এক অন্য ইতিহাস, অধ্যায়: অসাধারণ দ্বারকানাথ, লেখক: গোলাম আহমদ মর্তুজা, পৃষ্ঠা: ১৪১
  3. কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা,২৮শে কার্তিক,১৪০৬, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
 
এরমধ্যে শেষ দুটি সূত্র আসলে একই সূত্র কারণ গোলাম আহমদ তথ্যসূত্ররূপে দেখিয়েছেন ঐ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটিকেই। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি অবশ্য আমি হাতে পাইনি তাই জানিনা তিনি ঠিক কেমন তথ্যসূত্র দিয়েছেন। অবশ্য নিজের রচনাকে তথ্যসূত্রের ভারে ভারাক্রান্ত করার বদভ্যাস তাঁর আছে এমন দুর্নাম তাঁর অতিবড় শত্রু ও দেবে না। কপোলকল্পিত উপন্যাস রচনায় তাঁর দক্ষতা অনস্বীকার্য কিন্তু সেই উপন্যাসগুলিতে প্রদত্ত তথ্যগুলিকে পরম সত্য বলে ভেবে নেওয়াতে আমার অন্তত ঘোরতর আপত্তি আছে।
 
২০১৫ সালে প্রকাশিত "ঠাকুরবাড়ীর গোপন কথা: দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ " গ্রন্থটিতে যদিও দ্বারকানাথের পতিতাপল্লীর ব্যবসা বিষয়ে কোনো কথা নেই কিন্তু ২০১৮ সালে প্রকাশিত উপন্যাস "ডার্লিং ডোয়ার্কি" - তে পুনরায় একথা বলা হয়েছে যে "ফ্লেশট্রেড" করতেন দ্বারকানাথ, "নিষিদ্ধপাড়ায় তাঁর বাড়ী ছিল " (১, ১২৯)। যদিও নিজের সুনামের প্রতি লক্ষ্য রেখে এখানেও ঐ তথ্য দেওয়া হয়েছে কোনো সূত্র বা reference ব্যতিরেকেই।
 
আচ্ছা তাহলে এ তথ্যটি কি ঐ ১ম সূত্রে উল্লিখিত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে আছে? না নেই। ৩৫৮-৬০ পৃষ্ঠায় আছে “ঋণশোধ বিষয়ে দেবেন্দ্রনাথের সাধুতা” নামক অধ্যায়টি এবং সেখানে এমন কোনো তথ্যের সন্ধান আমি পেলাম না। এবং হ্যাঁ আমি ঐ ১৯৬২ সালের সংস্করণটিই দেখেছি। 
 
ঐ বইটির ৩৫৬ পৃষ্ঠায় "১৮৪০ সালে দ্বারকানাথের জমিদারী ও কারবার " নামে একটি ক্ষুদ্র অধ্যায় আছে কিন্তু সেখানেও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। 
 
তাহলে শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় কোথায় পেলেন এ তথ্য? শ্রী সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় "দ্বারকানাথের বিষয়সম্পত্তি" নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন যা ১৮৪৮ শক অর্থাৎ 1926 সালের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার কার্তিক ও অগ্রহায়ণ সংখ্যায় দুই পর্বে প্রকাশিত হয় (২, ১৮৮-১৯২ ও ২০৬-২১১)। সেখানেও দ্বারকানাথের এই বিশেষ ব্যবসাটির কোনো উল্লেখ নেই। 
 
ব্লেয়ার বি কিং, কিশোরীচাঁদ মিত্র, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কৃষ্ণ কৃপালনী প্রমুখ দ্বারকানাথের কোনো জীবনীকার যে এর কথা লেখেননি তা বলাই বাহুল্য। এমনকি শুধুমাত্র দ্বারকানাথের ব্যবসা ও জমিদারী বিষয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন সেই রঞ্জিত চক্রবর্তী (দ্বারকানাথ ঠাকুর : ঐতিহাসিক সমীক্ষা) বা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ভারতের শিল্প বিপ্লব : রামমোহন ও দ্বারকানাথ) ও নয়। তাহলে এই তথ্যের উৎস কোথায়?
 
অনেক খোঁজার পর সুমন্ত ব্যানার্জীর লেখায় পেলাম, "The old records showed up a ‘brothel in 235 and 236 Bow Bazar Street, owned by a member of Dwarkanath Tagore’s family. It had 43 rooms for prostitutes. . .’ " (৩, ৭২) 
 
এখানে তথ্যসূত্রের উল্লেখ্য আছে এবং সেটি হলো "Essays in Urban History" by S.N. Mukherjee.
S.N. Mukherjee বা সৌমেন্দ্র নাথ মুখার্জী Urban History বিষয়ে একজন গবেষক এবং গত শতকের সত্তরের দশকে ইনি কলকাতা শহরের গড়ে ওঠা বিষয়ে কিছু গবেষণা মূলক প্রবন্ধ লেখেন। যার মধ্যে একটি প্রবন্ধ আমাদের আগ্রহের বিষয় যার নাম "Calcutta in 1806: An essay in urban history and computer". 
 
এ প্রবন্ধটি 1993 সালে উপরোক্ত বইটিতে সংকলিত হয় যদিও তার আগেই 1977 সালে "Calcutta: Myths and History " নামক একটি বইতে সংকলিত হয়েছিল। দুটি বইয়ের ই প্রকাশক সুবর্ণরেখা।
উক্ত প্রবন্ধে তৎকালীন কলকাতার বাড়ি ঘর এর ধরন, মালিকানা, ভাড়া ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংকলিত হয়েছে। লেখকের বক্তব্য অনুসারে তিনি তথ্য সংগ্রহ করেছেন কলকাতা কর্পোরেশনের ১৮০৬ সালের House Assessment Book (HAB) থেকে। ইনি জানাচ্ছেন, 
 
"Notice the salient feature of our research: the major part of our time was absorbed in disaggregating and rearranging the data prior to the application of the Computer. We analysed HABS with the aid of non-quantitative sources and applied the Computer to read, to identify, to count, to classify and co-relate our variables. The Computer is asked to do the tedious job of counting, but decisions about the data are made by the researcher. His power is however limited by the very nature of the Computer program. Many individual characteristics of our-variables cannot be quantified and are lost in the IBM Punch Cards. To save some of this interesting information we have used a system of comment cards.
For instance we have been able to retain some information about a prostitute called Moynah Tackooraney who owned two lots in Moonshy Suderuddy's Lane in which there were 14 straw huts, one upper roomed house and a mosque. We do not know who were her clients and whether they prayed in her mosque. The comment cards also preserved such information as that of a brothel in 235 and 236 Bow Bazar St., owned by a member of Dwarkanath Tagore's family. It had 43 rooms for prostitutes and its rental value was 140." (৪, ১০০-১), (৫, ১২-৩) 
 
এখানে লক্ষণীয় ঐ শেষ বাক্যটি "....a brothel in 235 and 236 Bow Bazar St., owned by a member of Dwarkanath Tagore's family. It had 43 rooms for prostitutes and its rental value was 140." 
 
এটিই তাহলে ঐ তথ্যের উৎস যে দ্বারকানাথ ৪৩ (তেতাল্লিশ) টি বেশ্যালয়ের মালিক ছিলেন? আচ্ছা ভালো করে দেখুন তো বাক্যটা, দ্বারকানাথ মালিক ছিলেন ঐ বেশ্যালয়গুলির এমন কথা কি বলা হয়েছে আদৌ? বলা হয়েছে " দ্বারকানাথের পরিবারের কোনো সদস্য"। 
 
তার মানে কি বকলমে দ্বারকানাথ হতে পারেন না? না, পারেন না কারণ তথ্যটা ১৮০৬ সালের। দ্বারকানাথ তখন ১১-১২ বছরের বালক মাত্র। কোনোরকম আর্থিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি যুক্ত নন সেসময়ে। দ্বারকানাথ উপার্জন করতে আরম্ভ করেন ষোলো বছর বয়সে অর্থাৎ আরও চার পাঁচ বছর পরে।
 
আচ্ছা, এমন তো হতেই পারে যে ঐ পতিতাপল্লীটি ছিল দ্বারকানাথের পালক পিতা যিনি তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন সেই রামলোচন ঠাকুরের। পরবর্তীকালে দ্বারকানাথই এর মালিক হন এবং ব্যবসাটি পরিচালনা করতে শুরু করেন বয়ঃপ্রাপ্তির পরে? বিশেষত রামলোচন ঠাকুরের মৃত্যু হয় ১৮০৭ সালে এবং তাঁর সম্পত্তি সব দ্বারকানাথই পান।
 
সেক্ষেত্রে দেখা যাক, রামলোচনের থেকে দ্বারকানাথ উত্তরাধিকারসূত্রে কি কি পেয়েছেন। রামলোচন মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে একটি will বা ইচ্ছাপত্র মারফৎ দ্বারকানাথ কে নিজের সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়ে যান। সেই ইচ্ছাপত্রটি দেখে নেওয়া যেতে পারে একবার। সেটি এরকম, 
 
"....... আপন জানপূর্ব্বক ও সেচ্ছাধিন এই উইল করিতেছি আমার পৈতৃক দৌলাত নাই। শ্রীশ্রী ঠাকুর ও জায়গা ও বাটী ও এলবাস পোষাক তাঁরা পিতল কাঁসার ও রূপা সোণার বাসনদিগর সেওয়ায় গহনা পৈত্রিক যা কিছু আছে ইহার তিন অংশের এক অংশ আমি পাইব দুই অংশ ভায়ারা পাইবেন পৈত্রিক ও আমার দত্ত সোনা রূপার গহনার অংশ হইবেক না, জাহার জে চিহ্ণিত আছে সে তাহারই থাকিবেক। আর সংসারের খরচ ও ধর্মতলার বাটীদিগর বানানতে মবল গহায় আমার নিজ ঢাকা বিং খাতা রোকড় ভায়াদিগের স্থানে আমার পাওনা আছে এবং অন্যঅন্য লোকের স্থানেও জে পাওনা আছে আমার দেনা নাই এই সকল পাওনা ও পৈত্রিক হিস্যা ও আমার স্বোপার্জ্জিত দৌলাত ও সোনারূপার বাসন ও এলবাস পোষাক ও জেলা যশোহরের মোতালক পরগণে বিরাহিমপুর জমিদারী ও সহর কলিকাতার মধ্যের খরিদা জায়গা ওগায়রহ সেওয়ায় রতন রাড়ের দরণ বাটী আমার সোজ্জিত ও পৈত্রিক হিস্যা জে কিছু, সব তোমাকে দিলাম রতন রাড়ের দরুণ বাটী খরিদ করিয়া তৎকালীন তোমার মাতাকে দিয়াছি এবং সন ১২১৩ সালে তোমার মাতার পূণ্যক্রিয়া অর্থে আমি তুষ্ট হইয়া সিক্কা ১০,০০০ দশ হাজার টাকা দিয়াছি এ টাকা এবং রতন রাড়ের দরূণ বাটী ইহার সহিত তোমার এলাকা নাই ইহার দান বিতরণ এক্তার তৌমার মাতার। এখনও তুমি নাবালক একারণ এই জমিদারি ও গায়রহ জে কিছু বিসয় তোমাকে দিলাম ইহার কর্ম্মকার্ষ জাবত আমি বর্ত্তমান থাকিব তাবত আমিই করিব আমার অবর্তমানে জাবত তুমি বয়সপ্রাপ্ত না হও তাবৎ পরগণাদিগর এ সকল বিষয়ের কৰ্ম্মকাৰ্য্য ও সহী দস্তখত ও বন্দবস্ত ও হুকুম হাকাম সকলি তোমার মাতা করিবেন তুমি প্রাপ্ত বয়স হইলে জমিদারিদিগর আপন নামে হজর লেখাইয়া এবং আপন এক্তারে আনিয়া জমিদারির ও সংসারের কর্ম্ম কার্য ও জমিদারির বন্দবস্ত ও খরচপত্র ও গায়রহ মাতার অনুমতি পরামর্শে তুমি করিবা এবং জাবত তোমার মাতা বর্ত্তমান থাকিবেন ভাবত পরগণার মুনাফা ওগায়রহ জে কিছু, আমদানির তহবিল তোমার মাতার নিকট জেমন আমি রাখিতাম তুমিও সেই মতো রাখিবা। আমি ও তোমার মাতা যাবৎ বর্ত্তমান ও বর্ত্তমানা থাকিবেন ও থাকিব তাবত আমারদিগর পণ্য ক্রিয়া আদি যে কিছু, খরচপত্র এই দৌলাত হইতে পাইব। আমার সোপার্জিত জায়গার কবালা ও বরনামা ও গায়রহ আমার স্থানে ছিল!
 
