বেদোক্ত কর্মের উত্তমতা বিষয়ে বলা হচ্ছে —
কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ।
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোঽস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে॥ যজুর্বেদ ৪০.২
অর্থাৎ, মনুষ্যগণ আলস্য পরিত্যাগ করে সর্বদ্রষ্টা, ন্যায়াধীশ পরমাত্মা এবং পালনযোগ্য তাঁর আজ্ঞা মেনে চলে, শুভ কর্ম করে এবং অশুভ কর্মকে পরিত্যাগ করে, ব্রহ্মচর্যের দ্বারা বিদ্যা ও সুশিক্ষা লাভ করে, উপস্থেন্দ্রিয়ের সংযম দ্বারা বীর্য বৃদ্ধি করে, অকাল মৃত্যুকে প্রতিহত করবে এবং যুক্ত আহার-বিহারের দ্বারা শতবর্ষ আয়ু প্রাপ্ত করবে। যেমন যেমন মনুষ্য সুকর্মে চেষ্টা করে, সেরূপ পাপকর্ম থেকে তার বুদ্ধি নিবৃত্ত হতে থাকে। এর ফলস্বরূপ তার বিদ্যা, আয়ু ও সুশীলতা বৃদ্ধি পায়।
মহর্ষি দয়ানন্দ বলেছেন,
যারা এরূপে পরমেশ্বরের ওপর নির্ভর করে অলসভাবে বসে থাকে, তারা মহামূর্খ। কারণ পরমেশ্বর পুরুষার্থ করার যে আদেশ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি তা লঙ্ঘন করে, সে কখনো সুখী হতে পারে না। যথা— “কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ। (যজু০ ৪০।২)” অর্থাৎ পরমেশ্বর আজ্ঞা দিচ্ছেন যে, মানুষ শতবর্ষ পর্যন্ত তথা আজীবন কর্ম করতে করতে জীবন-ধারণের ইচ্ছা করবে, কখনো অলস হবে না (সত্যার্থ প্রকাশ, সপ্তম সমুল্লাস)
বৈদিক কর্মের প্রধানতা— মনুষ্য এই সংসারে বৈদিক নিষ্কাম কর্ম (অগ্নিহোত্রাদি) করতে করতেই শতবর্ষ জীবিত থাকার ইচ্ছা করবে। তাৎপর্য এই যে, মনুষ্য আলস্য পরিত্যাগ করে সর্বদ্রষ্টা, ন্যায়াধীশ পরমাত্মাকে ও পালনযোগ্য তাঁর আজ্ঞা মেনে শুভ কর্ম করে এবং অশুভ কর্মকে ত্যাগ করে, ব্রহ্মচর্য দ্বারা বিদ্যা ও উত্তম শিক্ষা প্রাপ্ত হয়ে, উপস্থেন্দ্রিয়ের (জননেন্দ্রিয়ের) সংযম দ্বারা বীর্য বৃদ্ধি করে অল্পায়ুকে প্রতিহত করবে। উপযুক্ত আহার-বিহার দ্বারা শতবর্ষ আয়ু প্রাপ্ত করবে। এভাবে বৈদিক (ধর্মযুক্ত) কর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার কারণে মনুষ্য নিজের মনোরথ দ্বারা অবৈদিক (অধর্মযুক্ত) কর্মে লিপ্ত হয় না। মনুষ্য যখন বৈদিক কর্মে প্রবৃত্ত হয়, তখন পাপকর্ম থেকে তার বুদ্ধি নিবৃত্ত হতে থাকে এবং তার বিদ্যা, আয়ু ও সুশীলতা বৃদ্ধি পায়। এই বৈদিক কর্ম ছাড়া অন্য কোনো পথে মনুষ্য কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না॥২॥
যজুর্বেদ ৪০.১ শ্রতিতে বলা হয়েছে যে, সংসারের ভোগ ত্যাগপূর্বক করা উচিত, নিজেকে ভোগের মধ্যে নিমজ্জিত করা অনুচিত। কারণ বিশ্বে যা কিছু আছে, তা মানুষের জন্য ঈশ্বরের দান, মানুষের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ঈশ্বরকে সবাইকে এই উপহার দিয়েছেন। তাই বলে এই সবকিছুকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করা উচিত নয়। দানের ভাবনা, ত্যাগের ভাবনা নিয়ে ভোগ করা উচিত। এখন প্রশ্ন হতে পারে, একজন মানুষ কর্ম করে যা লাভ করেছে, তা যদি অন্যদের দান করতে হয়, ত্যাগ করতে হয়, তাহলে কেন সে কর্ম করবে? কেননা, কর্ম করা হয় প্রাপ্তির জন্য, হারানোর জন্য নয়। যদি সংসারে ত্যাগপূর্বক বাঁচতেই হয়, যদি সংসারে লিপ্ত না-ই হতে হয়, তাহলে সে কেন কর্ম করবে? কারণ কর্ম না করলে প্রাপ্তি হবে না, আর প্রাপ্তি না হলে লিপ্তও হতে হবে না। আর লিপ্ত না হলে নিজের জীবন ত্যাগপূর্ণ হবে। তাহলে কর্মের ত্যাগ কেন নয়? এর উত্তর হচ্ছে, উপনিষদ্ ত্যাগের উপদেশ দিয়েছে, কিন্তু কর্মকে ত্যাগ করার উপদেশ দেয়নি। এ কথাকে বোঝার জন্য কিছু বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন—
(ক) কর্ম কখনো ত্যাগ করা যায় না— প্রথমত এই বিষয়টি বুঝতে হবে যে, একজন মানুষ যতই চেষ্টা করুক না কেন, সে কর্ম ছাড়া বাঁচতে পারবে না। কর্ম হলো সৃষ্টির প্রাণ। স্থাবর-জঙ্গমাত্মক এই জগতের সর্বত্রই কর্ম সম্পাদিত হচ্ছে। উদ্ভিদ বেড়ে ওঠছে, ফুল ফুটছে, ফুলের সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, ফল পরিপক্ব হচ্ছে, ছোট ছোট পিপীলিকা পর্যন্ত তাদের খাবার সংগ্রহ করছে। অর্থাৎ ছোট-বড় প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে যা ঘটছে তা মানুষের ক্ষেত্রেও ঘটছে। মানুষও প্রকৃতির নিয়মে আবদ্ধ, তাই সে কর্মকে ত্যাগ করতে পারে না। আর কর্ম হচ্ছে প্রত্যেক জীবের স্বভাব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন— “ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ। কার্য়তে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ॥ (গীতা ৩।৫)” অর্থাৎ “কর্ম না করে কেউ এক মুহূর্তের জন্যও অবস্থান করতে পারে না। কারণ সকলেই প্রকৃতিজাত গুণত্রয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অস্বতন্ত্ররূপে কর্ম করতে বাধ্য হয়।” এজন্য কর্ম করতেই হবে, কর্ম করেই বাঁচতে হবে। কেউই কর্ম থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে না, কর্ম ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। তাই উপনিষদ্ বলছে— “কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেৎ” = মানুষ কর্ম করেই বেঁচে থাকার ইচ্ছা করবে। কারণ কর্ম না করে বেঁচে থাকা অসম্ভব। একটি প্রসিদ্ধ নীতিবাক্য আছে, যথা— “আলস্যং হি মনুষ্যাণাং শরীরস্থো মহান্ রিপুঃ। নাস্তি উদ্যমসমো বন্ধুঃ য়ং কৃত্বা নাবসীদতি॥” অর্থাৎ মনুষ্য শরীরে অবস্থিত ‘আলস্য’ এক বড় শত্রু। অন্যান্য শত্রু তো আমাদের শরীরের বাইরে থাকে, আমাদের থেকে পৃথক থাকে, কিন্তু আমাদের শরীরের ভেতরেই অনেক বড় একটি শত্রু আছে, যার নাম ‘আলস্য’। সেই সাথে আরও বলা হয়েছে, “নাস্তি উদ্যমসমো বন্ধুঃ” অর্থাৎ উদ্যম = পুরুষার্থের সমান আমাদের কোনো মিত্র নেই। যারা পুরুষার্থ না করে কেবল ঈশ্বরের ওপর ভরসা করে অলসভাবে বসে থাকে, তারা জীবনে সফল হতে পারে না।
(খ) যদি কর্ম করেই বেঁচে থাকতে হয়, তাহলে কীভাবে কর্ম করতে হবে— উপনিষদ্ বলেছে, যতদিন কোনো মানুষ বাঁচতে চায়, ততদিন পর্যন্ত তাকে কর্ম করতেই হবে। আমাদের হাতে শুধু কর্মই আছে, সেটি শুভ হোক কিংবা অশুভ। অশুভ কর্ম করলে অশুভ ফলই লাভ হয়; তাই অশুভ কর্ম করার অনুপ্রেরণা বেদ ও উপনিষদ্ থেকে পাওয়া যায় না। কর্ম যদি করতেই হয়, তবে শুভ কর্ম করুন। আর সেই কর্ম হচ্ছে, ‘বেদোক্ত নিষ্কাম কর্ম’ যা নিজের ও অন্যের কল্যাণ সাধন করে। শ্রুতিতে ‘এবং’ শব্দটি অবধারণার্থে এসেছে, যা কর্মকে নিষ্কামভাবে সম্পন্ন করতে বোধ করায়। এখন আমাদের জানা উচিত এই নিষ্কাম কর্ম ও সকাম কর্ম কী? কর্ম করা আলাদা বিষয় এবং সকাম কর্ম, নিষ্কাম কর্ম এগুলোর বিষয়ে জ্ঞাত হওয়া আলাদা বিষয়। সকাম কর্ম হচ্ছে, যে কর্মের মাধ্যমে আমরা সাংসারিক সুখ ভোগের আকাঙ্ক্ষা করে থাকি। অর্থাৎ সাংসারিক ভৌতিক পদার্থ থেকে সুখ প্রাপ্তির অভিলাষী হয়ে কর্ম করাকে সকাম কর্ম বলা হয়। তা ধন হোক, অথবা সম্মান; পুত্র-পরিবার হোক, অথবা পদ-প্রতিষ্ঠা, যাই হোক না কেন, এদের মাধ্যমেই যদি আমাদের সুখ লাভের ইচ্ছা থাকে, তা-ই সকাম কর্ম। এর বিপরীতে যদি আমরা ফলের চিন্তা না করে, শুধু ঈশ্বরের সন্তুষ্টি এবং তাঁর বেদোক্ত আজ্ঞা পালনের জন্য কর্ম করি, তখন সেই কর্মকে নিষ্কাম কর্ম বলা হয়। আমরা যে কর্ম করি, সেই কর্ম সকাম কর্মও হতে পারে, আবার নিষ্কাম কর্মও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি একটি সৎসঙ্গ ভবনে, যজ্ঞশালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন, আপনার মনে যদি এমন ভাবনা থাকে, “আমি এই কক্ষ পরিষ্কার করছি, এখানে লোকজন আসবে, বসবে, তারা আনন্দিত হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেখে তাদের চিত্ত প্রসন্ন হবে।” তাদের প্রসন্ন করার জন্য আপনি মেঝে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেছেন। আপনার এই কর্ম নিষ্কাম কর্মের আওতাভুক্ত। এই কর্মই সকাম হয়ে যাবে, যদি আপনি মনে চিন্তা করেন, “আমাকে দেখে লোকেরা প্রশংসা করুক। তারা বলুক যে, আমি অনেক ভালো কাজ করেছি।” এই ভাবনা মনে আসা মাত্রই ওই কর্ম সকাম কর্মে পরিণত হয়ে যায়। একই কর্ম নিষ্কাম হতে পারে, যখন আমরা এর বিনিময়ে অন্যের থেকে কোনো কিছুর আশা না রাখি, মোক্ষ কামনা করি, বিবেক-বুদ্ধি কামনা করি। কিন্তু যদি আপনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন যে, “আমি এত সেবা করছি, এত পরোপকার করছি, এর বিনিময়ে লোকেরা আমাকে সম্মান করুক, আমার এই উপলব্ধি হয়ে যাক, আমি যেন এই পদ প্রাপ্ত হই”, তবে এসব সকাম কর্ম বলে গণ্য হবে। ঈশ্বর আদেশ করেছেন— “কুর্বন্-এব-ইহ কর্মাণি” = হে মনুষ্য! তোমরা সেবা, দান, পরোপকার, অগ্নিহোত্রাদি নিষ্কাম কর্ম করবে। আমরা ঈশ্বরের এই আদেশ মেনে পরোপকার, সেবামূলক কার্য করলে, তা নিষ্কাম কর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু এই কর্মকেই যদি আমরা কোনো সাংসারিক বিষয় ভাবনায় সম্পাদন করি এবং পরিণামে ধন, মান, যশ ইত্যাদি পেতে ইচ্ছা পোষণ করি, তবে তা সকাম কর্মে পর্যবসিত হবে। এখন আপনি বলতে পারেন, কোনো ব্যক্তি নিষ্কাম কর্ম করে, তারও তো খাওয়ার জন্য অন্ন, পরিধানের জন্য বস্ত্র, বাসের জন্য গৃহ প্রয়োজন; সে এসব কামনা করবে না কি করবে না? কামনা করা মাত্র কর্ম সকাম অথবা কামনা পরিত্যাগ করা মাত্রই কর্ম নিষ্কাম হয়ে যায়, এমন কোনো কথা নেই। কর্মের সঙ্গে আমাদের ভাবনা সম্পৃক্ত হতে হয়। আমার ক্ষুধা লেগেছে, অন্যের কাছে খাদ্যদ্রব্য চাইলাম, তো এটি সকাম কর্ম হয়ে গেল? না। কিন্তু যখন আমি বলব “আমি আপনাকে পাঠদান করেছি, এর বিনিময়ে আমাকে কিছু খেতে দিন” তখন তা সকাম কর্ম হবে। আমি আপনাকে পড়িয়েছি, তাই আপনার কাছে খাদ্য চাচ্ছি। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি, এখন আমার প্রতি আপনারও কিছু কর্তব্য রয়েছে, কিন্তু আপনি তা পালন করেননি— যা এ ধরনের ভাবনার সঙ্গে যুক্ত, তা সকাম কর্ম। ভোজনের জন্য খাদ্যদ্রব্য চাওয়ার অধিকার ব্রহ্মচারী এবং সন্ন্যাসীরও রয়েছে। নিজের ক্ষুধা নিবারণের জন্য কোনো ধার্মিক ব্যক্তির নিকট খাদ্য চাওয়া দোষাবহ নয়।
আপনি যখন কর্ম করবেন তখন পরীক্ষা করবেন যে, “আমি এই কর্ম আবেগের সাথে করছি? না কি অনিচ্ছাকৃতভাবে?” আপনি যে কর্মটি করছেন, তা নিষ্কাম কি না সেটি বোঝার মাপকাঠি হলো— এর মধ্যে ত্যাগের ভাবনা আছে কি না, এই কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবেন কি না। কেননা, সংসারের সকল বিবাদের কারণ ‘আসক্তি’। একজন ব্যক্তি যত বেশি আসক্তি ও মোহে আবদ্ধ হয়, ততই সে তার স্বত্ব হারিয়ে ফেলে। কর্মের ফল তো ঈশ্বরের ন্যায়-ব্যবস্থা দ্বারা অবশ্যই লাভ করবে, তাহলে এই ফলের চিন্তা করে শ্রান্ত হওয়া বৃথা। এজন্য মানুষের উচিত, সদা নিষ্কাম কর্মে প্রবৃত্ত থাকা। যদি আপনি কাউকে দান করেন, তাহলে তা কর্তব্য ভাবনা দ্বারা যথাসাধ্য দান করবেন, এটিই নিষ্কামতা। কিন্তু যদি দান করার পর তার ফলস্বরূপ নিজের প্রশংসা, খ্যাতি, সংবাদপত্রে নাম, সমাজে উঁচু আসন লাভের ইচ্ছা করেন, তাহলেই কর্মে সকামতা চলে আসে। সকামতা আসার কারণে ব্যক্তি তার কর্মের ফলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। কর্মফলে আসক্ত হওয়ার পরিণামস্বরূপ তিনি অধিক থেকে অধিক স্নেহ-সম্মান, যশ-কীর্তি প্রভৃতি পেতে চান। যদি তিনি তার ইচ্ছানুযায়ী দান গ্রহীতাদের থেকে সেগুলো না পান, তাহলে তাদের প্রতি ক্রোধ ও অবহেলা করতে শুরু করেন, ভবিষ্যতে তাদের উপকার করা থেকে বিরত থাকেন।
এজন্য মানবজাতির প্রতি বেদের আদেশ হচ্ছে— মনুষ্য নিজের কৃতকর্মের ফল প্রভুকে সমর্পণ করে, সদা কর্তব্য-ভাব দ্বারা ধর্মযুক্ত কর্ম করবে। কর্ম করতে কখনো প্রমাদ করবে না, কখনো আলস্য করবে না।
(গ) নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে শত বছর বেঁচে থাকার সংকল্প করবে— সবাই বাঁচতে চায়, কেউ মরতে চায় না। বৃদ্ধ হওয়ার পরও জীবনের আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়, অসুস্থ হয়েও মানুষ বাঁচতে চায়। যখন বেঁচে থাকার ইচ্ছা এত প্রবল, তখন বাঁচতে হলে, একশ বছর বেঁচে থাকুন। যজুর্বেদে (৩৬।২৪) বলা হয়েছে— “জীবেম শরদঃ শতম্”; ঈশোপনিষদ্ বলেছে— “জিজীবিষেৎ শতম্”। একজন কর্মযোগীর মৃত্যু হলো একটি পাকা ফলের মতো, যা নিজেই জীবনের সম্পূর্ণ রস গ্রহণ করে মাটিতে পতিত হয়। এই ধরনের মানুষ মৃত্যুবরণ করেন না, তাদের জীবন সম্পূর্ণ হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা বলেন, “Soldiers never die, they whither away.” অর্থাৎ সৈনিকরা কখনো মারা যায় না, তারা দূরে কোথাও চলে যায়। অনুরূপভাবে, একশো বছর বয়সে মৃত্যু হওয়া মানে জীবনের পূর্ণ রস উপভোগের পর পরিপক্ব হয়ে মৃত্যু। উপর্যুক্ত শ্রুতির লক্ষ্য, এই ধরনের জীবন যেন প্রত্যেক মানুষ লাভ করতে পারে। বৈদিক আদর্শ হলো এমন একটি জীবন অতিবাহিত করা, যার মধ্যে কোনো ব্যক্তি যতটা সম্ভব বাঁচতে পারে এবং ধর্মযুক্ত কর্মের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে পারে। কেননা, যখন তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, তখন সবাই যেন বলতে পারে যে, তাঁর জীবন ছিল এক আদর্শ কর্মযোগীর জীবন। তিনি যে কর্ম করেছেন, তা নিষ্কামভাবে, নির্লিপ্তভাবে এবং ত্যাগের ভাব দ্বারা করেছেন। যারা এইরকম জীবন যাপন করেন, তাদের জন্য এই উপনিষদ বলছে— “এবং ত্বয়ি নান্যথেতোঽস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে” অর্থাৎ যে ব্যক্তি কর্ম করার সময় ত্যাগের ভাব দ্বারা কর্ম সম্পাদন করেন, তিনি মোহ-মায়ার জাল থেকে মুক্তি লাভ করেন, তিনি কর্মের আবরণে লিপ্ত হন না। আর মানুষের এজন্যও নিরন্তর কর্ম করতে থাকা উচিত, যাতে সে নির্মল থাকতে পারে। কারণ যে নদীতে নিরন্তর গতি নেই, সতত প্রবাহ নেই, সেই নদীর জল মলিন হয়, পানের অযোগ্য হয়। তদ্রূপ এই মানব জীবনেও যদি গতি না থাকে, প্রবাহ না থাকে; তাহলে শরীর অলস, নিস্তেজ হয়ে পড়ে। যার ফলে মানুষ শীঘ্রই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। যদি তিনি কোনোভাবে বেঁচেও থাকেন, তাহলে সমাজের জন্য ভারস্বরূপ ও নিন্দার পাত্র হন। অকর্মা হওয়ার ফলে তার মন ও মস্তিষ্ক কুচিন্তার আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। অতএব, নিরন্তর কর্ম করার মধ্যেই জীবনের সৌন্দর্য নিহিত। এতে করে যেমন মানুষের নিজের লাভ হয়, তেমনি সমাজেরও লাভ হয়। তাঁর সর্বত্রই স্নেহ, সম্মান, যশ, কীর্তি প্রাপ্তি হয়।
(ঘ) সংসারে থাকাকালীন সংসার থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব?— এবার প্রশ্ন হতে পারে যে, মানুষের পক্ষে সংসারে বাস করা এবং এর জাল থেকে মুক্ত থাকা অর্থাৎ কাদায় বসবাস করা এবং এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, এটি সম্ভব কি না? এর উত্তর হচ্ছে— হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব। মনে করুন, কোনো একটি ঐতিহাসিক নাটক মঞ্চে চলছে। অভিনেতা সেই ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয় করছেন। যখন তিনি অভিনয় করছেন, তখন তিনি কিন্তু ভেতর থেকে বাইরে ঘটে যাওয়ার ঘটনার সাথে একাত্ম নন। এভাবে যতক্ষণ না আমরা বাইরের ঘটনাগুলোর সাথে আমাদের একত্ব প্রতিষ্ঠা করি, ততক্ষণ ঘটনা আলাদা, আমরা আলাদা। যদি সেই ঐতিহাসিক চরিত্র (ব্যক্তি) সত্যিই উপস্থিত থাকতেন, তাহলে বাইরের ঘটনা থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারতেন না। বাহ্য-বিষয়সমূহ থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারাই জীবনের শিল্প। এজন্যই উপনিষদ বলেছে, কর্ম করার সময় কর্মে লিপ্ত না হওয়ার উপায়ই হলো “তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ” এর পথ। একেই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে, “পদ্মপত্রমিবাম্ভসা; (গীতা০ ৫।১০)” অর্থাৎ যেরূপ পদ্মপত্র জলে থাকলেও জলের দ্বারা সিক্ত হয় না, তদ্রূপ এই সংসারে বাস করেও কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত থাকার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা ।
সন্দর্ভঃ উপনিষদ্ সংগ্রহ - ১
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর