বানপ্রস্থ আশ্রমে প্রবেশের সময় সাধারণত পঞ্চাশ বছরের পর, যখন সন্তানের সন্তান হয়ে যায় [মনুস্মৃতি ৬।১-৩, ২৭-২৯]। গৃহস্থাশ্রম উপভোগের পর প্রত্যেক পুরুষ ও নারীকে বানপ্রস্থ আশ্রমে প্রবেশ করে নিজের মানসিক ও আত্মিক শক্তি এবং জ্ঞান বৃদ্ধি করা, গুরুকুলে থেকে পড়ানো এবং অপরের সেবা কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করা উচিত [অথর্ববেদ ১৯।৫।১, ১৯।৪১।১, ১৯।৪০।৩]। ঈশ্বর–ভক্তি, ধ্যান–যোগ এবং বেদাদি শাস্ত্রের মননে নিজের সময়কে বিশেষ রূপে লাগানোই এই সময়ের মূল প্রতিপাদ্য। পাশাপাশি এইসময়ে অহিংসা, সত্য, ব্রহ্মচর্য, তপস্যা, শান্তি, ইন্দ্রিয়নিগ্ৰহ ইত্যাদি ধারণ করা উচিত। নিজের জ্ঞান ও অনুভব দ্বারা অপরকে যথাশক্তি লাভ পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা করা উচিত। যদি আগের দিনের মতো সকলে পঞ্চাশ বছর বয়সের পর বানপ্রস্থী হওয়ার নিয়ম মেনে নেয়, তাহলে গুরুকুল এবং উত্তম অপর সংস্থা চালোনো সহজ হবে। আজকালকার মতো বিদ্বান, অনুভব, ত্যাগী কার্যকর্তার অভাব এই সংস্থায় অনুভব হবে না। এভাবে শিক্ষা, সমাজের কাজ ভালোভাবে এবং সহজে চলতে থাকবে।
আসুন এবার বানপ্রস্থ আশ্রম বিষয়ে বেদ কী বলে জেনে নেই -
ব্র॒তেন॑ দী॒ক্ষামা॑প্নোতি দী॒ক্ষয়া॑প্নোতি॒ দক্ষি॑ণাম্। দক্ষি॑ণা শ্র॒দ্ধামা॑প্নোতি শ্র॒দ্ধয়া॑ স॒ত্যমা॑প্যতে॥১॥
[যজুর্বেদ ১৯। ৩০]
অর্থঃ যখন মানুষ ব্রহ্মচর্যাদি তথা সত্যভাষণাদি ব্রত, অর্থাৎ নিয়ম ধারণ করে, তখন সেই (ব্রতেন) ব্রতের দ্বারা উত্তম প্রতিষ্ঠারূপ (দীক্ষাম্) দীক্ষা (আপ্নোতি) লাভ করে। (দীক্ষয়া) ব্রহ্মচর্যাদি আশ্রমসমূহের নিয়ম পালন করে (দক্ষিণাম্) সসম্মানে ধন ইত্যাদি (আপ্নোতি) লাভ করে। (দক্ষিণা) সেই সম্মান হতে (শ্রদ্ধাম্) সত্যধারণে প্রীতি (আপ্নোতি) লাভ করে এবং (শ্রদ্ধয়া) সত্যধার্মিক জনগণের সাথে প্রীতি দ্বারা (সত্যম্) মানুষের সত্যবিজ্ঞান বা সত্য পদার্থ (আপ্যতে) অর্জিত হয়, এইজন্য শ্রদ্ধাপূর্বক ব্রহ্মচর্য ও গৃহাশ্রমের অনুষ্ঠান করে বানপ্রস্থ আশ্রমে প্রবেশ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ॥১॥
অ॒ভ্যাদ॑ধামি স॒মিধ॒মগ্নে॑ ব্রতপতে॒ ত্বয়ি॑। ব্র॒তংচ॑ শ্র॒দ্ধাং চোপৈ॑মী॒ন্ধে ত্বা॑ দীক্ষি॒তোঽ অ॒হম্॥২॥
[যজুর্বেদ ২০। ২৪]
অর্থঃ হে (ব্রতপতে অগ্নে) নিয়মপালকেশ্বর! (দীক্ষিতঃ) দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে (অহম্) আমি (ত্বয়ি) তোমাতে স্থির হয়ে (ব্রতম্) ব্রহ্মচর্যাদি আশ্রম ধারণ (চ) এবং এর সামগ্রী, (শ্রদ্ধাম্) সত্য ধারণা (চ) এবং তার উপায় (উপৈমি) প্রাপ্ত হই। এজন্য অগ্নিতে যেরূপ (সমিধম্) সমিধা (অভ্যাদধামি) ধারণ করি, সেরূপই বিদ্যা ও ব্রত ধারণ করে প্রজ্বলিত করি এবং সেরূপই (ত্বা) তোমাকে নিজের আত্মায় ধারণ করে সর্বদা (ঈন্ধে) প্রকাশিত করি। ॥২॥
আ ন॑য়ৈ॒তমা র॑ভস্ব সু॒কৃতাং॑ লো॒কমপি॑ গচ্ছতু প্রজা॒নন্। তী॒র্ত্বা তমাং॑সি বহু॒ধা ম॒হান্ত্য॒জো নাক॒মা ক্র॑মতাং তৃ॒তীয়॑ম্ ॥৩॥
[অথর্ববেদ ৯। ৫। ১]
অর্থঃ হে গৃহস্থ! (প্রজানন্) প্রকৃষ্টরূপে জেনে তুমি (এতম্) এই বানপ্রস্থাশ্রম (আরভস্ব) আরম্ভ করো। (আনয়) তোমার নিজের মনকে গৃহাশ্রম থেকে এদিকে নিয়ে এসো। (সুকৃতাম্) পুণ্যাত্মাগণের (লোকমপি) দর্শনীয় বানপ্রস্থাশ্রমকেও (গচ্ছতু) প্রাপ্ত হও। (বহুধা) বিবিধ প্রকারের (মহান্তি) অতি গভীর (তমাংসি) অজ্ঞানতা, দুঃখ প্রভৃতি সাংসারিক মোহ হতে (তীর্ত্বা) উত্তীর্ণ হয়ে, অর্থাৎ তা থেকে পৃথক্ হয়ে (অজঃ) নিজের আত্মাকে অজর অমর জেনে (তৃতীয়ম্) তৃতীয় (নাকম্) দুঃখ রহিত বানপ্রস্থাশ্রমে (আক্রমতাম্) যথারীতি আরূঢ় হও। ॥৩॥
ভ॒দ্রমি॒চ্ছন্ত॒ ঋষ॑য়ঃ স্ব॒র্বিদ॒স্তপো॑ দী॒ক্ষামু॑প॒নিষে॑দু॒রগ্রে॑। ততো॑ রা॒ষ্ট্রং বল॒মোজ॑শ্চ জা॒তং তদ॑স্মৈ দে॒বা উ॑প॒সংন॑মন্তু ॥৪॥
[অথর্ববেদ ১৯। ৪১। ১]
অর্থঃ যে বিদ্বান্ মনুষ্যগণ! যেরূপ (স্বর্বিদঃ) সুখগ্রাহী (ঋষয়ঃ) বিদ্বানেরা (অগ্নে) প্রথমে (দীক্ষাম্) ব্রহ্মচর্যাদি আশ্রমের দীক্ষা, উপদেশ গ্রহণ করে (তপঃ) প্রাণায়াম ও বিদ্যাধ্যয়ন, জিতেন্দ্রিয়ত্বাদি শুভ লক্ষণ (উপনিষেদঃ) প্রাপ্ত হয়ে তার অনুষ্ঠান করেন, সেরূপ এই (ভদ্রম্) কল্যাণকর বানপ্রস্থাশ্রম [প্রাপ্তির] (ইচ্ছন্তঃ) ইচ্ছা করো। যেরূপ রাজকুমার ব্রহ্মচর্যাশ্রম পালন করে (ততঃ) তারপর (ওজঃ) পরাক্রম (চ) এবং (বলম্) বল প্রাপ্ত হয়ে (জাতম্) প্রসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে (রাষ্ট্রম্) রাজ্যের ইচ্ছা ও রক্ষা করেন এবং (অস্মৈ) ন্যায়কারী ধার্মিক বিদ্বান্ রাজাকে (দেবাঃ) বিদ্বানেরা নমস্কার করেন, (তৎ) সেরূপ সকলে বানপ্রস্থাশ্রমে প্রবিষ্ট তোমাকে (উপ সং নমন্ত্ত) নিকটে পেয়ে নম্র হোক। ॥৪॥
মা নো॑ মে॒ধাং মা নো॑ দী॒ক্ষাং মা নো॑ হিংসিষ্ট যত্তপঃ॑। শি॒বা নঃ॒ শং স॒ন্ত্বায়ু॑ষে শি॒বা ভ॑বন্তু মা॒তরঃ॑ ॥ ৫।।
[অথর্ববেদ ১৯। ৪০। ৩]
অর্থঃ হে আত্মীয়গণ! (নঃ) বানপ্রস্থাশ্রমস্থ আমাদের (মেধাম্) প্রজ্ঞাকে (মা হিংসিষ্ট) নষ্ট কোরো না। (নঃ) আমাদের (দীক্ষাম্) দীক্ষা (মা) নষ্ট কোরো না এবং (নঃ) আমাদের (য়ৎ) যে (তপঃ) প্রাণায়ামাদি উত্তম তপ তাকেও তোমরা (মা) নষ্ট করো না। (নঃ) আমাদের দীক্ষা এবং (আয়ুষে) জীবনের জন্য সকল প্রজা (শিবাঃ) কল্যাণকারিণী (সন্তু) হোক। যেভাবে আমাদের (মাতরঃ) মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী প্রভৃতি (শিবাঃ) কল্যাণকারিণী হয়ে থাকেন, সেরূপ সকলে প্রসন্ন হয়ে আমাকে বানপ্রস্থাশ্রমের অনুমতিদাতা (ভবন্তু) হও। ॥৫॥
মানুষের ব্রহ্মচর্যাশ্রম সমাপ্ত করে গৃহস্থ, গৃহস্থ থেকে বানপ্রস্থী এবং বানপ্রস্থ সমাপ্ত করে সন্ন্যাসী হওয়া উচিত । ক্রমান্বয়ে এটিই আশ্রম বিধান। মহর্ষি মনু বলেছেন -
এবং গৃহাশ্রমে স্থিত্বা বিধিবৎ স্নাতকো দ্বিজঃ।
বনে বসেত্তু নিয়তাে যথাবদ্বিজিতেন্দ্রিয়ঃ ॥১॥
গৃহস্থস্তু যাদা পশ্যেদ্ বলীপলিতমাত্মনঃ।
অপত্যস্যৈব চাপত্যং তদারণ্যং সমাশ্রয়েৎ ॥২॥
সংত্যজ্য গ্রাম্যমাহারাং সর্বং চৈব পরিচ্ছদম্।
পুত্রেষু ভার্যাং নিঃক্ষিপ্য বনং গচ্ছেৎ সহৈব বা ॥৩॥
অগ্নিহােত্রং সমাদায় গৃহ্যং চাগ্নিপরিচ্ছদম্।
গ্রামাদরণ্যং নিঃসৃত্য নিবসেন্নিয়তেন্দ্রিয়ঃ ॥৪॥
মুন্যন্নৈৰ্বিবিধৈর্মেধ্যৈঃ শাকমূলফলেন বা।
এতানেব মহাযজ্ঞান্নির্বপেদ্বিধিপূর্বকম ॥৫॥ মনু০ [৬।১-৫]
এভাবে স্নাতক অর্থাৎ ব্রহ্মচর্যপূর্বক গৃহাশ্রমের কৰ্তা দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য গৃহাশ্রমে অবস্থান করে নিশ্চিতাত্মা হয়ে যথাবৎ ইন্দ্রিয়সমূহকে জয় করে বনে বাস করবে॥ ১॥
কিন্তু গৃহস্থের যখন মাথার কেশ শ্বেত হবে ও ত্বক শিথিল হবে এবং যখন পুত্রেরও পুত্র হবে, তখন গৃহী বনে গিয়ে বাস করবে॥২॥
যাবতীয় গ্রাম্য আহাৰ্য, বস্ত্রাদি উৎকৃষ্ট বস্তু ত্যাগ করে স্ত্রীকে পুত্রদের কাছে রেখে অথবা নিজের সঙ্গে নিয়ে বনে বাস করবে ৷৷৩৷৷
সাঙ্গোপাঙ্গ অগ্নিহােত্র সহকারে গ্রাম থেকে বের হবে এবং দৃঢ়েন্দ্রিয় হয়ে অরণ্যে বাস করবে॥৪॥
নীবারাদি নানাবিধ অন্ন, সুন্দর শাক, মূল, ফল, কন্দাদি দ্বারা পূর্বোক্ত পঞ্চ মহাযজ্ঞ করবে এবং তার মাধ্যমে অতিথি সেবা ও নিজের জীবন নির্বাহ করবে ৷৷৫৷৷
স্বাধ্যয়ে নিত্যযুক্ত স্যাদ্দান্তো মৈত্রঃ সমাহিতঃ।
দাতা নিত্যমনাদাতা সর্বভূতানুকম্পকঃ॥১॥
অপ্রযত্নঃ সুখাথের্ষু ব্রহ্মচারী ধরাশয়ঃ।
শরণেষ্বনমশ্চৈব বৃক্ষমূলনিকেতনঃ॥২॥ মনু০ [৬।৮,২৬]
স্বাধ্যায় অর্থাৎ অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় নিত্য যুক্ত, জিতাত্মা, সকলের মিত্র, ইন্দ্রিয়-দমনশীল, বিদ্যাদি দাতা এবং সকলের প্রতি দয়ালু হবে, কারো কাছে থেকে কিছু গ্রহণ করবে না, সর্বদা এমন আচরণ করবে ॥১॥
শারীরিক সুখের জন্য অত্যধিক চেষ্টা করবে না, ব্রহ্মচারী থাকবে অর্থাৎ নিজ স্ত্রী সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও তাঁর সাথে বিষয়ভােগের চেষ্টা করবে না। ভূমিতে শয়ন করবে। নিজের আশ্রিত ও নিজ সামগ্রীর উপর মমতা করবে না, বৃক্ষমূলে বাস করবে ॥২॥
তপঃশ্রদ্ধে যে হ্যুপবসন্ত্যরণ্যে শান্তা বিদ্বাংসো ভৈক্ষ্যচর্যাং চরন্তঃ ।
সূর্যদ্বারেণ তে বিরজাঃ প্রয়ান্তি যত্রামৃতঃ স পুরুষো হ্যব্যয়াত্মা ॥১॥ মুণ্ডক০ ১।খ০ ২।ম০ ১১
যেসকল শান্ত, বিদ্বান্ বানপ্রস্থাশ্রমবাসী তপস্যা, ধর্মানুষ্ঠান, সত্যনিষ্ঠা এবং ভিক্ষাচরণ সহকারে বনে বাস করেন, তাঁরা যেস্থানে অবিনাশী, হানি-লাভ রহিত, পূর্ণ পুরুষ পরমাত্মা আছেন, সেই স্থানে নির্মলচিত্ত হয়ে প্রাণদ্বার দিয়ে সেই পরমাত্মাকে লাভ করে আনন্দিত হন॥১॥
অভ্যা দধামি সমিধমগ্নে ব্রতপতে ত্বয়ি।
ব্ৰতং চ শ্রদ্ধাং চোপৈমীন্ধে ত্বা দীক্ষিতো অহম ॥১॥ যর্জুবেদে, অধ্যায় ২০ ম০ ২৪॥
বানপ্রস্থের কৰ্তব্য - ‘আমি অগ্নিতে হােমানুষ্ঠানপূৰ্বক দীক্ষিত হয়ে ব্রত, সত্যাচরণ ও শ্রদ্ধাশীলতা লাভ করবো’- এই অভিলাষী হয়ে বানপ্রস্থ অবলম্বন করবে। নানাবিধ তপশ্চৰ্যা, সৎসঙ্গ, যােগাভ্যাস এবং সুবিচার দ্বারা জ্ঞান ও পবিত্রতা লাভ করবে।৷১৷৷
পরে যখন সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা হবে তখন স্ত্রীকে পুত্রদের কাছে পাঠাবে তারপর সন্ন্যাস গ্রহণ করবে।
১। সংস্কারবিধি - ভগবৎপাদ মহর্ষি শ্রীমৎ দয়ানন্দ সরস্বতী
২। সত্যার্থ প্রকাশ - ভগবৎপাদ মহর্ষি শ্রীমৎ দয়ানন্দ সরস্বতী