নিস্তীমতো তোমাকে দিলাম পৈত্রিক জায়গা ও বাটীদিগরের কবালা ও পাট্টা ও গায়রহ কাগজ রামমণি বাবুর স্থানে আছে জায়গা হিস্যা চিহ্ণিত মতো বুঝিয়া লইবা এতদৰ্থে উইলপত্র লিখিয়া দিলাম।" (৬, ৫৪৯)
ঐ ইচ্ছাপত্রের সঙ্গে উল্লিখিত সম্পত্তির একটি তালিকাও ছিল যেটি এই প্রকার,
 
" জায় জায়গা সোপার্জ্জিত
জমিদারি পরগণে বিরাহিমপুর মোতালকে
জেলা জসোহর - ১
সহর কলিকাতার মধ্যে ডোম পিদুরু
সাহেবের দঃ জায়গা – ১
বামদেব বাইতির দঃ জায়গা – ১
কৃষ্ণচন্দ্র রায় কবিরাজের দঃ জায়গা-
তিলক বসাকের দঃ জায়গা – ১
শঙ্কর মুখোপাধ্যায় দঃ বাটী-১
রামকিশোর মিস্ত্রীর দঃ জায়গা – ১
রামনিধি সাহার দঃ বাটী – ১
রতন রাড়ের দঃ বাটী- এ বাটী তোমার মাতাকে দিয়াছি – ১
পৈত্রিক
নিজবাটী- ১
ধর্ম্মতলার বাটী - ১
বড়বাজারের বটতলার বাটী - ১
জানবাজারের হাড়িটোলার জায়গা – ১
ডোমটোলার জায়গা - ১
মাহুতের দঃ জায়গা- ১
কলিঙ্গা ব্রহ্মচারীর দঃ জায়গা - ১
পরগণে মাগুরা মৌজে ফতেপুর ব্রহ্মত্তর জমি - ১
মৌজে কপিলেশ্বর ব্রহ্মত্তর জমি - ১ "
(৭, ৮)
 
এখানে কি বৌবাজারের ২৩৫ ও ২৩৬ নং premises অর্থাৎ জায়গা বা বাড়ির কোনো উল্লেখ পেলেন? তাহলে কিসের ভিত্তিতে বলা যায় যে দ্বারকানাথ ঐ পতিতাপল্লীর প্রতিষ্ঠাতা বা মালিক বা লভ্যাংশ ভোগী? শুধু ঐ " দ্বারকানাথের পরিবারের কোনো সদস্য এর মালিক " কথাটি আছে বলে দ্বারকানাথ পতিতাপল্লী চালাতেন, তিনি এর মালিক এমনকি রবীন্দ্রনাথ এর টাকায় পরজীবীর মতন খেয়ে পরে দিনাতিপাত করেছেন এমন সব অপপ্রচার করা যায়? দ্বারকানাথের পরিবার অর্থাৎ ঠাকুর পরিবারের ছোট তরফ যাকে বলা হয় সেখানে কি দ্বারকানাথ ছাড়া আর কোনো সদস্য ছিলেন না? মনে রাখতে হবে, রামলোচন ঠাকুররা ছিলেন পাঁচ ভাই (কারু কারুর মতে অবশ্য তিন ভাই এক মবোন)। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল অনেক সুতরাং তাদের মধ্যে যে কেউ ঐ বৌবাজারের সম্পত্তিটির মালিক হতে পারেন। দ্বারকানাথের মাথায় এই দায়টা চাপানোর কারণ কি? 
 
আচ্ছা দ্বারকানাথের সঙ্গে যদি এর কোনো সম্পর্ক নাই থাকবে তাহলে ঐ গবেষণাপত্রে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে কেন?
 
কারণটা জানা যায় ঐ গবেষণাপত্রটি খুঁটিয়ে পড়লে যেখানে বলা হচ্ছে,
" A list of ‘famous families’ was made on the basis of our studies of the lists found in the Foreign Miscellanous Series, National Archives of India, in L. N. Ghose’s work and in the proceedings and reports of public meetings and associations as reported in the newspapers. When we made our list we took into account the political and social allegiance of a particular kinsgroup, hence we have two Tagore families and two Deb families. On the other hand there were leading men like Rev. Krishna Mohun Banerjee who had no ‘families’. With the aid of L. N. Ghose, Sambandha Nirnay'- and N. N. Basu’s Banger Jatiya Itihas, genealogies of most of these ‘famous families’ were made. Each ‘family' was given a number ; all ‘family’ members whose names appear in the family genealogy and who lived between c. 1800 and 1870, received a family number. For instance no. 3 refers to all members of Gopimohun Deb’s family. " (৪, ৯৯-১০০)
অর্থাৎ কিনা, বিখ্যাত পরিবারগুলির তালিকা তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন সূত্র থেকে যাদের মধ্যে অন্যতম হলো L. N. Ghosh বা লোকনাথ ঘোষ রচিত Modern History Of The Indian Chiefs Raja and Zamindar Part 2। (পূর্বোক্ত সূত্রে উল্লিখিত পৃষ্ঠার পাদটীকা দ্রষ্টব্য) 
 
এবার ঐ বইটির পাতা ওল্টালেই দেখা যাবে ঠাকুর বংশের বড় তরফ অর্থাৎ দর্পনারায়ণের পরিবারের প্রধান রূপে প্রথম (দর্পনারায়ণ বিষয়ে সংক্ষিপ্তাকারে বলার পর) বলা হয়েছে গোপীমোহন ঠাকুরের বিষয়ে। (৮, ১৬৩)
 
আর ছোট তরফ অর্থাৎ নীলমণির পরিবারের প্রধান পুরুষ রূপে বর্ণনা (নীলমণি ঠাকুরের সন্তানদের নামোল্লেখের পর) করা হয়েছে দ্বারকানাথকে (৮, ২১৫)। দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেখানে অন্তিমে অত্যন্ত সংক্ষেপে উল্লিখিত। রবীন্দ্রনাথের নামই নেই।
 
সুতরাং ১৮০৬ সালের বিখ্যাত পরিবারগুলির তালিকা প্রণয়ন কালে কেন গবেষক সৌমেন্দ্র নাথ মুখার্জী (S.N. Mukherjee) ঠাকুর পরিবারের বড় তরফকে গোপীমোহন ঠাকুরের ও ছোট তরফকে দ্বারকানাথের পরিবার বলছেন তা আশা করি বোঝা যাচ্ছে। যদিও উল্লিখিত সময় দ্বারকানাথ বালক মাত্র এবং কোনো ব্যবসার সঙ্গেই তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। 
 
এর সঙ্গেই আরো একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে কর্পোরেশনের House Assessment Book এ ঐ বিশেষ সম্পত্তির মালিকের নাম থাকবে না তা তো হতে পারে না তাহলে গবেষক সেই নামটি উল্লেখ না করে দ্বারকানাথের পরিবারের সদস্য বলছেন কেন? সম্ভবত নামটি এমনই অকিঞ্চিৎকর কোনো ব্যক্তির যাঁর নামোল্লেখে তাঁকে কেউ চিনবেন না বা ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক কেউ বুঝতে পারবেন না। সে কারণেই পরিবারের সর্বাপেক্ষা নামজাদা ব্যক্তিটির নামোল্লেখ করা হয়েছে পরিবারটিকে চিহ্নিত করার জন্য। এবং সর্বাপেক্ষা নামজাদা ব্যক্তিটিকে কেমন করে নির্বাচন করা হয়েছে তা আগেই বলা হয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, দ্বারকানাথ পতিতাপল্লী চালাতেন এই অভিযোগের আদৌ কোনো প্রামাণ্য সূত্র বা reference নেই। প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো নেই-ই এমনকি পরোক্ষ কোনো প্রমাণও নেই। তবুও এই অপপ্রচার চলছে এবং বিভিন্ন অপ্রামাণ্য সূত্র, secondary এমনকি tertiary সূত্র উল্লেখ করে তথাকথিত গবেষণা গ্রন্থ পর্যন্ত লেখা ও ছাপানো হচ্ছে। কিছু স্বঘোষিত গবেষক নিজেদের কপোলকল্পনাকে সত্য বলে দাবী করে শুধু দ্বারকানাথ নন এমনকি রবীন্দ্রনাথের নামও টেনে আনছেন এমন একটি ঘৃণ্য ব্যবসায় যার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্কই ছিল না। 
 
প্রকৃত গবেষণা যাঁরা করতে চান তাঁদের উচিত ঐ ১৮০৬ সালের House Assessment Book থেকে প্রকৃত নামটা উদ্ধার করে এই বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের অবসান ঘটানো। যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পেলে এ প্রবন্ধের লেখক ও সে কাজে আত্মনিয়োগ করবে। যদি ঐ বিশেষ তথ্যটি উদ্ধার করতে পারি তাহলে অবশ্যই সকলকে জানাব।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)