শ্রাদ্ধ মীমাংসা
শ্রাদ্ধ কী ? শ্রাদ্ধ অর্থ সত্যকে ধারণ করা অথবা যাকে শ্রদ্ধাপূর্বক ধারণ করা যায়। শ্রদ্ধাপূর্বক মনে প্রতিষ্ঠিত করে, বিদ্বান, অতিথি, মাতা-পিতা, আচার্য ইত্যাদি গুরুজন সবাইকে সেবা করার নামই শ্রাদ্ধ।
শ্রাদ্ধ জীবিত মাতা-পিতা, আচার্য, গুরু আদি পুরুষদেরই হতে পারে, মৃতদের নয়। মৃতদের শ্রাদ্ধ কেবল মিথ্যাবাদীদের কর্ম। বৈদিক যুগে তো মৃতক-শ্রাদ্ধের নামও কোথাও ছিলনা। মৃতকশ্রাদ্ধের ইতিহাস অনেক অর্বাচীন। মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ৯১তম অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে একটি আখ্যানের উল্লেখ আছে, যা থেকে এটা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে দুর্জনসন্তোষ ন্যায় অনুযায়ীও এই প্রথা মহাভারতকাল থেকে শুরু হয়েছে। আখ্যানটা এরকম–
মহারাজ যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকে প্রশ্ন করলেন যে, মৃতক শ্রাদ্ধ কখন এবং কে চালু করেন? তিনি উত্তর দিলেন, দত্তাত্রেয় নিমির অনেক সৌভাগ্যশালী শ্রীমান্ পুত্রের জন্ম হলো। বহু বছরের দুষ্কর তপস্যা করে তার পুত্র মারা গেল। শাস্ত্র-মর্যাদানুসারে নিমি রাজা শৌচ-স্নান করেও পুত্রে জন্য অত্যন্ত শোক করছিলেন। তারপর তিনি মনে মনে শ্রাদ্ধের সামগ্রী কল্পনা করে আমাবস্যার দিনে ব্রাহ্মণ-ভোজন করালেন তথা নিজের পুত্রের নাম-গোত্র আদি উচ্চারণ করে পিণ্ডদানও করলেন, কিন্তু এই সময়ে তিনি ধর্ম-ভঙ্গ দেখে অনুশোচনা করে বললেন—
অকৃতং মুনিভিঃ পূর্বং কিং ময়ৈতদনুষ্ঠিতম্ ।
কথং নু শাপেন ন মাং দহেয়ুর্ব্রাহ্মণা ইতি ॥ ১৭ ॥
অর্থাৎ, এর আগে মুনিগণ এমনটা কখনো করেননি, আমি এটা তা কেন করলাম ? ব্রাহ্মণরা আমাকে তাদের অভিশাপে না ভস্ম করে দেয়।
এরপরে অত্রি এসে একে প্রাচীন কালের বলে বৈধতা দেন 'পূর্বদৃষ্টো ধর্মোঽয়ং ব্রহ্মণা স্বয়ং' । এই আখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, মৃতক শ্রাদ্ধের প্রথা নিমী'র সময় থেকেই প্রাচলন হয়েছিলো। অত্রির নাম উল্লেখ করে একে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র, কেননা যদি নবীন না হতো তবে নিমির অযথা শোকের কারণ কী ? বা অত্রিরই কেন এই সাধারণ বিষয় সুনিশ্চিত করার জন্য ব্রহ্মার কথা নিয়ে আসতে হবে, বিধি বর্ণনা করতে হবে ? যদি অত্রির মতে এটি বিধিবদ্ধ হয়েই থাকে তবে তো নতুন করে বলার কিছু নেই বা নিমির শোকেরও কারণ নেই । অতএব এই প্রথা সর্বথা অর্বাচীন এবং অবৈদিক, কেননা চার বেদে মৃতের শ্রাদ্ধ ক্রিয়া প্রতিপাদকও কিছুই নেই। বেদ স্পষ্ট শব্দে মাতা-পিতা, গুরু এবং বড়দের সেবা করার আদেশ দেয়, যথা—
অনুব্রতঃ পিতুঃ পুত্রো মাত্রা ভবতু সংমনাঃ।
অথর্ব০ ৩। ৩০। ২
= পুত্র পিতার অনুকুল কর্ম সম্পাদনকারী এবং মাতার সাথে উত্তম আচরণ প্রদর্শনকারী হোক।
মৃতকের জন্য জিনিসপত্র দিতে হবে, তা সেখানে পৌঁছে যাবে, মৃতকের শ্রাদ্ধ হওয়া আবশ্যক তথা এভাবে হতে হবে এবং তিনি সেখানে পৌছে যাবেন, এরূপ কোন বেদমন্ত্রের বিধান নেই।
শ্রাদ্ধ কেবল জীবিতদেরই হতে পারে, মৃতদের নয়। পিতর সংজ্ঞাটিও জীবিতদের জন্যই প্রযুক্ত হয়, কেবল মৃতদের জন্য নয়। বৈদিক সনাতন ধর্মের এই সত্য সিদ্ধ করতে সর্বপ্রথম ‘পিতর’ শব্দের বিশ্লেষণ করবো আমরা৷
'পিতা পাতা বা পালয়িতা বা ', নিরুক্ত ৪.২১ অনুযায়ী পিতর শব্দ ‘পা রক্ষেণ’ ধাতু দ্বারা সৃষ্টি হয়, অতএব পিতর অর্থ পালক, পোষক, রক্ষক তথা পিতা হয়ে থাকে। জীবিত মাতা-পিতাই রক্ষণ এবং পালণ-পোষণ করতে পারেন। যিনি মৃত তিনি অপরের রক্ষা কী করবে সে-তো নিজের রক্ষাই করতে পারেনা, অতএব মৃতকদের পিতর মনে করা মিথ্যা তথা ভ্রমমূলক। বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, প্রচলিত পুরাণ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ তথা মনুস্মৃতি আদি শাস্ত্রসমূহের অবলোকন দ্বারা এটা স্পষ্টই বিদিত হয় যে, পিতর সংজ্ঞাটি জীবিতদের জন্যও, কেবলমারর মৃতকদের জন্য নয়৷ বরং পুরাণে পরবর্তীতে এই পিতরকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে শ্রাদ্ধের বেলাতে ব্যবহার করে অর্থ সংকুচিত করা হয়েছে। কিছু প্রমাণ এখানে উদ্ধৃত করা হলো—
আচ্যা জাতু দক্ষিণতো নিষদ্যেদং নো হবিরভি গৃণন্তু বিশ্বে।।
অথর্ব০ ১৮।১।৫২
= হে পিতরগণ ! আপনি জানু কুঞ্চিত করে এবং দক্ষিণাভিমুখী হয়ে বসে আমাদের এই অন্নকে গ্রহণ করুন।
এই মন্ত্রের অর্থ করার সময় কাণ্বশাখায় সায়ণ, মাধ্যন্দিন শাখায় মহীধর, উবট এবং গ্রিফিথ সাহেব – সকলেই নতজানু হয়ে বেদীর দক্ষিণদিক সংলগ্ন হয়ে বসতে বলছেন। এখন পৌরাণিকদের মতে এই কথা মৃতকের জন্য বলা । তাহলে তাদের যেহেতু দেহ নেই তারা এটা করতে পারবে না, তাহলে বেদমন্ত্র কী ব্যর্থ ? মৃতদের আত্মার কি হাঁটু থাকে? এই বর্ণনার দ্বারা ভালো করেই প্রমাণিত হয় যে জীবিতদের জন্যই পিতর সংজ্ঞা প্রযোজ্য ।
উপহূতাঃ পিতরঃ সোম্যাসো বর্হিষ্যেষু নিধিষু প্রিয়েষু ।
তঽআ গমন্তু তঽইহ শ্রুবন্ত্বধি ব্রুবন্তু তে বন্ত্বস্মান্ ॥
যজু০ ১৯।৫৭
ভাবার্থ হলো, আমাদের মাধ্যমে আহ্বানের পর সোমরস পানকারী পিতর প্রীতিকারক যজ্ঞ তথা আমাদের কোষসমূহে আগমন করুন। সেসব পিতরগণ আমাদের বচনসমূহ শ্রবণ করুন, আমাদের উপদেশ দিন তথা আমাদের রক্ষা করুন।
এই মন্ত্রে মহীধর তথা উবট এই কথাটা এক প্রকারে স্বীকার করেছেন যে, পিতর জীবিতই হয়ে থাকেন, মৃত নয়, কেননা মৃত না-তো আসতে পারে, না-তো শুনতে পারে, না-তো উপদেশ দিতে পারে আর না-তো রক্ষা করতে পারে। মন্ত্রে 'অবন্তু' এখানে অব্ ধাতু রক্ষণ, গতি, কান্তি, প্রীতি, তৃপ্তিসহ ১৯ প্রকার অর্থ প্রদান করে যার কোনটিই মৃত পিতর করতে সক্ষম না। তাই পৌরাণিক ও তাদের ভাষ্যকারগণ যতই আড়াল করার চেষ্টা করুন না কেন মন্ত্র নিজেই তার সঠিক অর্থের প্রমাণ দিচ্ছে ।
একইভাবে পৌরাণিকভাষ্যকাররা মৃত পিতর করতে না পেরে পিতর অধিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ করে যেসব ভাষ্যে লুকোচুরি করতে চেয়েও পারেনি তা নিম্নরূপ -
১। অক্ষন্.. শুন্ধধ্বম্ (যজু০ ১৯.৩৬) - পিতর হাত ধোবে বা আচমন করবে (সামশ্রমী)। বিনিয়োগে এই মন্ত্র দ্বারা অঙ্গারে জল প্রদান আছে, অথচ মন্ত্রে আছে ভিন্ন কথা। জল অগ্নিতে দেওয়ার বিনিয়োগে পিতর আসবে কীভাবে? অর্থাৎ এই মন্ত্র জীবিত পিতরদেরই বলছে।
২। যজুর্বেদ ১৯।৫৭-৫৯ অনুযায়ী পিতরদের যজ্ঞে আসতে, প্রার্থনা শুনতে, উপদেশ দিতে, আসনে আসীন হতে বলা হচ্ছে। যজুর্বেদ ১৯.৬৩ ও অথর্ববেদ ১৮.৩.৪৩ অনুযায়ীও একই নির্দেশনা পাওয়া যায়।
৩। যজুর্বেদ ২।৩৩ পিতরদের কাছে কুমারকে পোষণ করতে বলা হয়েছে। এখানে পিতর অর্থ মৃতক করা বুদ্ধিহীনতা।
৪। যজুর্বেদ ১৯.৩৭ এখানে পিতা - পিতামহ - প্রপিতামহ পর্যন্ত উল্লেখ জীবিত পিতরদেরই দ্যোতক।
৫। যজুর্বেদ ১৯.৫১ প্রচলিত ভাষ্যে পিতরদের বসিষ্ঠ গোত্রীয় বলা হচ্ছে। আমাদের সবার গোত্র ভিন্ন। তাই এই ভাষ্য অযথার্থ ও মৃতদের উল্লেখ এই মন্ত্রে করা হয়নি ।
৬। যজুর্বেদ ১৯.৩৭ - সোমযাগী পিতর আমাকে পবিত্র করুন। যজুর্বেদ ১৯.৬৭ পিতরকে যতি বলেছে এই বিশেষণও জীবিতদের পক্ষেই যথাযথ।
৭। যজুর্বেদ ১৯.৪৯ - ঋতজ্ঞাঃ অর্থাৎ যাজ্ঞিক স্বাধ্যায়নিষ্ঠ পিতর উব্বট উল্লেখ করেছেন, মৃত স্বাধ্যায় করে?
৮। ঋ০ ১.১২১.৫ পিতরৌ অর্থাৎ মা-বাবাকে বোঝায় যারা গোদহন করেন, ঋ০ ৩.৫৪.১৬ সত্যাচারী এবং নিজ কুলে যশস্বী পিতরকে বোঝায়, ঋ০ ৬.৭৫.৯ আয়ুযুক্ত সেনাযুক্ত ও শস্ত্রযুক্ত ইত্যাদি ৯টি বিশেষণযুক্ত পিতরকে নির্দেশ করে। ঋ০ ৩.৩৯.৪ যোদ্ধা পিতরকে বোঝায়, সায়ণভাষ্যে 'যোধাঃ যোদ্ধারোবর্তন্তে'। ঋ০ ১.৬২.২ পিতরদের পদজ্ঞাঃ অর্থাৎ ব্যাকরণজ্ঞ বলছে, ঋ০ ৪.৩৩.৩ 'পিতরা যুবানাং' অর্থাৎ যুবা বলে বিশেষায়িত করছে। ঋ০ ১০.১৪.৪ পিতরদের মধ্যে 'সংবিদানঃ' অর্থাৎ আলোচনার উল্লেখ করে, ঋ০ ১০.১৪.৮ 'সংগচ্ছস্ব পিতৃভিঃ' পিতরদের সাথে চলার কথা বলে । ঋ০ ১.১০৬.৩ 'সু প্রবাচনাঃ' অর্থাৎ উত্তম প্রবচনদাতা, ঋ০ ৭.৭৬.৪ সত্যজ্ঞানী, ক্রান্তদর্শী, আত্মদর্শী ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যযুক্ত পিতর উল্লেখ করে৷ এসবই জীবিতদের বেলাতেই সম্ভব।
৯। অথর্ববেদ ১৮.৩.১০ ঘৃত ও মধুদাতা পিতরের উল্লেখ করে 'মধুনা ঘৃতেন' ইত্যাদি।
১০। যজুর্বেদ ১৯.৬১ তে পিতরদের 'ঋতুমান্' অর্থাৎ ঋতু অনুকূল আচার-ব্যবহার পালনকারী বলা । এটিও জীবিতদের লক্ষণ।
পাশাপাশি,
শতমিন নু শরদো অন্তি দেবা যত্রা নশ্চক্রা জরসং তনূনাম।
পুত্রাসো যত্র পিতরো ভবন্তি মা নো মধ্যা রীরিষতায়ুর্গন্তোঃ॥আ
ঋ০ ১।৮৯।৯
যখন পুত্র পিতর হয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত হে পরমাত্মন্! আপনি আমাদের আয়ুর নাশ না করুন, অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পুত্র পিতর হয় ততক্ষণ পর্যন্ত যেন আমরা জীবিত থাকি।
এবার একটু বিচার করুন যে সংসারে এমন কোন অভাগা মাতা-পিতা আছেন যারা প্রভুর নিকট এই প্রার্থনা করেন যে, আমরা যেন ততক্ষণ জীবিত থাকি, যতক্ষণে আমাদের পুত্র চোখের সামনে মৃত্যু বরণ করে, অতএব এই মন্ত্রে এটাই সিদ্ধ হয় যে, পুত্র হওয়ার পর পুত্রদের জন্যও পিতর অর্থাৎ পিতা সংজ্ঞা প্রযুক্ত হয় –
মর্ত্যাঃ পিতরঃ [শতপথ০ ২।১।৩।৪] = মর্ত্যা অর্থাৎ মরণশীল মনুষ্যই পিতর।
বিশঃ পিতরঃ [শতপথ০ ১৩।৪।৩।৬] = প্রজাগণই পিতর। প্রসঙ্গক্রমে এখানে বয়স্করাই অভিপ্রেত। বেদেও গুরুজনদেরই সেবার উপদেশ বিদ্যমান ।
দেবা বা এতে পিতরঃ [গোপথ০ ২।১।২৪] = বিদ্বানই পিতর।
মনঃ পিতরঃ [শতপথ০ ১৪।৪।৩।১৩] = মনই পিতর।
অসৌ (দ্যৌ) পিতাঃ [তৈ০ব্রা০ ৩।৮।৯।১] = দ্যুলোকই পিতর।
এষ বৈ পিতা য এষ (সূর্য) তপতি [শতপথ০ ১৪।১।৪।১৫] = সূর্যই পিতা।
পিতরো নমস্যাঃ [শতপথ০ ১।৫।২।৩] = পিতর অন্ন ও নমস্কার যোগ্য।
বাল্মীকি রামায়ণ, গীতা তথা পুরাণ থেকেই এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জীবিতের নামও পিতর হয় , কেবল একপাক্ষিক মৃতের নয়। যেমন -
জ্যেষ্ঠো ভ্রাতা পিতা বাপি যশ্চ বিদ্যাং প্রয়চ্ছতি।
ত্রয়স্তে পিতরো জ্ঞেয়া ধর্মে চ পথি বর্তিনঃ॥
বা০ রা০ কিষ্কি০ ১৮।১৩
অর্থাৎ, ধর্মপথে চলা বড় ভাই, পিতা এবং বিদ্যাদাতা এই তিনজন ‘পিতর’ জানবে।
বিদ্যাদাতাঽন্নদাতা চ ভয়ত্রাতা চ জন্মদঃ।
কন্যাদাতা চ বেদোক্তা নরাণাং পিতরঃ স্মৃতাঃ ॥
ব্রহ্ম০ বৈ০ পু০ গণপতি খণ্ড ৮। ৪৭
অর্থাৎ, বিদ্যাদাতা, অন্নদাতা, ভয় হতে রক্ষাকারী, জন্মদাতা, কন্যাদাতা এই মানবগণকে পিতর বলা হয়।
চাণক্য নীতিতেও এরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়—
জনিতা চোপনেতা চ যস্তু বিদ্যাং প্রয়চ্ছতি ।
অন্নদাতা ভয়ত্রাতা পঞ্চৈতে পিতরঃ স্মৃতাঃ ॥
চাণক্য নীতি ৫.২২[৪.১৯]
এ সম্বন্ধে গীতার একটি শ্লোকও খুবই মাহাত্ম্যপূর্ণ। যখন উভয় সেনাগণ যুদ্ধের জন্য সুসজ্জিত হয়ে তৈরি ছিল সে সময় অর্জুন যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বললেন — “আমার রথ উভয় সেনাদের মধ্যে দাঁড় করাও।” অর্জুনের এরূপ কথার জন্য শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের রথ উভয় সেনাগনের মধ্যে দাড় করিয়ে দিলেন। তখন—
তত্রাপশ্যৎস্থিতান্পার্থঃ পিতৄনথ পিতামহান্
গীতা ১।২৬
= অর্জুন সেখানে দাড়িয়ে পিতর এবং পিতামহগণকে দেখলেন।
যেখানেতো মহর্ষি ব্যাসদেব পৌরাণিকমণ্ডলের মেরুদণ্ডই ভেঙে দিলেন, কেননা জীবিত পিতরই কেবল দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, মৃত নয়।
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদের এই কথন অনুসারে—
তৈব স্ত্রী ন পুংমানেষ ন চৈবায়ং নপুংসকঃ।
যদ্যচ্ছরীরমাদত্তে তেন তেন স লক্ষ্যতে।। –৫।১০
এই আত্মা না তো স্ত্রী, না তো পুরুষ এবং না তো নপুংসক, কিন্তু যেই যেই শরীরকে গ্রহণ করে, সেসবেই চিহ্নিত করা হয়।
তাহলে, মৃত্যুর পর পিতর সংজ্ঞা কীভাবে সম্ভব হতে পারে?
কিছু পদ বেদে শ্রাদ্ধ আছে বলে পৌরাণিকরা তুলে ধরে । যেমন,
‘অগ্নিষ্বাত্তাঃ’ । অথর্ববেদ ১৮.৩.৪৪ এ সায়ণ এর অর্থ করেছে ‘সোমযাগ যে করেনি’, উবট যজুর্বেদ ১৯.৫৮তে এর অর্থ করেছে যে ‘শ্রৌত স্মার্ত যজ্ঞ করেনি’, আর মহীধর উলটো লিখেছে যে ‘শ্রৌতস্মার্তযজ্ঞকারী’ । অর্থাৎ তাদের অর্থ পরস্পরবিরুদ্ধ । অগ্নিষ্বাত্ত অর্থ যদি অগ্নি দ্বারা ভক্ষণকৃত করা হয় তবে তা ভুল, কেননা 'অদ্ভক্ষণে' ধাতুর সাথে 'ক্ত' প্রত্যয় হলে 'অদো জগ্ধি..' (অষ্টা০ ২.৪.৩৬) অনুযায়ী জগ্ধ হবে, অত্ত না। কেউ কেউ বলে 'অগ্নিনা স্বাত্তঃ স্বাদিতঃ' হবে এটাও ভুল, কেননা 'ক্ত' প্রত্যয় হলে 'স্বাদিন' হবে, 'স্বাত্ত' না ।
অগ্নি+সু+আত্ত এই ৩ পদ। আ পূর্বক 'দা' ধাতুতে 'ক্ত' প্রত্যয়ে অষ্টা০ ৭.৪.৪৭ অনুযায়ী ‘আত্ত’ হয়। ‘দা’ ধাতু থেকে ‘আ’ উপসর্গ যোগে এর অর্থ হয় 'গ্রহণ করা'৷ যেমন 'আদদাত'= ‘আ দান’ । ‘আ’ত্ত শব্দের অর্থ গৃহীত। যে অগ্নিকে গ্রহণ করেছে 'সুষ্টু আত্তো গৃহীতোঽগ্নির্যেন স অগ্নিষ্বাত্তঃ'৷ অষ্টা০ ২.২.৩৭ অনুযায়ী 'স্বাত্তাগ্নি' না হয়ে 'অগ্নিষ্বাত্ত' হয়েছে। অর্থাৎ অগ্নিহোত্র কর্ম, অগ্নিবিদ্যায় নিপুণ বা আগ্নেয়াদি অস্ত্র কৌশলী অগ্নিষ্বাত্ত। যদি 'অগ্নিনাস্বাত্তঃ' = স্বাদিত ইতি অগ্নিষ্বাত্তঃ ধরেন তাও এর অর্থ 'অগ্নিদগ্ধ' হবে না কেননা, এরা সবাই ঋষি মরীচির পুত্র বা ব্রহ্মার মানসপুত্র আপনাদের মতেই ।
যজুর্বেদ ১৯.৬০, ঋগ্বেদ ১০.১৫.১৪ ও অথর্ববেদ ১৮.২.৩৫ এ অগ্নিষ্বাত্ত ও অগ্নিদগ্ধ এবং অনগ্নিষ্বাত্ত ও অনগ্নিদগ্ধ পর্যায়বাচী তাই এদের অর্থও একই প্রকার হবে । আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হলো পৌরাণিকরা এর অর্থ অগ্নিতে জ্বলিত করলেও সায়ণ - মহীধর ও উবট এই অর্থ করেনি ।
একটি উদাহরণ দেই, ‘প্রভিন্ন কমলোদরে মধূনি মধুকরঃ পিবতি’ অর্থাৎ কমলের উদরের মধু যে পান করে সে হলো ‘মধুকর’। এখন মধুকর আসলে কে তা অজ্ঞাত? কিন্তু অর্থ এখানে “ভ্রমর” ধরা হয় কেননা সে-ই কমলের মধু পান করে। একইভাবে বেদে অগ্নিষ্বাত্ত ইত্যাদি পিতরের বৈশিষ্ট্য আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি । তাই তা যে জীবিতদের জন্যই যথাযথ অর্থ প্রদর্শন করে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। “দেবযান” অর্থাৎ বিদ্বানরা যে পথে আসেন পিতররাও একইভাবে আসেন । দেব অর্থ বিদ্বান প্রসিদ্ধ (শত০ ৩.৭.৩.১০) ।
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১.৬.৯.৬ অনুযায়ী, সোম প্রযাজকারী পিতর, যজ্ঞকারী পিতর বর্হিষদ্ আর যজ্ঞ না করা অগৃহস্থ = সন্ন্যাসী হলো অগ্নিষ্বাত্ত । যদি কেউ ‘গৃহমেধিনঃ’ মানে তাতেও অযাজ্ঞিক গৃহস্থ হয়, জ্বলে যাওয়া না । শত০ ব্রা০ ২.৪.১.৭ এ “স্বদয়তি” অর্থ হবে সু+অদয়তি, যেখানে স্বদ্ = স্বাদ নেওয়া । সুতরাং অগ্নি যাকে স্বাদ প্রদান করে, লাভ প্রদান করে বা অগ্নি যার কলাকৌশল যজ্ঞ ও জীবন-নির্বাহের সাধন । ব্রাহ্মণে প্রসঙ্গও যজ্ঞেরই চলছে । তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ অনুযায়ী, যে সোম দ্বারা যাগ করছে সে পিতর, যে দান দ্বারা লোক জয় করে যে বর্হিষদ্ আর যে পূর্বের দুটোর কোনটা না করে অগ্নির দ্বারা লাভবান হয় সে অগ্নিষ্বাত্ত ।
বর্হিষদ্ = যে বর্হি বা কুশাসনে বসে, গৃহমেধী । তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ কিংবা অথর্ববেদ ১৮.১.৫১ সায়ণভাষ্যেও পাবেন এই অর্থ । অর্থাৎ দর্ভ বা কুশে বসে যোগাভ্যাসী সন্ধ্যাকারী পিতর । যেমন বিধান মনুস্মৃতি ২.১০৪ বা সামবেদ ১৪৩ এ উল্লেখিত রয়েছে। সোম্যাসঃ অর্থ হলো যে সোমরস প্রস্তুতকারক বা তা পানের যোগ্য, এটিও জীবিতদের বেলাতেই সম্ভব, মৃতদের জন্য না।
যে নিখাতা যে পরোপ্তা যে দগ্ধা যে চোদ্ধিতাঃ ।
সর্বাস্তানগ্ন আ বহ পিতৃন্হবিষে অত্তবে॥
অথর্ববেদ ১৮.২.৩৪
এখানে,
নিখাতাঃ = ভূমিতে প্রোথিত
পরোপ্তাঃ = ভাসিয়ে দেওয়া
দগ্ধাঃ = জ্বালানো
উদ্ধিতাঃ = নিক্ষিপ্ত
এই চার প্রকার মৃতের সংস্কার আছে বলে অনেকে দাবি করেন। এখন মন্ত্রের শেষভাগে “সর্বাস্তানগ্ন আ বহ পিতৃন্হবিষে অত্তবে” = সবাইকে অগ্নি অন্ন গ্রহণে নিয়ে আসুক - এতে আপত্তি নেই । আসুন বাকিগুলো দেখি।
গীতা ২.২৩-২৪ অনুযায়ী,
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।। ২/২৩
অর্থ: এই (আত্মাকে) অস্ত্রসকল ছেদ করতে পারে না, আগুন একে পোড়াতে পারে না, জল একে ভিজাতে পারে না, বাতাস একে শুকাতে পারে না।
অচ্ছেদ্যোঽয়মদাহ্যোঽয়মক্লেদ্যোঽশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোঽয়ং সনাতনঃ ॥ ২/২৪
অর্থ: এই আত্মা অচ্ছেদ্য, এই আত্মা অদাহ্য, অক্লেদ্য এবং নিঃসন্দেহেই অশোষ্য। এই আত্মা নিত্য, সর্বত্রগমনকারী, স্থির, অটল, সনাতন।
শব্দার্থ হলো, অচ্ছেদ্য = কাটা যায় না। অদাহ্য = পুড়িয়ে দেওয়া যায় না। অক্লেদ্য = জলে ভেজানো যায় না। অশোষ্য = শুকানো যায় না।
উক্ত অথর্ববেদীয় মন্ত্রের পৌরাণিক অর্থ জীবাত্মার বেলায় প্রযোজ্য হবে না কেননা জীবাত্মাকে দগ্ধ, প্রোথিত করা যায় না । যজুর্বেদ ৪০.১৫ অনুযায়ী দাহসংস্কারই একমাত্র সংস্কার মৃতদেহের, ৪ প্রকারপদ্ধতির প্রশ্নই আসে না । যদি বলেন এটা জীব তথা দেহকে বলা তাহলে পরের অর্ধেক বৃথা কেননা দেহকে তো আর কেউ ডেকে আনতেও পারবে না ও দেহ আসেও না । যদি বলেন জীবদেহ ও আত্মা উভয়কে বলা তবে তা আর মৃতের শ্রাদ্ধ হলো কীভাবে ? কারণ দেহে আত্মা থাকলে সে তো জীবিতই ।
এখানে নিখাত - ভূগর্ভবিদ্যা পণ্ডিত, উদ্ধিত - ভূপৃষ্ঠ ও আকাশমার্গবিদ্ তথা খনিজ পদার্থ বহির্গতকারী পণ্ডিত, দগ্ধ - অগ্নিবিদ্যার পণ্ডিত পরোপ্ত - জলযান পণ্ডিত এই অর্থই যথাযথ ও বেদের প্রকৃত মাহাত্ম্য প্রকাশ করে ।
যেভাবে স্নাতক অর্থ স্নান করা ব্যক্তি হলেও মূল লক্ষ্য হলো, গুরুকুল থেকে সমাবর্তনে স্নান করা বিদ্যার্থী এখানেও তেমনই ভাবে গ্রহণ করতে হবে ।
মনুস্মৃতি ৩.১৯৯ অনুযায়ী অগ্নিদগ্ধ ও অনগ্নিদগ্ধ কবি পুত্র এবং বর্হিষদ অগ্নিষ্বাত্ত সৌম্য ব্রাহ্মণদের পিতর । এখানেও এই পিতরদের অর্থ জ্বালানো হতে পারে না । এই শ্লোক প্রক্ষিপ্ত তা প্রমাণ করা যায় । কেননা কোথাও এই অর্থ নেই । মহাভারত বনপর্ব ৫০.৫ “সাগ্নয়োঽনগ্নয়স্তথা” অনগ্নি ও সাগ্নি ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে, এরা কেউ মৃত না । তাই মনুস্মৃতির উক্ত শ্লোক প্রক্ষিপ্ত । বনপর্বের ২৪.১৪-১৫ অনগ্নিকে নিরগ্নি ও সাগ্নিকে সাগ্নিহোত্র বলা হয়েছে । অর্থাৎ গীতা ৪.৩৩ অনুযায়ী যথাক্রমে জ্ঞানযজ্ঞ ও দ্রব্যযজ্ঞের যাজ্ঞিক এরা ।
বিষ্ণু পুরাণ ১.১০.১৮ অনুযায়ী,
অগ্রিষ্বাত্তা বহির্ষদোঽনগ্রয়ঃ সাগ্নয়শ্ব যে ।
তেভেয়ঃ স্বধা সুতে জজ্ঞ মৈনাং বৈধারিণীং তথা ॥
বর্হিষদ্, অগ্নিষ্বাদ্, অনগ্নি, সাগ্নি চার পিতর ব্রহ্মা উৎপন্ন করেন । যদি ব্রহ্মাই উৎপন্ন করেন তবে তাদের অর্থ প্রজ্বলিত পিতর কীভাবে হয়?
শিবপুরাণ রুদ্রসংহিতার সতীখণ্ড ৩.৪৮-৫০ অনুযায়ী,
মচ্ছরীরাত্তু ঘর্মাম্ভো যৎপপাত দ্বিজোত্তম ॥
ধর্মাম্ভো অগ্নিষ্বাত্তাঃ পিতৃগণা জাতাঃ পিতৃগণাস্ততঃ ॥
ভিন্নাঞ্জননিভাস্সর্বে ফুল্লরাজীবলোচনাঃ ॥
নিতান্তয়তয়ঃ পুণ্যাস্সংসারবিমুখাঃ পরে ॥
সহস্রাণাং চতুঃষষ্টিরগ্নিষ্বাত্তাঃ প্রকীর্তিতা ॥
ষডশীতিসহস্রাণি তথা বর্হিষদো মুনে ॥
অর্থাৎ, ব্রহ্মার স্বেদ থেকে অগ্নিষ্বাত্ত পিতরের জন্ম । তাদের থেকে ৬৪ হাজার অগ্নিষ্বাত্ত ও ৮৬ হাজার বর্হিষদ্ বলা হয় ।
আমাদের জন্য পুরাণাদি প্রমাণ না, তারপরেও দুর্জনসন্তোষ ন্যায় অনুযায়ী বিপক্ষীরা যে তাদের গ্রন্থের এই অর্থও অস্বীকার করতে পারবেন না এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে ।
শ্রাদ্ধে কিভাবে ব্যক্তিগণকে ভোজন করানো উচিত, এ বিষয়ে বিচার করে দেখা গেল মৃতের শ্রাদ্ধই হতে পারেনা। উদাহরণার্থ—
যাবতো গ্রসতে গ্রাসান্হব্যকব্যেষ্বমন্ত্রবিৎ ।
তাবতো গ্রসতে প্রেতো দীপ্তশূলর্ষ্ট্যযোগুডান্ ॥
প্রক্ষিপ্ত শ্লোকযুক্ত মনুস্মৃতি ৩। ১৩৩
অর্থাৎ, অবেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ হব্য কব্যে যত সংখ্যক গ্রাস ভোজন করেন, পরলোকে (শ্রাদ্ধকর্তা) তত সংখ্যক জ্বলন্ত শূলষ্টি নামক লৌহপিণ্ড ভোজন করেন।
যস্য মিত্রপ্রধাননি শ্রাদ্ধানি চ হবীংষি চ।
তস্য প্ৰেত্য ফলং নাস্তি শ্রাদ্ধেষু চ হবিঃষু চ ॥
প্রক্ষিপ্ত শ্লোকযুক্ত মনুস্মৃতি ৩। ১৩৯
যার শ্রাদ্ধে ও দেবকার্যে মিত্রভোজন করান হয়, পরলোকে সে ঐ কার্যসমূহের ফল পায় না।
চিকিৎসকান্দেবলকান্মাংসবিক্রয়িণস্তথা ।
বিপণেন চ জীবন্তো বর্জ্যাঃ স্যুর্হব্যকব্যযোঃ॥
প্রক্ষিপ্ত শ্লোকযুক্ত মনুস্মৃতি ৩। ১৫২
অর্থাৎ - বৈদ্য, পুজারী, কসাই, বণিক এসকলকে শ্রাদ্ধ ভোজন করানো উচিত নয়৷
এরকম একটি লম্বা লিস্ট দেওয়া আছে, (৩.১৫৩-১৬৬) যেখানে গ্রামবাসীর বা রাজার ভৃত্য,পশুপালক, নট, অন্ধ,যিনি বেতন নিয়ে অধ্যাপনা করেন, যে বেতন দিয়ে পড়ে, শূদ্রের শিষ্য (অর্থাৎ শূদ্র অধ্যাপকের নিকট অধ্যয়নকারী), শূদ্রের গুরু, যে সমুদ্রযাত্রা করে, স্তুতিপাঠক, যে তৈলের জন্য তিলাদি পেষণ করে, কূটসাক্ষী, রোগাৰ্ত, অভিশাপগ্রস্ত,ধনু ও শরনির্মাতা, যে পুত্রের নিকট বেদশিক্ষা করে, শ্বেতীরোগী, দুষ্ট, উন্মত্ত, অন্ধ, বেদনিন্দুক, হস্তী গাভী অশ্ব ও উষ্ট্রের প্রশিক্ষক, নক্ষত্রাদি গণনাদ্বারা জীবিকার্জনকারী, পক্ষিপোষক, যুদ্ধাৰ্থ অস্ত্রশিক্ষক, সেতুভঙ্গদ্বারা প্রবহমান স্রোত যে দেশান্তরে নিয়ে যায়, ঐরূপ স্রোত আবরণ করে, জীবিকাৰ্থে যে গৃহনির্মাণ শিক্ষা দেয়, দূত, (বেতনভোগী) বৃক্ষরোপক, ক্রীড়ার্থ কুকুরপোষক, শ্যেনপক্ষীদ্বারা জীবিকার্জনকারী, যে কন্যাগমন করে, শূদ্ৰবৃত্তিধারী, (বিনায়কাদি) গণযাগকারী, আচারভ্রষ্ট, ক্লীব, সর্বদা যাজ্ঞাকারী, কৃষিজীবী, মেষপালক, মহিষপালক, পুনর্ভূপতি ও ধনগ্রহণপূর্বক প্রেতদাহদিকারী যত্নসহকারে নিষেধই নয় বরং ভোজন সম্পাদনকারী এবং ভোজনকারীদের দণ্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে। মৃতের শ্রাদ্ধকারী পৌরাণিকদের উচিত দণ্ড থেকে বাঁচার জন্য এই তর্কশূন্য, বেদাশাস্ত্রবিরুদ্ধ, অবৈদিক মর্যাদাকে সর্বথা ত্যাগ করা। একে তো শ্রাদ্ধ করাই অবৈদিক এবং তার ফলস্বরূপ আবার দণ্ড ভোগ করা এটা কোথাকার বুদ্ধিমত্তা?
যদি দুর্জনতোষণন্যায়বশত মৃতক শ্রাদ্ধকে স্বীকার করে নেওয়া যায় তাহলে এতে অনেক দোষের উৎপত্তি হবে। সর্বপ্রথম দোষ হবে কৃতহানির। কর্ম যে কেউ করুক আর ফল অপর কারো প্রাপ্ত হয়, এরূপ হলে তাকে কৃতহানি বলা হয়। পুত্র বি.এ. পরীক্ষা দিলো আর ডিগ্রি পেল পিতা! পরিশ্রম কোন একজন করলো আর ফল কোন অপরজন পেলো । দান পুত্র করলো আর ফল মাতা-পিতার প্রাপ্ত হলো তো তাতে কৃতহানির দোষ আসবে।
অপর দোষ অকৃতভ্যাগমের হবে। কর্ম না করেই ফল প্রাপ্ত হওয়া, তাকে অকৃতাভ্যাগম বলা হয়। মানুষ এমন করে অন্যায়ভাবে যে কেউ কষ্ট করে অথচ ফল দেয় অন্যকে, কিন্তু পরমাত্মার ন্যায়ে এমন কখনো হতে পারেনা। পৌরাণিকরআ বলে, যে ফল অর্পণ করার কারণে তা অপরজন প্রাপ্ত হয়, কিন্তু এই কথাটি ঠিক নয়। পুত্র কোন ব্যক্তিকে খুন করে তার ফল পিতাকে অর্পণ করলে কি পিতার ফাঁসী হয়ে যাবে। যদি এমনটা হয়ে যায় তাহলেতো লোকজন পাপের সঙ্কল্পও পৌরাণিক পণ্ডিতগণের দ্বারা করিয়ে নিবেন। এই দোষসমূহের কারণেও মৃতক শ্রাদ্ধ সিদ্ধ হয় হয় না।
এবার প্রশ্ন এটা যে, মৃত পিতরদের কাছে ভোজন কী করে পৌঁছায়? মৃত্যুর পর জীব কোথাও জন্ম নেয়, যেমনটা গীতায় বলা হয়েছে -
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোঽপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ॥ ২/২২
= যেমন মানুষ জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে অন্য নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইভাবে আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নতুন শরীর আশ্রয় করে।
এখন বিচারণীয় বিষয় এটা যে তারা ভোজন কীভাবে পাবে ? ভোজন সেখানে পৌঁছায় নাকি পিতরগণ শ্রাদ্ধবাড়িতে ভোজন করতে আসেন। যদি এটা বলো যে সেখানেই পৌঁছায় তবে তা প্রত্যক্ষ প্রমাণ বিরুদ্ধ, কেননা তৃপ্তি ব্রাহ্মণের হয় । যদি ভোজন পিতরগণের নিকট পৌঁছে যেত তাহলে তো তারা শত শত ঘরে ভোজন করতে পারতো।
মনে করো, ভোজনই সেখানে পৌঁছে যায় তাহলে প্রশ্ন হলো, সেসব সামগ্রীই পৌঁছায় কি যা পণ্ডিতমশাইকে খাওয়ানো হয় নাকি পিতর যে যোনিতে জন্ম নেয় তেমনই পায় ? যদি সেসব সামগ্রীই লাভ করে যা ব্রাহ্মণকে দেওয়া হয় আর পিতর যদি নতুন জন্মে হয় পিঁপড়া, তাহলে তো পিতর সেই দানের চাপে পিষ্ট হয়ে মরে যাবে আর যদি পিতর হাতি হয় তাহলে তার উপর কি-ই বা প্রভাব পড়বে ? যদি যোনি অনুসারে দ্রব্য লাভ হয় আর পিতর মৃত্যুর পর মলভোজী কীট হয় তাহলে কি শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ যা খেলো সেসব তার বিষ্ঠার রূপে খাবার হিসেবে লাভ হবে? এটা কতটা অন্যায় এবং অনাচার যে, ব্রাহ্মণদের ক্ষীর-পুলি খাওয়াতে হয় আর তার পরিবর্তে প্রাপ্ত হলো সে মল।
এই সিদ্ধান্তানুসারে শ্রাদ্ধকারীর উচিত, ব্রাহ্মণদের যেন কখনো ঘাস খাওয়ায়, কখনো মাংস, কখনো গোবর এবং কখনো লতাপাতা কেননা নানা প্রাণীর নানা খাদ্য এসবই। যোনিসমূহ অনেক এবং প্রত্যেকের ভোজন ভিন্ন ভিন্ন হয়, অতএব বদলে বদলে ভোজন করানো উচিত, কেননা না জানি পিতর কোন যোনিতে আছেন।
এবার অপর পক্ষেও কিছুর বিচার করে নেওয়া যাক। পিতর ভোজন করতে সেখানে আসেন। যখন মারা যাওয়া মানুষের আত্মীয় ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করতে আসেন তখন পিতর প্রসন্ন হয় এবং ব্রাহ্মণের পেটে এসে বসে যান।
শ্রাদ্ধকর্ত্রা তু যদ্যেকঃ শ্রাদ্ধে বিপ্রো নিমন্ত্রিতঃ ।
উদরস্থঃ পিতা তস্য বামপার্শ্বে পিতামহঃ ॥
প্রপিতামহো দক্ষিণতঃ পৃষ্ঠতঃ পিণ্ডভক্ষকঃ ।
শ্রাদ্ধকালে যমঃ প্রেতান্পিতৄংশ্চাপি যমালয়াৎ ॥
গরুড় পু০ প্রে০ ১০। ২৭-২৮
অর্থাৎ, শ্রাদ্ধকারীর পিতা পেটে বসে, পিতামহ বাম পার্শ্বে বসে, প্রপিতামহ ডান পার্শ্বে বসে ভোজন করেন।
পৌরাণিকগণ ! এটা ভোজন করানোর কেমন প্রক্রিয়া ? প্রথমে পিতর ভোজন করে নাকি ব্রাহ্মণ ? মিথ্যা ভোজন কে করে ? পিতর কি তবে ব্রাহ্মণের মল এবং রক্ত ভোজন করে ?
আরেকটা কথা পিতর শরীরসহিত আসে নাকি শরীর ব্যতীত ? যদি শরীরসহিত আসে তাহলে পেটে এতটা জায়গা নেই যে সবাই সেখানে বসে থাকবে আর তাছাড়া আসতে কেউ দেখলোও না, অতএব শরীর ব্যতীতই আসেন হয়তো। পিতরের আসা-যাওয়ায়, ভোজন করানোর জন্য সময়তো নিশ্চয়ই লাগে । অতএব পিতর আগের যে যে শরীর রেখে এখানে খেতে আসে সেই শরীরকে তো ততোক্ষণে ভস্ম করে দেওয়া হবে, বা দেহ পচে যাবে ।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ [শ্রীকৃষ্ণ০ ১১৫.১১১] ও ভাগবতে শ্রাদ্ধে মাংস নিষিদ্ধ হলেও স্মৃতিতে ও পুরাণে মাংসের বিধানও আছে। বলতেই পারেন যে কলিযুগে এসব মান্য না , কিন্তু বিধান আছে এটা মানতে তারা বাধ্য । মাংসাহারী পিতর এরা কী আদৌ জীবাত্মা নাকি পিশাচ ? যেমন মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ৮৮ অধ্যায়ে,
শ্রাদ্ধকালে যে সমস্ত ভোজ্য প্রদান করা যায় তন্মধ্যে তিলই সর্বপ্রধান। শ্রাদ্ধে মৎস্য প্রদান করিলে পিতৃগণের দুই মাস, মেষমাংস প্রদান করিলে তিন মাস, ও শশ মাংস প্রদান করিলে চারি মাস, অজমাংস প্রদান করিলে পাঁচ মাস, বরাহ মাংস প্রদান করিলে ছয় মাস, পক্ষীর মাংস প্রদান করিলে সাত মাস, পৃষৎ নামক মৃগের মাংস প্রদান করিলে আট মাস, রুরু মৃগের মাংস প্রদান করিলে নয় মাস, গবয়ের মাংস প্রদান করিলে দশমাস, মহিষ মাংস প্রদান করিলে একাদশ মাস এবং গোমাংস প্রদান করিলে এক বৎসর তৃপ্তি লাভ হইয়া থাকে। ঘৃত পায়স গোমাংসের ন্যায় পিতৃ গণের প্রীতিকর ; অতএব শ্রাদ্ধে ঘৃতপায়েস প্রদান করা অবশ্য কর্তব্য।
বলা বাহুল্য গীতাপ্রেস এই সম্পূর্ণ অংশ লোকলজ্জার ভয়ে বাদ দিলেও, হরিদাসে যথাবৎ আছে।
বিষ্ণুপুরাণ ৩.১৬ অনুযায়ী,
ঔর্ব্ব কহিলেন, শ্রাদ্ধের দিনে ব্রাহ্মণদিগকে হবিষ্য করাইলে, পিতৃগণ একমাস পর্যন্ত পরিতৃপ্ত থাকেন, মৎস্য প্রদানে দুইমাস, শশক মাংস প্রদানে তিন মাস, পক্ষী মাংস প্রদানে চারিমা, শূকর মাংস প্রদানে পাঁচ মাস, ছাগ মাংস প্রদানে ছয় মাস, এণ মাংস দিলে সাত মাস, রুরুমৃগমাংস প্রদান করিলে আট মাস, গবয় মাংস প্রদানে নয় মাস, মেষমাংস প্রদানে দশ মাস, পায়স প্রদান করিলে এগার মাস পর্যন্ত পিতৃগণ পরিতৃপ্ত থাকেন। পরন্তু যদি বার্ধ্রীণস মাংস দেওয়া যায় , তাহা হইলে পিতৃলোক চিরদিন তৃপ্ত থাকেন। হে রাজন! গণ্ডারের মাংস, কৃষ্ণশাক ও মধু এই সমুদায় দ্রব্য শ্রাদ্ধকর্মে অত্যন্ত প্রশস্ত ও অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক।
এভাবে এটা স্পষ্ট প্রমাণিত যে শ্রাদ্ধ জীবিত মাতা-পিতারই হতে পারে। মহর্ষি দয়ানন্দেরও এটাই অটল সিদ্ধান্ত। মৃতক শ্রাদ্ধ অবৈদিক এবং অশাস্ত্রীয়। এটা তর্কদ্বারাও প্রমাণিত হয়না। এটা স্বার্থপর, ঠকবাজ এবং পৌরাণিকদের মায়াজাল। সাবধান! পৌরাণিক লেটার বক্সে ছেড়ে আসা এই পার্সেল তার গন্তব্যে পৌঁছায়না ! তাই আসুন জীবিত পিতা-মাতা-গুরুজনদের সেবা করি ।
ইত্যোম্
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর