প্রশ্নঃ কারো মৃত্যু হলে সেই বাড়িতে কি পূজা-পাঠ বন্ধ রাখা উচিত ? যে গৃহে মৃত্যু হয় সেই গৃহে ১০/১২/১৫/৩০ দিন পর্যন্ত পূজা পাঠ করা হয় না – সন্ধ্যা-যজ্ঞও করা অনুচিত – দীপ প্রজ্জ্বলন -উচিত নয়!
সমাধান: এ সবই মনের ভুল, ভ্রান্তি। ১০/১২/১৫/৩০ দিন তো অনেক দূরের কথা সেই ঘরে তো প্রত্যেকদিন পূজা-পাঠ করা উচিত, প্রতিদিন প্রাত-সন্ধ্যা দুইবার অগ্নিহোত্র-সন্ধ্যোপাসনা করা উচিত। যে ঘরে কারোর মৃত্যু হয় সেই ঘরের পরিবেশ শুদ্ধ করার জন্য যজ্ঞ তো অবশ্যই করা উচিত। যে কক্ষে মৃত্যু হয় সেই কক্ষকে সাবান-জল দ্বারা ভালোমতো পরিষ্কার করা উচিত- কীটনাশক দ্বারা পরিষ্কার করা উচিত। শুদ্ধ ঘৃতের জ্যোতি প্রজ্জ্বলিত করা উচিত যেন অন্ধকার ভাব দূর হয়। যজ্ঞ তো সর্বশ্রেষ্ঠ-সর্বোত্তম কর্ম, কারণ হবনসামগ্রী জ্বললে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পরিবেশ শুদ্ধ এবং সুগন্ধিত হয়। অথর্ববেদেই [১২.২.২০] বলা হয়েছে, 'শুদ্ধা ভবত যজ্ঞিয়াঃ'= শুদ্ধ ও যজ্ঞশীল হও। অমুক তমুক দিন পর্যন্ত কেন, সর্বদা উপাসনাত্মক কর্ম করা উচিত। পূজা-পাঠ তো পবিত্র কর্ম, না করলেই নিজেরই ক্ষতি। নিয়মপূর্বক সন্ধ্যা করা উচিত। নিত্যকর্ম কখনো পরিত্যাগ করা চলবে না -
বেদোপকরণে চৈব স্বাধ্যাযে চৈব নৈত্যকে।
নানুরোধোঽস্ত্যনধ্যাযে হোমমন্ত্রেষু চৈব হি॥১॥
নৈত্যকে নাস্ত্যনধ্যাযো ব্রহ্মসত্রং হি তৎস্মৃতম্।
ব্রহ্মাহুতিহুতং পূণ্যমনধ্যাযবষট্কৃতম্॥২॥ মনু০ [২। ১০৫-১০৬]
অর্থ - বেদের পঠন-পাঠন, সন্ধ্যোপাসনাদি পঞ্চমহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করা এবং হোমমন্ত্র সম্বন্ধে অনধ্যায় এবং নিরোধ অর্থাৎ অননুষ্ঠান [= অনুষ্ঠানের ত্যাগ এবং নিষেধ] নাই, কেননা নিত্যকর্মে অনধ্যায় হয়না ॥১॥
যেরূপ সর্বদা শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করিতে হয়, কখনও বন্ধ করা যায় না, সেইরূপ প্রতিদিন নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান করা কৰ্ত্তব্য। নিত্যকর্ম একদিনও পরিত্যাগ করিবে না। কেননা অনধ্যায়েও অনুষ্ঠিত অগ্নিহোত্রাদি উত্তম কর্ম পুণ্যরূপ হয়। যেরূপ মিথ্যা বলিলে সর্বদা পাপ এবং সত্য বলিলে সর্বদা পুণ্য হয়, সেইরূপ কুকর্মে সর্বদা অনধ্যায় ও সুকর্মে সর্বদা স্বাধ্যায়ই হইয়া থাকে॥২॥
ঈশ্বরের স্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনায় কোনও অবস্থায় অবহেলা করা উচিত নয়। মৃত্যুর পরিবেশে তো অবশ্যই করা উচিত। এর দ্বারা মনে শান্তি প্রাপ্ত হয় – ধৈর্য প্রাপ্ত হয় - আত্মিক বল পাওয়া যায়, যার ফলে বিদেহী আত্মার চলে যাওয়ার দুঃখ কম হয়। এই সময় ঈশ্বরের উপাসনা থেকে ভক্তকে দূরে সরিয়ে রাখা বরং অন্যায়। কেউ কেউ বলেন এসময় মন অস্থির থাকে তাই উপাসনা করা যায় না, তাদের কাছে প্রশ্ন ঈশ্বর কি আমাদের উপাসনা পাওয়ার ভিখারি ? অবশ্যই না। তাকে আমরা চাই যেন তাকে পেয়ে আমি আনন্দ লাভ করতে পারি। যখন আমার কেউ মারা গিয়েছো, আমার মন দুঃখ ভ্রারাক্রান্ত তখনই আমার ঈশ্বরকে বেশী ডাকা উচিত যেন আমি সম্বিৎ না হারাই, আমার মনে যেন মানসিক বল আসে, তাকে অবলম্বন করে যেন সামনে এগিয়ে যেতে পারি। অনেকে বেদপাঠ নিষিদ্ধ করেন, গীতা পড়তে বলেন। অথচ গীতাতেই বেদের উল্লেখ আছে। তাহলে কেন পড়বো না ? আমার জন্য বৈদিক বিধান আগে নাকি প্রক্ষিপ্তাদি যুক্ত স্মার্ত বিধান ? কেউ কেউ আবার শাস্ত্রীয় কর্ম বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক বা গুরুবাদী কর্ম করতে বলেন ধর্মীয় কর্মের জায়গায়। এটাও সরাসরি সনাতন শাস্ত্র বিরোধী। যদি কোন মতবাদ অনুযায়ী তথাকথিত ঈশ্বরকে আমি আমার দুর্বলতার সময়ে নিজের মাতা - পিতা -সখাভাবে আত্মিক প্রয়োজনে ডাকতেই না পারি, তার উপাসনাই করতে না পারি তাহলে সেই তথাকথিত ঈশ্বর দিয়ে কী করবো ? সেই ঈশ্বর বেদ প্রতিপাদিত অবশ্যই না। কেননা বেদ [ঋ০ ১০.১৫১.৫] নিজেই বলে ঈশ্বরকে সব সময় স্মরণ করতে।
'ত্রয়ো ধর্মস্কন্ধা যজ্ঞোঽধ্যয়নং দানমিতি ছান্দোগ্য০ ২।২৩।১' অর্থাৎ, ধর্মের ৩ স্কন্ধ - যজ্ঞ, অধ্যয়ন ও দান৷ পুণ্য কাজ নিত্য করা উচিত অর্থাৎ দান-পুণ্য অবশ্যই করা উচিত যার দ্বারা গৃহস্থের সুসংস্কার লাভ হয়। মনে রাখবেন, কর্তাই কর্মফল লাভ করে। বিদেহী আত্মার জন্য কিছুই করা সম্ভব নয়। যা জ্বলে ছাই হয়ে গেছে, তার নামে পুণ্যকর্ম করলে – দান-দক্ষিণা দিলে মৃত ব্যক্তির কোন লাভ হয় না। যে কর্তা সেই ফল লাভ করে। প্রমাণ স্বরূপ -
১. তস্যেদর্বন্তো রংহয়ন্ত আশবস্তস্য দ্যুম্নিতমং যশঃ । ন তমংহো দেবকৃতং কুতশ্চন ন মর্ত্যকৃতং নশৎ ~ ঋগ্বেদ ৮.১৯.৬
২. যসয় কুর্মা গৃহে হবিস্তমগ্নে বর্ধয়া ত্বম্ । তস্মৈ দেবা অধি ব্রবন্নয়ঞ্চ ব্রহ্মণস্পতিঃ ~ যজুর্বেদ ১৭.৫২
৩. উত্তিষ্ঠ ব্রহ্মণস্পতে দেবান্ যজ্ঞেন বোধয় । আয়ুঃ প্রাণং প্রজাং পশূন্ কীর্তিং যজমানং চ বর্ধয় ~ অথর্ববেদ ১৯.৬৩.১
৪. তস্মাৎসর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ - গীতা ৩.১৫
৫. অযজ্ঞিয়ো হতবর্চা ভবতি ~ অথর্ববেদ ১২.২.৩৭ = যে পঞ্চমহাযজ্ঞ ও মানবকল্যাণরূপ যজ্ঞ করে না সে তেজস্বী হতে পারে না।