“শ্রীকৃষ্ণ” এই নামটি শুনতে যেমন শ্রুতিমধুর তেমনি এই নামধারীর দর্শনও চক্ষুদ্বয়কে আনন্দ দিতো। আর তাই তো হস্তিনাপুরে শ্রীকৃষ্ণ যখন যুদ্ধের বদলে সন্ধি ও শান্তির বার্তা নিয়ে আসবেন এমন সংবাদ রাজা ধৃতরাষ্ট্র পেয়েছিলেন তখন তিনি পরম আনন্দে বলেছিলেন—
চক্ষুষ্মতাং বৈ স্পৃহয়ামি সঞ্জয় ! দ্রক্ষ্যন্তি যে বাসুদেবং সমীপে।
বিভ্রাজমানাং বপুষা পরেণ প্রকাশয়ন্তং প্রদিশা দিশশ্চ ॥৬২॥
[উদ্যোগপর্ব- ৬৬/৬২]
=> (ধৃতরাষ্ট্র): হে সঞ্জয়! যারা শ্রীকৃষ্ণকে অতি নিকট থেকে দর্শন করবেন আমি সেই দর্শনার্থীদের সৌভাগ্য কামনা করি। কারণ শ্রীকৃষ্ণ পরমসুন্দর দেহ দ্বারা বিরাজিত এবং নিজের কান্তি দ্বারা তিনি দ্বিগ্বিদিক্ আলোকিত করবেন।
রাজা ধৃতরাষ্ট্র কেবল এতটুকু বলেই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি ঘোষণা করলেন —
সস্ত্রীপুরুষ বালঞ্চ নগরং মধুসূদনম্। উদীক্ষতাং মহাত্মানং ভামনুন্তমিব প্রজা॥১৭॥
[উদ্যোগপর্ব- ৮০/১৭]
=> (ধৃতরাষ্ট্র) : মানুষ যেমন সূর্যকে দর্শন করে তেমনি নগরের স্ত্রী,পুরুষ,বালকেরা শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করুক।
তাই শ্রীকৃষ্ণ যেদিন হস্তিনাপুরে এসেছিলেন সেদিন একটিবার তাঁর দর্শন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সকল প্রজা গৃহ ছেড়ে রাজপথে ভিড় করেছিল।
ন চ কশ্চিদ্ গৃহে রাজংস্তদাসীদ্ভরতর্ষভ।
ন স্ত্রী ন বৃদ্ধো ন শিশুর্বাসুদেবদিদৃক্ষয়া॥৮॥ [উদ্যোগ পর্ব -৮২/৮]
=> শ্রীকৃষ্ণ যখন হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলেন তখন তাঁকে দেখবার ইচ্ছায় বালক,বৃদ্ধ, স্ত্রী কেউই আর ঘরের ভিতর ছিল না।
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করার জন্য এতো উৎসুক কেন ছিল সবাই? সত্য ও সৌন্দর্যের পূজারী যারা তাদের কাছে এপ্রশ্ন বাহুল্য মাত্র। যোগেশ্বরের রূপসৌন্দর্যের বর্ণনা শ্রবণ করলে আমার পূর্বোক্ত কথার যথার্থতা উপলব্ধি করতে আপনাদের কষ্ট হবে না। শ্লোকাংশ ও শ্লোক উদ্ধৃত করা হলো:
❝কৃষ্ণমায়ন্তং প্রসন্নাদিত্যাবর্চ্চসম্।❞
=> শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন সূর্যের ন্যায় প্রসন্ন নির্মল তেজযুক্ত। [উদ্যোগ পর্ব - ৮৩/২]
❝উদ্যন্মেঘস্বনঃ কালে প্রগৃহ্য বিপুলং ভুজম্।❞
=> শ্রীকৃষ্ণের স্বর ছিল সজল মেঘের ন্যায় অথচ গম্ভীর ধ্বনিযুক্ত। তাঁর ভূজদ্বয় ছিল বিশাল।
[উদ্যোগ পর্ব - ৮৪/১৭]
❝বাক্যমভ্যাদদে কৃষ্ণঃ সুদংষ্ট্রো দুন্দুভিস্বনঃ।❞
=> সুন্দরদম্ভশালী ও দুন্দুভির ন্যায় মধুরধ্বনি যুক্ত শ্রীকৃষ্ণ সভামধ্যে কথা বলতে শুরু করলেন।
[উদ্যোগ পর্ব - ৮৮/১]
❝রাজীবনেত্রঃ❞
=> শ্রীকৃষ্ণের চক্ষুদ্বয় ছিল পদ্মের ন্যায়।
[উদ্যোগপর্ব- ৮৪/১৮]
❝অতসীপুষ্পসংকাশঃ পীতবাসা জনার্দনঃ।
ব্যরাজত সভামধ্যে হেম্নীবোপহিতো মণিঃ❞ ॥৬৫॥
=>(নীল) অতসীপুষ্পের ন্যায় নীল বর্ণযুক্ত, পীতবর্ণের বস্ত্রপরিহিত শ্রীকৃষ্ণ যেন সভামধ্যে স্বর্ণের উপরে সংস্থাপিত ইন্দ্রনীলমণির ন্যায় শোভা পাচ্ছিলেন।
[উদ্যোগ পর্ব — ৮৭/৬৫]
অবশ্য মহাভারতের আরেকটি স্থলে পাওয়া যায়—
❝কৃষ্ণবর্ণশ্চ মে যস্মাত্তস্মাৎ কৃষ্ণোহহমর্জ্জুনম❞
=> (শ্রীকৃষ্ণ) : "যেহেতু আমার কৃষ্ণবর্ণ সেহেতু আমি কৃষ্ণ।"
[শান্তিপর্ব - ৩২৮/২৬৫, স্বয়ং বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বিধায় এটিই অধিক গ্রহণযোগ্য যে শ্রীকৃষ্ণ শ্যাম বর্ণের। ]
যার
এমন শ্যাম গাত্রবর্ণ, স্নিগ্ধ অঙ্গকান্তি অথচ তা রৌদ্রজ্বোল, যার কণ্ঠ
বর্ষার মেঘের ন্যায় গম্ভীর,দৃপ্ত অথচ শ্রুতিমধুর, যার ব্যক্তিত্বের কাছে
পর্বতমালাও ধূলিকণাসম অথচ সারল্য কোনো এক অনন্তকালের বাল্যবন্ধুর মতো,
এমনকি চিত্তবিভ্রান্ত শত্রুকেও যিনি পরম স্নেহপূর্বক ধর্মমার্গে চলার উপদেশ
দেন — সেই যোগেশ্বরের সাথে কোনো এক কল্পে বা জন্মান্তরে সাক্ষাৎ করার
সৌভাগ্য হবে কি?
সন্দর্ভ — মহাভারত: হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক।