দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







নিরাকারবাদীদের মন্দিরের কী প্রয়োজন ?

সত্যান্বেষী
0

✅ নিরাকারবাদীদের মন্দিরের কী প্রয়োজন ❓
▪️উত্তর: ভগবান্ সর্বত্র বাস করেন, সদা বিরাজমান। উপাসনালয় মানুষ নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী স্থানবিশেষের নির্মাণ করেছেন, পরমপিতা পরমাত্মার বাস সর্বত্র। ঈশ্বর কণায়-কণায় সমাহিত আছেন কারণ ঈশ্বর সর্বব্যাপক।
 
লোক পূজা-পাঠ করতে মন্দিরে যায় তবে আপত্তিকর কোন কিছু নেই। পূজা-পাঠ তো যেখানে খুশি করা যেতে পারে, যে কোনও সময়ে করা যেতে পারে। এর জন্য কোন মন্দির বিশেষে অথবা কোন বিশেষ স্থানে যাবার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কেবল শ্রদ্ধা ও প্রেমের।
বাহ্যিক মন্দিরের থেকে কিছু শেখা উচিত। মন্দির হল আমাদের ভিতরে থাকা মন-মন্দিরের প্রতীক। ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হল আমাদের হৃদয় যেখানে তিনিও বিরাজ করেন, আমরা স্বয়ংও (আত্মা) বাস করি। এই মন মন্দিরের থেকে বৃহৎ আর কোন স্থান হতে পারে না। ঈশ্বর তো সর্বত্র বিদ্যমান, কিন্তু আত্মা এই দেহেই বাস করে কারণ সে (আত্মা) একদেশী অণু পরিমাণ। অল্পজ্ঞতার কারণে আমরা ইশ্বরকে বাইরে অনুসন্ধানের চেষ্টা করি যা ব্যর্থই আমাদের জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট করে দেয়।
 
প্রভু-ভক্ত যে কোনও স্থানে যাক, মন্দির যাক অথবা মসজিদে, গির্জায় অথবা গুরুদ্বারে, কিন্তু এতটুকু অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যে, সেই পরমপিতা পরমাত্মা আমাদের মধ্যেই আছেন। পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখতে হবে তথাকথিত উপাসনালয়কে কী আসলেই উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নাকি অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোই সেখানে অন্যতম একটা লক্ষ্য । এজন্য যেখানে সর্বজীবের কল্যাণ কামনা করা হয় ও প্রকৃত সত্যের উপদেশ দেওয়া হয় সেটিই মন্দির, প্রকৃত উপাসনালয় । আমরা যেখানে সেখানে আমাদের পরমপ্রিয় প্রভুও থাকেন।
 
মন্দিরে অবশ্যই যাওয়া উচিত। সেখানকার পরিবেশ দেখা উচিত। সেখানকার পবিত্রতা দর্শন করা উচিত। যেসব মহাপুরুষদের মূর্তি রয়েছে, তাঁদের বিষয়ে - তাঁদের জীবনের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। এইভাবে যে মন্দিরে যাবেন, হোক তা শংকর ভগবানের মন্দির অথবা মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্র মহারাজের, অথবা যোগেশ্বর ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের, এই মহাপুরুষগণের চরিত্রের চিন্তা করুন এবং সেরূপই হওয়ার প্রচেষ্টা করুন। মহাপুরুষদের জীবন থেকেই আমরা নিজের জীবনকে সেই অনুরূপ করার প্রচেষ্টা করবেন তবে কিছুটা হলেও নিজেদের জীবনকে সংশোধন করতে পারি। ভগবান্ রাম্, ভগবান্ কৃষ্ণ উভয়েই ভারতীয় সংস্কৃতির এমন প্রতীক যাদের উপর গর্ববোধ করা যায়। অতএব তাদের মন্দির থেকে আমরা উচ্চ প্রকারের মহাত্মা হবার প্রেরণা লাভ করি। শিশুদেরও সঙ্গে নিয়ে যান যাতে তারাও আমাদের পূর্বপুরুষদের বিষয়ে জানতে পারে।
 
নিজের ঘরে এমন মহাপুরুষদের চিত্র অবশ্যই লাগানো উচিত। শ্রীরাম ও শ্রীকৃষ্ণ তো আমাদের আদর্শ। যার মধ্যে উপনিষদে বর্ণিত গুরুর ন্যায় গুণাবলী বিদ্যমান থাকে তাকে ভগবান বলা যেতে পারে। তবে তেমন গুণাবলীযুক্ত মানব দুর্লভ । 
 
ভগবান্ যে কেউই হতে পারে কিন্তু পরমেশ্বর এক। না কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারে আর না কেউ তার থেকে মহান্ হতে পারে। ঈশ্বর সর্বোপরি।
 
মন্দির থেকে বহু বিষয় শেখা যেতে পারে-
 
১. পবিত্রতা – দেহ-মন দ্বারা নিষ্কলুষ থাকা মানব-জীবনের জন্য পরম কল্যাণময়।
২. সমর্পণ- সমর্পণভাবনা দ্বারাই আমরা ঈশ্বরের দয়া-কৃপার সুপাত্র হতে ।
৩. নিয়ম – নিয়মপূর্বক পূজা-পাঠ করলে জীবন অনুশাসিত হয় যার ফলে ব্যক্তি মহান্ হয় - যশ ও কীর্তিযুক্ত হয়।
৪. প্রসাদ- বণ্টন করে প্রদত্ত নৈবেদ্য আহার করাকে প্রসাদ বলা হয় সাধারণত । মূর্তি জড় পদার্থ, খেতে পারে না। অতএব ঈশ্বরের নির্মিত মূর্তির অর্থাৎ সমস্ত জীবের সঙ্গে মিলেমিশে-বণ্টন করেই ভোজন করুন। এর ফলে নিজেদের মধ্যে মিত্রতা ও ঘনিষ্ঠতা বজায় থাকে - সুখ ও শান্তি লাভ হয়। বৈদিক যজ্ঞের স্বিষ্টকৃতের অবশিষ্ট যাকে যজ্ঞাবশিষ্টান্ন বলা তা আমাদের সকলের জন্য প্রসাদস্বরূপ । নৈমিত্তিক পঞ্চমহাযজ্ঞ করুন ।
৫. স্বচ্ছতা – মন্দির স্বচ্ছ হয়, এর থেকে এই শিক্ষা লাভ হয় যে, আমাদের নিজ দেহ ও মনকে স্বচ্ছ রাখা উচিত যেখানে প্রভু স্বয়ং বাস করেন। পান-আহার শুদ্ধ হওয়া উচিত। মানবের ভোজনের যোগ্য বস্তুই আহার করুন। মাংস-মাছ খেয়ে এই প্রভু মন্দিরকে অশুদ্ধ করবেন না। এই হত্যার থেকে বড় আর কোন পাপ নেই।
৬. জ্যোতি - মন্দিরে যজ্ঞবেদিতে জ্যোতি জ্বালানো হয় যাতে কিরণ প্রদান হয়, নিজ মনমন্দিরে জ্ঞানের জ্যোতি জ্বালানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যাতে সেই জ্ঞান রূপী জ্যোতির দ্বারা আত্মা-পরমাত্মার সাক্ষাৎ হতে পারে। আধ্যাত্মিক জ্যোতি প্রজ্জ্বলিত হয় বেদাধ্যয়ন দ্বারা, সৎসঙ্গ দ্বারা, আপ্ত পুরুষের বচন দ্বারা, তথা স্বাধ্যায় দ্বারা। যার আত্মা সজাগ হয় সে পরমেশ্বরের আনন্দ লাভ করে।
৭. সুগন্ধ - ধূপ-আগরবাতি মন্দিরে জ্বালানো হয়, এই কারণে যে, পরিবেশ সুগন্ধিত হয়। যদিও উচিত যজ্ঞের মাধ্যমেই এই কাজটি করা কেননা এটিই শাস্ত্রানুমোদিত । এর থেকেও শিক্ষা লাভ হয় যে, নিজের জীবনে শ্রদ্ধা ও প্রেমের সুগন্ধ দ্বারা এইভাবে সুগন্ধিত পরিবেশ উৎপন্ন করো যে, সবাই এই সুগন্ধের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং নিজেদের মধ্যে মৈত্রীভাব বজায় থাকে!
৮. ভজন-কীর্তন – মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা ভজন-কীর্তন-আরতি হয়- ভগবানের গুণগান করা হয়। এইরূপ আমরাও নিজেদের জীবনকে সঙ্গীতময় করে তুলি। সকাল-সন্ধ্যা নিত্যপ্রতিদিন ঈশ্বরের স্তুতি-প্রার্থনা- উপাসনা করুন যার দ্বারা আমরা ঈশ্বরের নিকট থাকার অধিকারী হই তথা প্রভু-কৃপায় সদা আনন্দে থাকি।
৯. নমস্কার - মন্দিরে ভক্তগণ একে-অন্যকে অভিনন্দন জানায়। কেউ রাম-রাম বলে তো কেউ রাধে-রাধে তো কেউ হরে কৃষ্ণ। এখানেও আমাদের শেখা উচিত যে, যখনই আমরা নিজেদের মধ্যে সাক্ষাৎ করবো তখন এই মহাপুরুষদের স্থানে 'নমস্তে/নমস্কার' বলে করজোড়ে অভিনন্দন জানাবো। ছোট-বড় স্ত্রী-পুরুষ সবাই যে কোনও সময়ে নমস্কার করতে পারেন। নমস্কার জানানো কোন সম্প্রদায়-মত-পন্থ ইত্যাদির সূচক নয়, অতএব আমরা সবাইকে সমান মনে করি। সকলেই ঈশ্বরের সন্তান তবে ভেদা-ভেদ কীসের? যেখানে ভেদ নেই সেখানে মিত্রতা বৃদ্ধি পায়। যেখানে মিত্রতা আছে সেখানে প্রেম উৎপন্ন হয়। যেখানে প্রেম সেখানেই ঈশ্বর। বলা হয় গড ইজ লাভ এণ্ড লাভ ইজ গড।
১০. মন্দির তো জড়ই - ভবন ইট-প্রস্তর দ্বারা নির্মিত। কখনও নির্মাণ হয় কখনও ভঙ্গ হয়, কিন্তু আমাদের মন-মন্দির যেখানে আত্মা-পরমাত্মা উভয় বাস করে, সদা একই সঙ্গে থাকে। জড় ও চেতনের জ্ঞান পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে ঈশ্বর মন্দিরেও ব্যাপ্ত আছেন, কিন্তু সেই মন্দিরের চিত্রের মধ্যে আমরা পৌঁছাতে পারি না; অন্যদিকে আমরা স্বয়ং মনের মধ্যে বিরাজ করি আর ঈশ্বরও আমাদের সঙ্গে রয়েছেন যেখানে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাহলে আমরা নিজের প্রিয়তমের সঙ্গে অন্তরেই সাক্ষাৎ করি না কেন। মন্দির আমাদের মন-মন্দিরের প্রতীক। 
 
🔸শ্রী মদন রহেজা
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)