স্বামী দয়ানন্দের বেদভাষ্য
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ঋগ্বেদ সংহিতার শুরু থেকে ৭ম মণ্ডলের, ৬১ সূক্তে ৬ মন্ত্র পর্যন্ত এবং বাজসনেয়ী মাধ্যন্দিন যজুর্বেদ সংহিতার সম্পূর্ণ ভাষ্য করেছেন। তাঁর এই বেদভাষ্য পূর্ববর্তী ভাষ্য অপেক্ষা অনেক নতুন বিশেষত্ব রাখে, যার মধ্যে থেকে কিছু কিছু এখানে দেখানো উপযুক্ত হবে–
বৈদিক দেবের অর্থ অনুসন্ধান
বেদে অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র, অশ্বিনৌ, মিত্র, বরুণ, অর্যমা, রুদ্র, সবিতা আদি পুংলিঙ্গবাচক দেবের তথা অদিতি, উষা, সরস্বতী, পৃথিবী আদি স্ত্রীলিঙ্গবাচক দেবতাদের বারংবার বর্ণনা আছে। উবট, সায়ণ, মহীধর আদি পূর্ববর্তী ভাষ্যকারগণ এদের পৃথক্-পৃথক্ স্বতন্ত্র দেব-দেবী বলে স্বীকার করতেন তথা এটি মানতেন যে বেদ বর্ণিত প্রত্যেক প্রাকৃতিক দেবতা উষা, সূর্য, পৃথিবী, আপঃ, নদী, ওষধি আদির এক-এক স্বতন্ত্র চেতন অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আছে, সেই চেতন দেবতার এই নাম দ্বারা বেদে স্তুতি করা হয়েছে। যে দেবতাদের প্রাকৃতিক স্বরূপ নিশ্চিত নয় তিনিই স্বতন্ত্র চেতন দেবতা, যজ্ঞে আবাহন করার পর এসব দেবতা হবি দ্বারা প্রসন্ন হয়ে যজমানকে পুত্র, পৌত্র, পশু, ধন আদি প্রদান করতেন। কিন্তু স্বামী দয়ানন্দ প্রমাণসহ এটি ঘোষণা করেছেন বেদ অনেকেশ্বরবাদী নয়, বরং বেদের বিভিন্ন পুংলিঙ্গবাচী এবং স্ত্রীলিঙ্গবাচী দেবতা পিতা এবং মাতার রূপে এক ও অদ্বিতীয় পরমাত্মারই গুণকর্ম বোধক বিভিন্ন নাম। বেদের বর্ণনশৈলীর এই বিস্ময় যে সেইসাথে ঐ দেবতা শরীরে আত্মা, মন, বুদ্ধি, প্রাণ, অপান, উদান, চক্ষু, শোত্র আদির; রাষ্ট্রে রাজা, সেনাপতি, ন্যায়াধীশ, গৃহপতি, আচার্য আদির এবং ভৌতিক জগতে প্রকৃতি, সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, জল আদির বাচকও হয়। যেখানে যেমন প্রকরণ, সেখানে সেরূপ অর্থ গ্রহণ করা উচিৎ।
এই দৃষ্টিকে ধ্যানে রেখে দয়ানন্দ-ভাষ্যে প্রসঙ্গ বা উচিৎ অনুসারে ‘অগ্নি’ এর অগ্রণী, বিজ্ঞানস্বরূপ, সর্ববিদ্যোপদেষ্টা, স্বয়ং প্রকাশমান, প্রকাশক পরমেশ্বর, বিদ্বান অধ্যাপক, উপদেশক, অগ্রনায়ক রাজা, বীর সেনাপতি, যজ্ঞাগ্নি, শিল্পে প্রয়োগ করার যোগ্য ভৌতিক অগ্নি আদি অর্থ করা হয়েছে। 'ইন্দ্র' কে ঐশ্বর্যশালী পরমেশ্বর, শত্রু বিদারক রাজা, সভাসদ্-সেনা-ন্যায়াধীশ, বিদ্যার্থীদের জড়তার বিচ্ছেদক গুরু, বায়ু, বিদ্যুৎ, সূর্য আদি অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘রুদ্র’ কে দুষ্টরোদক পরমাত্মা, জীবাত্মা, বৈদ্য, বায়ু, প্রাণ, শত্রু সংহারক সেনাপতি, ব্রহ্মচারী আদি অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 'অশ্বিনী' কে রাজা-অমাত্য, প্রাণ-অপান, জল-অগ্নি, বায়ু-বিদ্যুৎ, সূর্য-চন্দ্র, অধ্যাপক-উপদেশক, সভেশ সৈনেশ আদি অর্থ করা হয়েছে।
বৈদিক দেবীকেও স্বামী দয়ানন্দ ভৌতিক জগত এবং শরীরের সাথে সাথে সমাজেও প্রয়োগ করেছেন। সে অনুসারে তাঁর ভাষ্যে 'উষা' এর অর্থ প্রভাতবেলা বা সন্ধ্যা ছাড়াও 'উষার ন্যায় জ্ঞান দ্বারা সমস্ত রূপের প্রকাশিকা বিদুষী স্ত্রী' ও করেছেন।১ এই প্রকার 'সরস্বতী' এর অর্থ বাণী এবং বেগবতী নদীর অতিরিক্ত বিদুষী কন্যা, প্রশস্তজ্ঞানবতী বিদুষী স্ত্রী, প্রশস্ত বিজ্ঞানযুক্ত পত্নী, শিক্ষিতা মাতা এবং বেদাদিশাস্ত্র বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানযুক্ত অধ্যাপিকাও করেছেন।২ প্রচুর বৈদিক দেবতাগণকে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অর্থে নিয়ে সম্পূর্ণ মন্ত্রকে সামাজিক বা রাষ্ট্রপরক অর্থের ব্যাখ্যা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীরই মহিমান্বিত কৃতিত্ব। এর পূর্ব ব্রাহ্মণগ্রন্থে ঐরূপ অর্থের সংকেত কোন কোন স্থলে দেয়া হয়েছিল। স্বামী দয়ানন্দ বৈদিক দেবতার যে অর্থ করেছেন তা স্বয়ং বেদ দ্বারা তথা ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, আরণ্যক ও বেদাঙ্গ সাহিত্য দ্বারা সমর্থিত।
বেদ মন্ত্রের বহুবিধ অর্থ
বেদ মন্ত্রের অধ্যাত্ম, অধিদৈবত, অধিযজ্ঞ আদি অর্থ করার পরম্পরা প্রথম থেকেই ছিলো। যাস্কাচার্য নিজের নিরুক্তে কোন এই প্রকারের মন্ত্র-ব্যাখ্যা প্রস্তুত করেছেন। স্বামী দয়ানন্দ এই পরম্পরাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি মন্ত্রার্থকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন পারমার্থিক অর্থ এবং ব্যাবহারিক অর্থ।৩ এই দুটিতে পূর্বজ আচার্যগণ দ্বারা নির্ধারিত অধ্যাত্ম, অধিদৈবত, অধিযজ্ঞ, অধিভূত আদি সকল অর্থ-প্রক্রিয়া সমাবিষ্ট হয়। পরমেশ্বর তথা পরমেশ্বর-প্রাপ্তি সম্বন্ধীয় অর্থ পারমার্থিক প্রক্রিয়াতে এবং শেষ সকল অর্থ ব্যাবহারিক প্রক্রিয়ার অন্তর্গত।
স্বামী দয়ানন্দ নিজের বেদভাষ্যে এক বেদ মন্ত্রের অনেক পক্ষে অর্থ যোজনা অনেক স্থলে করেছেন। ঋগ্বেদের প্রথম পাঁচ অগ্নিদেবতাক মন্ত্রের ব্যাখ্যা তিনি পরমেশ্বরপক্ষে তথা শিল্পাগ্নিপক্ষে করেছেন। 'ধূরসি ধূর্বন্তম্' যজু০ ১।৮ মন্ত্রেও অগ্নির অর্থ পরমেশ্বর তথা শিল্পসাধক অগ্নি দুটিই নিয়েছেন। বায়ুদেবতাকে ঋক০ ১।২।১-৩ এই তিন মন্ত্রের ব্যাখ্যা পরমেশ্বর তথা ভৌতিক বায়ু দুটি পক্ষেই করেছেন। ইন্দ্র দেবতার 'য়ুঞ্জন্তি ব্রধ্নমরুষম্' ঋক০ ১।৬।১ মন্ত্রকে পরমেশ্বর, আদিত্য এবং প্রাণ তিন পক্ষে ব্যাখ্যা করেছেন। 'আ কৃষ্ণেন রজসা বর্তমানো' ঋক০ ১।৩৫।২ আদি সবিতৃদেবতাক মন্ত্রের অর্থ পরমেশ্বর তথা সূর্য উভয় পক্ষে করেছেন। সূর্যপরক অর্থেও সূর্যের আকর্ষণশক্তির বর্ণনা করেছেন। 'অদিত্যাস্ত্বগসি' যজু০ ৪।৩০ আদি বরুণ দেবতা মন্ত্রের ব্যাখ্যা পরমেশ্বর, সূর্য তথা বায়ু তিন পক্ষে করেছেন। 'কদ্রুদ্রায় প্রচেতসে' ঋক০ ১।৪৩।১ আদি রুদ্র দেবতার মন্ত্রকে পরমেশ্বর, জীবাত্মা তথা ভৌতিক বায়ু তিন পক্ষে করেছেন। ইন্দ্র দেবতার 'য়োগে য়োগে তবস্তরম্' ঋক০ ১।৩০।৭ আদি মন্ত্র ঈশ্বর তথা সেনাধ্যক্ষ দুটি পক্ষে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রসিদ্ধ মন্ত্র 'য়াং মেধাং দেবগণাঃ' যজু০ ৩২।১৪ এ অগ্নি পদ দ্বারা জগদীশ্বর তথা বিদ্বান্ অধ্যাপকের গ্রহণ করেছেন। 'অয়ং মিত্রো নমস্যঃ' ঋক০ ৩।৫৯।৪ আদি মন্ত্রে মিত্রের অর্থ ঈশ্বর তথা রাজা পক্ষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 'পুরাং ভিন্দুর' ঋক০ ১।১১।৪ আদি ইন্দ্র বিষয়ক মন্ত্রের ব্যাখ্যা সূর্য এবং সেনাপতি উভয় পক্ষে করেছেন। সোম দেবতার 'ত্বম্ সোমাসি সৎপতিঃ' ঋক০ ১।৯১।৫ আদি মন্ত্র শ্লেষ দ্বারা পরমেশ্বর, গৃহস্বামী তথা সোম ওষধি তিন পক্ষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 'বৃত্রখাদো বলংরুজঃ' ঋক০ ৩।৪৫।২ আদি ইন্দ্রদেবতাক মন্ত্রের অর্থযোজনা বিদ্যুৎ, সূর্য, বায়ু এবং রাজা পরক করা হয়েছে। ঐরূপ মন্ত্রের সংখ্যা দুই শত থেকেও অধিক যাতে শ্লেষালংকার মেনে স্বামীজী একাধিক অর্থ করেছেন। মন্ত্রের একাধিক ব্যাখ্যা যতটুকু স্বামীজী নিজের বেদভাষ্যে করেছেন, তা অন্য কোন বেদভাষ্যকার করেননি।৪
ঐতিহাসিক অর্থের উপেক্ষা
বেদমন্ত্রে প্রযুক্ত নামকে কোন ঐতিহাসিক ঋষিদের, ঋষিকাদের, রাজাদের, রাণীদের, নদীর, নগর ইত্যাদি নাম মেনে নেয়ার প্রবৃত্তি বেদ ভাষ্যকারদের মধ্যে পাওয়া যায়। বেদার্থের ঐতিহাসিক সম্প্রদায় যাস্কাচার্য থেকেও প্রথমে বিদ্যমান ছিলেন, কারণ তিনি নিজের নিরুক্ত গ্রন্থে কোন প্রসঙ্গে এই সম্প্রদায়ের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নিজের সম্মতি তিনি তাদের বিরোধেই রেখেছেন।৫
আধুনিক যুগের বেদ বিচারক বিদেশী বিদ্বানদের তো আধারস্তম্ভ এটিই। অতএব বেদে পদে-পদে ইতিহাসের অন্বেষণ করার পূর্বাগ্রহ তারা বানিয়েছেন। বিদেশের বিদ্বানগণ বেদে লৌকিক ইতিহাস ভালোভাবেই মানতেন। কিন্তু আশ্চর্য তো তখন হতে হয় যখন বেদকে সৃষ্টির আদিতে প্রকটিত ঈশ্বরীয় জ্ঞান মান্যকারী স্কন্দস্বামী, উবট, সায়ণ, মহীধর আদি ভারতীয় ভাষ্যকারগণও অনেক স্থলে বেদ মন্ত্রের ইতিহাসপরক ব্যাখ্যা করেছেন। স্বামী দয়ানন্দ নিজের সুদীর্ঘ বেদভাষ্যে একটি স্থলেও ইতিহাস মানেননি। ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকায় তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন বেদমন্ত্রে ইতিহাসের লেশমাত্রও নেই। অতএব সায়ণাচার্য আদি পণ্ডিতগণ যেখানে-কোথাও ইতিহাসের বর্ণনা করেছে তা ভ্রমমূলক।৬
নিজের বেদভাষ্যেও কোন কোন স্থলে স্বামী দয়ানন্দ সায়ণের ঐতিহাসিক অর্থের বিরোধ করেছেন। যথা, সায়ণ ঋ০ ১।৩১।১১ এ নহুষকে রাজা-বিশেষ, ঋ০ ১।১৮।১ এ কক্ষীবান ঔশিজকে আশিক নামের মাতার পুত্র কক্ষীবান ঋষি, ঋ০ ১।৩১।১৭ এ যযাতিকে এই নামের রাজা, ঋ০ ১।৩৬।১৮ এ তুর্বশ, যদু, উগ্রদেব, নববাস্তু, বৃহদ্রথ এবং তুর্বীতিকে রাজর্ষি-বিশেষ মেনেছেন। কিন্তু স্বামী দয়ানন্দ এই স্থলে নৈরুক্ত প্রক্রিয়া অনুসারে ব্যাখ্যা করেছেন এবং সায়ণের নাম নিয়ে তার ইতিহাসপরক অর্থের খণ্ডন করেছেন । স্বামীজীর যুক্তি হচ্ছে এই যে, রাজা নহুষ৭ আদি তো বর্তমান কালের এবং বেদ তো সনাতন। অতএব সনাতন বেদে লৌকিক ইতিহাস না থাকার মান্যতা স্থাপন তো নিজের ঋগ্বেদভাষ্যের উপোদ্ঘাতে সায়ণও করেছেন।৮ কিন্তু বেদভাষ্যে তিনি তার নির্বাহ করতে পারেন নি। কিন্তু মহর্ষি দয়ানন্দ নিজের প্রতিজ্ঞার নির্বাহ বেদভাষ্যের সর্বত্র করেছেন। তিনি অগস্ত্য, অত্রি, অম্বরীষ কুৎস, কুশিক, ত্রসদস্যু, দিবোদাস, বসিষ্ঠ, বামদেব, বিশ্বামিত্র, শুনঃশেপ প্রভূতি সমস্ত ঐতিহাসিক প্রতীত হওয়া নামের নিরুক্ত পদ্ধতি দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। সত্যিকারে বেদে লৌকিক ইতিহাসের কল্পনা বেদকে জর্জরিত করে। বেদে ইতিহাস না মেনে যোগার্থের বল দ্বারা যে অর্থ করার পদ্ধতি মূলত সেটি দ্বারাই বেদের রহস্যার্থ হৃদয়ঙ্গম করা যেতে পারে। অন্যথা ঐতিহাসিক কাহিনী যেমন ভাষ্যকারগণ রচনা করে বেদের উপর রোপন করেছেন, ঐরূপ প্রত্যেক বেদ মন্ত্রের উপর বানানো যেতে পারে। বেদের ঐতিহাসিক সম্প্রদায়কে ব্যাপক ক্রিয়াত্মক উত্তর প্রদানের জন্য শ্রেষ্ঠ একমাত্র স্বামী দয়ানন্দের ভাষ্যই।
পূর্ব-বিনিয়োগ থেকে স্বতন্ত্র বেদার্থ
পূর্বকালে দর্শ, পৌর্ণমাস, বাজপেয়, রাজসূয়, অশ্বমেধ, পুরুষমেধ, সোমযাগ আদি বিবিধ শ্রৌত যাগে, ব্রহ্মযজ্ঞাদি পঞ্চ যজ্ঞে, জাতকর্মাদি বিভিন্ন সংস্কারে তথা অন্য অনেক বিধি-বিধানে বেদ মন্ত্রের বিনিয়োগ করা হয়েছিলো। সেসব বিনিয়োগের পরীক্ষা করার দ্বারা জ্ঞাত হয় যে, তাতে কিছু বিনিয়োগ রূপসমৃদ্ধ অর্থাৎ মন্ত্রার্থ দ্বারা অনুমোদিত আর কিছু অরূপসমৃদ্ধ অর্থাৎ যেগুলি মন্ত্রার্থের বিরুদ্ধ অথবা মন্ত্রার্থের সাথে অসংবদ্ধ। ব্রাহ্মণ গ্রন্থকারগণ রূপসমৃদ্ধ বিনিয়োগ দ্বারাই যজ্ঞের পরিপূর্ণতা মানতেন।৯
তথাপি অরূপসমৃদ্ধ বিনিয়োগও চলতে থাকল এবং তাকেই প্রামাণিকও মানা হলো। স্বামী দয়ানন্দ এটি স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন যে পূর্বকৃত বিনিয়োগে যা যুক্তিসিদ্ধ, বেদাদি প্রমাণের অনুকূল এবং মন্ত্রার্থের অনুসৃত বিনিয়োগ সেটিই গ্রাহ্য হতে পারে।১০ সেই সাথে তিনি এটিও মেনেছেন যে বেদ ব্যাখ্যার জন্য রূপসমৃদ্ধ বিনিয়োগেরও অনুসরণ করা অনিবার্য নয়, সেই বিনিয়োগ থেকে স্বতন্ত্র হয়েও বেদ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অতএব তিনি ঋগ্বেদ এবং যজুর্বেদের নিজের ভাষ্য পূর্ব-বিনিয়োগের অনুসরণ করা ছাড়াও লিখেছেন এবং ভূমিকাতে এটি নির্দেশ করে দিয়েছেন যে, আমি তো শব্দার্থতঃ ই মন্ত্রের ব্যাখ্যা করবো। যারা অগ্নিহোত্র থেকে শুরু করে অশ্বমেধ পর্যন্ত কর্মকাণ্ডের পরিচয় পেতে চান, তারা ঐতরেয়, শতপথ, পূর্বমীমাংসা, শ্রৌতসূত্র আদি দেখতে পারেন। কিন্তু তাতে যে বেদ বিরুদ্ধ বিনিয়োগ রয়েছে, সেসব তারা যেন না মানেন।
স্বামী দয়ানন্দের বেদ ভাষ্য দ্বারা এটি স্পষ্ট যে পূর্ব-বিনিয়োগ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে করা তার বেদব্যাখ্যা মহোপকারক সিদ্ধ হয়েছে এবং তা দ্বারা পাঠকদের বেদে মানবোপযোগী বিবিধ জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং কর্তব্যের জ্ঞান হয় এবং তাদের এই ভ্রান্তি হয়নি যে, বেদে কমকাণ্ডের অতিরিক্ত আর কিছু নেই। মহীধর পূর্ব বিনিয়োগ দ্বারা আবদ্ধ হয়ে তথা তার প্রামাণিকতা বা অপ্রামাণিকতার বিচার করা ছাড়াই নিজের যজুর্বেদভাষ্য করেছেন।
অতএব, অনেক স্থলে ওই ভাষ্য ভ্রান্ত হয়েছে, যথা ষষ্ঠ অধ্যায়ে অগ্নীষোমীয় পশুপ্রয়োগের প্রকরণে অজ (ছাগল) এর বধ, অশ্বমেধ- প্রকরণে ২৩ অধ্যায়ে রাজমহিষীর অশ্বমেধ অশ্বের কাছে শয়ন (মন্ত্র ১৯-২১), রাজপত্নী তথা পুরোহিতদের মধ্যে অশ্লীল হাস্য-পরিহাস, রাজ পত্নীদের দ্বারা অশ্বের শরীরকে সূচীর দ্বারা সংস্কার (মন্ত্র ৩৩-৩৭) এবং অশ্বের পেট কর্তন করা (মন্ত্র ৩৯-৪২), ২৫ অধ্যায়ে অশ্বের কর্তিত অঙ্গের দেবতাদের জন্য হোম করা, ৩৫ অধ্যায়ে পিতৃমেধ-প্রকরণে গাভীর চর্বির হোম করা (মন্ত্র ২০) আদি১১ স্থলে পূর্ব-বিনিয়োগের অনুসরণ না করে লেখা হয়েছে। মহর্ষি দয়ানন্দের ভাষ্য অত্যন্ত চমৎকার, প্রামাণ্য তথা বেদের সত্য স্বরূপের প্রকাশক।
বেদে বিবিধ বিদ্যার আবিষ্কার
পূর্ব-ভাষ্যকারগণের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই বেদে কর্মকাণ্ড ছাড়া অন্য কোন বিদ্যার আবিষ্কার করার চেষ্টা করেননি। কিন্তু স্বামী দয়ানন্দ 'বেদে সকল বিদ্যা রয়েছে' এটি ঘোষণা করেছেন।১২ তিনি নিজের 'ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা' গ্রন্থে ব্রহ্মবিদ্যা, সৃষ্টিবিদ্যা, পৃথিব্যাদিলোকভ্রমণ বিদ্যা, আকর্ষণানুকর্ষণবিদ্যা, প্রকাশ্যপ্রকাশকবিদ্যা, গণিতবিদ্যা, উপাসনাবিদ্যা, মুক্তিবিদ্যা, নৌবিমানাদি নির্মাণচালন বিদ্যা, তারযন্ত্রবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, রাজবিদ্যা, যজ্ঞবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, শিল্পবিদ্যা, বর্ণাশ্রম- বিদ্যা আদি বিবিধ বিদ্যার বৈদিক প্রমাণের সাথে প্রতিপাদন করেছেন তথা নিজের কৃত বেদভাষ্যেও এসবের প্রকাশ করেছেন।
কতিপয় অন্য বিশেষত্ব
স্বামী দয়ানন্দের বেদ ভাষ্যে কিছু অন্য বিশেষত্ব পাওয়া যায়, যা অন্য বেদভাষ্যকারগণের ভাষ্যে পাওয়া যায় না। উদাহরণ হিসেবে, কিছু বিশেষত্ব নিচে লেখা হলো -
(ক) দয়ানন্দ সরস্বতী বেদ মন্ত্রের অশ্লীল, পরমাত্মার স্বভাব এবং সৃষ্টিনিয়মের বিরুদ্ধ এবং লোকবিদ্বেষকারী অর্থ কোথাও করেননি।
(খ) তিনি বেদে মাংসভক্ষণ, পশুবলি, জড়পূজা, মৃতকশ্রাদ্ধ, জাদু-টোনা, অসম্ভব চমৎকার কাহিনী ইত্যাদি অস্বীকার করেছেন। যেসব ভাষ্যকারগণ এমন পক্ষের অর্থ নিজেদের বেদব্যাখ্যায় কল্পনা করেছেন, তিনি তাদের ভ্রান্ত বলেছেন।
(গ) নির্বচনশাস্ত্র তথা শব্দের ব্যুৎপত্তিতেও তাঁর বিশেষ যোগদান রয়েছে, নিজের বেদভাষ্যে তথা উণাদি কোষের ব্যাখ্যাতে তিনি অনেক নতুন নির্বচন প্রস্তুত করেছেন।
(ঘ) তিনি বৈদিক শব্দকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেছেন। যথা 'দেব' শব্দে পরমেশ্বর, বিদ্বান্, মাতা, পিতা, আচার্য, অতিথি, জ্ঞানেন্দ্রিয় আদির গ্রহণ করেছেন।১৩ যজ্ঞ দ্বারা কেবল অগ্নিহোত্রকে নয় বরং দেবপূজা, সংগতিকরণ, শিল্প, দান আদিকেও সম্মিলিত করেছেন।১৪ ধনবাচক রৈ, রাধস্, রয়ি, ধন, বসু প্রভৃতি শব্দ দ্বারা সুবর্ণ আদি ধনের সাথে সাথে বিদ্যা, ধর্ম, আরোগ্য, চক্রবর্তী রাজ্য, মোক্ষ আদি ধনকেও গ্রহণ করেছেন।১৫ রশ্মি আদি কিরণবাচী শব্দ দ্বারা কেবল ভৌতিক প্রকাশের কিরণকেই নয়, বরং বিদ্যা-বিজ্ঞানের তেজ এবং অন্তঃপ্রকাশক গুণেরও বোধ করায়।১৬ 'রথ' শব্দের প্রায় সর্বত্রই ভূযান, জলযান এবং বিমান অর্থ হয়ে থাকে।১৭ এমন নানাবিধ অর্থ বৃত্র, বৃক, নমুচি, নদী, ধনুষ্, ইষু আদি অন্য অনেক শব্দেরও আছে।১৮
(ঙ) তাঁর বেদভাষ্য মানবকে অভ্যুদয় তথা নিঃশ্রেয়স উভয়কে প্রাপ্তির জন্য উদ্বোধন দান করে। লৌকিক উৎকর্ষে তার ব্যাখ্যাদৃষ্টি অনুসারে কৃত বেদভাষ্য সমগ্র ভূমণ্ডলের ধর্ম পূর্ণ চক্রবর্তী রাজ্য পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়, দিব্য উৎকর্ষে মোক্ষের পরমানন্দ পর্যন্ত নিয়ে যায়।
এই প্রকার অনেক নতুনত্ব এবং বিশেষত্বের কারণে স্বামী দয়ানন্দের বেদভাষ্য অত্যন্ত উপাদেয়।
· টীকাঃ
১. (উষঃ) উপর্বৎ সর্বরূপপ্রকাশিকে বিদুষি স্ত্রি। ঋ০ভা০ ৬।৪৯।৭, (উষঃ) উষর্বদ্ বিদ্যমানে বিদুষি। ঐ ১।১১৩।১২ (ঊসষঃ) প্রভাতবেলা ইব স্ত্রিয়ঃ। ঐ ১।১১৩।২০
২. (সরস্বতী) বিজ্ঞানাঢ্যা (বিদুষী কন্যা)। ঋ০ ভা০ ৬।৪৯।৭, প্রশস্তং সরো বিজ্ঞানং বিদ্যতে য়স্যাঃ সা (বিদুষী স্ত্রী)। য়০ ভা০ ১৯।৮৩, প্রশস্তজ্ঞানয়ুক্তা পত্নী। ঐ ১৯।৮২, বিদুষী শিক্ষিতা মাতা। ঐ ২০।৬৪, (সরস্বতীম্) বহুবিধং সরো বেদাদিশাস্ত্রবিজ্ঞানং বিদ্যতে য়স্যাস্তাং বিজ্ঞানয়ুক্তাম্ অধ্যাপিকা স্ত্রিয়ম্। ঐ ৯।২৭।
৩. অথাত্র য়স্য-য়স্য মন্ত্রস্য পারমার্থিকব্যবহারিকয়োর্দ্বয়োরর্থয়োঃ শ্লেষালঙ্কারাদিনা সপ্রমাণঃ সম্ভবোঽস্তি তস্য তস্য দৌ দ্বাবর্থো বিধাস্যেতে। ঋ০ ভা০ ভূ০, প্রতিজ্ঞাবিষয়
৪. অধিক বিস্তারের জন্য দ্রষ্টব্যঃ লেখকের গ্রন্থ 'বেদ ভাষ্যকারদের বেদার্থপ্রক্রিয়া, অধ্যায় ৪।
৫. দ্রষ্টব্যঃ নিরু০ ২।১৭, ১২।১, ১২।১০।
৬. নাত্র মন্ত্রভাগে হীতিহাসলেশোজ্যস্তীত্যবগন্তব্যম্। অতো য়চ্চ সায়ণাচার্য়াদিভিবৈদপ্রকাশাদিষু য়ত্রকুত্রেতিহাসবর্ণনং কৃতং তদ্ ভ্রমমূলমেবাস্তীতি গন্তব্যম্।- ঋ০ ভা০ ভূ০, বেদসংজ্ঞা বিচার বিষয়।
৭. নহুষস্যেত্যত্র সায়ণাচার্য়েণ নহুষনামকরাজবিশেষো গৃহীতঃ, তদসৎ। কস্যচিন্নহুষস্যেদানীংতনত্বাদ্ বেদানাং সনাতন ত্বাৎ তস্য গাথান্ন ন সম্ভবতি, নিঘণ্টৌ নহুষস্যেতি মনুষ্য নাম্নঃ প্রসিদ্ধেশ্চ। দ০ভা০, ঋ০ ১।৩১।১১
৮. ববরাদ্যনিত্যদর্শনং য়দুক্তং তস্য কিমুত্তরমিত্যাশঙ্ক্য উত্তরং সূত্রয়তি- পরং তু শ্রুতিসামান্যমাত্রম্ (জৈ০ সূ০ ১।১।৩১) ইতি। য়ৎ পরং ববরাদিকং তৎ শব্দসামান্যমেব ন তু মনুষ্যো ববরনামকোত্র বিবক্ষিতঃ ববরণ্বনিয়ুক্তস্য প্রবহণস্বভাবস্য দায়োস্ত্র বক্তুং শক্যত্বাৎ। -সায়ণ, ঋগ্ভাষ্য, উপোদ্ঘাত, পূনা সংস্করণ পৃ০ ১৫
৯. এতদ্ বৈ য়শস্য সসৃদ্ধং য়ৎ রূপসমৃদ্ধং য়ৎ কর্ম ক্রিয়মাণম্ ঋগভিবদতি । ঐ০ বা০ ১।১৬, এতদ্ধৈ য়জ্ঞস্য সমৃদ্ধং য়ৎ রূপসমৃদ্ধং ক্রিয়মানম্ ঋগ্ য়জুর্বাভিবদতি। গো০ উ০ ২।৬
১০. তস্মাদ্ য়ুক্তিসিদ্ধো বেদাদিপ্রমাণানুকূলো মন্ত্রার্থানুসৃতস্ত দুক্তোঽপি বিনিয়োগঃ গৃহীতং য়োগ্যোঽস্তি।- ঋ০ ভা০ ভূ০ প্রতিজ্ঞা বিষয়।
১১. বিশেষ বিস্তারের জন্য দ্রষ্টব্য: আর্য সমাজ পানিপথ থেকে প্রকাশিত "ধর্ম এবং সংস্কৃতি" গ্রন্থে লেখকের লেখা 'স্বামী দয়ানন্দের যজুর্বেদ ভাষ্যের এক তুলনাত্মক দৃষ্টি'।
১২. বেদেষু সর্বা বিদ্যাঃ সন্তি আহোস্বিন্ন ? অত্রোচ্যতে, সর্বাঃ সন্তি মূলোদ্দেশ্যতঃ।- ঋ০ ভা০ ভূ০, ব্রহ্মাবিদ্যাবিষয়ের আরম্ভ।
১৩. দ্রষ্টব্য: ঋ০ ভা০ ভূ০, বেদবিষয়বিচার
১৪. ধাত্বার্থাদ্ য়জ্ঞার্থস্ত্রিধা ভবতি। বিদ্যাজ্ঞানধর্মানুষ্ঠানবৃদ্ধানাং দেবানাং বিদুষামৈহিকপারমার্থিকসুখসম্পাদনায় সৎকরণং, সম্যক পদার্থগুণসম্মেলবিরোধজ্ঞানসংগত্যা শিল্পবিদ্যাপ্রত্যক্ষীকরণং, নিত্যং বিদ্বৎসমাগমানুষ্ঠানং, শুভবিদ্যাসুখধর্মাদিগুণানাং নিত্যং দানকরণমিতি। য়জু০ ভাষ্য ১।২।
১৫.(রায়ঃ) বিদ্যাচক্রবর্তিরাজ্যশ্চিয়াদীনি ধনানি।- য়০ ভা০ ২।২৪, (রাধসঃ) বিদ্যাসুবর্ণচক্রবর্তিরাজ্যাদিধনস্য - ঋ০ ভা০ ১।২২।৭, (ধনানি) বিদ্যাধর্মচক্রবর্তিরাজ্যশ্রীপ্রসিদ্ধানি।- ঋ০ ভা০ ১।৪২।৬, (রয়িম্) ধর্মমোক্ষ বিদ্যাচক্রবর্তিরাজ্যারোগ্যাদিস্বরূপং ধনম্। বেদভাষ্য নমুনা-ঋ০ ১।১।৩, (বসু) সুখেষু বসন্তি য়েন তদ্ ধনং বিদ্যারোগ্যাদি সুবর্ণাদি বা।- ঋ০ ভা০ ১।১০।৬।
১৬. (রশ্মিভিঃ) প্রকাশকৈর্গুণৈঃ কিরণৈর্বা। (রশ্মিভিঃ) অন্তঃ প্রকাশকৈর্গুণৈঃ।- য়০ ভা০ ১।৩১
১৭. (রথে) ভূজলাকাশগমনা য়ানে।- ঋ০ ভা০ ১।৬।২
১৮. (বৃত্রং) মেঘমিব অবিদ্যাম।- ঋ০ ভা০ ৪।১৮।১১, প্রকাশাবরকং মেষমিব ধর্মাত্মাবরকং (দুষ্টং শত্রুম্)।- য়০ ভা০ ৩৩।২৬, (বৃকঃ) বৃকবদুৎকোচকশ্চোর ।- ঋ০ ভা০ ২।২৮।১০ (নমুচিম্) য়োঽয়র্মং ন মুচ্যতি তম্ (অধর্মাত্মমানং জনম্)।- ঋ০ ভা০ ২।১৪।৫ (নমুচেঃ) ন মুঞ্চতি পরপদার্থান্ দুষ্টাচারান্ বা যঃ স্তেনস্তস্য।- য়০ ভা০ ১০।১৪, (নদীনাম্) সরিতামিব বিদ্যমানানা বিদুষী নাম।- ঋ০ ভা০ ৩।৩৩।১২, (নদীভিঃ) সরিদ্ভিরিবনাড়ীভিঃ।- ঋ০ ভা০ ৫।৪১।১৯, (ধনুঃ) শস্ত্রাস্ত্রম।- য়০ ভা০ ২৯।৩৯, (ইষবঃ) শস্ত্রাস্ত্রাণিঃ।- য়০ ভা০ ১৬।৬৬