শ্রদ্ধার মাহাত্ম্য
দৃষ্ট্বা রূপে ব্যাকরোৎসত্যানৃতে প্রজাপতিঃ । অশ্রদ্ধামনৃতে দধাচ্ছ্রদ্ধাং সত্যে প্রজাপতিঃ । ঋতেন সত্যমিন্দ্রিয়ং বিপানং শুক্রমন্ধসঽইন্দ্রস্যেন্দ্রিয়মিদম্পয়োমৃতম্মধু ॥
যজুর্বেদ ১৯।৭৭
= প্রজাপালক পরমেশ্বর তাঁর জ্ঞান শক্তিদ্বারা সত্য এবং অসত্যের স্বরূপকে পৃথক করেন। সেই পরমেশ্বর অসত্যে অশ্রদ্ধা ধারণ করান এবং সত্যে শ্রদ্ধা ধারণ করান।
'শ্রদ্ধা'র অর্থ
শ্রদ্ধা শব্দ শ্রৎ এবং ধা— এই দুই শব্দের সমন্বয়ে তৈরি হয়। শ্রৎ অর্থ সত্য এবং ধা অর্থ ধারণ করা৷ কায়মনোবাক্যে প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের দ্বারা সুপরীক্ষিত সত্যকে ধারণ করার নাম শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা হৃদয়ের একটি সূক্ষ্ম, পবিত্র তথা ভব্য ভাবনা।
শ্রদ্ধা মানবজীবনের মূলস্বরূপ। এটা ছাড়া মানবজীবনরূপী ভবন ভিত্তি লাভ করতে পারেনা। চোখ ছাড়া দেখা যায়না এবং কান ছাড়া শোনা যায়না, একই ভাবে শ্রদ্ধা ছাড়া জীবন তৈরি হতে পারেনা। যারা এই জীবনে সংসারে উন্নতি করেছে, তাদের জীবনে শ্রদ্ধা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। মানবজীবনে শ্রদ্ধার স্থান তেমনই যেমনটা প্রদীপে তেলের। যদি দাহকশক্তি না থাকে তো আমরা সেটিকে অগ্নি বলতে পারিনা, সমুদ্রে তরঙ্গ না থাকলে আমরা সেটিকে সমুদ্র বলতে পারিনা এবং যে নবযুবকে উদ্যম থাকেনা তাকে যুবক বলা যায়না; একইভাবে আমরা সেই মানুষকে মানুষ বলতে পারিনা, যার মধ্যে শ্রদ্ধা নেই। যেভাবে পুষ্প এবং ফলহীন বৃক্ষ সামান্য কাঠমাত্র হয়, একইভাবে শ্রদ্ধাহীন মানুষও সামান্য কাঠের সমান হয়।
বর্তমানে অধিকাংশ লোক শ্রদ্ধাবিহীন, এটাই কারণ যে বর্তমানে মানব আর মানব নেই, দানব হয়ে গিয়েছে। শ্রদ্ধার অভাবে আজ সন্তান পিতার অনাদর করে, শিষ্য গুরুদের তিরষ্কার করে। এর বিপরীতে প্রাচীনকালে মানুষকে শ্রদ্ধার প্রতীক করা হতো। আচার্য শিষ্যদের এমন শিক্ষা দিতেন—
মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব। আচার্যদেবো ভব।
অতিথিদেবো ভব।।
তৈ০উ০ ১।১১।২
= মাতাকে শ্রদ্ধা করো, পিতাকে সেবা করো, গুরু এবং অতিথিদের সম্মান করো। কারণ তারা দেব ।
এই শিক্ষার কারণেই আমরা প্রাচীনকালের মহামানবগণের জীবনে মাতা, পিতা এবং গুরুজনদের কথা ওতপ্রেতভাবে পেতাম। আসুন, প্রাচীন ইতিহাসের কিছু গৌরবপূর্ণ গাথা অবলোকন করি।
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের ঘোষণা হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু পরদিনই দৃশ্য বদলে গেলো। প্রাতকালে কৈকেয়ী শ্রীরামকে ডাকেন। যখন শ্রীরাম মহলে পৌঁছান তখন তার পিতাকে দীন এবং কাতর অবস্থায় দেখে মাতা কৈকেয়ীকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। কৈকেয়ীর বললেন যে,”যদি তুমি মহারাজের আজ্ঞাকে স্বীকার করো.. ” একথা শুনে শ্রীরামচন্দ্র বড়ই ব্যথিত হলেন। তিনি বললেন—
অহো ধিঙ্ নার্হসে দেবি বক্তুং মামীদৃশং বচঃ।
অহং হি বচনাদ্রাজ্ঞঃ পতেয়মপি পাবকে।।
ভক্ষয়েয়ং বিষং তীক্ষ্ণং মজ্জেয়মপি চার্ণবে৷।
বা০ রা০ অযো০ ১৮৷ ২৭-২৮
= হা আমারকে ধিক্কার! হে দেবী! তোমার এমন কথা বলা উচিত নয়। অন্য বিষয়ে কী বা বলার আছে, মহারাজের আজ্ঞাতে আমি অগ্নিতে ভস্ম হতেও তৈরি আছি, বিষও পান করতে পারি, সমুদ্রে ঝাঁপ দিতেও তৈরি।
এই হলো পিতার জন্য শ্রদ্ধা!
মহাভারতের ভীষণ সংগ্রামে অভিমন্যু বীরগতি লাভ করেন। যখন অর্জুন এই কথা শুনলেন তখন তিনি তার পুত্রের হত্যাকারী জয়দ্রথকে বধ করার প্রতিজ্ঞা করলেন। জয়দ্রথকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে আচার্য দ্রোণ শকট- বূহ্য রচনা করলেন। একই সাথে ভীষণ যুদ্ধ করতে লাগলেম। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন যদি অর্জুন এভাবেই লড়াই করতে থাকে তাহলে জয়দ্রথ-বধ অসম্ভব। অর্জুনকে বললেন,’ আমাদের বেশি সময় যেন এখানেই না লেগে যায়, তাই দ্রোণাচার্যকে ছেড়ে সামনে অগ্রসর হও।’ অর্জুন বললেন,’যেমন আপনার ইচ্ছা।’ এবং তারপর তিনি আচার্যকে পরিক্রমা করে বেড়িয়ে গেলেন। এটা দেখে দ্রোণাচার্য বললেন—
ততোঽব্রবীৎস্বয়ং দ্রোণঃ ক্বেদং পাণ্ডব গম্যতে।
ননু নাম রণে শত্রুমজিত্বা ন নিবর্তসে॥
মহা০ দ্রোণপর্ব ৯১।৩৩
= পাণ্ডুনন্দন! তুমি এভাবে কোথায় যাচ্ছ? তুমি তো রণক্ষেত্রে শত্রুকে পরাজিত না করে কখনো এভাবে চলে যেতে না?
একথা শুনে অর্জুন বললো—
গুরুর্ভবান্ন মে শত্রুঃ শিষ্যঃ পুত্রসমোঽস্মি তে।
ন চাস্তি স পুমাঁল্লোকে যস্ত্বাং যুধি পরাজয়েৎ॥
মহা০ দ্রোণপর্ব ৯১।৩৪
= আপনি আমার গুরু, শত্রু নন। আমি আপনার পুত্রসম প্রিয় শিষ্য। এই সংসারে এমন কোন পুরুষ নেই যে আপনাকে পরাজিত করতে পারে।
এই হলো শিষ্যের গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, যুদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু তবুও শ্রদ্ধায় একটুও কমতি নেই।
শ্রদ্ধায় প্রচুর বল আর শক্তি আছে। শ্রদ্ধার মাধ্যমে সবকিছু হতে পারে। শ্রদ্ধার মাধ্যমে যেন বড়-বড় পর্বতকেও টলানো যায়। “শ্রেয়াংসি বহু বিঘ্নানি” ভালো কাজে নানা ধরনের বিঘ্ন উপস্থিত হয়, কিন্তু শ্রদ্ধা দ্বারা জীবনের প্রত্যেক বাধাকে দূর করা যায়। শ্রদ্ধার মাধ্যমে প্রত্যেক ইচ্ছা পূরণ করা যায়।
শ্রদ্ধা বিশ্বাসের জননী। যেখানে শ্রদ্ধা আছে সেখানেই বিশ্বাসও অবশ্যই আছে। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের জীবনে আমাদের এই বৈদিক সত্যের সাক্ষাকার পাওয়া যায়। একবার স্বামী শ্রদ্ধানন্দেরর কাছে ব্রহ্মকুমারী সংস্থার কয়েকজন প্রচারক এলেন আর বললেন, ‘আমরা আপনাকে দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যই ভগবানের দর্শন করাতে পারি।’ স্বামীজি বললেন, ‘ ভগবান ১০-১৫ মিনিট দূরে কীভাবে থাকতে পারে? আমি সেই ভগবানকে মানিনা যে চাইলে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও দূরে চলে যান। আমার ভগবান তো সবসময় আমার সাথে থাকেন।’ স্বামীজির ঈশ্বরের প্রতি এমন অটল বিশ্বাস শ্রদ্ধার কারণেই ছিল।
সাল ১৯০২ থেকে ১৯১২ অবধি সময় আর্যসমাজের জন্য বড়ই সংকটকালীন সময় ছিলো। আর্যসমাজের উপর ইংরেজদের বক্রদৃষ্টি ছিলো। আর্যসমাজকে রাজদ্রোহী সংস্থা এবং সত্যার্থ প্রকাশ কে রাজদ্রোহী গ্রন্থ মানা হতো। আর্জসমাজকে অপরাধী (out law) ঘোষিত করা হয়েছিলো। রাজদণ্ডের সকল ব্যবস্থার প্রয়োগ আর্যসমাজ এবং আর্যসমাজীদের বিরুদ্ধে করা হচ্ছিলো। এই সঙ্কটকালে যেসকল সরকারী চাকুরিজীবী আর্য ছিলো, আর্যসমাজ থেকে নিজেদের তাদের পরিবার সম্পর্ক-বিচ্ছেদ করানোর জন্য চাপ দেওয়া শুরু করলো, যুবকরা দ্বিধায় পড়লো পরিবারের দিকে তাকাবে নাকি আর্যসত্যের দিকে । স্বামী শ্রদ্ধানন্দের কানে খবর পৌঁছে গেলো । সেসময় নিজের দৃঢ় বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধাকে প্রকাশ করে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ তার পত্রিকা ‘সদ্ধর্ম প্রচারক’-এ লিখলেন—
“আর্যগণ! তোমাদের কি পরমাত্মায় প্রকৃত বিশ্বাস নেই? যদি থাকে তো দুই হাতের মানুষ তোমাকে যা দেয় তার জন্য সহস্রহাতে সম্পদ দাতা সহস্রবীর্য ভগবানকে কেন অনাদর করছো ? দুইহাতওয়ালা যে ব্যক্তি তোমার রোজগার ছিনিয়ে নিতে পারে সহস্র মানুষের পালক সহস্রাবাহুর ন্যায় বলবালী ভগবান কী তোমাকে এর থেকেও বেশি রোজগার দিতে পারবে না ?”
এই হলো স্বামীজির ঈশ্বরের প্রতি মহান শ্রদ্ধাপূর্ণ উদ্গার! সকল ধরনের উত্তম কাজে শ্রদ্ধা থাকা পরম আবশ্যক। কেননা শাস্ত্রে বলে 'শ্রদ্ধা আপঃ' = শ্রদ্ধা জলের মতো । যেভাবে জলের অভাবে বৃক্ষ শুকিয়ে যায়, একইভাবে শ্রদ্ধারূপী জলের অভাবে যজ্ঞ, দান, তপ সব ভালো কাজ ব্যর্থ হয়ে যায়, এজন্যই তো যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন —
অশ্রদ্ধয়া হুতং দত্তং তপস্তপ্তং কৃতং চ যৎ ।
অসদিত্যুচ্যতে পার্থ ন চ তৎপ্রেত্য নো ইহ ॥
গীতা ১৭।২৮
= শ্রদ্ধা ব্যতীত কৃত যাগ-যজ্ঞাদি, সমর্পিত দানাদি, কৃত তপশ্চর্যা, এমন কী শ্রদ্ধা ব্যতীত সম্পাদিত কোন কর্মই ফলপ্রদ হয়না, ব্যর্থ হয়ে যায়। হে অর্জুন! শ্রদ্ধারহিত কর্মের মাধ্যমে এই লোকে কোন রকম সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়না, তাহলে পরলোকে কীভাবে প্রাপ্ত হতে পারে। তাই উপনিষদের ঋষি বলেছেন—
শ্রদ্ধয়া দেয়ম্। –তৈ০ উ০ ১১।৪
শ্রদ্ধাপূর্বক দানাদি করা উচিত।
মানবজীবনের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মার বিকাশ, সত্য এবং আনন্দস্বরূপ পরমাত্মার প্রাপ্তি - এগুলো শ্রদ্ধার মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে।
মানুষের উচিত শান্ত এবং উদার হয়ে তথা বিষয়-বিকারাদি থেকে দূরে থেকে, সহনশীল তথা শ্রদ্ধাধনে ধনী হয়ে নিজের আত্মার দর্শন করা।
বেদের আদেশও আছে—
শ্রদ্ধয়াগ্নিঃ সমিধ্যতে শ্রদ্ধয়া হূয়তে হবিঃ ।
শ্রদ্ধাং ভগস্য মূর্ধনি বচসা বেদয়ামসি ॥
ঋ০ ১০।১৫১।১
= শ্রদ্ধার দ্বারা আত্মাগ্নি প্রদীপ্ত হয়, তাতে শ্রদ্ধাপূর্বকই অহংকৃতির আহুতি দেওয়া হয়। শ্রদ্ধা সমস্ত কল্যাণকারী সাধনসমূহের সর্বোচ্চে বিরাজমান আছে। শ্রদ্ধা ব্যতীত কোন কার্য হতে পারেনা।
এই ভাবই প্রকাশ করে বেদে অন্য এক স্থানে বলা হয়েছে—
'শ্রদ্ধয়া বিন্দতে বসু' ঋ ১০। ১৫১।৪
= শ্রদ্ধার মাধ্যমে মানুষ ধন লাভ করে।
বিদ্যাধন, বুদ্ধিধন, জ্ঞানধন, বিজ্ঞানধন, বলধন এবং ঐশ্বর্য —সবকিছু শ্রদ্ধার মাধ্যমেই লাভ হয়। সদাচার, সদবিচার, অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য আদি আধ্যাত্মিক ধনও শ্রদ্ধার মাধ্যমেই লাভ হয়। যার মধ্যে শ্রদ্ধা নেই সে কোনো ধরনের সম্পদ লাভ করতে পারেনা। সেই মানুষ বড়ই ভাগ্যহীন যার ধন নেই, এর বিপরীরে শ্রদ্ধাবান মনুষ্য ধন-ধান্য না রাখলেও অনেক ভাগ্যবান হয়, কেননা শ্রদ্ধা আছে তো সবকিছুই পাবে এবং যদি শ্রদ্ধা না থাকে তো যা কিছু আছে তা-ও চলে যাবে, তাই মানুষের শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হওয়া উচিত।
যোগদর্শনেও প্রভুপ্রাপ্তির জন্য শ্রদ্ধাকে সর্বপ্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। যে সাধক পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাযুক্ত নয়, সেই সাধকের যোগসাধন কীভাবে হবে, এর বর্ণনা করে সেখানে বলা হয়েছে—
শ্রদ্ধাবীর্যস্মৃতিসমাধিপ্রজ্ঞাপূর্বক ইতরেষাং ॥
যো০ দ০ ১।২০
= সত্যকে ধারণ করার নাম শ্রদ্ধা। যখন মানুষের মধ্যে এই শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয় তখন ব্যাসভাষ্যানুসারে ‘সা হি জননীব কল্যাণী যোগিনং পাতি’—এই শ্রদ্ধা যোগীকে মায়ের মতো রক্ষা করে। এই শ্রদ্ধার মাধ্যমে যোগীর হৃদয়ে বিশ্বাস এবং আহ্লাদ উৎপন্ন হয়। সেই বিশ্বাস এবং আনন্দ দ্বারা যোগী বীর্যবান্ = শক্তিশালী এবং উৎসাহী হয়, পুনরায় তার স্মৃতি জাগ্রত হয়। স্মৃতির দৃঢ়তায় চিত্ত নিশ্চল হয়, তখন সমাধি সম্পন্ন হয়, যার মাধ্যমে বিবেক-বুদ্ধির প্রকাশ হয়৷ এভাবে যথার্থ জ্ঞান লাভ করে যোগী তত্ত্বজ্ঞানী হয়।
শ্রদ্ধা তিন প্রকার হয়। গীতায় বলা হযেছে—
ত্রিবিধা ভবতি শ্রদ্ধা দেহিনাং সা স্বভাবজা ।
সাত্ত্বিকী রাজসী চৈব তামসী চেতি তাং শৃণু ॥
গীতা ১৭।২
= দেহধারী মানুষের স্বভাব থেকে উৎপন্ন শ্রদ্ধা সাত্ত্বিকী ও রাজসী এবং তামসী⎯এই তিন প্রকারই হয়। তা তুমি বিস্তারিত শ্রবণ করো।
তামসিক শ্রদ্ধা সেটিই, যা অপরের ক্ষতি করার জন্য হয়, সংসারে অশান্তি বিস্তারের জন্য হয়। রাজসিক শ্রদ্ধা সেটিই, যা নিজের সাংসারিক কল্যাণের জন্য হয় এবং সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা হলো সেটিই যা মানব জীবনকে সফল বানাতে হয়। যখন সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয়, তখন সেই শ্রদ্ধা মনুষ্যের সকল দুর্গুণ এবং দুর্ব্যসন দূর করে প্রভুর নিকট নিয়ে যায়, যেমনটা মুণ্ডকোপনিষদে বলা হয়েছে—
তপঃশ্রদ্ধে যে হ্যুপবসন্ত্যরণ্যে শান্তা বিদ্বাংসো ভৈক্ষ্যচর্যাং চরন্তঃ ।
সূর্যদ্বারেণ তে বিরজাঃ প্রয়ান্তি যত্রামৃতঃ স পুরুষো হ্যব্যযাত্মা ॥
মুণ্ডক ১।২।১১
= যাঁরা সমাহিতচিত্ত, বিদ্বান, ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে বনে অথবা একান্তদেশে বাস করে তপ ও শ্রদ্ধার সেবন করেন, তাঁরা নির্মল হয়ে সূর্যের রশ্মি দ্বারা সেখানে গমন করেন, যেখানে নিশ্চিতরূপে সেই অমর, অব্যয়াত্মা পরম-পুরুষ আছেন
যাগ-যজ্ঞাদি কর্মকাণ্ডের ফল প্রতিপাদন করে এখন প্রসঙ্গবশত জ্ঞানকাণ্ডের ফল বর্ণনা করছেন। বিষয়সমূহের অসারতা অনুভব করে যাঁর ইন্দ্রিয় ও মন শান্ত হয়েছে এবং কর্মফলের ক্ষীণতা দেখে যাঁর আত্মা অবিদ্যার অন্ধকারকে ভেদ করে বিদ্যার বিমল প্রকাশে পৌঁছেছে অর্থাৎ নিজের বাস্তবিক স্বরূপ সম্বন্ধে যাঁর বোধ হয়েছে, যিনি বনে বা একান্তে বাস করে স্বাধ্যায়াদি তপ ও বেদবাক্যে দৃঢ় বিশ্বাসরূপ শ্রদ্ধার সেবন করেন, নিষ্কামভাবে নিজের আশ্রমবিহিত কর্মের আচরণ করে সর্বদা ব্রহ্মের উপাসনায় তৎপর থাকেন, নিঃসঙ্গ ও নির্বিকল্প হয়ে অপরিগ্রহ-বৃত্তি দ্বারা যা কিছু লাভ করেন, তা দ্বারাই নিজের জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন; এরূপ আত্মজ্ঞানী মহাপুরুষ যে-কোনো (ব্রহ্মচর্যাদি) আশ্রমে থেকে কর্ম করলেও তিনি কর্মবন্ধনে লিপ্ত হন না, তিনি সেই অবিনাশী ব্রহ্মকে লাভ করার অধিকারী।
এইভাবে যজুর্বেদে সত্য লাভের উপদেশ দেওয়া হয়েছে—
ব্র॒তেন॑ দী॒ক্ষামা॑প্নোতি দী॒ক্ষয়া॑প্নোতি॒ দক্ষি॑ণাম্। দক্ষি॑ণা শ্র॒দ্ধামা॑প্নোতি শ্র॒দ্ধয়া॑ স॒ত্যমা॑প্যতে ॥
যজু০ ১৯।৩০
= ব্রহ্মচর্য আদি উত্তম ব্রতসমূহ হতে দীক্ষা=অধিকার প্রাপ্ত হয়। দীক্ষা থেকে দক্ষিণা=উৎসাহ প্রাপ্তি ঘটে এবং দক্ষিণা থেকে শ্রদ্ধা লাভ হয় তথা শ্রদ্ধা থেকে সত্য লাভ হয়।
এরূপ বেদ-উপনিষদাদিতে শ্রদ্ধার মহিমার উচ্চস্বরে কীর্তন করা হয়েছে। এই হলো শ্রদ্ধার মহত্ত্ব, এর বিপরীত অশ্রদ্ধা মানব হৃদয়কে নিরস এবং কুতার্কিক করে নাস্তিকতার রূপ ধারণ করে। এমন লোক পরমাত্মাকে দোষী মনে করতেও লজ্জিত হয়না।
একবার এক ব্রজবাসী ঘুরতে ঘুরতে কাবুল পৌঁছে গেল। সেখানে আঙুরের বাগান তথা অনেক প্রকারের ফুল এবং ফল তথা শুকনো মিষ্টি এবং ব্রজভূমির আকন্দ-পলাশ দেখে এবং ববুল আদি বৃক্ষসমূহের স্বরণ করে সে বলতে লাগলো—
হায় দই! গোপাল কী পড়ী মতি পে ধুর।
কাবুল মেং মেবা ভই, ব্রজ মেং বোয়ে ববুর।।
অর্থাৎ হায় রে ভাগ্য, গোপালের মতিভ্রম হয়েছে। কাবুলে মিষ্টি আর ব্রজে কাঁটাগাছ ।
এই হলো নাস্তিকতার ভয়ঙ্কর পরিণাম! ভুলে যাওয়া যে সব জায়গাতেই ভালো আছে, খুঁজে নিতে হয়, কোন সাময়িক মোহে যা আছে তার প্রতি বিশ্বাস হারানো উচিত না। এতটুকুই নয় অশ্রদ্ধাশীল মানুষ নিজেই নিজেকে হীন এবং নপুংসক মনে করে। স্বভাবে ক্রুরতা, রুক্ষতা এবং খিটখিটেভাব আসে, ক্রোধের মাত্রা বাড়ে। লোক এবং পরলোকের কথা ভালো লাগেনা, শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি অবিশ্বাসী হয়ে যায় এবং তখন তার কী দশা হয় ?
অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি
গীতা ৪।৪০
= মূর্খ, কারো ওপর শ্রদ্ধা রাখেননা —এমন সংশয়যুক্ত ব্যক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
মহাভারতের শান্তিপর্বে [২৬৪.১৫] বলা হয়েছে—
অশ্রদ্ধা পরমং পাপং শ্রদ্ধা পাপপ্রমোচনী।
অর্থাৎ অশ্রদ্ধা থেকেও বড় কোন পাপ নেই এবং শ্রদ্ধা হচ্ছে পাপ-পুঞ্জ ভস্ম করে জ্ঞানের প্রকাশ উৎপন্নকারী। যখন মানুষের মন-মন্দিরে শ্রদ্ধাবৃত্তি জাগ্রত হয় তখন তার ফল কী হয়, তা অথর্ববেদের একটি মন্ত্রে দেখুন—
ওজশ্চ তেজশ্চ সহশ্চ বলং চ বাক্চেন্দ্রিয়ং চ শ্রীশ্চ ধর্মশ্চ ॥
অথর্ব০ ১২।৫।৭
অর্থাৎ, শ্রদ্ধাবান মানুষের জীবনে পরাক্রম, তেজ, সহনশক্তি, শারীরিক আরোগ্যতা, প্রিয় এবং মধুর-ভাষণ, ইন্দ্রিয়সমূহের সংযম, শ্রী, ধর্ম আদি দৈবীগুণ প্রকট হয়।
গীতায় বলা হয়েছে—
শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ ।
জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি ॥
গীতা ৪।৩৯
= শ্রদ্ধালু ব্যক্তি ইন্দ্রিয় সংযম করে তৎপরা এবং সাধনাপূর্বক জ্ঞানের প্রাপ্তি করে নেয়। জ্ঞানোদয় হলে তার মুক্তি প্রাপ্ত হয় এবং সে পরমসুখের অনুভব করে।
শ্রদ্ধার মাধ্যমে অসীম আনন্দ লাভ হয়, কিন্তু বর্তমানে সংসারে শ্রদ্ধা বিষয়ে অনেক ভ্রান্তির বিস্তার আছে। কিছু মানুষের ধারণা এমন যে যুক্তি-তর্ক এবং শ্রদ্ধার পারস্পরিক বিরোধ আছে। তাদের মতে, তর্ক এবং শ্রদ্ধা একসাথে থাকতে পারেনা, পরন্তু এই ধারণা একদম মিথ্যা, কেননা মানুষ স্বভাবতই অনেক কথাই তর্ক ছাড়াই মেনে নেয়, কারণ—
' শ্রদ্ধাময়োঽয়ং পুরুষঃ' গীতা ১৭।৩
= মনুষ্য স্বভাব থেকেই শ্রদ্ধাশীল। যদি মানুষ প্রত্যেক কথাতেই তর্ক শুরু করে তবে জীবনে চলাই অসম্ভব, এজন্য মহর্ষি ব্যাস লিখেছেন—
'তর্কাপ্রতিষ্ঠানাৎ' ব্রহ্মসূত্র ২।১।১১
তাৎপর্য, যদি আমরা প্রত্যেক বাক্যে তর্কাকর্কি শুরু করি তো আমরা একটি ছোট্ট কাজও পূর্ণ করতে পারবোনা।
তর্ক মস্তিষ্কের বস্তু এবং শ্রদ্ধা হৃদয়ের ভাবনা, উভয়ের মেলবন্ধনেই জীবনে উন্নতি এবং সফলতা প্রাপ্ত হতে পারে অন্যথা নয়, এজন্য অথর্ববেদে বলা হয়েছে —
'মূর্ধানমস্য সংসীব্যাথর্বা হৃদয়ং চ যৎ' অথর্ব০ ১০।২।২৬
= হে নিশ্চল আত্মন! মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের ভাবনাকে অর্থাৎ তর্ক এবং শ্রদ্ধাকে মিলিত করো ।
মহর্ষি দয়ানন্দের জীবনে উভয়ের সমাবেশ ছিল। তিনি অদ্ভুত তার্কিক হয়েও মহান শ্রদ্ধালু ছিলেন।
'শ্রদ্ধা প্রাণঃ' অথর্ব০ ৯।৫।২১ = শ্রদ্ধা মানবজীবনের প্রাণ। তাই নিজের জীবনে শ্রদ্ধার আহ্বান করো।
শ্রদ্ধাং প্রাতর্হবামহে শ্রদ্ধাং মধ্যন্দিনং পরি ।
শ্রদ্ধাং সূর্যস্য নিম্রুচি শ্রদ্ধে শ্রদ্ধাপয়েহ নঃ ॥
ঋ০ ১০।১৫১।৫
ডাকো ! আমন্ত্রণ করো শ্রদ্ধাকে । আমরা প্রাতকালে শ্রদ্ধাযুক্ত হই, মধ্যাহ্নে শ্রদ্ধাযুক্ত হই, সায়ংকালে শ্রদ্ধাযুক্ত হই এবং রাত্রিতেও শ্রদ্ধাযুক্ত হই। আমরা জীবনের প্রত্যেক ক্ষণে এবং প্রত্যেক কাজে শ্রদ্ধা দ্বারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত । হে শ্রদ্ধা! আমাদের জীবনকে শ্রদ্ধাযুক্ত করো।