দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







ত্রৈতবাদ নিয়ে মূর্খের আস্ফালন নিবারণ

সত্যান্বেষী
0

মহর্ষি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীজীর জ্ঞানের ওপর প্রশ্ন তোলার দুঃসাহস কিছু অবোধ শিশুগণ করছেন । তাদের ন্যূন জ্ঞান দ্বারা তারা বিবিধ অপ্রামাণিক ও সাম্প্রদায়িক পুস্তক দ্বারা এহেন সিদ্ধান্ত প্রচার করে আত্মতুষ্টিতে ভোগে । আমরা প্রতিবারই তাদের সমুচিত খণ্ডন করে থাকি কিন্তু তৎপশ্চাতও তারা একই বুলি আওড়ে যান এবং নতুন নতুন অপপ্রচার তৈরী করেন । অবশ্য অপপ্রচার করাটাই অতীব স্বাভাবিক কারণ শাস্ত্রে অনধিকারী ও মূর্খদের যতই যুক্তি প্রমাণ দেওয়া হোক না কেন তারা তা বুঝতে অক্ষম । তবে এদের মূর্খ না বলে অসম্পূর্ণ পাঠক কিংবা স্বল্প পড়ুয়া জ্ঞানপাপী বলাই শ্রেয় ।
ত্রৈতবাদ হচ্ছে একটি বেদভিত্তিক দর্শন । এটা কোনো কপলোকল্পিত দর্শন নয় , সম্পূর্ণ বেদাদি শাস্ত্রের আঁধারেই প্রতিষ্ঠিত । ত্রৈতবাদ বাস্তবিকতা , বুদ্ধিগ্রাহ্যতা , সত্য , সম্ভাব্যতা এবং বৈজ্ঞানিক যথার্থ আধারের উপর প্রতিষ্ঠিত । এই দর্শন অনুসারে , পরমাত্মা , জীবাত্মা এবং প্রকৃতি– এই তিনটি সত্তা অনাদি , নিত্য ও পৃথক ৷ এদের মধ্যে পরমাত্মা এই সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ , প্রকৃতি উপাদান কারণ এবং জীবাত্মা সাধারণ কারণ ৷ এই দর্শন অনুসারে , পরমাত্মা এক , অদ্বিতীয় , চেতন , সর্বজ্ঞ , সর্বব্যাপী , আনন্দময় , একরস , বিকারশূন্য । অপরদিকে জীবাত্মা বহু , চেতন , একদেশী , অল্পজ্ঞ । আর প্রকৃতি অচেতন , সর্বব্যাপী নয় । 
 
✅ ব্রহ্ম , জীবাত্মা এবং প্রকৃতি—এই তিন সত্তাই অজন্মা বা অনাদি , এটিই বেদের সিদ্ধান্ত । জীবাত্মা ও ব্রহ্মে কিছু ভেদ পরিলক্ষিত হয় । যথাঃ 
 
(১) ঈশ্বর জ্ঞানস্বরূপ তথা সর্বজ্ঞ , কোন কিছুই তাঁর নিকট অজ্ঞাত নয় । কিন্তু ব্রহ্ম সন্নিধানে জীবাত্মা অল্পজ্ঞ । [ ঋ০ ৮।১০১।১৪, ১০।৭১।৩ ; যজু০ ৩২।১০ ]
(২) ঈশ্বর অনন্ত সামর্থ্যবান তথা সকলের স্বামী , কিন্তু জীবাত্মা অনীশ (অন্ + ঈশ) বা অসমর্থ । [ ঋগ্বেদ: ১০।৯০।২ ঋগ্: ১০।৮২।৩, ৬।৯।৩; ঋগ্বেদ: ১।১৬৪।৬ , ১০।৭৯।৬ ]
(৩) ঈশ্বর সর্বদ্রষ্টা , সর্বব্যাপী , কিন্তু জীব তার জড় শরীরের বন্ধনে আবদ্ধ । [ ঋ০ ৮।২৪।২১; অথর্ব০ ১০।৮।২৪ ; যজু০ ৪০।৮, ১৭।৭১ ]
(৪) ঈশ্বর সর্বভূতের অন্তরাত্মা , সর্বান্তর্যামী , কিন্তু জীব কেবল একটি নির্দিষ্ট শরীরের আত্মা । [ ঋ০১।৮৯।৫, ৮।৬৪।৩, ১০।৮৯।১০, ১।৩২।১৫ ]
(৫) ঈশ্বর অনন্ত ঐশ্বর্য্যবান , আপ্তকাম [নিত্যতৃপ্ত] কিন্তু জীব অল্প ঐশ্বর্য্যবান , অনাপ্তকাম [অতৃপ্ত ] । [ ঋ০ ১০।৮২।৭ ,অথর্ব:২।৩৬।৩ যজুর্বেদ:৩৮।২০ ]
(৬) ঈশ্বর ❝অনীড়❞ নামে খ্যাত শ্বেতা০ ৫.১৪ । ❝নীড়❞ শব্দের অর্থ গৃহ , বাসস্থান , দেহ , আশ্রয় । ঈশ্বর সর্বঘটে বিরাজমান হওয়ায় , তাঁর কোন গৃহ বা বাসস্থানের প্রয়োজন নাই । তিনি- যজুর্বেদ৪০.৮ ❝অকায়ম্❞ অর্থাৎ তিনি কদাপি সূক্ষ্ম , স্থূল , কারণ দেহধারণ করেন না । কিন্তু জীব দেহধারণ করে ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয় । [ কঠ০ ১।২।১৮ , গীতা০ ২।২৭ , ছান্দোগ্য০ ৬।১১।৩ , মুণ্ডক০ ৩।১।৯ , শ্বেতাশ্বতর০৫।৯ , ন্যায়০৩।১।১-৭,১২) ]
(৭) যেরূপ জীব প্রকৃতির ফল ভোগের দ্বারা বন্ধনে আবদ্ধ হন , সেরূপ কার্য কারণাত্মক জগতে পরিব্যাপ্ত পরমাত্মা , এই প্রকৃতির ফল ভোগ করেন না এবং এর বন্ধনেও লিপ্ত হন না । [ যর্জুবেদ০ ২৩।৫৬, অর্থববেদ০ ১০।৮।৩০,ঋ০ ১।১৬৪।৪৪ , শ্বেতা০ ৪।৫ , ]
(৮) আর প্রকৃতি তো সর্বদা জড় , অচেতন , অসমর্থ এবং জীবের ভোগ্য সম্পাদনে নিযুক্তা । ভোক্তা জীবের ভোগের সামগ্রীযুক্ত ❝প্রকৃতি❞ –যা কারো দ্বারা কখনো উৎপন্ন না হওয়ার কারণে , অনাদি । [ গীতা০ ১৩।২০ , অথর্ববেদ০ ৯।১৪।২০ , সাংখ্যদর্শন০ ১।৬১ ,ঋ০ ৬।৪৭।১৮ ,শ্বেতা০ ৪।১০ ]
 
1️⃣▶️ আক্ষেপ: ত্রৈতবাদ হচ্ছে একটি দার্শনিক মতবাদ। যে মতবাদ দয়ানন্দ কর্তৃক প্রচারিত। এই দর্শনের মূল কথা গুলো হলো, ব্রহ্ম(ঈশ্বর, পরমাত্মা); জীবাত্মা; জগৎ তিনটা সত্ত্বাই অনাদি। এই তিন সত্ত্বাই স্বাধীন। কেও কারো অধীন নয়। কেও কারো অংশ নয়, তিনটা সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্ত্বা। 
 
💢✅ প্রত্যুত্তরঃ প্রথম ত্রৈতবাদ হচ্ছে একটি বেদভিত্তিক দার্শন । যদিওবা তাদের কপোলকল্পিত মতবাদের পিছনে কোনো শাস্ত্রীয় প্রমাণ নেই কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেই । ❝কেও কারো অধীন নয়❞ নূন্যতম ত্রৈত বোঝার মত মস্তিষ্ক এদের নেই । এদের মস্তিষ্ক বিদ্বেষ ও কূটকাচালিতে পরিপূর্ণ । প্রথমত এরা কেউ মূলগ্রন্থ পড়েনা । ঘুঁটে কুড়ানির মতো এখান ওখান থেকে বিক্ষিপ্ত রসদ যোগাড় করে জনসম্মুখে নিজের প্রতিভা প্রদর্শনের নামে অর্বাচীনত্ব প্রদর্শন করতে অধিক পছন্দ করে । ❝মক্ষিকা ব্রণমিচ্ছন্তি❞ - মক্ষিকা যেমন কেবল মানবদেহের ক্ষতই খুঁজে বেড়ায় , তেমনি এই জ্ঞানপাপী ঠগবাজরাও কেবল নিজেদের মস্তিষ্কপ্রসূত বিকৃত তথ্যই খুঁজে বেড়ায় । ত্রৈত সিদ্ধান্তে জীব তার কর্মে স্বতন্ত্র কিন্তু ঈশ্বরীয় ব্যবস্থায় পরতন্ত্র । এই সম্পর্কে মহর্ষি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতীর তাঁর সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে বলেছেন - জীব নিজ কর্তব্য কর্মে স্বতন্ত্র কিন্তু ঈশ্বরের ব্যবস্থায় পরতন্ত্র । ❝স্বতন্ত্রঃ কর্তা❞ এটা পাণিনীয় ব্যাকরণের সূত্র । যিনি স্বতন্ত্র অর্থাৎ স্বাধীন তিনিই কর্তা । কোন হত্যাকারী কোন শস্ত্র বিশেষ দ্বারা কাউকে হত্যা করে ধরা পড়লে হত্যাকারী দণ্ডভোগ করে , শস্ত্র দণ্ডভোগ করেনা , সেইরূপ পরাধীন জীব পাপপুণ্যেরও ভাগী হবে না । অতএব জীব নিজ সামর্থ্য অনুসারে কর্ম করতে স্বতন্ত্র , কিন্তু কোন পাপকর্ম করলে সে ঈশ্বরের ব্যবস্থানুসারে পরতন্ত্র হয়ে পাপের ফল ভোগ করে । সুতরাং কর্ম বিষয়ে জীব স্বতন্ত্র , কিন্তু পাপের দুঃখরূপ ফলভোগ বিষয়ে সে পরতন্ত্র । অংশ নিয়ে আক্ষেপ সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত বিরূদ্ধ । কেননা স্পষ্টতঃভাবে যজুর্বেদ ৪০.৮ বলা হয়েছে ❝অব্রণম❞ তিনি এক অখণ্ড সত্তা , অচ্ছেদ্য , অভেদ্য , নিষ্কম্প ও অচল । এজন্য তার মধ্যে কনো অংশ-অংশী ভাব নেই , কেননা তার মধ্যে কোন প্রকার ছিদ্র থাকতে পারে না । পরমাত্মাকে ❝অব্রণম❞ বলার অর্থ হচ্ছে , তিনি অচ্ছেদ্য অর্থাৎ যাঁকে ছেদন করা যায় না । যে-কোনো বিশাল বস্তুকে আমরা ছেদন করতে পারি , ভেঙে চুরমার করতে পারি , দ্বিখণ্ডিত করতে পারি । কিন্তু পরমাত্মা হলেন ❝অব্রণম❞ অর্থাৎ ছেদনযোগ্য নয় । পরমাত্মাকে খণ্ড-খণ্ড করা যায় না । অখণ্ড পরমাত্মার কোনো অংশ নেই । পরমাত্মা হলেন অংশী , জীবাত্মা তাঁর অংশ- এই ধারণাকেও এখানে নিষেধ করে বলা হয়েছে , কখনোই পরমাত্মার ভেদন বা ছেদন হয় না, তাঁর মধ্যে কোনো ব্যাবধান থাকে না , ছিদ্র থাকে না। এজন্যই তাঁকে ❝অব্রণম❞ বলা হয়েছে । মূলত পদার্থের বিকৃতি , প্রতিস্থাপন , সংযোজন-বিয়োজন ঘটে কিন্তু জ্ঞানস্বরূপ চেতন সত্তা সর্বব্যাপী পরমাত্মার কোনো সংযোজন , বিয়োজন , খণ্ডায়ন , অংশায়ন , বিকৃতি , ছেদ , প্রতিস্থাপন ঘটে না । অতঃ ঈশ্বরের অংশ মানা সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় বিরুদ্ধ এবং কল্পনাপ্রসূত ।
 
🚫 একটা বিষয় ক্লিয়ার করা আবশ্যক -
 

  • ১। ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ ও বেদানুকূল গ্রন্থ-বচনসমূক পরতঃ প্রমাণ বিরোধ দর্শনে বেদ সর্বাগ্রে সর্বোচ্চ সর্বমান্য ।
    ২। সনাতন ধর্মের প্রতিটি শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত পূর্বোক্ত সূত্র [ ১ ] অনুযায়ী নির্ণীত হবে । শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত যেখানে স্পষ্ট সেখানে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা কপোলকল্পিত মতামত কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় ।
    ৩। শাস্ত্র বিরুদ্ধ কর্ম যেই করুক না কেন তা তামসিক , নিষিদ্ধ ও গর্হিত বলে বিবেচিত হবে ।
    ৪। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মতামত সবার থাকা অতীব স্বাভাবিক‌ । কিন্তু ধর্মীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে শাস্ত্রবিরুদ্ধ কোন মতামত গ্রহণীয় নয় ৷

2️⃣▶️ আক্ষেপ: ত্রৈতবাদে জীবাত্মা, জগৎ ও ব্রহ্ম ভিন্ন সত্ত্বা। স্বাধীন সত্ত্বা। কেও কারো অধীন না, কেও কারো অংশ না। এবার জীবাত্মার সাপেক্ষে ব্রহ্ম ও জগৎ আলাদা সত্ত্বা। ব্রহ্মের সাপেক্ষে জীবাত্মা ও জগৎ আলাদা সত্ত্বা। আবার জগতের সাপেক্ষে ব্রহ্ম ও জীবাত্মা আলাদা সত্ত্বা।
এবার ব্রহ্ম যেহেতু জীবাত্মা ও জগতের বিচারে আলাদা একটা সত্ত্বা এবং যেহেতু জীবাত্মা ও জগৎ তার কোনো অংশ নয়, যেহেতু জীবাত্মা ও জগৎ স্বাধীন, সেহেতু জীবাত্মা আর জগতের উপর ব্রহ্মর কোনো অধিকার নাই। কারণ জগৎ ও জীবাত্মা ঈশ্বর/ব্রহ্ম বহির্ভূত সত্ত্বা। অধিকার তখনই আসবে যখন কোনো কিছু কারো অধীনে হয়। যেহেতু জীবাত্মা ও জগৎ ব্রহ্ম অধীন নয়, ব্রহ্মাংশও নয় সেহেতু জীবাত্মা ও জগতের উপর ব্রহ্মের কোনো অধিকার নাই, অর্থাৎ ব্রহ্ম কখনোই জীবাত্মাকে জগতের সাথে মিশিয়ে জীবকে সুখ দুঃখ দানের অধিকার রাখে না।
এখানে হয়তো কেও বলতে পারে ঈশ্বর ন্যায় বিচারক তাই সে জীবাত্মাকে তার কর্মফল দান করেন।
কিন্তু ঈশ্বরের সেই অধিকারও নাই। কারণ জীবাত্মা স্বাধীন সত্ত্বা। জীবাত্মা ঈশ্বরের অংশ না। সুতরাং জীবাত্মাকে জগতে প্রেরণ করে জীবকে সুখ দুঃখ ভোগ করালে ঈশ্বর অবশ্যই অনধিকার চর্চা করছে বলতে হবে। কারণ জীবাত্মা ও জগৎ তার অংশও না তার অধীনও না, ব্রহ্মের কোনো অধিকার নাই জীবাত্মা ও জগতের উপর হস্তক্ষেপ করার।
তারপরও ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করেই যাচ্ছেন, জীবাত্মাকে জগতের সাথে জড়িয়ে সুখ দুঃখ দিচ্ছেন। এটা ঈশ্বরের অনধিকার চর্চা। এমন অনধিকার চর্চাকারী ঈশ্বর কদাপি ন্যায়কারী হতে পারে না।
ঈশ্বরের এমন করার পিছনে কারণ হিসেবে দুটো বিষয় থাকতে পরে :-
১. ত্রৈতবাদের ঈশ্বর/ব্রহ্মকে এটা করতেই হয়। না করে থাকতে পারেন না। তাহলে বলতে হবে ঈশ্বর, জীবাত্মা ও জগৎ কোনো নিয়মে আবদ্ধ। এখন সেই নিয়মটাকেই সুপ্রিম মূল ঈশ্বর / ব্রহ্ম মানতে হবে। তাহলে পূর্বোক্ত ত্রৈতবাদের ব্রহ্ম / ঈশ্বর মূলত ব্রহ্ম বা ঈশ্বর নন। এই নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। এবং এই নিয়মে আবদ্ধ জীবাত্মা, জগৎ ও পূর্বোক্ত ব্রহ্ম এই নিয়মরূপী ব্রহ্মের অংশ ও অধীন।
২. এই তিনটি সত্ত্বার মধ্যে ঈশ্বর/ ব্রহ্ম সত্ত্বাটি অধিকতর শক্তিমান তাই সে শক্তিমান হওয়ায় বাকি দুই তুলনামূলক দূর্বল সত্ত্বার উপর জুলুম করছেন। দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার আরকি। তো সে হিসেবে ঈশ্বর অন্যায় কারী, অত্যাচারী একটা সত্ত্বা।
 
💢✅ প্রত্যুত্তরঃ পরমেশ্বরে অনন্ত গুণ বিদ্যমান , অতএব গুণের ক্ষেত্রে তিনি সবার থেকে বড় । প্রকৃতিতে বিকার আসে , জীবও বদ্ধ-মুক্ত দশা লাভ করে , কিন্তু পরমেশ্বর সদা নির্বিকার- একরসে থাকেন । জীবের শরীর এবং প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনশীল । রূপান্তরের কারণে তারা নিত্য নতুন অবস্থায় আসার কারণে তারা পরমেশ্বর থেকে ছোট । প্রকৃতি সর্বদা অজ্ঞ , কিন্তু পরমেশ্বর সর্বজ্ঞ । জীব প্রকৃতির ন্যায় অজ্ঞ নয় , আর না পরমেশ্বরের ন্যায় সর্বজ্ঞ , বরং অল্পজ্ঞ । অতঃ মধ্যবর্তী হওয়ার কারণে জীব মধ্যমস্থানীয় । প্রকৃতি জড় , অজ্ঞ এবং চেতনের অধীনস্থ ভোগ্য-রূপ হওয়ার কারণে সবার থেকে ছোট । ঈশ্বর ন্যায়কারী , তিনি সর্বজীবের কর্মফল ন্যায়পূর্বক দিয়ে থাকেন , এটা আর্ষ ত্রৈতবাদের সিদ্ধান্ত । কিন্তু ভ্রান্তবাদী মহাশয় পূর্ব কথার অনুরূপে বলছেন , জীব কর্মে স্বাধীন হওয়ায় ও সত্ত্বায় সতন্ত্র হওয়ায় ঈশ্বর নাকি জীবের ন্যায়বিচারও করার অধিকার রাখেন না । প্রজা বলছেন , হে রাজা আমি মানুষ হিসেবে স্বাধীন , আমি তোমা হতে উৎপন্ন হইনি । তাই তুমি আমার ন্যায়বিচার করতে পারো না । হে রাজন তুমি আমার বিচার করে , অনধিকার চর্চা করছো । কিন্তু মজার বিষয় কোনো অতি মূর্খ প্রজাও এমন করবেন না । বেদান্তিগণের দৃষ্টি অন্ধ পুরুষের ন্যায় অন্বয়ের দিকে পড়ে ব্যতিরেক ভাব হতে পৃথক হয়ে বিরুদ্ধ হয়েছে । মূর্খগণ স্বভাব ও গুণ কি তা সম্পর্কে অবগত নয় । তাদের আক্ষেপ ত্রৈতবাদে ঈশ্বর নিয়মে আবদ্ধ । পরন্তঃ তা নিতান্তই ভ্রান্ত । ন্যায় করা ঈশ্বরের একটি গুণ । স্বভাবের কার্য , নিয়মের হেতু অথবা কর্তব্যবশতঃ সম্পাদন হয় না । অগ্নি হতে সর্বদাই তাপ নির্গত হবে , এটাই তার গুণ/স্বভাব , এর জন্য কর্তব্যবোধের প্রয়োজন হতো না । ন্যায় করা ঈশ্বরের গুণ-স্বভাব । ন্যায়ের জন্য তিনি কারোর উপর বাধিত নন । ব্রহ্ম সর্বশক্তিমান এ কথা সর্বমান্য । কিন্তু সর্বশক্তিমান হলেই যে অত্যাচারী হতে হবে এর কোনো ভিত্তিই নেই । ব্রহ্মের ক্ষেত্রে এমনটা কখনোই হতে পারে না । কারণ ব্রহ্ম সর্বশক্তিমানের পাশাপাশি ন্যায়কারীও বটে । পাঠকগণের নিকট প্রশ্ন , আচার্য শিষ্যের শাসন করলে তা জুলুম করা হয় ? ন্যায়কারী পরমেশ্বর জীবের কর্মফল জীবকে দিলে সেটাকে জুলুম বলা যায় ? আর এখানে একটা কথা প্রকৃতি তো অচেতন , তবে তার উপর জুলুমই বা কীভাবে হতে পারে ?
 
পরমাত্মা সর্বজ্ঞানী , তিনি তার শিষ্যস্বরূপ জীবাত্মার ভোগের জন্য এই জগতকে সৃষ্টি করেন । এটা কী জীবাত্মার উপর জুলুম করা ? কদাপি নয় । পরমাত্মা এই জগতের সৃষ্টি করেন জীবাত্মার হিতের জন্য । জীবাত্মার ভোগের জন্য । জীবাত্মাকে অহেতুক শাস্তি দেওয়া ঈশ্বরের কর্ম নয় । শিক্ষক যেমন ছাত্রের হিতের জন্য তিরষ্কার করেন , তেমনি ঈশ্বর আমাদের হিতের জন্য আমাদের কর্মফল প্রদান করেন । আমরা এই ফল হতেই শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতে শুভ কর্ম করি । তারা জীবাত্মাকে পরমাত্মার অংশ ভাবে এবং মনে করে জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ পরমাত্মা থেকে জীবাত্মার সৃষ্টি হয়েছে এটা যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত সেটা সুধী ও স্বাধ্যায় পাঠক মাত্রেই অবগত ।
 
❝সূর্য়াচন্দ্রমসৌ ধাতা যথাপূর্বমকল্পয়ৎ ❞ঋ০ ১০।১৯০।৩ প্রবাহ দ্বারা অনাদি এ সৃষ্টির রচনা প্রত্যেক কল্পেই পূর্ববৎ সংঘটিত হয় । এই ক্রম অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকে । ❝ন হি প্রয়োজনমনভিসন্ধায় প্রেক্ষাবন্ত প্রবর্তন্তে❞ - বিনা প্রয়োজনে প্রবৃত্তি হয় না । প্রয়োজনের লক্ষণ হলো ❝য়মর্থমধিকৃত্য প্রবর্ততে তৎপ্রয়োজনম্❞ অর্থাৎ , যেই অর্থকে লক্ষ্য করে কেউ প্রবৃত্ত হয় , সেই অর্থকে প্রয়োজন বলা হয় । একইভাবে , পরমেশ্বর কর্তৃক বার-বার সৃষ্টি রচনার পেছনেও কোনো না কোনো প্রয়োজন অবশ্যই আছে । সেই প্রয়োজন ❝ভোগাপবর্গার্থং দৃশ্যম্ ❞ যোগ০ ২।১৮ এই সূত্রে স্পষ্ট করা হয়েছে । ভোগ ও অপবর্গের এই নির্দেশ ❝অকাম' ও 'নিত্যমুক্ত ❞ পরমেশ্বরের জন্য হতে পারে না । এতে স্পষ্ট হয় যে , জীবের উদ্দেশ্যেই বার-বার সৃষ্টির রচনা করা হয় । [ গীতা ২.১৭-২৮] পড়লেই স্পষ্টতঃভাবে প্রমাণিত যে ❝হন্তা চেন্মন্যতে হস্তুং হতশ্চেন্মন্যতে হতম্। উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে। ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥❞-কঠ০১।২।১৮-১৯ অর্থাৎ হত্যাকারী যদি মনে করে সে আত্মাকে হত্যা করবে এবং যে নিহত হবে সে যদি মনে করে আত্মা নিহত হয়েছে , তবে সেই দুজনের কেউই আত্মার স্বরূপ জানে না । কারণ , আত্মা হত্যাও করে না , নিহতও হয় না । এই আত্মার জন্ম-মৃত্যু হয় না ; এই আত্মা কোনো কিছু হওয়ার জন্য হয়নি , কোনো কিছু এর থেকেও হয়নি । এই আত্মা জন্মরহিত, নিত্য , শাশ্বত, পুরাণ বৃহদারণ্যক: ৪।৪।২০ শরীর নিহত হলেও আত্মা নিহত হয় না ।
 
যদি সৃষ্টি প্রবাহ দ্বারা অনাদি হয় , তাহলে জীবাত্মার মুক্তিও প্রবাহ দ্বারা অনাদি বলে স্বীকার করতে হবে । জীবগণের মোক্ষে গমন করে আবর্তনের মাধ্যমেই এটি হওয়া সম্ভব । অনেকে বলতে পারেন- ❝মুক্তি থেকে ফিরে না আসলেও সংসারের উচ্ছেদ ঘটবে না❞ । কারণ আবশ্যকতা-অনুসারে নতুন জীবাত্মাগণের উৎপত্তি হতে থাকবে । কিন্তু তা কখনো হতে পারে না। কারণ তখন জীবাত্মা অনিত্য হয়ে পড়বে । পরমেশ্বর সর্বশক্তিমান হওয়ার অর্থ এই নয় যে তিনি যা চান , তা-ই করতে পারেন । সর্বশক্তিমানের তাৎপর্য এটুকুই যে , পরমেশ্বরকে তাঁর নিজ কার্য সম্পাদনে অন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না । জীবগণের ভোগ ও অপবর্গের ব্যবস্থা করা পরমেশ্বরের কাজ , জীবাত্মাদের সৃষ্টি করা নয় । যদি ❝দুর্জনতোষন্যায়❞ দ্বারাও পরমেশ্বর কর্তৃক জীবগণের উৎপত্তি স্বীকার করা হয় । তাহলে এই জীবগণের অনিত্য হওয়া স্বতসিদ্ধ । কারণ যার উৎপত্তি হয় , তার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী । আর যখন জীবাত্মাই থাকলো না , তাহলে তার মুক্তি নিত্য হবে কীভাবে ? তখন জীবগণের উৎপত্তির কারণ কী হবে ? জীবের না থাকার ফলে কেবল দুটি পদার্থ অবশিষ্ট রয়েছে- ঈশ্বর ও প্রকৃতি । সর্বব্যাপক , সর্বজ্ঞ , সর্বশক্তিমান এবং নিত্যমুক্ত পরমেশ্বর থেকে একদেশী , অল্পজ্ঞ , অল্পশক্তিমান এবং জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে আবদ্ধ জীবের উৎপত্তির কল্পনা কীভাবে করা সম্ভব ? একইভাবে জড় প্রকৃতি থেকে চেতন তত্ত্ব জীবের উৎপত্তিও অসম্ভব । অতএব , অবিনাশী জীবাত্মার উৎপত্তি সম্ভব নয় । মুক্তি থেকে পুনরাবৃত্তিতেই এসব সমস্যার সমাধান নিহিত আছে ।
 
শয়ুঃ পরস্তাদধ নু দ্বিমাতাহবন্ধনশ্চরতি বৎস একঃ । মিত্রস্য তা বরুণস্য ব্রতানি মহদ্দেবানামসুরত্বমেকম্ ॥ ঋ০ ৩।৫৫।৬
এই মন্ত্রে মহত্ত্বপূর্ণ শব্দ হচ্ছে- ❝দ্বিমাতা বৎস একঃ❞ এখানে ❝বৎস❞ পদ জীবের বাচক । ব্রহ্ম ও প্রকৃতি তার দুই মাতা , যারা তাকে ধারণ করে এবং তার পালন-পোষণ করেন । এইপ্রকার এই মন্ত্রেও ঈশ্বর , জীব ও প্রকৃতি- তিন সত্তার কাব্যাত্মক শৈলীতে বর্ণনা রয়েছে ।
 
[ দ্বিমাতৃতয়া পরমাত্মপ্রকৃৎয়োনির্দেশঃ তদ্ভিন্না বৎসো জীব ইতি শ্রতম্। পরমাত্মপক্ষে- ত্বং মাতা শতক্রতো বভূবিথ। ঋ০ ৮।৯৮।১১; গর্ভং মাতা সুধিতম্। ঋ০ ১০। ২৭।১৬; প্রকৃতিপক্ষে- মাতা প্রকৃত্যাখ্যা- সায়ণঃ; মাতা প্রকৃতিঃ ইত্যুদ্গীথঃ। "অন্যা বৎসং ভরতি ক্ষেতি মাতা” (ঋ০ ৩।৫৫।৪) ইতি অস্মিন্ মন্ত্রে অন্যা ব্রহ্মণো ভিন্না প্রকৃতিঃ। 'অন্যা ভিন্না ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিঃ'- দয়ানন্দঃ। ]
 
জ্ঞাজ্ঞৌ দ্বাবজাবীশানীশাবজা হোকা ভোক্তৃভোগ্যার্থযুক্তা । অনন্তশ্চাত্মা বিশ্বরূপো হ্যকর্তা এয়ং য়দা বিন্দতে ব্রহ্মমেতৎ ॥
শ্বেতা০ ১।৯
পদার্থঃ (জ্ঞাজ্ঞেী) সর্বজ্ঞ ব্রহ্ম এবং অল্পজ্ঞ জীব (দ্বৌ) এই দুই (অজৌ) জন্মরহিত বা অনাদি , এদের মধ্যে (ঈশানীশৌ) ব্রহ্ম সামর্থ্যবান এবং জীব অসমর্থ , তৃতীয় (হি) নিশ্চিতরূপে একা) এক (অজা) জন্মরহিত [অনাদি প্রকৃতি] যা (ভোতৃভােগ্যার্থযুক্তা) ভোক্তা জীবের ভোগ্য র্থে যুক্তা অর্থাৎ ভোগ্য সিদ্ধিতে তৎপর (চ) এবং সেই (অনন্তঃ) অনন্ত [অসীম] (আত্মা) রমাত্মা (বিশ্বরূপঃ) বিশ্বরূপ [সমগ্র বিশ্বই যাঁর রূপ] (হি) নিশ্চিতরূপে (অকর্তা) তিনি কর্ম ও র্মফলের বন্ধনে লিপ্ত হন না (য়দা) যখন মানুষ (এয়ম) উক্ত তিন সত্তাকে [ব্রহ্ম, জীব ও কৃতিকে] (বিন্দতে) সম্যক্ জানেন , তখন তিনি (এতৎ) এই (ব্রহ্মম্) ব্রহ্মকে [প্রাপ্ত হন] ।
 
নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানামেকো বহুনাং য়ো বিদধাতি কামান ॥ (কঠ০ ২।২।১৩)
ব্রহ্ম প্রকৃত্যাদি নিত্যপদার্থের মধ্যে নিত্য এবং চেতন জীবগণের মধ্যে চেতনস্বরূপ । তিনি এক এবং এই বিবিধরূপ সৃষ্টির রচনা করেন । এখানে পরমাত্মা থেকে ভিন্ন প্রকৃত্যাদি নিত্যপদার্থ বং ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন চেতন জীবকে স্পষ্টরূপে স্বীকার করা হয়েছে ।
 
ঋতং পিবন্তৌ সুকৃতস্য লোকে গুহাং প্রবিষ্টৌ পরমে পরার্ধে। ছায়াতপৌ ব্রহ্মবিদো বদন্তি পঞ্চান্নয়ো য়ে চ ত্রিণাচিকেতাঃ ॥ (কঠ০ ১।৩।১)
এই শ্রুতিতে জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে ছায়া ও আলোর ন্যায় ভিন্ন-ভিন্ন মানা হয়েছে এবং এই উভয়কেই হৃদয়াকাশে প্রবিষ্ট বলা হয়েছে বেদান্ত-দর্শনের ❝গুহাং প্রবিষ্টাবাত্মানৌ হি তদ্দর্শনাৎ❞ ব্র০ সূ০ ১।২।১১ এই সূত্রেও জীব ও ব্রহ্মের ভিন্নতার প্রতিপাদন স্পষ্টভাবে করা হয়েছে ।
 
ঈশা বাস্যমিদং সর্বং য়ৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্ ॥
এই মন্ত্রে ❝'ঈশা❞ পদ দ্বারা পরমাত্মা , 'জগৎ' পদ দ্বারা চরাচর সংসার এবং ❝ভুঞ্জীথাঃ❞ পদ দ্বারা ভোগকারী জীবের বর্ণনা হওয়ার কারণে ত্রৈতবাদ স্পষ্ট । কারণ পরমাত্মা তো স্বয়ং ভোগ করেন না এবং পরমাত্মা থেকে ভিন্ন যদি প্রকৃত্যাদির কোনো সত্তাই না থাকতো‌, তাহলে কাকে আচ্ছাদন করছেন‌ ? এর কোনো সমাধান না হওয়ার কারণে প্রকৃতির এবং ভোক্তা জীবের এতে বর্ণনা স্পষ্ট ‌।
 
সমূলাঃ সোম্যেমাঃ সর্বাঃ প্রজা সদায়তনাঃ সৎপ্রতিষ্ঠাঃ॥ (ছান্দো০ উ০ ৬।৮।৪)
অর্থাৎ সত্যস্বরূপ প্রকৃতি , জগতের মূলাধার এবং স্থিতির কারণ । এখানে মূল-প্রকৃতিকে ❝সৎ❞ বলা হয়েছে , যার কখনো অভাব হয় না । এই সমস্ত সংসার প্রকৃতির বিকার হওয়ার কারণে প্রলয়ের পর প্রকৃতিতেই লীন হয়ে যায় ।
 
য়তো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে। য়েন জাতানি জীবন্তি ।
য়ৎপ্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি। তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব । তদ্‌ব্রহ্মেতি ॥ তৈত্তি০ উ০ ৩।১।১
এই শ্রুতিতে ব্রহ্মের লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে বেদান্তদর্শনের ❝জন্মাদ্যস্য য়তঃ❞ এই সূত্রে যে ব্রহ্মের লক্ষণ বলা হয়েছে , সেটিই এ উপনিষদে বলা হয়েছে। সেই পরব্রহ্ম এই সৃষ্টির উৎপত্তি , স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ । তিনি জগতের উপাদান-কারণ নন বরং নিমিত্ত-কারণনা । যেমন ঘটের নির্মাণে কুম্ভকার নিমিত্ত-কারণ এবং মৃত্তিকা উপাদান-কারণ , তেমনি সৃষ্টি-রচনাতে ব্রহ্ম নিমিত্ত- কারণ এবং প্রকৃতি উপাদান-কারণ । ব্রহ্ম সৃষ্টির উপাদান-কারণ এজন্য নয় , কারণ সৃষ্টির মধ্যে ব্রহ্মের জ্ঞানাদি গুণ নেই । কেননা , উপাদান-কারণের গুণ কার্যে অবশ্যই আসতো । এই শ্রুতিতে বলা হয়েছে , সেই ব্রহ্ম সকল ভূতগণকে রচনা করেন , এদের জীবিত রাখেন এবং প্রলয়কালে কারণরূপে লীন করেন ।
 
যোগদর্শনে (১।৩) বলা হয়েছে- ❝তদা দ্রষ্টুঃ স্বরূপেহবস্থানম্॥ ❞ অর্থাৎ সেই অবস্থায় জীবাত্মা পরমাত্মার স্বরূপে থাকে । এই সূত্রে ❝দুষ্টু❞ শব্দটি পরমাত্মারও বাচক । এটি সত্য যে , জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়ই দ্রষ্টা । কিন্তু ❝মুখ্যামুখ্যয়োমুখ্যে কায়সম্প্রত্যয়❞ এই নীতি অনুযায়ী মুখ্য দ্রষ্টা হলেন পরমেশ্বর । জীবাত্মা আনন্দের আকাঙ্ক্ষী। একমাত্র পরমেশ্বরই আনন্দের উৎস- ❝রসো বৈ সঃ । রসংহ্যেবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি❞ । (তৈত্তি০ উপ০ ২।৭।২)"। ঋগ্বেদে (৭।১১।১) বর্ণিত হয়েছে- ❝ন ঋতে ত্বদমৃতা মাদয়ন্তে ❞ = হে পরমেশ্বর! তোমাকে ছাড়া মুক্ত আত্মাগণ আনন্দিত হয় না । এমন অবস্থায় মুক্তাত্মা সেই আনন্দদাতা প্রভুর পরম-আনন্দ অনুভব করেন । এটিই পরমাত্মার স্বরূপে অবস্থিত হওয়ার অর্থ । পরমাত্মাতে অবস্থান করার পরও জীবের স্বাধীন অস্তিত্ব থাকে । কারণ মুক্তিতে জীবাত্মা ব্রহ্মে লয় (বিলীন) হয় না । অবিদ্যা নাশ হওয়ার পর এবং কর্মের বন্ধন অর্থাৎ সংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার পর জীবাত্মা সর্বব্যাপী পরমাত্মাতে এমনভাবে অবস্থান করেন , ঠিক যেভাবে সমস্ত পদার্থ আকাশের স্থিত থাকে ।
 
ঔপচারিকভাবে বলা হয়েছে - ❝ য়ত্র নান্যৎ পশ্যতি❞ (ছান্দো০ উ০ ৭।২৪।১), ❝ন তু তদ্‌ দ্বিতীয়মস্তি ততোহন্যদ্‌ বিভক্তং য়ৎ পশ্যেৎ❞(বৃহদা০ ৪।৩।২৩) এবং ❝ব্রহ্মৈব সন্ ব্রহ্মাপ্যেতি❞ (বৃহদা০ ৪।৪।৬) ইত্যাদি বাক্যের এটিই তাৎপর্য । এগুলো আনন্দানুভূতির আধিক্যেই অতিশয় শব্দে বলা বচনমাত্র । তৈত্তিরীয় উপনিষদে (৩। ৬।১) বলা হয়েছে, ❝ আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ ❞ অর্থাৎ আনন্দই ব্রহ্ম , এরূপ জানবে । এ থেকে স্পষ্ট যে , ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ । ❝অ॑কা॒মো ধীরো॑ অ॒মৃতঃ॑ স্বয়ম্॒ভূ রসে॑ন তৃ॒প্তো ন ❞ অথর্ববেদ -১০।৮।৪৪
 
শুধু তাই নয় , জীব মুক্তিতে ব্রহ্মের সাথে লয় হয়ে যায় না , আর না জীব ব্রহ্মের সমরূপ হতে পারে । যেহেতু ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ (আনন্দো ব্রহ্ম; তৈত্তি০ উ০) এবং তাঁকে লাভ করে জীবও আনন্দিত হন (রসংহ্যেবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি; তৈত্তি০ উ০ ২।৭।২), তাহলে তো উভয়ই এক হয়ে গেল ! এটি বলা যুক্তিযুক্ত নয় । কারণ শুধুমাত্র একটি গুণ বা কিছু গুণের মধ্যে সাদৃশ্য থাকার কারণে দুটি পদার্থ এক হয়ে যায় না । চিনি ও লবণ সাদা রঙের হওয়ায় এ দুটি পদার্থ কখনো এক হতে পারে না । শুধু পদার্থ হওয়ায় জল ও দুধকে এক হিসেবে বিবেচনা করা যায় না । তত্ত্বজ্ঞান তখনই অর্জিত হয় , যখন সাধর্য্যের পাশাপাশি বৈধর্য্যের জ্ঞানও থাকে । ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য হলো- ❝ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ❞ । (যোগ০ ১।২৪) অর্থাৎ ক্লেশ , কর্ম , বিপাক ও আশয় থেকে অসম্পৃক্ত (সম্বন্ধহীন) চেতন-তত্ত্ব বিশেষকে ঈশ্বর বলা হয় । অন্যদিকে ❝ইচ্ছাদ্বেষপ্রয়ত্নসুখদুঃখজ্ঞানান্যাত্মনো লিঙ্গম্॥❞ (ন্যায়০ ১।১।১০) = ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রচেষ্টা, সুখ, দুঃখ ও জ্ঞান আত্মার লিঙ্গ (চিহ্ন) । ঈশ্বর ও জীব উভয়েরই নিজস্ব গুণ রয়েছে । গুণসমূহ গুণীর সাথে সম্পর্কিত অর্থাৎ গুণ তার গুণী থেকে আলাদা হতে পারে না । ঈশ্বরের গুণাবলি ঈশ্বরের মধ্যে এবং জীবের গুণাবলি জীবের মধ্যে সর্বদাই থাকবে। অতএব স্বীয় স্বরূপ থেকে বিচ্যুত হয়ে ঈশ্বর জীবের মতো এবং জীব ঈশ্বরের মতো হতে পারে না । ছান্দোগ্য উপনিষদে (৮।১২।৩) বলা হয়েছে যে , জীবাত্মা কখনো নিজের স্বরূপ ত্যাগ করেন না । অতঃ তিনি যা করেন , তা ❝স্বেন রূপেণাভিনিষ্পদ্যতে❞ স্বীয় স্বরূপে স্থিত হয়ে করেন ।
 
❌ মূর্খগণ দাবি করছে , জীবাত্মা ও জগৎ তার অংশও না তার অধীনও না, ব্রহ্মের কোনো অধিকার নাই জীবাত্মা ও জগতের উপর হস্তক্ষেপ করার।
✅ এয়ঃ কেশিনঃ ঋতুথা বি চক্ষতে সংবৎসরে বপত এক এষাম্ । বিশ্বমেকো অভি চষ্টে শচীভির্ধাজিরেকস্য দদৃশে ন রূপম্॥
ঋ০ ১।১৬৪।৪৪
পদার্থঃ(ত্রয়ঃ) তিন (কেশিনঃ) প্রকাশময় পদার্থ [কেশি কাশানাব্দা প্রকাশানাব্দা ; নিরুক্ত ১২।২৬‌ ] তুথা) নিয়মানুসারে (বি চক্ষতে) বিবিধ কার্য করে থাকে (এষাম্) এদের মধ্যে থেকে (একঃ) একটি (সংবৎসরে) বাসযোগ্য সংসারে , অথবা সৃষ্টিকালে (বপতে) বীজ বপন করে । (একঃ) একটি (শচীভিঃ) শক্তি , কর্ম ও বুদ্ধি দ্বারা (বিশ্বম্) বিশ্বকে (অভি চষ্টে) দুই দিক থেকে দেখেন । (একস্য)একটির (ধাজিঃ) বেগ তো (দদৃশে) দেখা যায়‌, কিন্তু (ন রূপম্) রূপ দেখা যায় না‌ ।
 
এই মন্ত্রে জীবদের কর্মফল প্রদানের জন্য প্রকৃতিতে বীজ বপন অথবা কারণরূপ প্রকৃতিকে র্যরূপ দানের জন্য ঈশ্বরের , নিজের কর্ম দ্বারা শুভ-অশুভ দুই প্রকার ফলের ভোক্তা-রূপে জীবের এবং কার্যরূপে দৃশ্যমান হলেও সূক্ষ্ম হওয়ায় কারণরূপে অদৃশ্য প্রকৃতির বর্ণনা করা হয়েছে‌ ।
 
প্রকৃতি জড় ও অচেতন । অচেতন হওয়ার কারণে প্রকৃতি স্বয়ং পরিবর্তিত হতে পারে না । যেরূপ মৃত্তিকাখণ্ড কারো কর্ম ব্যতীত স্বয়ং কলসীতে পরিণত হতে পারে না , কারণ মৃত্তিকাতে এমন ক্ষমতা নেই । সেরূপ প্রকৃতির মধ্যেও এমন ক্ষমতা বা শক্তি নেই , যে সে স্বয়ং জগতে পরিণত হবে । প্রকৃতি জীবাত্মার ভোগ্য হওয়ার কারণে জীবাত্মার দ্বারাও জগৎ নির্মাণ সম্ভব নয় । কারণ ভোক্তা নিজে ভোগ্য হতে পারেন না । সুতরাং তাদের আরেকটি সত্তার (ঈশ্বর) উপর নির্ভরশীল হতেই হবে ।
 
অচেতন প্রকৃতি জীব এবং জগতের মূল কারণ হলে তদ্দ্বারা উদ্দেশ্য এবং উপায়ের যথাযথ সমন্বয় হতে পারে না । প্রকৃতির নির্দিষ্ট কোন কার্যটি পুরুষার্থের পক্ষে সহায়ক হবে , কোন কার্যটি তদনুকূল হবে না , অচেতন প্রকৃতির পক্ষে তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় । জীবাত্মাও অল্পজ্ঞ ও একদেশী বলে জগৎ নির্মানের কার্য তার দ্বারা সম্ভব নয় । সুতরাং জগৎ নির্মানের জন্য জীবাত্মা ও প্রকৃতি ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল ।
প্রকৃতি-পুরুষের (জীবাত্মা) সংযোগের ফলে জগতের অভিব্যক্তি এবং বিয়োগের ফলে জগতের বিনাশ হয় । কিন্তু প্রকৃতি এবং পুরুষ বিরুদ্ধধর্মী । উদাহরণস্বরূপ- প্রকৃতি অচেতন , আর পুরুষ সচেতন । প্রকৃতি এবং পুরুষ বিরুদ্ধধর্মী হওয়ার কারণে তাদের সংযোগ বা বিয়োগ তাদের স্বাভাবিক ধর্ম হতে পারে না । সুতরাং সচেতন , সর্ব-শক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের সাহায্যে এই সংযোগ বা বিয়োগ সম্ভব হয়েছে এরূপ স্বীকার করতে হবে । অতএব জীবাত্মা ও প্রকৃতি ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল । জীবাত্মা চেতন হওয়ায় তার সান্নিধাস্থিত অন্তঃকরণের অধিষ্ঠাতা হয়ে থাকে । জীবের জ্ঞান সাপেক্ষ , জীব একদেশী , পরতঃ প্রকাশ ও অল্প সামর্থ্য বিশিষ্ট হওয়ায় সৃষ্টিকর্তা হতে পারে না । জীবাত্মা যাদের সাহায্যে কার্য করবে , সেই সমস্ত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় , বুদ্ধি , অহংকার এমনকি স্থুল শরীর গঠন করার সামর্থ্য তার নেই । বুদ্ধি , ইন্দ্রিয় , শরীর লাভ করেও এই সূক্ষ্ম শরীর , সূক্ষ্ম ভূত , সূর্য্য , বায়ু , সমুদ্র , পর্বত‌ , পৃথিবী ও পৃথিবীর গর্ভস্ত সূবর্ণাদি সৃষ্টি করা তো দূরের কথা এদের সমন্ধে যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে হলেও যোগজ সামর্থ্যের প্রয়োজন । জীব নির্গুন‌, চৈতন্য স্বরূপ ও সহোজা অর্থাৎ‌ , অপরের সাহায্যে তার প্রকাশ ও প্রয়োজন সিদ্ধ হয়ে থাকে । বুদ্ধির সাহায্যে আদি গুরু পরমাত্মা থেকে ক্রম পূর্বক বিদ্যালাভ করে সামর্থ্য অনুযায়ী স্থুল ভূতের উপর কিয়ৎ পরিমানে কর্তৃত্ত্ব করতে সমর্থ হয়ে থাকে । 
 
সর্বদা কর্তার সাথেই কর্মের সম্বন্ধ হয় ও ক্রিয়াও সর্বদা কর্তার ওপরেই প্রযুক্ত হয় । উদাহরণস্বরূপ- আপনি কাউকে ছুরি দিয়ে হত্যা করলেন । এখানে হত্যার জন্য দায়ী আপনি , কারণ ছুরি জড় পদার্থ । ছুরি কাউকে হত্যা করতে পারে না , যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তাকে চালনা করে । আর হত্যার সম্বন্ধও হস্তারকের উপরেই প্রযুক্ত হয় , অস্ত্রের ওপরে নয় । অর্থাৎ হত্যাকরী হিসেবে আপনার নামই প্রযুক্ত হবে , কারণ আপনি কর্তা । কেউই বলবে না যে ছুরি অমুককে হত্যা করেছে । 
 
ন তস্য কার্য়ং করণং চ বিদ্যতে ন তৎসমশ্চাভ্যধিকশ্চ দৃশ্যতে। পরাহস্য শক্তির্বিবিধৈব ক্রয়তে স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ ।
শ্বেতা০ ৬।৮
পরামাত্মা থেকে কোনো তদ্রূপ কার্য এবং তার করণ অর্থাৎ সাধকতম অন্য কিছু অপেক্ষিত নেই‌। তাঁর তুল্য অথবা তাঁর চেয়ে অধিক [মহান] কেউ নেই‌ । তাঁর সর্বোত্তম শক্তি অর্থাৎ তাঁর মধ্যে যে অনন্ত জ্ঞান‌ , অনন্ত বল এবং অনন্ত ক্রিয়া আছে‌ , তা স্বাভাবিক- এরূপ শোনা যায় । যদি পরমেশ্বর নিষ্ক্রিয় হতেন , তাহলে জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয় করতে পারতেন না । এজন্য তিনি ❝বিভু❞ তথাপি চেতন হওয়ায় তাঁর মধ্যে ক্রিয়াও আছে । যেরূপ পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাব অনাদি , তাঁর জগতের সৃষ্টি-স্থিতি প্রলয় করাও সেইরূপ অনাদি । ঈশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাবের যেমন আরম্ভ ও অন্ত নাই , সেইরূপ তাঁহার কর্তব্য কর্মের আরম্ভ ও অন্ত নাই । চক্ষুর প্রয়োজন কি ? তুমি বলবে ❝দর্শন❞ । তাহলে সৃষ্টি ব্যতীত ঈশ্বরে সৃষ্টিবিজ্ঞান, বল ও ক্রিয়ার প্রয়োজন কি ? তুমি উত্তরে অন্য কিছুই বলতে পারবে না । আর জগৎ সৃষ্টি দ্বারাই পরমেশ্বরের ন্যায়শীলতা, ধারণ এবং দয়া প্রভৃতি গুণ সার্থক হতে পারে । তাঁর অনন্ত সামর্থ্য জগতের উৎপত্তি , স্থিতি ও প্রলয় ব্যবস্থা দ্বারাই স্বার্থক হয়ে থাকে । যেরূপ নেত্রের স্বাভাবিক গুণ দর্শন, সেরূপ জগৎ সৃষ্টি করে সমস্ত জীবকে অসংখ্য পদার্থ প্রদান পূর্বক পরোপকার করা ঈশ্বরের ❝ক্রয়তে স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ ❞স্বাভাবিক গুণ ।
 
3️⃣▶️ আক্ষেপ: ত্রৈতবাদ মতে জীবাত্মা নিরাকার। জীবাত্মা একাধিক, বহু সংখ্যক। প্রত্যেক জীবের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জীবাত্মা অবস্থিত। এবার এখানে সমস্যা হচ্ছে কোনো কিছু নিরাকার হলে একাধিক হওয়া সম্ভব কিভাবে!?
জীবাত্মা যদি একাধিক হয় তাহলে বলতে হবে প্রতিটা জীনাত্মা আলাদা। একটা জীবাত্মা আরেকটা জীবাত্মা থেকে আলাদা। আলাদা বললে বলতে হবে অবশ্যই জীবাত্মার একটা সীমানা বা বাউন্ডারি আছে। নয়তো বাউন্ডারী না থাকলে আলাদা জীবত্মা বলা যায় না।
আরো ভালো করে বুঝতে দুটি জীবাত্মা নিয়ে চিন্তা করুন। এখন যদি বলা হয় দুইটি জীবাত্মা। তাহলে জীবাত্মা দুটি একটা আরেকটার থেকে পৃথক। একটা আত্মা আরেকটা থেকে আলাদা। আত্মা দুটির অবশ্যই বাউন্ডারি আছে নয়তো তারা আলাদা থাকতে পারে না। বাউন্ডারি না থাকলে আত্মা দুটি একত্রে মিশে যেত। সুতরাং অবশ্যই তাদের বাউন্ডারি আছে ।নয়তো বাউন্ডারী না থাকলে আলাদা জীবত্মা বলা যায় না।
আরো ভালো করে বুঝতে দুটি জীবাত্মা নিয়ে চিন্তা করুন। এখন যদি বলা হয় দুইটি জীবাত্মা। তাহলে জীবাত্মা দুটি একটা আরেকটার থেকে পৃথক। একটা আত্মা আরেকটা থেকে আলাদা। আত্মা দুটির অবশ্যই বাউন্ডারি আছে নয়তো তারা আলাদা থাকতে পারে না। বাউন্ডারি না থাকলে আত্মা দুটি একত্রে মিশে যেত। সুতরাং অবশ্যই তাদের বাউন্ডারি আছে তাই তারা মিশে একাকার হয়ে যায় না। যার বাউন্ডারি বা সীমানা আছে সেটা কখনোই নিরাকার না। আর কোনোকিছু নিরাকার হলে সেটাকে একটা দুইটা এভাবে গণনা করা অসম্ভব। যেমনঃ জলকে কেও বলে না একটা জল, বয়ুকে কেও বলে না একটা বায়ু, আলোকে কেও বলে না একটা আলো। সুতরাং নিরাকরকে কখনোই গণনা করা যায় না। আর নিরাকরের কোনো সীমনা বা বাউন্ডারিও থাকে না। আর দুই পাত্রে রাখা একই ধর্মীয় নিরাকার কোনো কিছু একত্র করলে তারা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। যেহেতু নিরাকারের কোনো সীমানা নাই। সুতরাং জীব আত্মাকে একাধিক বললে অবশ্যই মানতে হবে জীব আত্মা সাকার। এই তথাকথিত ত্রৈতবাদে এরূপ বেশ কিছু ফাঁক ফোকর দৃশ্যমান হয়। এমন ফাঁক ফোকর যুক্ত দর্শন কখনোই অপৌরুষেয় বেদের দর্শন হতে পারে না। এই ত্রৈতবাদ দয়ানন্দ সৃষ্ট মতবাদ বৈ কিছুই নয়। 
 
💢✅প্রত্যুত্তর: আত্মা অপরিমেয় । [গীতা২।১৮] অপরিমেয় তাই সংখ্যা নেই । যেমন: এক ট্রাক বালু আছে এতে বালুর কণা অসীম । কিন্তু ট্রাকে বালুর কণার সংখ্যা নিদিষ্ট । আমার দ্বারা গণনা করা সম্ভব নয় বলে বলছি অসংখ্য । জীবাত্মার বিষয়টিও এমনই । জীবাত্মার অবস্থান মস্তিকে বৈদিক শাস্ত্র সমূহে শতাধিক প্রমাণ বিদ্যমান । জীবাত্মা যে বহু সেটাও শাস্ত্র দ্বারা প্রমাণিত । জীবাত্মা' নিত্য (❝অমর্ত্য❞ ঋ০১।১৬৪।৩৮), অজন্মা (❝ন জায়তে❞ গীতা০ ২।২০), কর্মফলের ভোক্তা (❝পিপলং স্বাদন্তি❞ অথর্ব০ ৯।৯। ২০), চেতন এবং অনেক (❝পুরুষবহুত্বম্❞ (সাংখ্য০ ১।৫১), নিত্য, চেতন ও বহুসংখ্যক (❝নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চ.... বহুনাং❞....। শ্বেতা০ ৬।১৩) । ঈশ্বর ও জীবাত্মা পরস্পর অনাদিকাল থেকে স্বরূপত ভিন্ন-ভিন্ন সত্তা (❝ভেদব্যপদেশাচ্চ;❞ বেদান্ত০ ১।১।১৭) ।
 
💥বেদে স্পষ্টতঃভাবে বর্ণিত রয়েছে -
বালাদেকমণীয়স্কমুতৈকং নেব দৃশ্যতে । ততঃ পরিম্বজীয়সী দেবতা সা মম প্রিয়া ॥
(অথর্ব০ ১০।৮।২৫)
পদার্থঃ (একম্) এক জীবাত্মা (বালাদণীয়স্কম্) কেশ থেকেও সূক্ষ্মতর [ বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ , ভাগো জীবঃ। শ্বেতা০ ৫।৯ ] (উত) এবং (একম্) এক প্রকৃতি (নৈব দৃশ্যতে) দৃষ্টির অগোচর হওয়ার কারণে অব্যক্ত হয়ে আছে । (ততঃ পরিম্বজীয়সী দেবতা) তার থেকেও সূক্ষ্মতর । এবং ব্যাপক যে পরমাত্মদেব (সা মম প্রিয়া) তিনিই আমার প্রিয় ।
প্রকৃতির পরমাণু অতি সূক্ষ্ম , জীবাত্মা তার থেকেও সূক্ষ্মতর , সেই জীবের থেকেও সূক্ষ্মতর হলেন পরমাত্মা । ❝ অণোরণীয়ান্ মতো মহীয়ানাত্মা ❞ শ্বেতা০৩.২০ অর্থাৎ , সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর মহান থেকেও মহত্তর সেই পরমাত্মা । ❝য়স্মাৎ পরং নাপরমস্তি কিঞ্চিদ্ । ❞শ্বেতা০৩.৯ অর্থাৎ , যার থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য কিছুই নেই , যার থেকে সূক্ষ্ম ও মহান কিছুই নেই যিনি প্রকাশময় স্বরূপে বৃক্ষের ন্যায় নিশ্চলভাবে বিরাজমান , সেই এক ও অদ্বিতীয় পূর্ণ পরমাত্মা দ্বারা এই সম্পূর্ণ জগৎ পরিব্যাপ্ত ।
য় আত্মনি তিষ্ঠন্ আত্মনোহন্তরো য়মাত্মা ন বেদ । য়স্য আত্মা শরীরম্ । য় আত্মানমন্তরো য়ময়তি সত আত্মান্তয়াম্যমৃতঃ ॥ (শত০ ব্রা০ ১৪।৬।৭। ৩০)
অর্থাৎ , যিনি আত্মায় অবস্থান করেন , অথচ আত্মা থেকে পৃথক , আত্মা যাঁকে জানে না , কিন্তু আত্মা যাঁর শরীর এবং যিনি আত্মার অভ্যন্তরে থেকে আত্মাকে শাসন করছেন , তিনিই তোমার পরমাত্মা ; ইনি অন্তর্যামী ও অমৃত ।
 
এখানে জীবাত্মা ও পরমাত্মার ব্যাপ্য-ব্যাপক সম্বন্ধ বর্ণনা করে বলা হয়েছে- অতি সূক্ষ্ম হওয়ার কারণে পরমাত্মা জীবাত্মার মধ্যেও ব্যাপ্ত, অথচ জীবাত্মা থেকে পৃথক। এই জীবাত্মা তাঁকে জানে না। সেই পরমাত্মার নিবাস হওয়ার কারণে এই জীবাত্মা তাঁর শরীর। এতে স্পষ্ট যে, জীবাত্মা ব্যাপ্য এবং পরমাত্মা ব্যাপক, অতএব এই দুটি সত্তা পরস্পর থেকে ভিন্ন।
 
অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি
ঈশানং ভূতভব্যস্য ন ততো বিজুগুপ্সতে । এতদ্বৈ তৎ॥
কঠো০ ২।১।১২
পদার্থঃ (ভূতভব্যস্য) ভূত ও ভবিষ্যতের [সর্বকালের] (ঈশানম্) স্বামী বা অধ্যক্ষ (অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ) অঙ্গুষ্ঠমাত্র হৃদয়দেশে লভ্য (পুরুষঃ) সর্বত্র ব্যপ্ত পরমাত্মা (আত্মনি) প্রত্যেক জীবাত্মার (মধ্য) মধ্যে (তিষ্ঠতি) অবস্থিত (ততঃ) তাঁকে জানার পর কোনো পুরুষ (ন বিজুগুন্সতে) নিন্দিত হয় না (এতৎ বৈ তৎ) ইনিই সেই ব্রহ্ম ।
সরলার্থঃ অঙ্গুষ্ঠমাত্র হৃদয়দেশে লভ্য পরমাত্মা প্রত্যেক জীবাত্মার মধ্যে বিরাজমান , তিনি ভূত ও ভবিষ্যত অর্থাৎ সর্বকালের অধ্যক্ষ । তাঁকে জানার পর কোনো পুরুষ নিন্দিত হয় না ইনিই সেই ব্রহ্ম ।
 
অঙ্গুষ্ঠমাত্রো রবিতুল্যরূপঃ সংকল্পাহংকারসমন্বিতো য়ঃ বুদ্ধের্গুণেনাত্মগুণেন চৈব আরাগ্রমাত্রো হ্যপরোঽপি দৃষ্টঃ॥
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্‌০ ৫.৮
পদার্থঃ (য়ঃ) যিনি [জীবাত্মা] (অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ) অঙ্গুষ্ঠমাত্র (সংকল্প অহংকার সমন্বিতঃ) সংকল্প এবং অহংকারযুক্ত (রবিতুল্যরূপঃ) সূর্যের ন্যায় প্রকাশস্বরূপ (আরাগ্রমাত্রঃ) সূঁচের অগ্রভাগের ন্যায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম (অপি) এবং (অপরঃ) অপর [পরমাত্মা থেকে ভিন্ন] (বুদ্ধেঃ) বুদ্ধির (গুণেন) উৎকৃষ্ট গুণ [জ্ঞান] (চ) এবং (আত্মগুণেন) আত্মগুণ [চেতনা] (এব হি) দ্বারাই (দৃষ্টঃ) তিনি দৃষ্ট হন ।
সরলার্থঃ জীবাত্মা অঙ্গুষ্ঠমাত্র , সংকল্প এবং অহংকারযুক্ত , সূর্যের ন্যায় প্রকাশস্বরূপ । তিনি সূঁচের অগ্রভাগের ন্যায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং পরমাত্মা থেকে ভিন্ন । বুদ্ধির উৎকৃষ্ট গুণ (জ্ঞান) এবং আত্মগুণ (চেতনা) দ্বারাই তাঁকে (জীবাত্মাকে) জানা যায় । 
 
অঙ্গুষ্ঠ-পরিমিত হৃদয়পুরীতে অবস্থান করেন বলেই জীবাত্মাকে ❝অঙ্গুষ্ঠমাত্র❞ বলা হয়েছে । এই কারণে পুনরায় বলা হয়েছে , তিনি ❝আরাগ্রমাত্র❞ অর্থাৎ সূঁচের অগ্রভাগের ন্যায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম । আত্মার এই সূক্ষ্মতাকে কোনো জড় বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব নয় । শুধু বোঝানোর সুবিধার্থে এই লৌকিক দৃষ্টান্ত অবলম্বন করা হয়েছে । জীবাত্মা সংকল্প (Determined will) এবং অহংকার (Ego) সমন্বিত । তিনি সূর্যের ন্যায় প্রকাশস্বরূপ অর্থাৎ জড় শরীরে চেতনা প্রদানকারী । যেরূপ সূর্য সমগ্র জগৎকে প্রকাশিত করে , তদ্রূপ জীবাত্মা স্বীয় চেতন-ধর্ম দ্বারা সম্পূর্ণ দেহকে প্রকাশিত করেন । নিজের গুণানুসারে তিনি ❝অপর❞ অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন । বুদ্ধির উৎকৃষ্ট গুণ (জ্ঞান) ও আত্মগুণ (চেতনা) দ্বারাই, নিজের আত্মাকে সূক্ষ্মদর্শী যোগিগণ জানতে পারেন । এই বিষয়ে ❝গীতায় (১৫।১০)❞ বলা হয়েছে , দেহ ত্যাগের সময় অথবা দেহে অবস্থানপূর্বক বিষয়-ভোগকালে বা প্রকৃতির গুণত্রয়ের সঙ্গে সংযুক্ত রূপে এই জীবকে অজ্ঞ ব্যক্তিরা দেখতে পায় না , কিন্তু জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্র দ্বারা তাকে দর্শন করেন । 
 
বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ ।
ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ স চানন্ত্যায় কল্পতে॥
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্‌০ ৫.৯
পদার্থঃ (বালাগ্রশতভাগস্য) একটি কেশের অগ্রভাগের শতভাগকে (চ) পুনরায় [তার একটি ভাগকে] (শতধা) শতভাগ রূপে (কল্পিতস্য) কল্পনা করলে (ভাগঃ) যে সূক্ষ্ম এক ভাগ হয় (জীবঃ) জীবাত্মাকে (সঃ) সেই পরিমাণ সূক্ষ্ম বলে (বিজ্ঞেয়ঃ) জানবে (চ) এবং (সঃ) তিনি (আনন্ত্যায়) পরমপদ [মোক্ষ] লাভের জন্য (কল্পতে) সমর্থ , যোগ্য ।
সরলার্থঃ একটি কেশের অগ্রভাগের শতভাগকে পুনরায় তার একটি ভাগকে শতভাগ রূপে কল্পনা করলে যে সূক্ষ্ম এক ভাগ হয় , জীবাত্মাকে সেই পরিমাণ সূক্ষ্ম বলে জানবে এবং তিনি পরমপদ (মোক্ষ) প্রাপ্তির যোগ্য ।
 
এই শ্রুতিতে জীবাত্মার অতি সূক্ষ্মতার নিরূপণ করে বলা হয়েছে— একটি কেশের অগ্রভাগকে ❝দশ হাজার ভাগ করলে❞ , তার একভাগ যে পরিমাণ সূক্ষ্ম হয়, জীবাত্মাও তদ্রূপ অতি সূক্ষ্ম । ❝ত্রস-রেণুর তুল্য❞ পরিমাণ কেশের অগ্রভাগের দশ হাজার টুকরো করা সম্ভব নয় । এজন্য এখানে শব্দার্থের প্রধানতা গ্রন্থকারের অভিপ্রেত নয় , বরং বাক্যের মুখ্য আশয় গ্রহণই অভীষ্ট । জীবাত্মা এতটা সূক্ষ্ম হয়েও অনন্ত সামর্থ্য বা পরমপদ (মোক্ষ) প্রাপ্তির জন্য সমর্থ ।
 
💥 ন্যায়শাস্ত্রের পদ্ধতি অনুসারে পঞ্চাবয়ব দ্বারাও এই বিষয় প্রস্তুত করা যেতে পারে –
প্রতিজ্ঞা— আত্মা নিরাকার ।
হেতু— চেতন হওয়ার কারণে ।
উদাহরণ— যেমন , ঈশ্বর ।
উপনয়— ঈশ্বর নিরাকার এবং চেতন , তদ্রূপ জীবও চেতন হওয়ার কারণে নিরাকার ।
নিগমন— ঈশ্বরের ন্যায় চেতন হওয়ার কারণে জীবও নিরাকার ।
এখন এই বিষয়কে শাস্ত্রের প্রমাণ দ্বারা বিচার করা যাক । যোগদর্শনের সূত্র অনুসারে— ❝ভোগাপবর্গার্থং দৃশ্যম্❞ (যোগ০ ২।১৮) যা কিছু দৃশ্য (প্রকৃতির বিকার বা কার্য) , তা আত্মার ভোগ এবং অপবর্গের (মোক্ষের) সিদ্ধির জন্য । এজন্য ভোক্তা অর্থাৎ আত্মা কখনো দৃশ্য হতে পারে না , নতুবা তিনি ভোগ্য হয়ে যাবেন । দৃশ্য মাত্র সাকারই হয়ে থাকে , অতএব আত্মা সাকার নয় । যোগদর্শনে বলা আছে ❝দ্রষ্টা দৃশিমাত্রঃ শুদ্ধঃ❞ (যোগ০ ২।২০) অর্থাৎ দ্রষ্টা জ্ঞানস্বরূপ আত্মা সর্বথা শুদ্ধ (নির্বিকার) । এ বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সত্যার্থ প্রকাশের দ্বাদশ সমুল্লাসে লিখেছেন— ❝দ্রষ্টা দ্রষ্টাই থাকে, কখনো দৃশ্য হয় না । যদি দ্রষ্টা ও ভোক্তা জীবাত্মাকে সাকার মানা হয় , তাহলে তিনি দৃশ্যের অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং ভোগ্য হয়ে যাবেন❞ ।
 
একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা। কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতাদিবাসঃ সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ ॥
শ্বেতা০ ৬।১১
পদার্থঃ (দেবঃ) পরমদেব পরমেশ্বর (একঃ) এক (সর্বভূতেষু) [তিনি] সকল প্রাণীর মধ্যে (গূঢ়ঃ) গূঢ়ভাবে বিদ্যমান (সর্বব্যাপী) সর্বব্যাপক হয়ে (সর্বভূতান্তরাত্মা) সকল প্রাণীর আত্মার মধ্যে অন্তর্যামীরূপে স্থিত (কর্মাধ্যক্ষঃ) সবার কর্মের অধিষ্ঠাতা [ যথাযোগ্য কর্মফল প্রদানকারী ] (সর্বভূতাদিবাসঃ) সর্বভূতের আধার বা নিবাসস্থান (সাক্ষীঃ) সকল জীবের শুভাশুভ কর্মের দ্রষ্টা (চেতা) চেতনস্বরূপ (কেবলঃ) অদ্বিতীয় (চ) এবং (নির্গুণঃ) গুণাতীত [সত্ত্ব , রজঃ , তমঃ- এই গুণত্রয় থেকে পৃথক] ।
সরলার্থঃ পরমদেব পরমেশ্বর এক ও অদ্বিতীয়; তিনি সকল প্রাণীর মধ্যে গূঢ়ভাবে বিদ্যমান , সর্বব্যাপক হয়ে সকল প্রাণীর আত্মার মধ্যে অন্তর্যামীরূপে স্থিত এবং সবার কর্মের অধিষ্ঠাতা অর্থাৎ যথাযোগ্য কর্মফল প্রদানকারী । তিনিই সর্বভূতের নিবাসস্থান , সকল জীবের শুভাশুভ কর্মের দ্রষ্টা , চেতনস্বরূপ এবং গুণাতীত ।
 
এই শ্রুতিতে পরমাত্মার নিত্য স্বরূপের বর্ণনা করা হয়েছে । তিনি এক , অদ্বিতীয় অর্থাৎ অনেক ঈশ্বর নেই । তিনি সর্বব্যাপী অর্থাৎ এমন কোনো স্থান নেই , যেখানে তিনি বিরাজ করেন না , সকল জীবের হৃদয়েই তিনি অবস্থিত । সকল জীবের কৃতকর্মের যথাযোগ্য কর্মফল তিনিই প্রদান করেন । তিনি চেতনস্বরূপ , জীবের ❝শুভ-অশুভ সমস্ত কর্মের দ্রষ্টা❞ এবং গুণাতীত অর্থাৎ সত্ত্বাদি গুণত্রয়ের বন্ধন থেকে তিনি সদা মুক্ত । অতএব , যে সকল মানুষ সর্বদা এক ও অদ্বিতীয় , সর্বব্যাপী , সর্বসাক্ষী , সর্বনিয়ন্তা , কর্মফলদাতা , গুণাতীত সেই পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ করেন , তাঁরাই কৃতার্থ হন ।
 
পুণ্ডরীকং নবদ্বারং ত্রিভিগুণেভিরাবৃতম্। তস্মিন্ য়দ্ য়ক্ষমাত্মন্বৎ তদ্বৈ ব্রহ্মবিদো বিদুঃ ॥
অথর্ববেদ ১০।৮।৪৩
 
এই মন্ত্রে ❝পুণ্ডরীক❞ পদ মানবদেহের জন্য প্রযুক্ত হয়েছে । লোক ও সাহিত্যে এই পদের অর্থ কমল অথবা পুষ্পমাত্র প্রসিদ্ধ । পুষ্পকে মানবদেহের প্রতীক বা উপমান বলা হয় , তাকে সুন্দর তথা আকর্ষক বলার পাশাপাশি তার নশ্বরতারও সংকেত করা হয়েছে । তাৎপর্য এই যে , দেহের আকর্ষণে মানুষের নিজের স্বরূপকে ভুলে যাওয়া উচিত নয় । ভ্রমরের ন্যায় তার রসের ভোগ করা তো ঠিক আছে‌ , কিন্তু তার মধ্যে ডুবে হওয়া উচিত নয় । মন্ত্রে দেহের বিশেষতাকে বর্ণনা করেছে ❝নবদ্বারং❞ পদ (❝নবদ্বারে পুরে দেহী হংসো লেলায়তে বহিঃ। শ্বেতা০ ৩।১৮❞) । এই নয়টি দ্বার হচ্ছে- দুই চোখ , দুই কান , দুই নাসাছিদ্র , এক মুখ এবং দুই অধোদ্বার- পায়ু ও উপস্থ‌ । 
 
শরীরকে ❝ত্রিভিগুণেভিরাবৃতম্❞ গুণত্রয় দ্বারা আবৃত বলা হয়েছে , অর্থাৎ দেহ সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ এর পরিণাম । দেহে এর অধিষ্ঠাতা- চেতন আত্মা নিবাস করে । এই চেতন জীব ছাড়াও আরো একটি ❝যক্ষ❞এই দেহে ব্যাপ্ত । এই ❝যক্ষ❞ চেতন পরমাত্মা , যাঁকে ব্রহ্মজ্ঞানীরাই জানতে পারেন । দেহ-পর্যায়ী ❝পুণ্ডরীক❞ পদ কার্যমাত্রের উপলক্ষণ , অর্থাৎ এই সমস্ত ব্যক্ত জগৎ সত্ত্ব-রজ- তমোরূপ মূল-প্রকৃতির পরিণাম । মূলত দেহ-প্রতীকে আত্মা (জীব-চেতন) এর ন্যায় অখিল ব্রহ্মাণ্ডে এই যক্ষ (পরমাত্ম-চেতন) ব্যাপ্ত‌ । এভাবে এই মন্ত্রে জগতের মূল উপাদান ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির , তার ভোক্তারূপে জীবাত্মার এবং সবার নিয়ন্তারূপে পরমাত্মার স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে ।
 
❌ নিরাকার বহু কী করে হতে পারে ?
✅ কেন পারে না ? নিরাকারত্ব হলো একটা ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য । একই জাতীয় বৈশিষ্ট্য কি একাধিক বস্তুতে থাকতে পারে না ? জলই কি শুধু তরল ? তেল কি তরল নয় ? মধু কি তরল নয় ? এবং নিরাকার- নিরাকার মিক্স হওয়ার বিষয়ে ও যাদের শঙ্কা- মিক্স হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় হচ্ছে উপাদান বিদ্যমান থাকা । যেমন লবণের মধ্যে যে উপাদানের আয়নিক বন্ধ থাকে , তা জলে সহজে ভেঙে গিয়ে মিশ্রণ তৈরি হয় । কিন্তু পাথরে এরকম আয়নিক বন্ধ থাকে না এবং উপাদানগুলো কঠিন হওয়ায় জলে মিশ্রিত হয় না । তাই মিশ্রণ নিয়ে যে শঙ্কা সেটির মূলেই রয়েছে উপাদানের ব্যাপার । কিন্তু জীবাত্মার কী আলাদা কোনো উপাদান আছে ? যদি না থাকে তবে মিশ্রণের প্রসঙ্গ আসে না । জলের উপাদান H+, OH– লবণের উপাদান Na+, Cl–জলে লবণ যতই দ্রবীভূত হোক না কেন লবণের যে মূল উপাদান Na+, Cl– তা কিন্তু কখনোই জলে লুপ্ত হয়ে যায় না , সদাই বিদ্যমান থাকে । জলের আয়ন আর লবণের আয়ন দুইটাই তো আয়ন ৷ কিন্তু দুইটাই ভিন্ন । কারণ এদের বৈশিষ্ট্য আলাদা ৷ বৈশেষিকে সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্য নামের দুইটা কথা আছে ৷ আত্মা আর পরমাত্মার সাধর্ম্য বা একই ধর্ম হলো এই দুইটাই নিরাকার , সৎ , চিৎ ৷ কিন্তু র্বৈধর্ম্য বা আলাদা ধর্ম হলো এদের একটা আনন্দস্বরূপ আরেকটা নয় , একটা একদেশি আরেকটা সর্বব্যাপী । এখন যদি কেউ বলে ঘনত্বে আর বিভিন্ন গুণে তে তো পার্থক্য আছেই ? তখন তেমনি ভাবে পরমাত্মার আর জীবাত্মার অন্যগুণে পার্থক্য আছে ৷ এজন্য জল আর তেল একসাথে থাকলেও তরল হওয়ার পরও যেমন মেশে না , তেমনি আত্মা ও পরমাত্মা নিরাকার হওয়ার পরও অন্য বৈধর্ম্যের কারণে একত্রে মিশে যায় না । উভয়ে নিরাকার হলেও জীবাত্মা সর্বব্যাপী নয় ৷ 
 
একদেশিত্ব নিরাকারত্বের বাধক নয় । জীবাত্মার কোনো উপাদান কারণ না থাকায় তা সর্বদা নিরাকার ৷ আর নিরাকার হওয়ার পরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম । যেরকম ফোটন আকারবিহীন হওয়ার পরও কণারূপে গণ্য ।
এরূপ কোনো দ্রব্য নেই যাতে সগুণ-নিগুর্ণতা , অন্বয় , ব্যতিরেক , সাধ্য , বৈধ্য ও [বিশেষ্য বিশেষণ ভাব থাকে না । প্রতিটি জীবাত্মা সূক্ষ্ম দেহধারী হয় । এই সূক্ষ্ম দেহ অণুপরিমাণ ❝অণুপরিমাণং তত্কৃতিশ্রুতেঃ॥সাংখ্য ৩।১৪ ।❞ এই দেহ সৃষ্টি থেকে প্রলয় অব্দি থাকে । এবং প্রলয় কালে যখন এই সূক্ষ্ম শরীর আবার প্রকৃতিতে পরিণত হয় তখন সেই জীবাত্মা স্বীয় স্থানেই থাকে অপরের সাথে মিলে যায় না । কারণ সূক্ষ্ম দেহ ব্যাতিত জীবাত্মার গতি হয় না এবং সে কোনো প্রকার ভোগও করতে পারে না । জীবাত্মার এই অবস্থাকে নাসদীয় সূক্তে অসৎ বা অব্যাক্ত অবস্থা বলা হয়েছে । আবার নব সৃষ্টির প্রারব্ধে পরমাত্মা পূর্ব কল্পের সংস্কার যুক্ত একটি সূক্ষ্ম দেহ জীবাত্মাকে প্রদান করলে সে আবার গতিপ্রাপ্ত হয় ও জীবন ধারণ করে ভোগ করে । তাই অসংখ্য জীবাত্মা নিরাকার হওয়া সত্ত্বেও লিঙ্গ শরীরের আশ্রয়ে থাকায় ও শরীরহীন অবস্থায় অচল হওয়ায় একে অপরেরর সাথে সংমিশ্রিত হয় না ।
 
জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়েই অনাদি , সৎ এবং চিৎ । এটিই উভয়ের সাধারণ ধর্ম । কিন্তু পরমাত্মা আনন্দস্বরূপ , সর্বব্যাপক , নিরাকার , সর্বজ্ঞ , সৃষ্টিকর্তা , জীবের কর্মফলের সাক্ষী এবং কর্মফল-দাতা , বেদ-জ্ঞানের উপদেষ্টা , ন্যায়কারী, পরম-পবিত্র , সর্বশক্তিমান ইত্যাদি গুণযুক্ত । অপরদিকে জীবাত্মা পরিচ্ছিন্ন (সীমাবদ্ধ) , কর্মে স্বতন্ত্র কিন্তু কর্মফল ভোগে পরতন্ত্র, অল্পজ্ঞ এবং ইচ্ছা , দ্বেষ , সুখ-দুঃখাদি গুণযুক্ত ; প্রতিটি শরীরে ভিন্ন-ভিন্ন জীবাত্মা বিদ্যমান । 
 
♋ পরমাত্মা ও জীবাত্মার সাদৃশ্যবাচক সাধ্য ও বৈসাদৃশ্যবাচক বৈধ্য বর্ণনা - 
 
(ক) জীব ও ঈশ্বর উভয়ই চেতনস্বরূপ । উভয়েরই স্বভাব পবিত্র । উভয়ই অবিনাশী ও ধার্মিকতা আদি গুণযুক্ত । কিন্তু সৃষ্টির উৎপত্তি , স্থিতি ও প্রলয় করা , সকলকে নিয়ন্ত্রণ করা , জীবদের পাপ-পুণ্যের ফল প্রদান ইত্যাদি ধর্মযুক্ত কর্ম পরমেশ্বরের । সন্তানোৎপত্তি, সন্তান পালন , শিল্পবিদ্যা আদি উত্তম-অধম সকল জাগতিক কর্ম জীবের। নিত্য-জ্ঞান , আনন্দ , অনন্ত বল আদি গুণ ঈশ্বরের । আর ইচ্ছা , দ্বেষ , প্রযত্ন , সুখ , দুঃখাদি যে জীবাত্মার গুণ , তা ঈশ্বরের গুণ থেকে ভিন্ন ।
(খ) জীবের স্বরূপত অল্পজ্ঞ , অল্প এবং সূক্ষ্ম । আর পরমেশ্বর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম , অনন্ত , সর্বজ্ঞ এবং সর্বব্যাপক স্বরূপ । এজন্য জীব ও পরমেশ্বরের ❝ব্যাপ্য-ব্যাপক❞ সম্বন্ধ ।
(গ) জীব পরমেশ্বর থেকে স্কুল এবং পরমেশ্বর জীব থেকে সূক্ষ্ম হওয়ায় পরমেশ্বর ব্যাপক ও জীব ব্যাপ্য । জীব ও পরমেশ্বরের মধ্যে যেমন এই ব্যাপ্য-ব্যাপক সম্বন্ধ রয়েছে , তেমনি সেবক-সেব্য , আধার-আধেয় , ভৃত্য-স্বামী , প্রজা-রাজা এবং পুত্র-পিতা ইত্যাদি সম্বন্ধ আছে ।
(ঘ) পরমেশ্বরের অনন্ত জ্ঞান-আনন্দ-বল-ক্রিয়া , নির্ভান্তিত্ব ও ব্যাপকতা জীব থেকে ভিন্ন এবং জীবের অল্প-জ্ঞান , অল্প-বল , অল্প-স্বরূপ , সভ্রান্তিত্ব ও পরিচ্ছিন্নতাদি গুণ ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন । অতএব জীব ও পরমেশ্বর এক নয় ; কেননা এঁদের স্বরূপও (পরমেশ্বর অতিসূক্ষ্ম এবং জীব পরমেশ্বর অপেক্ষা কিছু স্থূল হওয়ার কারণে) ভিন্ন ।
 
💥প্রশ্ন ব্রহ্ম ও জীবের কি সর্বদা একত্ব বা বহুত্ব থাকে❓ অথবা কখনো [ব্রহ্ম ও জীব] উভয়ে মিলে এক হয়ে যায় বা যায় না❓
✅ উত্তর: সাধ্য-অন্বয়ভাব দ্বারা [জীব ও ব্রহ্মের] একতা হয়ে থাকে । যেমন- আকাশে ও মূর্ত-দ্রব্যে জড়ত্ব থাকায় এবং কখনো পৃথক না থাকায় একতা এবং আকাশের বিভূত্ব , সূক্ষ্মত্ব , অরূপত্ব , অনন্তত্ব আদি গুণ এবং মূর্ত-পদার্থের পরিচ্ছিন্নত্ব , দৃশ্যত্ব আদি বৈধ্যবশত ভেদ হয়ে থাকে , অর্থাৎ যেরূপ পৃথিব্যাদি পদার্থ আকাশ থেকে কখনো ভিন্ন থাকতে পারে না , কেননা ❝অন্বয়❞ অর্থাৎ অবকাশ ব্যতীত মূর্ত-দ্রব্য কখনো থাকতে পারে না এবং ❝ব্যতিরেক❞ অর্থাৎ স্বরূপতঃ ভিন্ন হওয়ায় [আকাশ ও মূর্ত-দ্রব্যের মধ্যে] পার্থক্য আছে । সেরূপ ব্রহ্ম ব্যাপক হওয়ায় জীব ও পৃথিব্যাদি পদার্থ তাঁর থেকে পৃথক থাকতে পারে না , আবার স্বরূপতঃ একও হয় না । যেমন , গৃহ নির্মাণ করার পূর্ব ভিন্ন-ভিন্ন দেশে মৃত্তিকা , কাষ্ঠ এবং লৌহ আদি পদার্থ আকাশেই থাকে । যখন গৃহ নির্মিত হয়ে যায় , তখনও আকাশেই বর্তমান থাকে এবং যখন তা নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ সেই গৃহের সকল অবয়ব ভিন্ন-ভিন্ন দেশকে প্রাপ্ত হয় , তখনও সেগুলো আকাশেই থাকে ; অর্থাৎ তিন কালেই আকাশ থেকে ভিন্ন হতে পারে না এবং স্বরূপতঃ ভিন্ন হওয়ায় কখনো এক ছিল না , এক নেই , আর এক হবে না । এইপ্রকারে জীব ও সংসারের সমস্ত পদার্থ পরমেশ্বরে ব্যাপ্য হওয়ায় তিন কালেই পরমাত্মা থেকে ভিন্ন থাকে না এবং স্বরূপতঃ ভিন্ন হওয়ায় কখনো এক হয় না ।
 
4️⃣▶️ আক্ষেপ:ত্রৈতবাদ মতে, "ব্রহ্ম/পরমাত্মা/ঈশ্বর নিরাকার। সর্বত্র অনুপ্রবিষ্ট। ঈশ্বর কদাপি সাকার হন না।"
উক্ত মত অনুযায়ী, ব্রহ্ম/পরমাত্মা নিরাকার এবং সর্বত্র অনুপ্রবিষ্ট। জগতের সকল পদার্থ কি বৃহৎ কি ক্ষুদ্র কি স্থূল কি সূক্ষ্ম
, সকল কিছুতে অনুপ্রবিষ্ট। সকল পদার্থের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরমাত্মা অনুপ্রবিষ্ট। এমন কোনো তিল পরিমাণ জায়গায়ও নাই যেখানে ব্রহ্মের অনুপ্রবেশ নাই।
এবার বিবেচনা করি একটা গাছ (বিবেচ্য বিষয় ত্রৈতবাদে ব্রহ্ম, প্রকৃতি/জগৎ, জীবাত্মা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বাধীন সত্ত্বা। তাই গাছ ও ব্রহ্ম/পরমাত্মা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটা সত্ত্বা)। গাছটার প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরমাত্মা অনুপ্রবিষ্ট। গাছের ভেতর বাহির সর্বত্র পরমাত্মা অনুপ্রবিষ্ট। গাছ টা বিবেচনায় আনলে গাছের বিন্দুমাত্র জায়গা খালি নাই যেখানে পরমাত্মা উপস্থিতি নাই। অর্থাৎ গাছের ভিতরে অণুতে পরমাণুতে এমনকি গাছের আত্মায়ও (জীবাত্মা) পরমাত্মা অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছেন।
এবার গাছের ভিতরে পরমাত্মার অবস্থান বিচার করুন তো। গাছটার প্রতিটা অংশে পরমাত্মা থাকলে তাহলে গাছের ভিতর পরমাত্মার যে অংশ আছে তা গাছের মত আকারই ধারণ করে আছে। এখন বিবেচনায় গাছটার ভিতরের পরমাত্মার অংশ টা আনলে পরমাত্মার ঐ অংশ গাছের আকৃতি বিশিষ্ট।
সুতরাং এই ত্রৈতবাদ দর্শন অনুযায়ী ব্রহ্ম সাকার রূপ ধারণে অক্ষম হলেও সাকার বস্তুর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে পরজীবীর মত সাকার রূপ ধারন করতে পারে। এই মতবাদ মতে দেখা যাচ্ছে ঈশ্বর এতোটাই অক্ষম যে তার অন্য সাকার বস্তু ব্যাতীত সাকার হওয়ার উপায় নাই। আবার এই ঈশ্বরই জগতকে সাকার রূপে তৈরি করতেছেন অথচ তার নিজের সাকার হওয়ার ক্ষমতা নাই!
বলিহারি! এই ত্রৈতবাদ বালকের প্রলাপ ব্যাতীত ইহা আর কি হইতে পারে!
দ্বিতীয়ত,
ত্রৈতবাদে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলা হয়। অথচ সর্বশক্তিমানের সংজ্ঞা শুনলে না হেসে পারা যায় না।
তাদের মতে সর্বশক্তিমান অর্থ যিনি সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের জন্য অন্য কারো সহায্য গ্রহন করেন না, এজন্য তিনি সর্বশক্তিমান।
বলিহারি! পাঠকগণই বিবেচনা করুন, এটা কি সর্বশক্তিমানের সংজ্ঞা নাকি অন্যের সাহায্য ব্যাতীত সৃষ্টিআদি কার্যকারীর সংজ্ঞা?
সর্বশক্তিমান বলতে তাকেই বুঝায়, সমস্ত শক্তি যার অধীনে। এখন জগতের যে সাকার হওয়ার শক্তি এটাও তার অধীনস্থ শক্তি হতে হবে। নয়তো ঈশ্বরের শক্তি সল্পতা আছে। তার সাকার হওয়ার শক্তি নাই। সে হিসেবে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলা যায় না।
আর এক্ষেত্রে সাকার হতে অক্ষম ঈশ্বর হতে জগৎ একটা গুণে এগিয়ে থাকলো। এই গুণের বিচারে জগৎ ঈশ্বর অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। 
 
💢✅প্রত্যুত্তর: ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য ও গুণ অনন্ত । তারপরেও বেদে ঈশ্বর সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি -
সৎ [ঋগ্বেদ ১।১৬৪।৪৬, ১।৬৯/১,১০।৮৫।১; যজুর্বেদ ৩২।৮৯, অথর্ববেদ ১০।৮।৬], চিৎ [ঋগ্বেদ ৪।৩১।১, ৬।৪।৩,১।৭২।১; যজুর্বেদ ৩৬।৫, অথর্ববেদ ১৮।৪।১৪], আনন্দ [ঋগ্বেদ ১০।১২১।১-১০, ৮।৪৩।১৪, যজুর্বেদ ২২।১০, অথর্ববেদ ২।১।৫, ৪।২।৪], অদ্বিতীয় [ঋগ্বেদ ১।১৬৪।৪৬, যজুর্বেদ ৩২।১, অথর্ববেদ ১৩।৪[২]।১৫-১৮], সর্বশক্তিমান [ঋগ্বেদ ৮।২৪।২১, ৮।৩২।১৫, ১০।৫৫।৬,৬।২৫।৫, ১।৫২।১২, ৫।৩৮।২, ২।৩৩।১০,১।৫৪।২; অথর্ববেদ ১০।৮।২৪; যজুর্বেদ ৪০।৮, ১৭।৭১], নিরাকার [ঋগ্বেদ ৪।১।১১, ৮।৬৯।১১ ৮।৭২।৩, ১।২৬।১৪; যজুর্বেদ ৩২।২-৪, ৪০।৮], নির্বিকার [ঋগ্বেদ ১০।১১১।৩, ৮।৪৭।৯; যজুর্বেদ ৩৪।৫৩, অথর্ববেদ ১০।৮।৪৪], সর্বব্যাপক [ঋগ্বেদ ১।৯৭।৬, ১।২২।১৭-২১, ১।১৫৪।১-২; যজুর্বেদ ৩২।৮, ৪০।১, ৪০।৮], অনাদি [যজুর্বেদ ৩২।২; ঋগ্বেদ ৮।২১।১; সামবেদ ৩৯৯, ৪০৮, ৭০৮; অথর্ববেদ ১০।৮।২২], নিত্য [ঋগ্বেদ ১০।৫৫।৬, ১।৬১।৬,৬।২৪।৭, ৬।৪।৩, ৪।৩২।১৩, ১।১৬৪।৩০; অথর্ববেদ ১০।৮।২২-২৩], জ্ঞানী তথা সর্বজ্ঞ [ঋগ্বেদ ৮।১০১।১৪, ১০।৭১।৩; যজুর্বেদ ৩২।১০], দুঃখরহিত [ঋগ্বেদ ৫।৫৪।৭], শুদ্ধ পবিত্র [ঋগ্বেদ ৮/৯৫/৭-৮, ৯।৩৫।৬, ৮।২৮/৫, অথর্ববেদ ১০।৮।৪০], সর্বেশ্বর [ঋগ্বেদ ১।৮৯।৫, ৮।৬৪।৩, ১০।৮৯/১০, ১।৩২।১৫, ১০।১২১।৩, ৮।৯৩।৩-৪, অথর্ববেদ ১৩।৩।৩], অজ [জন্ম নেই যার] [ঋগ্বেদ ১।৬৭।৩, ৬।৫০।১৪, ৭।৩৫।১৩; যজুর্বেদ ৩১।১৯, ৪০।৮, ৩৪।৫৩; অথর্ববেদ ১০।৮।৪], জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়কর্তা তথা সর্বাধার [ঋগ্বেদ ১।৫৯।১; যজুর্বেদ ৩১।১১,১৩।৪; অথর্ববেদ ১০।৭।২৭, ১০।৮।৬, ১০।৭।১-৪৩, ৪।১১।৭], [ঋগ্বেদ ১।৯৬।৭, ৬।১৫।১৩], ন্যায়কারী [ঋগ্বেদ ১।৯০।৯, যজুর্বেদ ৩৬।৯, অথর্ববেদ ১৯।৯।৬], সম্বুদ্ধির ও গুণের প্রেরক [ঋগ্বেদ ১।৭৯।১০], ব্রহ্মতেজ প্রদানকারী [ঋগ্বেদ ৯।৪৩।৪], পতিতোদ্ধারক [ঋগ্বেদ ৯।৮৬।৪৩], অন্নাদিভোগ্য প্রদাতা [ঋগ্বেদ ১।৮১।৬], তিনি অনুপম [ঋগ্বেদ ৭।৩২।২৩, ৮।৫২।২, ১০।১২।১০, ১০।৮।২৩, ৬।১৮।১২, ১৪৫২।১৩; সামবেদ ২৪২], [ঋগ্বেদ ৯।৮৬।৩৮, যজুর্বেদ ৩১।২], মোক্ষাভিলাষে । [ঋগ্বেদ ৮।৫২।৭] ঈশ্বর বল জ্ঞান ও ক্রিয়াসমূহের আধার [ঋগ্বেদ ৯।৮৬।৩৯], [ঋগ্বেদ ১।৫১।৮], ধর্মকার্যের অধ্যক্ষ [ঋগ্বেদ ১।১।৬], দণ্ডদাতা [ঋগ্বেদ ১।৯৪/৯]
 
অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা পশ্যত্যচক্ষুঃ স শূণোত্যকর্ণঃ। 
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্ ॥
পদার্থঃ (সঃ) সেই পরমাত্মা (অপাণিপাদঃ) হস্ত-পদাদি রহিত হয়েও (গ্রহীতা) নিজের অনন্ত শক্তি দ্বারা সবকিছু গ্রহণ অর্থাৎ ধারণ করেন [এবং] (জবনঃ) সর্বব্যাপক হওয়ার কারণে সর্বাধিক বেগবান (অচক্ষুঃ) চক্ষু-রহিত হয়েও (পশ্যতি) যথাযথ দর্শন করেন (অকর্ণঃ) কর্ণ- রহিত হয়েও (শূণোতি) সবই শ্রবণ করেন (সঃ) তিনি (বেদ্যং) সমস্ত জ্ঞাতব্য বিষয় (বেত্তি) জানেন (চ) অথচ (তস্য) তাঁর (বেত্তা) জ্ঞাতা (ন অস্তি) কেউ নেই। [এজন্য জ্ঞানিগণ] (তম) তাঁকে (অগ্রগ্র্যম) সর্বাগ্রণী (মহান্তম) সর্বাপেক্ষা মহান (পুরুষম) পুরুষ (আহুঃ) বলেন ।
 
এই শ্রুতিবাক্যে স্পষ্টতঃভাবে পরমাত্মার ইন্দ্রিয়ের প্রতিষেধ করা হয়েছে । পরমেশ্বর চক্ষু-কর্ণাদি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও হস্ত-পদাদি কর্মেন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়াই গ্রহণ , দর্শন‌ , শ্রবণাদি কার্য সিদ্ধ করতে পারেন , আর এটিই তাঁর সর্বশক্তিমত্তা । ❝সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্ ❞ ॥ (গীতা ১৩।১৫)” অর্থাৎ “সেই ব্রহ্ম চক্ষুরাদি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের গুণসমূহ প্রকাশিত করেন , অথচ তিনি স্বয়ং সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত ।
 
তবে তার আকার নিরূপণ কীভাবে হবে ? পরমাত্মা যেমন চিত্রে দেখানো গাছের ভিতরে আছেন , তেমনি গাছের বাইরেও একই ভাবে আছেন , জগতের বাইরেও আছেন ❝য়ৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ❞তাই গাছের ভিতরে পরমাত্মাকে নিবন্ধ করার মতন হাস্যকর আর কিছু নেই । আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করুন । মন্ত্রে বলা হয়েছে❝ স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বা ❞। এখানে স্পষ্টই পুরুষ ভিন্ন অপর বস্তুর কথা বলা হয়েছে , এবং সেই অপর বস্তুর কী ❝ভূমিম্ ❞ ভূবন । এখানেও ত্রৈতবাদের সিদ্ধি হচ্ছে ।
 
তাই পরমাত্মার সাথে ❝অক্ষম❞ বিশেষণ যুক্ত করে পরমাত্মার কপোলকল্পিত সাকার হওয়ার যুক্তি ধূলিসাৎ হলো । পরের লাইনেই তিনি বলেছেন নিরাকার পরমাত্মা সাকার জগৎ তৈরি করলো কীভাবে।? উত্তরও সহজ পরমাত্মা সাকার বস্তু প্রকৃতি থেকেই সাকার জগৎ তৈরি করেছেন । হে ঈশ্বর তুমি নিজেকে হত্যা করতে পারো না‌‌ , এটা বলা যেমন মূর্খতা , তেমনি হে ঈশ্বর তুমি সাকার হতে পারো না, এটা বলাও তেমন মূর্খতা । উভয়ই পরমাত্মার নিষ্প্রয়োজন । যদি ঈশ্বর নিরাকার হন‌ , তবে সৃষ্টি কী করে সাকার হয় ? এই প্রশ্ন তখন আসবে যদি ঈশ্বরই জগতের উপাদান হন , যেমন সোনার অলংকারের উপাদান সোনা , লোহার পেরেকের উপাদান লোহা । সোনা ও লোহার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অলংকার ও পেরেকের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় । যদি ঈশ্বরকে উপাদান কারণ মানা যায় , তো এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য । পরন্তুঃ ঈশ্বর নিমিত্ত কারণ ❝আদিঃ স সংয়োগনিমিত্তহেতুঃ শ্বেতা০ ৬।৫❞ উপাদান কারণ নয় । যদি মাটির কলসের নির্মাতা কুমার হন‌‌ , তো কুমারের সাথে মাটির কলসের বৈশিষ্ট্য মিল থাকার আবশ্যকতা নেই । কুমারের স্বরূপ আর মাটির কলসির স্বরূপ আলাদা । অতঃ প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধের ন্যায় কুযুক্তি খণ্ডিত হলো ।
 
সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের শক্তির বিশেষণ শুনে দেখছি শ্রীমান প্রলাপ বকছেন । তা তাদের জগত গুরু আচার্য বা এই জগতের কোনো জীব কী সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশের ক্ষমতা রাখেন ? কেউই প্রকৃতিকে আবার ত্রিগুণের সাম্যাবস্থায় নিয়ে যেতে পারবেন‌ ? কেউই পারবেন না । এমনকি মুক্তাত্মাও পারেন না । একমাত্র পরমাত্মাই এই কার্য সম্পাদন করতে পারেন । সর্বশক্তিমান মানে যথেচ্ছাচারী নন ঈশ্বর সদা একরস , অপরিবর্তনীয়, ধ্রুব , শাশ্বত , বিকারহীন , সর্বব্যাপী , সর্বশক্তিমান, পূর্ণকাম , সর্বজ্ঞ , সর্বদ্রষ্টা , নিত্য , সর্বাধার আদি গুণ রয়েছে । বিকারশীল বস্তুর তথা জড়া প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে , কিন্তু পরমাত্মায় ভোগ ও তা থেকে জন্ম নেওয়া কাম থাকে না‌ , বিকার আসে না ।
 
আর ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হবার সাথে তার সাকার হবার কোন সম্পর্ক নেই । ঈশ্বর সর্বশক্তিমান , তিনি কি আত্মহত্যা করতে পারেন ? তিনি কি এমন কোন পাথর তৈরী করতে পারেন যার ভার তিনি নিজেই উত্তোলন করতে পারেন না ? উত্তর হলো না , তিনি এগুলো করতে পারবেন না । কারণ এগুলো ঈশ্বরের শাশ্বত বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে । সর্বশক্তিমান শব্দের অর্থ সব ই করতে পারা নয় । ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এর অর্থ হলো ঈশ্বর বিনা সাহায্যে এবং বিনা ক্লেশে নিজ শাশ্বত বৈশিষ্ট্য ও নিয়ম অনুযায়ী মহাবিশ্ব পরিচালনা করতে পারেন । সর্বশক্তিমান অর্থ যদি সকল কিছু করতে পারার ক্ষমতা হয় তবে তাকে শুধুমাত্র সাকার কেন ? ব্যাভিচারী‌ , হত্যাকারী , অন্যায়কারী , অজ্ঞানী হতে হবে । নয়তো শ্রীমান কূপমূণ্ডকের দৃষ্টিতে পরমাত্মা সর্বশক্তিমান হতে পারেন না । কিন্তু এর উল্টোটাও বলা যেতে পারে , সামান্য কার্য সম্পাদন করতে যার স্বরূপের পরিবর্তন করতে হয় , নিরাকার হতে সাকার হতে হয় , সে কীভাবে সর্বশক্তিমান হতে পারে ? বস্তুতঃ ঈশ্বর কারোর কথা মতন চলতে বাধ্য নন । 
 
🌼 অতঃ মায়াবাদীগণ যে সর্বদা ভ্রান্ত কল্পনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত এবং অবৈদিক মান্যতা বৃথা প্রদর্শন করার প্রয়াস করে তা সহজেই অনুমেয় । ছয় অনাদি পদার্থের সত্তা মেনে প্রকারান্তর দ্বারা ব্রহ্ম থেকে অতিরিক্ত অন্য তত্ত্বের সত্তাকে স্বীকার করে নেন । বস্তুতঃ পূর্বাপর প্রসঙ্গকে না দেখে কোন শব্দ বা বাক্যের অর্থ সঠিকভাবে জানা যেতে পারে না । নবীন বেদান্তীদের মহাবাক্য নামে অভিহিত কিছু এরূপ বাক্য আছে , যার আধারে তারা জীব ও ব্রহ্মের একতার প্রতিপাদন করার প্রচেষ্টা করেন । বাস্তবে সেসব ভাবোদ্রেকে তাৎস্থ্যোপাধি , তৎসহ-চরিতোেপাধি অথবা তাদাত্ম্যভাবে বলা বচনমাত্র । দর্শনে বুদ্ধি তত্ত্ব প্রধান হয় , কাব্যে রাগাত্মক তত্ত্ব । উপনিষদে রাগাত্মক তত্ত্বের প্রাধান্যের কারণে বর্ণন-শৈলীতে অলংকারের প্রাচুর্য থাকায় লক্ষণা ও ব্যঞ্জনার প্রাচুর্য রয়েছে । পরিণামস্বরূপ দর্শন ও উপনিষদে বস্তুর উপস্থাপনা একে অন্যের থেকে ভিন্ন ।উপনিষদের নিজস্ব এক বিশিষ্ট শৈলী আছে । জীব ও ব্রহ্মের অভেদ ভাবনার সংকেত অনেক স্থলে পাওয়া যায় । কিন্তু সেসব লৌকিক প্রয়োগের ন্যায় ব্রহ্মের অতিশয় মহত্ত্বকে অথবা ব্রহ্মানন্দে লীন জীবাত্মার ভাবাবেশকে ব্যক্ত করে । কাব্যাত্মক অভিব্যক্তির তরঙ্গে ঔপচারিকরূপে বিবৃত বাক্যসমূহকে যথাতথ্য গ্রহণ করে ওইরূপ সন্দর্ভকে আপাতত দৃষ্টিতে প্রতীয়মান অর্থকে মেনে মধ্যকালীন আচার্যগণ তথাকথিত অদ্বৈতবাদের বিশাল ফাঁপা ভবন দাঁড় করিয়েছেন যেটা কিনা বৈদিক সিদ্ধান্ত নয় এবং কপোলকল্পিত ।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)