দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







বেদে সন্ন্যাস আশ্রমের কথা কোথায় আছে ?

সত্যান্বেষী
0

 

বেদে সন্ন্যাস আশ্রমের কথা কোথায় আছে ?

সন্ন্যাস শব্দের অর্থ সমস্ত মোহাদি আবরণ ও পক্ষপাতত্যাগ করা। সন্ন্যাসী তাঁকেই বলে যিনি সমস্ত কুকর্ম ও নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে ঈশ্বরের ধ্যান এবং বৈরাগ্যবান হয়ে পরোপকারে জীবন অতিবাহিত করেন [ঋগ্বেদ ৯।১১৩।১-১১, মনুস্মৃতি ৬।৩৩-৮৫]। যিনি ধন, পুত্র এবং যশের ইচ্ছা থেকে ওপরে উঠে গেছেন, তিনি নির্ভয় হয়ে সমস্ত জায়গায় ধর্মের প্রচার করেন। অধর্ম, অন্যায়, অত্যাচারের ঘোর বিরোধিতা করেন। যিনি সমস্ত প্রাণীর প্রতি প্রেম–দৃষ্টি রাখেন। এমন সত্যিকারের সন্ন্যাসীর সংখ্যা যত অধিক হবে তত তাড়াতাড়ি সংসারের ভালো এবং উদ্ধার হবে।

প্রশ্ন- সন্ন্যাসগ্রহণের প্রয়ােজন কী?

উত্তর - শরীরের যেমন মাথার প্রয়ােজন তেমন আশ্রমসমূহের মধ্যেও সন্ন্যাসের প্রয়ােজন। কারণ সন্ন্যাস ব্যতীত কখনও বিদ্যোন্নতি ও ধর্মোন্নতি হতে পারে না । অন্যান্য আশ্রমস্থদের বিদ্যাভ্যাস, গৃহকৃত্য এবং তপশ্চর্যাদি থাকার জন্য অবসর অতি অল্পই থাকে। পক্ষপাত পরিত্যাগপূর্বক কাৰ্য করা অন্য আশ্রমবাসীর পক্ষে দুষ্কর। সন্ন্যাসী যেমন সর্বতােভাবে মুক্ত হয়ে জগতের উপকার করেন তেমন অন্য কোন আশ্রমবাসী করতে পারে না। কারণ সত্যবিদ্যা দ্বারা পদার্থ বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে সন্ন্যাসীর যেমন অবকাশ থাকে, অন্য কোন আশ্রমবাসীর তেমন থাকে না। কিন্তু ব্রহ্মচর্য থেকে সন্ন্যাসী হয়ে সত্যেপদেশ দ্বারা জগতের যেমন উন্নতি করা যায় গৃহস্থ অথবা বানপ্রস্থ আশ্রমের পর সন্ন্যাসী হলে তেমন করা যায় না।


প্রশ্ন- সন্ন্যাস গ্রহণ করা ঈশ্বরের অভিপ্রায় বিরুদ্ধ কারণ মানবসংখ্যাবৃদ্ধি পরমেশ্বরের অভিপ্রেত। গৃহস্থাশ্রম প্রতিপালন না করলে তার দ্বারা সন্তানও হবে না। যদি সন্ন্যাস আশ্রমই মুখ্য হয় এবং সকল মানুষ তা গ্রহণ করে তবে মানুষের মূলােচ্ছেদ হবে।

উত্তর - আচ্ছা, বিবাহ করেও অনেকের সন্তান হয় না অথবা হলেও শীঘ্র নষ্ট হয়ে যায়। তাও তবে ঈশ্বরের অভিপ্রায় বিরুদ্ধ হল। যদি বল, ‘যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি কোঽত্র দোষঃ’ এটা কোন কবির উক্তি [পঞ্চতন্ত্র, মিত্রভেদ ৪.২১৭ ]= চেষ্টা সত্ত্বেও কাৰ্যসিদ্ধি না হলে তাতে আমার কোন দোষ নেই। তাহলে আমি তােমাকে জিজ্ঞাসা করি যদি গৃহস্থাশ্রম পালন করে বহু সন্তান জন্মে এবং তারা পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ ও বিবাদ করে মরে তবে কতদূর অনিষ্ট হয়ে থাকে? ভুল বুঝার জন্য অনেক বিবাদ হয়ে থাকে। যখন সন্ন্যাসী এক বেদোক্তধর্মের উপদেশ দ্বারা পরস্পর প্রীতি উৎপন্ন করবেন তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ রক্ষা পাবে এবং সহস্র সহস্র গৃহস্থের ন্যায় মানব বৃদ্ধি হবে। আর সকল মানুষ সন্ন্যাস গ্রহণ করতেই পারে না। কারণ সবার বিষয়াসক্তি কখনো দূর হয় না। সন্ন্যাসীদের উপদেশ অনুসারে যাঁরা ধার্মিক হন তারা সন্ন্যাসীদের পুত্র তুল্য জানবে।


প্রশ্ন - সন্ন্যাসীরা বলেন আমাদের কোন কর্তব্য নাই। অন্ন বস্ত্র পেয়ে আনন্দে থাকব। অবিদ্যারূপী সংসার নিয়ে মাথা ঘামাব কেন? নিজেকে ব্রহ্ম মেনে সন্তুষ্ট থাকব এবং কেউ জিজ্ঞাসা করলে তাকেও উপদেশ দেব, ‘তুমিও ব্রহ্ম, তােমাকে পাপপুণ্য কিছুই স্পর্শ করতে পারে না, কারণ শীতা-উষ্ণ শরীরের, ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রাণের এবং সুখ-দুঃখ মনের ধর্ম। জগৎ মিথ্যা এবং জগতের যাবতীয় ব্যবহারও কল্পিত অর্থাৎ মিথ্যা। সুতরাং তাতে আবদ্ধ হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পাপপুণ্য যা কিছু সব দেহ ও ইন্দ্রিয়ের ধর্ম, আত্মার নয়’ ইত্যাদি । তারা এসব উপদেশ দিয়ে থাকেন । কিন্তু আপনি সন্ন্যাসের অন্য রকম ধর্ম বলছেন। এখন কার কথা সত্য মানব?

উত্তর- সৎকর্ম করাও কি তাদের কর্তব্য নয়? দেখ, ‘বৈদিকৈশ্চৈব কর্মভিঃ' মনু০ [৬.৭৫]। মন লিখেছেন, ‘বৈদিক কর্ম’ যা ধর্মসঙ্গত সত্য কর্ম তা সন্ন্যাসীদেরও অবশ্য কর্তব্য। সন্ন্যাসীরা কি গ্রাসাচ্ছাদনাদি কর্মও পরিত্যাগ করতে পারে? যদি এসব পরিত্যাগ করা না যায় তবে উত্তম কর্ম পরিত্যাগ করলে তারা কি পতিত হবে না? যদি তারা গৃহস্থদের নিকট হতে অন্নবস্ত্রাদি গ্রহণ করে কিন্তু তাদের কোন প্রত্যুপকার না করে তবে কি তারা মহাপাপী হবে না? যেমন চোখ দিয়ে না দেখলে এবং কান দিয়ে না শুনলে চোখ-কান থাকা বৃথা তেমনি সত্যোপদেশ ও বেদাদি সত্যশাস্ত্রের আলােচনা ও প্রচার না করলে সন্ন্যাসীরা জগতে বৃথা, ভারস্বরূপ হয়ে থাকে।

আর যে ‘অবিদ্যারূপী সংসারে মাথা কেন ঘামাব’ ইত্যাদি কথা লেখা ও বলা হয়, যারা এমন উপদেশ প্রদান করে তারা স্বয়ং মিথ্যাস্বরূপ পাপের বৃদ্ধিকারী পাপী। শরীরাদি দ্বারা যেসব কর্ম করা হয় সেসব আত্মারই কর্ম এবং আত্মাই সেসবের ফলভােগী । যারা জীবকে ব্রহ্ম বলে তারা অবিদ্যারূপ নিদ্রায় নিদ্রিত। কারণ জীব একদেশী ও অল্পজ্ঞ কিন্তু ব্ৰহ্ম নিত্য, বুদ্ধ এবং মুক্ত স্বভাবযুক্ত। আর জীব কখনও বদ্ধ ,কখনও মুক্ত থাকে। ব্রহ্ম সর্বব্যাপক বলে তার কখনও অবিদ্যা অথবা ভ্রম হতে পারে না। কিন্তু জীবের কখনও বিদ্যা, কখনও অবিদ্যা হয়ে থাকে। ব্রহ্ম কখনও জন্ম-মরণ জনিত দুঃখ প্রাপ্ত হন না, কিন্তু জীব তা প্রাপ্ত হয়। অতএব তাদের ওসব উপদেশ মিথ্যা।

বনেষু চ বিহৃত্যৈবং তৃতীয়ং ভাগমায়ুষঃ ।

চতুর্থং আয়ুষো ভাগং ত্যক্বা সঙ্গান্পরিব্রজেৎ॥১॥ [মনু০ ৬।৩৩]

এভাবে বনে আয়ুর তৃতীয় ভাগ অর্থাৎ পঁচিশ বছর থেকে,পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর বচহর পর্যন্ত বানপ্রস্থে থেকে আয়ুর চতুর্থ ভাগে সঙ্গত্যাগ করে ‘পরিব্রাট্‌’ অর্থাৎ সন্নাসী হবে।

প্রশ্ন- ব্রহ্মচর্য থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করলে তা পালন করা কঠিন হবে। কাম নিরােধ করা অতি কঠিন। তাই গৃহাশ্রম ও বানপ্রস্থ আশ্রম শেষ করে বৃদ্ধাবস্থায় সন্ন্যাস গ্রহণ করাই ভালো।

উত্তর- যিনি সন্ন্যাস পালনে ও ইন্দ্রিয় নিরােধে অসমর্থ, তিনি ব্রহ্মচর্য হতে সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন না। কিন্তু যিনি সমর্থ তিনি গ্রহণ করবেন না কেন? যিনি বিষয়ভােগের দোষ ও বীৰ্যসংরক্ষণের গুণ জানেন তিনি কখনো তাতে আসক্ত হন না, এবং তারা বীৰ্য বিচার রূপ অগ্নির ইন্ধন সদৃশ অর্থাৎ তাতেই ব্যয়িত হয়ে যায়। রােগীর জন্য চিকিৎসক ও ঔষধের প্রয়ােজন, নীরােগের জন্য নয়। এমনই যে পুরুষ বা নারীর উদ্দেশ্য বিদ্যোন্নতি, ধর্মোন্নতি ও সমস্ত জগতের উন্নতি করা তিনি বিবাহ করবেন না। পঞ্চশিখ প্রভৃতি পুরুষ এবং গার্গী প্রভৃতি নারী এমন ছিলেন। তাই যাঁরা অধিকারী তাদের সন্ন্যাসী হওয়া উচিত, অনধিকারী সন্ন্যাস গ্রহণ করলে নিজেও ডুববেন এবং অপরকেও ডোবাবেন। যেমন ‘সম্রাট’সর্বোপরি চক্রবর্তী রাজা তেমনই সন্ন্যাসী ‘পরিব্রাট্‌’। বরং রাজা স্বদেশে অথবা নিজ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে সম্মানিত হন আর সন্ন্যাসী সর্বত্র পূজিত হন।

বিদ্বত্ত্বং চ নৃপত্বং চ নৈব তুল্যং কদাচন।

স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে ৷৷১॥ এটি চাণক্য নীতিশাস্ত্রের শ্লোক[৩]।

বিদ্বান এবং রাজা কখনো সমতুল্য হন না, কারণ রাজা কেবল নিজ দেশেই সম্মান লাভ করেন, আর বিদ্বান সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

আসুন সন্ন্যাস সম্পর্কে বেদ কী বলে জেনে নেই - 


শ॒র্য॒ণাব॑তি॒ সোম॒মিন্দ্র॑: পিবতু বৃত্র॒হা। 

বলং॒ দধা॑ন আ॒ত্মনি॑ করি॒ষ্যন্বী॒র্যং॑ ম॒হদিন্দ্রা॑য়েন্দো॒ পরি॑ স্রব॥১॥ 

আ প॑বস্ব দিশাং পত আর্জী॒কাৎ সো॑ম মীঢ্বঃ। 

ঋ॒ত॒বা॒কেন॑ স॒ত্যেন॑ শ্র॒দ্ধয়া॒ তপ॑সা সু॒ত ইন্দ্রা॑য়েন্দো॒ পরি॑ স্রব ॥ ২।।

[ঋগ্বেদ ৯। ১৩। ১-২] 

অর্থঃ- আমি ঈশ্বর, সন্ন্যাসগ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, যেমন (বৃত্রহা) মেঘবিনাশক (ইন্দ্রঃ) সূর্য্য (শর্যণাবতি) হিংসনীয় পদার্থযুক্ত ভূমিতলে স্থিত (সোমম্) রসকে পান করে, সেরূপ সন্ন্যাস গ্রহণে ইচ্ছুক পুরুষ উত্তম ফলমূলের রসকে (পিবতু) পান 

করুক এবং (আত্মনি) নিজের আত্মার (মহৎ) মহৎ (বীর্যম্) সামর্থ্যকে (করিষ্যন্) বৃদ্ধি করবো, এইরূপ ইচ্ছা করে (বলং দধানঃ) দিব্যবল ধারণপূর্বক (ইন্দ্রায়) পরমৈশ্বর্যের জন্য, হে (ইন্দো) চন্দ্রমাসদৃশ সকলকে আনন্দদাতা পূর্ণ বিদ্বান্! তুমি সন্ন্যাস গ্রহণ করে সকলের উপর (পরি স্রব) সত্যোপদেশ বর্ষণ করো। ॥১॥ 

হে (সোম) সৌম্যগুণসম্পন্ন (মীঢ্বঃ) সত্য দ্বারা সকলের অন্তঃকরণকে সিঞ্চনকারী, (দিশাং পতে) সত্যজ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে সর্বদিকস্থ মনুষ্যের পালক, (ইন্দো) শম ইত্যাদি গুণযুক্ত সন্ন্যাসী! তুমি (ঋতবাকেন) যথার্থ ন্যায় বচন, (সত্যেন) সত্যভাষণ দ্বারা, (শ্রদ্ধয়া) সত্যধারণে সত্য প্রীতি এবং (তপসা) প্রাণায়াম, যোগাভ্যাস দ্বারা (আর্জীকাৎ) সরলতাপূর্বক (সুতঃ) নিষ্পন্ন নিজের শরীর, ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে (আ পবস্ব) পবিত্র করো, (ইন্দ্রায়) পরমৈশ্বর্যবান্ পরমেশ্বরের জন্য (পরি স্রব) সর্বদিকে গমন করো। ॥২॥ 

 

ঋ॒তং বদ॑ন্নৃতদ্যুম্ন স॒ত্যং বদ॑ন্ত্সত্যকর্মন্। 

শ্র॒দ্ধাং বদ॑ন্ত্সোম রাজন্ধা॒ত্রা সো॑ম॒ পরি॑ষ্কৃত॒ ইন্দ্রা॑য়েন্দো॒ পরি॑ স্রব॥৩॥

[ঋগ্বেদ ৯। ১১৩। ৪] 

অর্থঃ- হে (ঋতদ্যুম্ন) সত্যধন ও সত্যকীর্তিময় যতিবর! (ঋতং বদন্) নিরপেক্ষভাবে সত্যবাদী, (সত্যকর্মন্) সত্য, বেদোক্ত কর্মের অনুষ্ঠাতা হে সন্ন্যাসী! (সত্যং বদন) সত্য বলতে, (শ্রদ্ধাম্) সত্যধারণে প্রীতি করতে (বদন) উপদেশ প্রদাতা, (সোম) সৌম্যগুণসম্পন্ন, (রাজন্) জ্যোতির্ময় আত্মবান্, (সোম) যোগৈশ্বর্যযুক্ত (ইন্দো) সকলকে আনন্দদাতা হে সন্ন্যাসী! তুমি (ধাত্রা) সম্পূর্ণ বিশ্বের ধারণকর্তা পরমাত্মার অবলম্বনে যোগাভ্যাস করে (পরিষ্কৃতঃ) শুদ্ধ হয়ে (ইন্দ্রায়) যোগোৎপন্ন পরমৈশ্বর্যের সিদ্ধির জন্য (পরি স্রব) যথার্থ পুরুষার্থ করো। ॥৩॥ 

 

যত্র॑ ব্র॒হ্মা প॑বমান ছন্দ॒স্যাং॒৩॒॑ বাচং॒ বদ॑ন্। 

গ্রাব্ণা॒ সোমে॑ মহী॒য়তে॒ সোমে॑নান॒ন্দং জ॒নয়॒ন্নিন্দ্রা॑য়েন্দো॒ পরি॑ স্রব ॥৪॥

[ঋগ্বেদ ৯। ১১৩। ৬] 

অর্থঃ- (ছন্দস্যাম্) স্বতন্ত্র (বাচম্) বাণী (বদন) বলতে বলতে (সোমেন) বিদ্যা, যোগাভ্যাস ও ঈশ্বরভক্তি দ্বারা (আনন্দম্) সকলের জন্য আনন্দ (জনয়ন্) প্রকট করতে করতে, (ইন্দো) আনন্দদাতা (পবমান) পবিত্রাত্মা ও পাবক হে সন্ন্যাসী! (যত্র) যে (সোমে) পরমৈশ্বর্য্যময় পরমাত্মায় (ব্রহ্মা) চতুর্বেদজ্ঞাতা বিদ্বান্ (মহীয়তে) মহত্ত্ব প্রাপ্ত হয়ে সৎকার লাভ করেন, যেমন (গ্রাব্ণা) মেঘ দ্বারা সমস্ত জগতের আনন্দ হয়, তেমনই তুমি সকলকে (ইন্দ্রায়) সেই পরমৈশ্বর্য্যময় মোক্ষানন্দ দানের জন্য সর্বপ্রকার সাধন (পরি স্রব) সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হও। ॥৪॥ 


যত্র॒ জ্যোতি॒রজ॑স্রং॒ যস্মিঁ॑ল্লো॒কে স্ব॑র্হি॒তম্ । 

তস্মি॒ন্ মাং ধে॑হি পবমানা॒মৃতে॑ লো॒কে অক্ষি॑ত॒ ইন্দ্রা॑য়েন্দো॒ পরি॑ স্রব ॥৫॥

[ঋগ্বেদ ৯। ১১৩। ০৭] 

অর্থঃ- হে (পবমান) অবিদ্যাদি ক্লেশনাশক, পবিত্রস্বরূপ (ইন্দো) সর্বানন্দদায়ক পরমাত্মা! (য়ত্র) এই- তোমার স্বরূপে (অজস্রম্) নিরন্তর ব্যাপক তোমার (জ্যোতিঃ) তেজ, (য়স্মিন্) যে (লোকে) জ্ঞান দ্বারা দর্শনযোগ্য তোমাতে (স্বঃ) নিত্য সুখ (হিতম্) অবস্থিত, (তস্মিন্) সেই (অমৃতে) জন্ম-মৃত্যু এবং (অক্ষিতে) নাশরহিত, (লোকে) জ্ঞান দ্বারা দর্শনযোগ্য স্বীয় স্বরূপে তুমি (মা) আমাকে (ইন্দ্রায়) পরমৈশ্বর্য্য প্রাপ্তির জন্য (ধেহি) কৃপা করে ধারণ করো এবং আমার প্রতি মাতার মতো কৃপা পূর্বক (পরি স্রব) আনন্দ বর্ষণ করো। ॥৫॥ 


যত্র॒ রাজা॑ বৈবস্ব॒তো যত্রা॑ব॒রোধ॑নং দি॒বঃ। 

যত্রা॒মূর্য॒হ্বতী॒রাপ॒স্তত্র॒ মাম॒মৃতং॑ কৃ॒ধীন্দ্রা॑য়েন্দো॒ পরি॑ স্রব॥৬॥

[ঋগ্বেদ ৯। ১১৩। ০৮] 

অর্থঃ- হে (ইন্দো) আনন্দদাতা পরমাত্মন্! (য়ত্র) যে তোমাতে (বৈবস্বতঃ) সূর্যের প্রকাশ (রাজা) প্রকাশিত হচ্ছে, (য়ত্র) যে তোমাতে (দিবঃ) বিদ্যুৎ, অথবা কু-বাসনার (অবরোধনম্) অবরোধ বিদ্যমান, (য়ত্র) যে তোমাতে (অমূঃ) সেই কারণরূপ (যহ্বতীঃ) বৃহৎ ব্যাপক আকাশস্থ (আপঃ) প্রাণপ্রদ বায়ু বিদ্যমান, (তত্র) তোমার সেই আপন স্বরূপে (মাম্) আমাকে (অমৃতম্) মোক্ষ লাভ (কৃধি) করাও। (ইন্দ্রায়) পরমৈশ্বর্য্যের জন্য (পরি স্রব) তুমি আমায় আর্দ্রভাবপূর্বক প্রাপ্ত হও॥৬॥ 


যত্রা॑নুকা॒মং চর॑ণং ত্রিনা॒কে ত্রি॑দি॒বে দি॒বঃ। 

লো॒কা যত্র॒ জ্যোতি॑ষ্মন্ত॒স্তত্র॒ মাম॒মৃতং॑ কৃ॒ধীন্দ্রা॑য়েন্দো॒ পরি॑ স্রব॥৭॥

[ঋগ্বেদ ৯। ১১৩। ৯]

অর্থঃ- হে (ইন্দো) পরমাত্মন্! (য়ত্র) যে তোমাতে (অনুকামম্) ইচ্ছানুকূল স্বতন্ত্র (চরণম্) বিচরণ বিদ্যমান, (য়ত্র) যে (ত্রিনাকে) ত্রিবিধ, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক দুঃখরহিত, (ত্রিদিবে) তিন, [অর্থাৎ] সূর্য্য, বিদ্যুৎ ও ভৌম্য অগ্নি [এই তিন] দ্বারা প্রকাশিত সুখস্বরূপ তোমাতে (দিবঃ) কামনাযোগ্য শুদ্ধ কামনাযুক্ত, (লোকাঃ) যথার্থ জ্ঞানযুক্ত (জ্যোতিষ্মন্তঃ) শুদ্ধ বিজ্ঞানযুক্ত, মুক্তি লাভ করা সিদ্ধপুরুষ বিচরণ করেন, (তত্র) তোমার সেই স্বরূপে (মাম্) আমাকে (অমৃতম্) মোক্ষ প্রাপ্ত (কৃধি) করাও এবং (ইন্দ্রায়) সেই পরম আনন্দৈশ্বর্য্যের জন্য (পরি স্রব) [আমাকে] কৃপা পূর্বক প্রাপ্ত হও। ॥৭॥ 


যত্র॒ কামা॑ নিকা॒মাশ্চ॒ যত্র॑ ব্র॒ধ্নস্য॑ বি॒ষ্টপ॑ম্। 

স্ব॒ধা চ॒ যত্র॒ তৃপ্তি॑শ্চ॒ তত্র॒ মাম॒মৃতং॑ কৃ॒ধীন্দ্রা॑য়েন্দো॒ পরি॑ স্রব ॥৮॥

[ঋগ্বেদ ৯। ১১৩। ১০] 

অর্থঃ- হে (ইন্দো) নিষ্কামানন্দদাতা, সচ্চিদানন্দস্বরূপ পরমাত্মা! (য়ত্র) যে তোমাতে (কামাঃ) সব কামনা (নিকামাঃ) ও অভিলাষ দূরে চলে যায় (চ) এবং (য়ত্র) যে তোমাতে (ব্রধ্নস্য) বৃহত্তম প্রকাশমান সূর্য্যের (বিষ্টপম্) বিশিষ্ট সুখ বিদ্যমান, (চ) এবং (য়ত্র) যে তোমাতে (স্বধা) [তোমার] নিজেরই [স্বরূপ] ধারণ (চ) ও যে তোমাতে (তৃপ্তিঃ) পূর্ণ তৃপ্তি বিদ্যমান, (তত্র) [তোমার] সেই আপন স্বরূপে (মাম্) আমাকে (অমৃতম্) মুক্তি প্রাপ্ত (কৃধি) করাও এবং (ইন্দ্রায়) সর্ব দুঃখ বিনাশের জন্য তুমি আমার উপর (পরি স্রব) করুণা করো। ॥৮॥ 


যত্রা॑ন॒ন্দাশ্চ॒ মোদা॑শ্চ॒ মুদ॑: প্র॒মুদ॒ আস॑তে। 

কাম॑স্য॒ যত্রা॒প্তাঃ কামা॒স্তত্র॒ মাম॒মৃতং॑ কৃ॒ধীন্দ্রা॑য়েন্দো॒ পরি॑ স্রব ॥৯॥

[ঋগ্বেদ ৯। ১১৩। ১১] 

অর্থঃ- হে (ইন্দো) সর্বানন্দময় জগদীশ্বর! (য়ত্র) যে তোমাতে (আনন্দাঃ) সম্পূর্ণ সমৃদ্ধি, (চ) এবং (মোদাঃ) সম্পূর্ণ হর্ষ, (মুদঃ) সম্পূর্ণ প্রসন্নতা, (চ) এবং (প্রমুদঃ) প্রকৃষ্ট প্রসন্নতা (আসতে) স্থিত রয়েছে, (য়ত্র) যে তোমাতে (কামস্য) কামনাযুক্ত পুরুষের (কামাঃ) সব কামনা (আপ্তাঃ) পূর্ণ হয়, (তত্র) [তোমার] সেই স্বীয় স্বরূপে (ইন্দ্রায়) পরমৈশ্বর্যের জন্য (মাম্) আমাকে (অমৃতম্) জন্ম-মৃত্যুর দুঃখরহিত মোক্ষ প্রদান করো, যাতে মোক্ষকালীন সময়ের মধ্যে সংসারে আর ফিরে আসতে না হয়, সেই মুক্তি (কৃধি) [আমাকে] প্রদান করো এবং একইভাবে সব জীবকে (পরি স্রব) সর্বদিক হতে প্রাপ্ত হও। ॥৯॥ 


যদ্দে॑বা॒ যত॑য়ো যথা॒ ভুব॑না॒ন্যপি॑ন্বত। 

অত্রা॑ সমু॒দ্র আ গূ॒ল়্হমা সূর্য॑মজভর্ত্তন॥১০॥

[ঋগ্বেদ ১০। ৭২। ৭] 

অর্থঃ- হে (দেবাঃ) পূর্ণ বিদ্বান্ (যতয়ঃ) সন্ন্যাসীগণ! তোমরা (যথা) যেরূপ (অত্র) এই (সমুদ্রে) আকাশে (গূল়্হম্) গুপ্ত (আ সূর্যম্) স্বয়ং প্রকাশস্বরূপ সূর্যাদির প্রকাশক যে পরমাত্মা বিদ্যমান, তাঁকে (আ অজভর্তন) চতুর্দিক থেকে স্বীয় আত্মায় ধারণ করো ও আনন্দিত হও, সেরূপ (য়ৎ) যে (ভুবনানি) সব ভুবনস্থ গৃহস্থাদি মনুষ্য আছে, তাদেরকে সর্বদা (অপিন্বত) বিদ্যা ও উপদেশ দান করতে থাকো, এটাই তোমাদের পরম ধর্ম। ॥১০॥ 


ভ॒দ্রমি॒চ্ছন্ত॒ ঋষ॑য়ঃ স্ব॒র্বিদ॒স্তপো॑ দী॒ক্ষামু॑প॒নিষে॑দু॒রগ্রে॑। 

ততো॑ রা॒ষ্ট্রং বল॒মোজ॑শ্চ জা॒তং তদ॑স্মৈ দে॒বা উ॑প॒সংন॑মন্তু॥১১॥

[অথর্ববেদ ১৯। ৪১। ০১] 

অর্থঃ- হে বিদ্বানগণ! যারা (ঋষয়ঃ) বেদার্থবিদ্যা প্রাপ্ত, (স্বর্বিদঃ) সুখ প্রাপ্ত, (অগ্রে) প্রথম (তপঃ) ব্রহ্মচর্য্যরূপ আশ্রমকে সম্পূর্ণ সেবন তথা যথাবিধি স্থিরতাপূর্বক প্রাপ্ত হয়ে (ভদ্রম্) কল্যাণ (ইচ্ছন্তঃ) কামনা করে, (দীক্ষাম্) সন্ন্যাসের দীক্ষাকে (উপনিষেদুঃ) ব্রহ্মচর্য দ্বারাই প্রাপ্ত হন, তাঁদেরকে (দেবাঃ) বিদ্বানেরা (উপসংনমন্তু) যথাবিধি সম্মান করুন। (ততঃ) তারপর (রাষ্ট্রম্) রাজ্য (বলম্) বল (চ) ও (ওজঃ) পরাক্রম (জাতম্) উৎপন্ন হোক, (তৎ) তা দ্বারা (অস্মৈ) এই সন্ন্যাসাশ্রম পালনের জন্য যত্ন করতে থাকুন। ॥১১॥

যে দেহধারী সে কখনও সুখ-দুঃখপ্রাপ্তি হতে পৃথক থাকতে পারে না। যখন অশরীরী জীবাত্মা শুদ্ধ হয়ে মুক্তি অবস্থায় সর্বত্রব্যাপক পরমেশ্বরের সহিত অবস্থান করে, তখন তার সাংসারিক সুখদুঃখ থাকে না। এজন্য-

পুত্রৈষণায়াশ্চ বিত্তৈষণায়াশ্চ লোকৈষণায়াশ্চ ব্যুত্থায়াথ ভিক্ষাচর্যং চরন্তি৷৷ শত০ কা০ ১৪ [ ১৪.৬.৪.১]॥ 

পুত্রাদির মােহ; লাভ, ঐশ্বৰ্যজনিত ভােগ-সম্মান; লােকপ্রতিষ্ঠা থেকে পৃথক হয়ে সন্ন্যাসীরা ভিক্ষুক হয়ে দিবারাত্র মােক্ষসাধনে তৎপর থাকেন।


প্রাজাপত্যাং নিরূপ্যেষ্টিং তস্যাং সর্ববেদসং হুত্বা ব্রাহ্মণঃ প্ৰব্ৰজেৎ॥১॥ যজুর্বেদব্রাহ্মণে, [ ন্যা০ বা০ ভা০ ৪.১.৬১]

প্রাজাপত্যং নিরুপ্যেষ্টিং সর্ববেদসদক্ষিণাম্ ।

আত্মন্যগ্নীন্সমারোপ্য ব্রাহ্মণঃ প্রব্রজেদ্গৃহাৎ ॥২॥

যো দত্ত্বা সর্বভূতেভ্যঃ প্রব্রজত্যভয়ং গৃহাৎ ।

তস্য তেজোময়া লোকা ভবন্তি ব্রহ্মবাদিনঃ ॥৩॥ মনু০ ৬ [৩৮,৩৯]

প্রজাপতি অর্থাৎ পরমেশ্বর প্রাপ্তির জন্য ইষ্টি অর্থাৎ যজ্ঞ করে তাতে যজ্ঞােপবীত শিখাদি চিহ্ন ত্যাগ করে, আহবনীয়াদি পাঁচ অগ্নিকে প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান এবং সমান এই পঞ্চপ্রাণে আরােপণ করে ব্ৰহ্মবিৎ ব্রাহ্মণ গৃহ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে সন্ন্যাসী হবে৷৷১-২৷৷

যিনি সর্বভূত=প্রাণিমাত্রকে অভয়দান করে গৃহ থেকে বহির্গত হয়ে সন্নাসী হন সেই ব্রহ্মবাদী অর্থাৎ পরমেশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত বেদোক্ত ধর্মাদি বিদ্যার উপদেষ্টা সন্ন্যাসী প্রকাশময় অর্থাৎ মুক্তির আনন্দস্বরূপ লােক প্রাপ্ত হন ৷৷৩৷৷


প্রশ্ন - সন্ন্যাসীদের ধর্ম কী?

উত্তর - পক্ষপাত রহিত ন্যায়াচরণ, সত্যগ্রহণ, অসত্য বৰ্জন, ঈশ্বরের বেদোক্ত আজ্ঞা পালন, পরােপকার, সত্যভাষণাদি লক্ষণ সকল আশ্রমবাসীরই অর্থাৎ মানবমাত্রেরই একই রকম। তবে সন্ন্যাসীর বিশেষ ধর্ম হলো - মনু০ ৬ [৪৬, ৪৮-৪৯, ৫২, ৬০, ৬৬, ৬৭, ৭০-৭৩, ৭৫, ৮০,৯১, ৯২,৮১]

পথে গমনকালে সন্ন্যাসী ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত না করে নিম্নে ভূমির প্রতি দৃষ্টি রাখবে, সর্বদা বস্ত্রদ্বারা ছেঁকে জল পান করবে, নিরন্তর সত্য কথাই বলবে এবং সর্বদা মনে মনে বিচার করে সত্য গ্রহণ ও অসত্য বৰ্জন করবে ॥১॥

কোন স্থানে উপদেশ অথবা কথােপকথন কালে কেউ সন্ন্যাসীর প্রতি ক্রুদ্ধ হলে অথবা তার নিন্দা করলে, তৎপ্রতি ক্রোধ প্রকাশ না করে তার কল্যাণার্থ উপদেশ প্রদান করা সন্ন্যাসীর কর্তব্য। মুখের এক, নাসিকার দুই, চক্ষুর দুই এবং কর্ণের দুই রন্ধ্রে বিকীর্ণ বাণীকে কোন কারণে মিথ্যা কখনও বলবে না ॥২॥

স্বীয় আত্মা এবং পরমাত্মাতে স্থির নিরপেক্ষ থেকে মদ্য-মাংসাদি বর্জনপূর্বক আত্মারই সাহায্যে সুখার্থী হয়ে এই সংসারে ধর্মোন্নতি ও বিদ্যোন্নতিজনক উপদেশাৰ্থ সর্বদা পৰ্যটন করতে থাকবে ৷৷৩৷৷

কেশ, নখ, দাঁড়ি ও গোঁফ কাটবে; সুন্দর পাত্র,দণ্ড ধারণ ও কুসুম্ভ প্রভৃতি দ্বারা রঞ্জিত বস্ত্র পরিধানপূর্বক নিশ্চিতাত্মা হয়ে ও কোন প্রাণীকে কষ্ট না দিয়ে সর্বত্র বিচরণ করবে ॥৪॥

ইন্দ্রিয়সমূহকে অধর্মাচরণ হতে নিবৃত্ত করে রাগদ্বেষ পরিত্যাগপূর্বক সকল প্রাণীর প্রতি নির্বৈর থেকে মােক্ষের জন্য সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে থাকবে ৷৷৫৷৷

কেউ সংসারে নিন্দা বা স্তুতি করলে সন্ন্যাসী সকল আশ্রমস্থ মনুষ্য ও সকল প্রাণীর প্রতি পক্ষপাতশূন্য হয়ে স্বয়ং ধর্মাত্মা থাকবে এবং অপরকে ধর্মাত্মা করতে চেষ্টা করবে । মনে মনে নিশ্চিতভাবে জানবে যে শুধুমাত্র দণ্ড, কমণ্ডলু এবং গেরুয়া বস্ত্র প্রভৃতি চিহ্নধারণ ধর্মের কারণ নয়। মানুষকে সত্যোপদেশ ও বিদ্যাদান দ্বারা তাদের উন্নতি করাই সন্ন্যাসীর প্রধান কর্তব্য ৷৷৬৷৷

যদিো নির্মলী বৃক্ষের ফল পেষণ করে অপরিষ্কৃত জলে নিক্ষেপ করলে জল পরিষ্কৃত হয় কিন্তু নিক্ষেপ না করে তার নাম মাত্র উচ্চারণ বা শ্রবণ দ্বারা জল পরিষ্কৃত হতে পারে না ॥৭॥

 অতএব ব্রাহ্মণ অর্থাৎ ব্রহ্মবিৎ সন্ন্যাসীর কর্তব্য এই যে, তিনি ওঙ্কার সহিত সপ্তব্যাহৃতি দ্বারা বিধিপূর্বক যথাশক্তি প্রাণায়াম করবেন। কিন্তু কখনো তিনটির কম প্রাণায়াম করা উচিত নয়। এটিই সন্ন্যাসীর পরম তপস্যা ৷৷৮৷৷

যেমন অগ্নিতে ধাতুদের উত্তপ্ত অথবা দ্রবীভূত করলে তাদের মল নষ্ট হয়ে যায় তেমন প্রাণের নিগ্রহ দ্বারা মন প্রভৃতি ইন্দ্রিয় সমূহের দোষ ভস্মীভূত হয় ॥৯॥

অতএব সন্ন্যাসীগণ প্রতিদিন প্রাণায়াম দ্বারা আত্মা - অন্তকরণ ও ইন্দ্রিয় সমূহের দোষ, ধারণার দ্বারা পাপ, প্রত্যাহার দ্বারা সঙ্গদোষ এবং ধ্যান দ্বারা অনীশ্বর গুণ অর্থাৎ জীবের হর্ষ, শােক এবং অবিদ্যাদি দোষ ভস্মীভূত করবেন ॥১০৷৷

এই ধ্যানযােগ দ্বারা অযােগী, অবিদ্বানদের পক্ষে দুর্জেয়, ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল পদার্থে পরমাত্মার যে ব্যপ্তি এবং নিজ আত্মা অন্তর্যামী পরমাত্মার যে গতি তা দর্শন করবেন ৷৷১১৷৷

পূর্বোক্ত সন্ন্যাসীই প্রাণীদের প্রতি নির্বৈর ভাব, ইন্দ্রিয় বিষয় বর্জন, বেদোক্ত কর্ম এবং অত্যুগ্র তপশ্চর্যা দ্বারা সংসারে মােক্ষপদ লাভ করতে ও করাতে পারেন, অন্য কেউ পারে না ৷৷১২॥

যখন সন্ন্যাসী সকল ভাবে অর্থাৎ সকল পদার্থে নিস্পৃহ= নিরাকাঙ্খী এবং আভ্যন্তরিক ও বাহ্য আচরণে পবিত্র থাকেন তখনই তিনি এই দেহে ও মরণান্তে নিরন্তর সুখ প্রাপ্ত হন ৷৷১৩॥

এজন্য ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাসী যত্ন সহকারে দশ লক্ষণান্বিত ধর্ম পালন করবেন ৷৷১৪॥

দশ লক্ষণ বিশিষ্ট পক্ষপাত রহিত ন্যায়াচরণরূপ ধর্ম পালন চার আশ্রমবাসীরই কর্তব্য। এই বেদোক্ত ধর্মানুসারে স্বয়ং চলা এবং অপরকেও বুঝিয়ে চালিত করা সন্ন্যাসীদের বিশেষ ধর্ম ॥১৫॥

সন্ন্যাসী এভাবে ধীরে ধীরে সমস্ত সঙ্গদোষ পরিত্যাগ করে এবং হর্ষ-শােকাদি দ্বন্দ্ববিমুক্ত হয়ে ব্রহ্মেই অবস্থিত হন। গৃহস্থ প্রভৃতি সকল আশ্ৰমীকে সর্বপ্রকার ব্যবহার সম্বন্ধে সত্য নিশ্চয় করা এবং অধর্মাচরণ হতে নিবৃত্ত ও সকল সংশয় ছিন্ন করে সত্য ধর্মাচরণে প্রবৃত্ত করা সন্ন্যাসীদের প্রধান কর্তব্য ৷৷১৬॥

প্রশ্ন- গৃহস্থও তাে অধ্যাপন ও উপদেশ প্রদান করে থাকে, তবে সন্ন্যাসীর কী প্রয়ােজন ?

উত্তর- সকল আশ্রমবাসীই সত্যোপদেশ দান করবে এবং শুনবে। কিন্তু সন্ন্যাসীর যতঅবকাশ এবং পক্ষপাতশূন্যতা থাকে গৃহস্থের তত থাকে না। অবশ্য যাঁরা ব্রাহ্মণ তাঁদের মধ্যে পুরুষরা পুরুষদের এবং স্ত্রীরা স্ত্রীদের সত্যোপদেশ ও বিদ্যাদান করবে। সন্ন্যাসী ভ্রমণের অবকাশ যত পায় তত অবকাশ গৃহস্থ ব্রাহ্মণ কখনো পায় না। ব্রাহ্মণ বেদবিরুদ্ধ আচরণ করলে সন্ন্যাসী তাকে নিয়ন্ত্রিত করে। অতএব সন্ন্যাসী হওয়া উচিত।


প্রশ্ন- সন্ন্যাসী ছাড়া অন্য সাধু, বৈরাগী, গোঁসাই, খাখী প্রভৃতি সন্ন্যাস আশ্রমে পরিগণিত হবে কিনা?

উত্তর- না, কারণ তাদের মধ্যে সন্ন্যাসের একটি লক্ষণও নেই। তারা বেদবিরুদ্ধ পথে চলে আর বেদ থেকে নিজেদের সম্প্রদায়ের আচার্যদের বাক্যকেই বেশী মানে এবং তারা নিজ নিজ মতেরই প্রশংসা করে। মিথ্যা প্রপঞ্চে আবদ্ধ হয়ে স্বার্থের জন্য অপরকেও স্ব স্ব মতে আবদ্ধ করে। সংশোধনের কথা তো দূরে থাকুক, তার পরিবর্তে তারা সংসারকে বিভ্রান্ত করে অধোগতি লাভ করায় ও স্বীয় প্রয়োজন সিদ্ধ করে। একারণে এদের সন্ন্যাসাশ্রমে গণ্য করা যেতে পারে না। কিন্তু এরা যে পুরোদস্তুর স্বার্থাশ্রয়ী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এজন্য বিদ্যাভ্যাস, সুশিক্ষা গ্রহণ এবং বলবান হওয়ার জন্য ব্রহ্মচর্যাশ্রম; সর্ববিধ সদানুষ্ঠানের জন্য গৃহস্থাশ্রম; বিচার, ধ্যান ও জ্ঞান বৃদ্ধি এবং তপশ্চরণের জন্য বানপ্রস্থাশ্রম এবং বেদাদি সত্যাশাস্ত্রের প্রচার, ধর্মাচরণ গ্রহণ ও দুষ্ট ব্যবহার বর্জন, সত্যোপদেশ প্রদান ও সকলের সংশয় দূরীকরণ ইত্যাদির জন্য সন্ন্যাসাশ্রম। কিন্তু যাঁরা সন্ন্যাস আশ্রমের মুখ্য কর্ম সত্যেপদেশ দান প্রভৃতি করেন না, তারা পতিত ও নরকগামী হন। তাই সত্যোপদেশ দান, সংশয় নিরাকরণ, বেদাদি সত্যশাস্ত্রের অধ্যাপন এবং যত্নপূর্বক বেদ্যোক্ত ধর্মপ্রচার দ্বারা জগতের উন্নতি সাধন করা সন্ন্যাসীর কর্তব্য।

হে সন্ন্যাসী, আপনি স্বয়ং ধর্মপথে চলুন ও সমস্ত সংসারকে চালিত করুন যাতে আপনি নিজে এবং সর্ব জগৎ ইহলোক অর্থাৎ বর্তমান জন্মে এবং পরলোকে অর্থাৎ পরজন্মে স্বর্গ অর্থাৎ সুখভোগ করুন।

  • সন্দর্ভ: 

১। সংস্কারবিধি - ভগবৎপাদ মহর্ষি শ্রীমৎ দয়ানন্দ সরস্বতী 

২। সত্যার্থ প্রকাশ - ভগবৎপাদ মহর্ষি শ্রীমৎ দয়ানন্দ সরস্বতী 

 

© বাংলাদেশ অগ্নিবীর

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)