স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী জীর অমর গ্রন্থ 'সত্যার্থ প্রকাশ' রচনা, মানুষ জাতি কিভাবে কষ্ট থেকে মুক্তি প্রাপ্ত করে, শত বর্ষ পর্যন্ত সুখী জীবনযাপন করতে পারে? এই বিষয়ে ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।
যে মানুষ আপন জীবনকালে এই অমর গ্রন্থ পাঠ করবেন সত্যের সাথে তার সাক্ষাৎকার হবে এবং অসংখ্য ভণ্ডের ভণ্ডামি থেকে মুক্ত হয়ে নিজ জীবন সুখময় করে তুলতে পারবেন। কখনোই কোন নতুন মত বা সম্প্রদায় চালানো তাঁর (স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী) অভিপ্রায় ছিলো না, তিনি আজীবন বেদাদি সত্যশাস্ত্র, ব্রহ্মা থেকে শুরু করে জৈমিনিমুনি পর্যন্ত ঈশ্বরাদি পদার্থকেই মেনেছেন। যে সৃষ্টির পূর্বে ছিলো, আজও আছে, প্রলয় বা অন্ত পর্যন্ত থাকবে, যাঁর কখনো অভাব হয়না, সে-ই কেবল সত্য। যাঁকে সকল আপ্ত পুরুষ অর্থাৎ যার কথা ও কাজ সত্যের ওপর ভিত্তি করে, যাঁকে পক্ষপাত ছাড়াই সব বিদ্বান ব্যক্তি তিন কালেই এক হিসেবে মানেন, বেদানুকূল হওয়ার কারণে তাঁকে সনাতন বলা হয়। মানুষ তাকেই বলে, যে ব্যক্তি বিচার বিবেচনা দ্বারা অপরের সুখ- দুঃখ, লাভ-ক্ষতি বুঝতে পারে। অন্যায়কারী যতই বলবান হোক না কেন তাকে ভয় পায় না, ঈশ্বরীয় ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস রেখে অন্য প্রাণিকেও যত্ন করে, এবং ব্যক্তি যতই দুর্বল হোক না কেন ধর্ম পথে চলা ন্যায়কারী ব্যক্তিকে সদা সম্মান করে।
ঈশ্বর বা পরমেশ্বর কি? এই প্রশ্ন সবচেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাঁকে জানার জন্য সবচেয়ে কম প্রয়াস করে থাকি। এবং ভণ্ড ধূর্ত লোকদের কথাকে সত্য হিসেবে মেনে নিয়ে আমরা পথভ্রষ্ট হই। ঈশ্বরীয় তত্ত্ব সদা সত্য হওয়ায়, এটি খোলামেলা আলোচনার বিষয়।
ঈশ্বর বহু পবিত্র গুণ-কর্ম ও স্বভাববিশিষ্ট, নিরাকার, সর্বব্যাপক, অজন্মা, অনন্ত, সর্বশক্তিমান, দয়ালু, ন্যায়কারী, সকল সৃষ্টির কর্তা-ধর্তা, এবং সৎ চিৎ আনন্দযুক্ত। তাঁর দ্বারা নির্ধারিত কর্মফল ব্যবস্থা, তাঁর অনুশাসন থেকে, এর স্বয়ংক্রিয় সুপার কম্পিটারাইজড ব্যবস্থা থেকে ব্রহ্মাণ্ডের সব শক্তি এক হয়েও একে প্রভাবিত করতে পারে না। তাই তিনি কখনো অন্যায় করেন না, তাঁর কোন কিছুরই ভয় নেই। এইজন্যই তিনি তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি যাকে মানুষ বলা হয়, তাকে তার বুদ্ধি দিয়ে পাপ-পূণ্য কর্ম করার জন্য স্বতন্ত্র করে ছেড়ে দিয়েছেন।
যখনই কোন মানুষ পাপ বা পূণ্য কর্ম করার জন্য চিন্তা করে, তখন থেকে শুরু করে কর্ম পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত সেই দয়ালু ঈশ্বর তাঁর পক্ষ থেকে সাবধান করে। এবং তার অস্তিত্বের কথা অনুভব করান। মানুষ যেমন আর যতটুকু কর্ম করে। ঈশ্বর তাঁর সুপার কম্পিটারাইজড, নির্ধারিত কর্মফল ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা দ্বারা তার ফল শতগুণ নির্ধারিত করে। যতক্ষণ অব্দি জীব বিশেষ তার কর্মফল ভোগ করে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কর্মফল স্থির থাকে।
বিশ্বের কোন মন্ত্র, কোন উপবাস, কোন কথা-কাহিনী, কোন যাত্রা, কোন নদীতে স্নান, কোন গাছ বা পাথরের পুজা, কোন ধূর্ত পাখন্ডীর ভণ্ডামি, কোন সদাব্রত, কোন দান, কোন শ্রাদ্ধ বা তর্পন, কোন প্রার্থনা, কোন চিৎকার, যত ইচ্ছা ইবাদত করুক না কেন, যত ইচ্ছা আপনি কোন কনফেস বাক্সের সামনে দাঁড়ান না কেন কর্মফল স্থির থাকে। মানে কোন পুজারী, কোন মৌলভী, কোন পোপ, কোন ফাদার বা মাদার ইত্যাদি সবাই ঊনার সুপার কম্পিউটারাইজড স্বয়ংক্রিয় কর্মফল ব্যবস্থার অধীন। সবার একই ব্যবস্থা থেকে জন্ম হয়েছে, এবং ঊনার ব্যবস্থার মধ্যেই প্রত্যেকেই নিজ মৃত্যু প্রাপ্ত হবেন।
কিছুক্ষণ বসে শান্ত মনে চিন্তা করুন, সেই সুপারিশ, কার কাছে, কর্মফল স্থির থাকে। মানে কোন পুজারী, কোন মৌলভী, কোন পোপ, কোন ফাদার বা কোথায়, কিভাবে, কেউ তার নির্ধারিত কর্মফলের সুপারকম্পিউটারাইজড স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা স্পর্শ করতে পারে? পরমেশ্বর এক স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। যদি কেউ তাঁকে প্রভাবিত করতে সমর্থ বলে দাবি করে তাহলে তাকে পরমেশ্বরের চেয়ে বড় হতে হবে, মহান হতে হবে। তাহলে সে গমের বীজ থেকে ছোলা, আমের বীজ থেকে আমলকি উদ্ভিদ উৎপাদনে সক্ষম হবে। যদি কোন পাখন্ডী এরকম দাবি করে থাকে যে; সে ঈশ্বরীয় নির্ধারিত সুপারকম্পিউটারাইজড সয়ংক্রিয় কর্মফল ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে পারে। তার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া খুব সহজ কাজ। প্রশ্ন করে দেখতে হবে যে, তাঁর ব্যবস্থা কি কেউ পরিবর্তন করতে পারে? এরকম কখনোই হয় না।
ধর্মকে বাহানা বানিয়ে এসব লোক আপনাকে সে তার নিজের ঠগ বিদ্যা দ্বারা ফাঁসাচ্ছে, আপনার লালস প্রবৃত্তিকে দেখে আপনাকে পথভ্রষ্ট করছে। সে অজানা জঙ্গলী লোক নিজ নারকীয় কষ্টের সাথে আপনাকেও তার সাথে নরকগামী করছে। বেদোক্ত ধর্ম ঈশ্বর দ্বারা প্রকাশিত হয় এটি সদা সত্য, সবার জন্য মান্য। দেখুন পাথরাদি ছোড়ার ভণ্ডামি চলছে ২৫০০ বছর ধরে, মুসলিম মত ১৪০০ বছর ধরতে, ঈশায়ী মত ২২০০ বছর ধরে চলছে। আর সৃষ্টির সাথে বেদোক্ত ধর্ম পরমপিতা পরমেশ্বর ম্যানুয়েলের মতো প্রকাশ করে, মানুষকে বলেছিলেন যে- তার কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে, কবে করতে হবে, কেন করতে হবে, আমি কে, আপনি কে, আপনার চারপাশে কি এই খেলা, কিভাবে এর উন্নতি করা যায়, আপনার সৃষ্টি রহস্য সব খোলা-মেলা ভাবে বলেছেন।
সেই পরমপিতা পরমেশ্বর বেদের মধ্যে সব প্রকারের ভূগোল, খগোল, গণিত, রসায়ন, পদার্থ, শারীরিক সূত্র, সূর্য বিজ্ঞান, বিদ্যুৎ বিজ্ঞান, দূরসমাচার, মেটলর্জি, ভূ-বিজ্ঞান, জল বিজ্ঞান, বায়ু বিজ্ঞান, এমনকি তাঁর সৃষ্টি যেমন অনন্ত, তদ্রূপ বেদের মধ্যে তিনি তাঁর অনন্ত জ্ঞান মানুষের জ্ঞান লাভের জন্য প্রকাশিত করে দিয়েছেন। চারটি বেদের মধ্যে কোনটিতেই কোন দেশ বা কালান্তরের ইতিহাস বা কাহিনী লিখিত হয়নি। বেদে সূর্য চন্দ্রাদি যা সৃষ্টির শুরুতে শ্বাশত প্রতীক। এর মাধ্যমে তিনি অবশ্যই উপদেশ দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ সূর্যের দিকে তাকান এবং চিন্তা করুন যে, এই আকাশে অগ্নির প্রতীক সূর্য সৃষ্টির আদিকাল থেকেই ছিলো, আপন সৌরমণ্ডলে স্বয়ং রাত-দিন জ্বলছে। এবং এক মুহুর্তও বিশ্রাম না নিয়ে শক্তি, তাপ ও আলো প্রদান করে ঈশ্বর দ্বারা অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। সূরণ্যের প্রতি বেদের এই নির্দেশ। আর সে বেদোক্ত আজ্ঞা পালন করতে করতে বলে- হে মানব! তুমিও আমার মতো সবসময় বেদোক্ত পরিশ্রম কর, আলস্য ত্যাগ করে কর্ম কর। আমরা এর অন্যথা চিন্তা করা বা বেদে ইতিহাস ইত্যাদি কল্পনা করা, সর্বদাই ন্যায়সংগত নয়। কারণ, বেদ কোন ব্যক্তি বিশেষের রচনা নয়। এটি পরমপিতা পরমাত্মার পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য এক বিশেষ উপহার।
আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা বেদবিদ্যার অভ্যাস ছেড়ে দিয়ে, আধুনিক পতনশীল বিজ্ঞানকে সত্য মেনে এর অভ্যাস শুরু করে দিয়েছি। আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তা পরমপিতা পরমেশ্বর সৃষ্ট বেদোক্ত পথ থেক বিচ্যুত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছি। এখনো সময় আছে আমরা কল্যানকর বেদোক্ত পথে ফিরে আসতে পারি এবং মানবতার বিনাশ থেকে রক্ষা পেতে পারি।
দেখুন মহর্ষি কপিল মানব জীবনের উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর সাংখ্য শাস্ত্রে বলেছেন-
প্রশ্নঃ মানব জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য কি?
উত্তর- অথঃ ত্রিবিধদুঃখাত্যন্ত নিবৃত্তিরত্যন্ত পুরুষার্থ।।১.১।।
অর্থঃ জীবনের উদ্দেশ্য হলো তিন প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি।
প্রশ্নঃ তিন প্রকারের দুঃখ কি?
উত্তরঃ আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক।
প্রশ্নঃ আধ্যাত্মিক দুঃখ কাকে বলে?
উত্তরঃ যে সকল দুঃখ শরীরে উৎপনজন হয়। যথাঃ ঈর্ষা, লোভ, মোহ, দ্বেষ, ক্লেশ, রোগসমূহ।
প্রশ্ন: আধিভৌতিক দুঃখ কাকে বলে?
উত্তর: যা অন্য প্রাণীর সংসর্গ থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে। যেমনঃ সাপে কাটা বা সিংহ দ্বারা মারা গেলে বা মানুষের পরস্পর যুদ্ধ থেকে যে দুঃখ উৎপন্ন হয় তাকে আধিভৌতিক দুঃখ বলে।
প্রশ্নঃ আধিদৈবিক দুঃখ কাকে বলে?
উত্তরঃ যে সকল দুঃখ দৈবী শক্তি যেমন অগ্নি, বায়ু বা জলের আধিক্যের কারণে উৎপত্তি হয়, তাকে আধিদৈবিক দুঃখ বলে।
প্রশ্ন: সময়ের বিচারে দুঃখ কত প্রকার?
উত্তর: তিন প্রকার- ভূত, বর্তমান, অনাগত (ভবিষ্যৎ)
প্রশ্ন: এই তিনটির জন্য পুরুষার্থ করা উচিত?
উত্তর: কেবল অনাগত (ভবিষ্যৎ) এর জন্য পুরুষার্থ করা উচিত। কারণ, ভূত সংঘটিত হয়ে যাওয়ার ফলে তা নাশ হয়ে যায় আর বর্তমান তো পরক্ষণে ভূত হয়ে যায়।
অতএব এই দুটি স্বয়ং বিনাশ প্রাপ্ত হয়। তাই ভবিষ্যতের জন্যই পুরুষার্থ করা আবশ্যক। বর্তমানে পুরুষার্থ করলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুটিরই সংশোধন হয়ে যায়।
কবিবর মৈথিলীশরণ গুপ্ত বলেছেন —
তোমার ভূতও মহান এবং তোমার ভবিষ্যৎও মহান।
যদি তোমার যা বর্তমান তা সামলে নাও।।
মানব জীবনের উদ্দেশ্য
লেখক: শ্রী মনমোহন রায় গর্গ