দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







হোলি বা বাসন্তী নবসস্যেষ্টির তাৎপর্য

সত্যান্বেষী
0

 


ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় পালিত হোলি উৎসবের প্রাচীন নাম "বাসন্তী নবস্যেষ্টি"। বসন্ত ঋতুর আগমনে এই উৎসব পালিত হয়। চৈত্র কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে একে অপরের মুখে রং মাখিয়ে বা জলে গোলা রং একে অপরের উপর ছিটিয়ে এবং একে অপরের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে এই উৎসব পালনের প্রথা চলে আসছে। এও বলা হয় যে এই উৎসবের দিনে পুরনো মতভেদ, শত্রুতা ইত্যাদি ভুলে নতুন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শুরু করা হয়। কোথাও কোথাও প্রত্যাশিত ফল পাওয়া গেলেও, এর সম্পূর্ণ সফলতা সন্দেহজনক।
 
চারদিকে রংবেরঙের ফুলের সমারোহে পরিবেশও যেন রঙিন হয়ে ওঠে। তাই বাসন্তিক নবশস্যেষ্টি অপর নাম হোলি, তাকে রঙের উৎসবের তুলনা দেওয়া যেতে পারে। ভারতে প্রচলিত ছয়টি ঋতুর মধ্যে বসন্ত ঋতুকে রাজা বলা হয়। বসন্তকালে শীতকালের অবসান হয় এবং আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হয়ে ওঠে। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ দেখা যায় এবং নানা রকমের ফুল ও সবুজ পাতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
মনে হয় যেন প্রকৃতি কোনো বিশেষ উপলক্ষে কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে নিজেকে সাজিয়েছে। এই সাজসজ্জা যেন বসন্ত ঋতু ও চৈত্র মাস থেকে শুরু হওয়া নববর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্য। পলাশ গাছে ফুলে ভরা ডালপালা শোভা পেয়ে বলছে, "তোমরাও আমাদের অনুসরণ করে নিজেদের জীবনকে বিভিন্ন সাত্ত্বিক রঙে রাঙিয়ে নতুন আভায় শোভিত করো।"
 
এই পরিবেশে মন আনন্দে ভরে ওঠে। প্রকৃতির এই রূপ দেখে সাত্ত্বিক মনের মানুষ বলে ওঠে, "হে ঈশ্বর, তুমি মহান।" নানা রকমের ফল, পাতা ও লতাপাতায় সজ্জিত এই সৃষ্টি দেখেও যদি মানুষ এর সৃষ্টিকর্তাকে অনুভব বা প্রত্যক্ষ না করে, তবে তা এক প্রকার জড়বুদ্ধির প্রমাণ। বিভিন্ন রঙের ফুলের শোভা ও সুগন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে বার্তা দিচ্ছে যে, তোমরাও বিভিন্ন রঙ ও সুগন্ধ অর্থাৎ বিবিধ গুণ নিজেদের জীবনে ধারণ করো, যা আকর্ষণীয় হবে এবং যার দ্বারা জীবন ফুলের মতো প্রফুল্ল, প্রস্ফুটিত এবং অন্যদেরও আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করবে।
 
প্রকৃতির এই বিভিন্ন রঙ তো ঈশ্বরের থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে, যা থেকে অনুমান করা যায় যে সাত্ত্বিক মানুষেরও শুধু নির্জনবাসী না হয়ে সমাজের সাথে মিশে নিজেদের আনন্দ সাত্ত্বিক রঙের মাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত। হোলির দিনে মানুষ এমনই কিছু মনোভাবকে কাজে পরিণত করতে দেখা যায়। হয়তো দেখা যায়, উৎসবের দিনে যার যে নেশা থাকে, সে তার উপর রং মাখিয়ে আনন্দিত হয়। আজকাল হোলির সময় মদ্যপান তেমনই এক কাজ বলে মনে হয়। মদ্যপান জীবনকে বিবেকহীন করে পতনের দিকে নিয়ে যায়। এভাবে হোলি পালন করা বৈদিক সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের নিজস্ব পদ্ধতি।
 
এছাড়া আমরা দেখি, হোলির পূর্ণিমার রাতে হোলিকা দহন করা হয়। অনেক কাঠ এক জায়গায় জড়ো করে অবৈদিক পদ্ধতিতে পূজার্চনা করে তাতে আগুন জ্বালানো হয়। কিছুক্ষণ পর কাঠগুলো জ্বলে নিভে যায়। লোকেরা মনে করে যে তারা খুব বড় কোনো ধর্মীয় কাজ করেছে, কিন্তু তা নয়। বরং এভাবে হোলিকা দহন কোনো প্রাচীন লুপ্ত প্রথার দিকে ইঙ্গিত করে। 
 
সৃষ্টির শুরু থেকেই বেদের অনুপ্রেরণায় আমাদের দেশে অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করার প্রথা চলে আসছে। আজও আর্য সমাজ মন্দির ও আর্যদের বাড়িতে নিয়মিতভাবে এই যজ্ঞ করা হয়।
প্রাচীন শাস্ত্রে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার দিনে পক্ষ্যেষ্টি যজ্ঞ করার বিধান আছে, যা দর্শ ও পৌর্ণমাস নামে পরিচিত। পরিবারের মধ্যে যে কাজ করা হয় তা স্বাভাবিকভাবেই ছোট হয় এবং যা সম্মিলিতভাবে করা হয় তা বৃহত্তর রূপ নেয়, যার প্রভাবও পরিমাণের অনুরূপ হয়। হোলির দিন পূর্ণিমার দিন।
ফাল্গুন মাসে কৃষকদের জমিতে গমের ফসল ঢেউ খেলছে। গমের শীষে গমের দানা পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেছে, এখন তাদের সূর্যের আলো দরকার যাতে সেগুলো পাকতে পারে। এই গমের শীষ বা এর ভাজা দানাগুলোকে হোলা বলা হয়। কয়েকদিন পরেই ফসল পেকে যাবে এবং কৃষক তা কেটে নিজেদের বাড়ির আঙিনায় জমা করবে। এই জমা করা শস্য থেকে সারা বছর ধরে তাদের পরিবার ও দেশবাসী ভোগ করবে, যার থেকে সবাই বল, শক্তি, তেজ, আয়ু, সুখ, আনন্দ ইত্যাদি লাভ করবে। গমের শীষ বা হোলা পূর্ণিমার যজ্ঞে দিয়ে তা অগ্নির মাধ্যমে সমস্ত প্রাণী ও দেবতাদের সমর্পণ করা হয় এবং দেবতাদের অংশ দেওয়ার পর কৃষক ও অন্যান্য লোকেরা তা ব্যবহার ও ভোগ করেন।
 
হোলির পুরাতন বিধান সেই নব-অন্ন-ইষ্টি যজ্ঞের স্মৃতিকে স্মরণ করায়। তাই প্রাচীনকালে এই উৎসবকে নবশস্যেষ্টি বলা হতো। আজকের দিনে হোলির রূপ পরিবর্তন করা উচিত। রাতে হোলিকা না জ্বালিয়ে দিনের বেলা ১০-১১ টার মধ্যে গ্রামের সব লোকের উপস্থিতিতে কোনো এক জায়গায় বৃহৎ যজ্ঞের আয়োজন করা উচিত।
 
কোনো বৈদিক পণ্ডিত, যিনি যজ্ঞে বিশেষজ্ঞ, তিনি সেই যজ্ঞ করাবেন। উপস্থিত জনগণকে এর গুরুত্ব জানাবেন এবং যজ্ঞের পর সব পুরুষ-মহিলা মিলে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাবেন ও নিজেদের থেকে মিষ্টি বিতরণ করবেন। হোলি বা নবস্যেষ্টি উৎসব উপলক্ষে সেখানে বড় ভোজ বা লঙ্গরও করা যেতে পারে। চাইলে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী প্রাকৃতিক রঙের টিকা মুখে লাগিয়েও একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করা যেতে পারে। প্রাচীন বর্ণাশ্রম প্রথা অনুযায়ী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারটি বর্ণের একটি করে উৎসব আছে, যাদের নাম যথাক্রমে শ্রাবণী বা রক্ষা-বন্ধন, দশেরা বা বিজয়াদশমী, দীপাবলি বা শারদীয় নবস্যেষ্টি এবং হোলি বা বাসন্তিক নবস্যেষ্টি। আমাদের এখানে প্রাচীনকাল থেকেই যজ্ঞের পরম্পরা চলে আসছে। প্রতি পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় পক্ষ্যেষ্টি যজ্ঞ করা হতো এবং আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠার পর তা আবার প্রচলিত হয়েছে। গমের নতুন ফসলের দানা দিয়ে পূর্ণিমার বৃহৎ যজ্ঞে আহুতি দিলে হোলি নাম সার্থক হয়। প্রাচীনকালে এমনই হতো, যার বিকৃত রূপ আজকের হোলি উৎসব। যদিও এই উৎসব কৃষক, শ্রমিক ও বৈশ্য বর্ণের, তবুও সব বর্ণ ও সম্প্রদায়ের লোকেরা মিলে এটি পালন করলে সমাজে এক ভালো ভাবনার উদয় হয়। দেখুন সময়ের সাথে সাথে কিছু লোকের সম্পদ অনেক বেড়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। ধনীরা নিজেদের কৃত্রিম মানসিক প্রকৃতি ও রুটিন অনুযায়ী প্রতিটি কাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। অন্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত লোকেরা তাদের অন্ধ অনুকরণ করে। এই সব এবং মধ্যযুগের অজ্ঞতা ও অন্ধকার উৎসবের মূল ভাবনাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। গমের দানাযুক্ত শীষ সমগ্র মানবসমাজের জন্য প্রয়োজনীয়, অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেহ ও শরীর অন্নময়। অন্য সব প্রাণীর শরীরও অন্নময়। সব অন্নের মধ্যে প্রধান গম বা হোলাকে প্রতীক ধরলে কৃষক ও ঈশ্বরের দ্বারা এর নির্মাণ ও উৎপাদন এবং জমিতে ফসল দেখে কৃষক-শ্রমিক-বৈশ্য ভাইদের ও অন্য সব মানুষের যে আনন্দ হয়, তা প্রকাশ করার জন্য বৃহৎ যজ্ঞ করা এবং সবাই মিলে তাতে নতুন ফসল গমের দানা হোলা যজ্ঞদ্রব্য হিসেবে আহুতি দেওয়া, যাতে ঈশ্বরের কৃপায় সেই অন্ন সব দেশবাসীর সুখ-সমৃদ্ধির ভিত্তি হয়, এই ভাবনা উৎসবে নিহিত রয়েছে ।
 
একবার রঙের সম্পর্কে পুনরায় চিন্তা করে এর মধ্যে থাকা বার্তা জানার চেষ্টা করি। সব রঙ ঈশ্বরের তৈরি। এরও জীবনে কিছু উপযোগিতা নিশ্চয়ই থাকবে, না হলে ঈশ্বর এগুলো তৈরি করতেন কেন? যদি চিন্তা করি, তবে শৈশবকালের পর বাল্যকাল আসে, যখন মা-বাবা ছেলে-মেয়েকে গুরুকুলে পাঠিয়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতি দেওয়ার চেষ্টা করেন। বাল্যকালের পর যৌবনকাল শুরু হয়, এটিও জীবনের একটি অংশ বা রঙ, যখন মানুষের মধ্যে শক্তি ও উৎসাহ ঢেউ তোলে। জীবনের এই পর্যায়ে মানুষ সাফল্য লাভ করে। মহর্ষি দয়ানন্দও ১৮ বছর বয়সে নিজের বাড়ি, পরিবার, পাড়া, মা-বাবা, ভাই-বন্ধু ও বন্ধুদের ছেড়ে সংসারের সত্যতা ও রহস্য জানার জন্য এবং সৃষ্টিকর্তাকে জেনে তাকে পাওয়ার জন্য (যাকে আমরা সত্য শিবের খোঁজ বলি) বেরিয়েছিলেন।
 
এছাড়াও তার মনে মৃত্যুর ভয় ছিল, যা থেকে তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন। এই ভয় জয় করার উপায় খোঁজা ছিল তার উদ্দেশ্য, যাতে তিনি সফল হয়েছিলেন। মৃত্যুর উপর বিজয় পাওয়ার প্রমাণ তার নিজের মৃত্যুর দৃশ্য। আমরা দেখি, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তার মৃত্যু ও তার আগের শারীরিক কষ্ট তাকে সামান্যও বিচলিত করতে পারেনি। যৌবনকালের আগে ও যৌবনকালের কিছু সময় বিদ্যা অর্জনে লেগে যায়। এরপর বিবাহ হয় এবং তারপর ব্যবসার নির্বাচন, সন্তান বৃদ্ধি ও সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব থাকে।
 
যৌবনকালে মানুষ ভালো বা মন্দ, নিজের স্বভাব অনুযায়ী, জ্ঞান, সামর্থ্য, অনুপ্রেরণা ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করে। যৌবনকালের পর পরিপক্কতা আসে, যা যৌবনকালের শেষ সময় এবং এর কিছু সময় পর বার্ধক্য শুরু হয়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের নিজস্ব গুরুত্ব ও উপযোগিতা আছে এবং এতে নানা রকমের রঙ থাকে। রঙ অর্থাৎ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়। অন্য পর্যায়গুলো বাদ দিয়ে যদি যৌবনকালের দিকে তাকাই, তবে দেখি আজকের যুবকেরা আধুনিকতার রঙে রঙিন, যেখানে বুদ্ধির ব্যবহার নামমাত্র। আমাদের মনে হয়, কিছু কথা হয়তো ভালো হতে পারে। আধুনিক জীবনযাত্রা আমাদের ধ্বংসের দিকে বেশি নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের যুবকদের চিন্তা ও বোঝার ক্ষমতা বেশি নেই। আজকালকার সামাজিক ও বৈশ্বিক পরিবেশও অনুকূল নয়, প্রতিকূল। আমাদের এখানে বিবেক দিয়ে নিজেদের পথ বেছে নিতে হবে।
 
আজকের যুবসমাজ আধুনিকতার চাকচিক্যে এতটাই মোহিত যে তারা বেদ, বৈদিক সাহিত্য, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর জীবনচরিত এবং তাঁর "সত্যাৰ্থ প্রকাশ"-এর মতো গ্রন্থগুলি পাঠ করেনি। যদি তারা এগুলো অধ্যয়ন করত, তবে তারা জ্ঞানের চোখ বন্ধ করে আধুনিকতাকে অনুসরণ করত না এবং নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝতে পারত। তাই, হোলি উৎসব পালনের সময় আমাদের আত্ম-বিশ্লেষণ করা উচিত, ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করে ভালটিকে গ্রহণ করা উচিত এবং অন্যদের মতো বিবেচনাহীনভাবে আধুনিকতার স্রোতে ভেসে না গিয়ে সত্য, বৈদিক জ্ঞান এবং বিবেকের পথে চলা উচিত। অন্যথায়, আধুনিক জীবনধারা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য অনুশোচনার কারণ হবে। অতএব, যুবসমাজের উচিত নিজেদের বুদ্ধিকে সত্য-মিথ্যা এবং ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা দেওয়া এবং মিথ্যাকে পরিত্যাগ করে সত্যকে গ্রহণ করা। হোলি উৎসবের এই প্রেক্ষাপটে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বিষয় হতে পারে।
 
আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ভিত্তি হলো বেদ এবং বৈদিক সাহিত্য। বেদ ঈশ্বরের প্রদত্ত জ্ঞান। ঈশ্বর এই বিশ্বের রচয়িতা এবং সমগ্র প্রাণীজগতের সৃষ্টিকর্তা। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী, সত্য-চিত্ত-আনন্দস্বরূপ, নিরাকার এবং বিশ্বের ধারক ও পালক। তিনি আমাদের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য পূরণের জন্য মানুষের জন্ম দিয়েছেন। আমাদের তাঁকে জানতে হবে। সেই লক্ষ্য হলো ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ। দুঃখ থেকে মুক্তি এবং আনন্দ লাভের পথ হলো বৈদিক গ্রন্থ অধ্যয়ন, যজ্ঞ এবং বৈদিক জীবনযাপন। ধর্ম অর্থাৎ কর্তব্য এবং বেদ-নির্দেশিত কর্ম, যেমন সন্ধ্যা উপাসনা, অগ্নিহোত্র, পিতৃযজ্ঞ, অতিথিয়জ্ঞ এবং বলিবৈশ্বদেব-যজ্ঞ ইত্যাদি। এগুলোর পালন এবং আচরণই ধর্ম। মানুষের উচিত শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি করা, যা বেদ অধ্যয়নের মাধ্যমে সম্ভব। এগুলো জানা এবং পালন করাই ধর্ম। এই কর্মগুলি করার মাধ্যমে ধর্ম থেকে অর্থ উপার্জন করা এবং ধর্ম ও অর্থ থেকে প্রাপ্ত সুখের সামগ্রী বৈদিক নিয়ম অনুসারে ভোগ করাই 'কাম'।
 
এই কর্মগুলি করার মাধ্যমে উপাসনা-যোগ দ্বারা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ হলে মোক্ষ লাভ হয়। এখানে পৌঁছে জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়। জীবনের লক্ষ্য মোক্ষের কাছাকাছি হয়। যদি আমরা এই পথ অনুসরণ না করি, তবে আমাদের এই জন্ম এবং পরজন্ম উভয়ই দুঃখপূর্ণ এবং ব্যর্থ হবে। আমরা দেখেছি যে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি কোনো অশিক্ষিত ব্যক্তিকে অনুসরণ করে না, যদি করে তবে সে মূর্খ। কিন্তু এখানে আমরা দেখি যে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আমরা প্রায়শই মূর্খদের অনুসরণ করি। যাদের শিক্ষিত করা আমাদের কর্তব্য ছিল, তাদের মূর্খতাপূর্ণ কাজগুলি আমরা নিজেদের কামনা-বাসনা পূরণের জন্য অনুসরণ করেছি।
এটি আমাদের বড় ভুল, যা আমাদের সংশোধন করতে হবে, অন্যথায় এর অপ্রীতিকর পরিণতি ভবিষ্যতে আমাদের সামনে আসবে। অতএব, সত্য-মিথ্যা বিচারের ক্ষেত্রে দেরি করা ক্ষতিকর। এখানে অবশ্যই বলতে হয় যে বেদ এবং বৈদিক সাহিত্যে বর্তমানে পালিত হোলি উৎসবের কোনো উল্লেখ নেই। মহর্ষি দয়ানন্দও তাঁর বিস্তৃত সাহিত্যে এই ধরনের হোলির উল্লেখ বা বিধান করেননি, তিনি কেবল নবস্যেষ্টির উল্লেখ করেছেন। পুরাণগুলিতেও এই ধরনের হোলির বিধান থাকার সম্ভাবনা কম। পুরাণগুলিতে রাজা হিরণ্যকশিপু, তাঁর বোন হোলিকা এবং পুত্র প্রহ্লাদের একটি গল্প রয়েছে, যার উদ্দেশ্য হলো ঈশ্বরের উপাসনা এবং ভক্তিমূলক বার্তা দেওয়া, যাতে লোকেরা ঈশ্বর ভক্তিতে প্রবৃত্ত হয়।
 
এই গল্পের সঙ্গে বর্তমান হোলির কোনো সরাসরি এবং উপকারী সম্পর্ক নেই। হোলির দিনে ফাল্গুন মাস শেষ হয় এবং চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়। চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষ থেকে নতুন বৈদিক বর্ষ শুরু হয়। আমাদের মনে হয়, হোলি উৎসব পুরোনো বছরকে পূর্ণিমার দিনে বৃহৎ অগ্নিহোত্র-যজ্ঞের মাধ্যমে বিদায় জানিয়ে চৈত্র কৃষ্ণ প্রতিপদের দিনে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসবও বটে। পৌরাণিক ঐতিহ্য অনুসারে, স্বাগত জানানোর জন্য ফুল এবং ফুলের মালা ব্যবহার করা হয়। এভাবে ফুল উপহার দিয়ে দেখানো হয় যে ফুলের মতো বিভিন্ন রঙে সজ্জিত এবং সুন্দর এবং তাদের সুগন্ধের মাধ্যমে নিজেদের সুস্থ রাখা হচ্ছে।
 
প্রকৃতি এই দিনে বিভিন্ন রঙের ফুল দিয়ে সেজে চৈত্র মাসকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত থাকে। আবহাওয়াও তার শীতলতা কমিয়ে আনে। এই দিনে, যদি বৃষ্টি না হয়, তবে আবহাওয়া খুব মনোরম এবং অনুকূল থাকে। মনে হয়, প্রকৃতি তার রঙিন ফুল এবং তাদের সুগন্ধ দিয়ে নতুন বছরের প্রথম মাস চৈত্রকে স্বাগত জানাচ্ছে। আমরা যজ্ঞের মাধ্যমে পরিবেশে সুগন্ধ সৃষ্টি করি, প্রকৃতিও ফুলের সুগন্ধ দিয়ে পরিবেশকে সুগন্ধিত করে।
 
এটি প্রকৃতির নিজস্ব সৃষ্টি-যজ্ঞ। আমাদের যজ্ঞও এর প্রতীক। আমাদের জীবন উৎসাহ, উদ্দীপনা, উদ্যম, বিবেক, জ্ঞান, উপাসনা, অগ্নিহোত্র-যজ্ঞ, আত্ম-কল্যাণের ভাবনা, বেদের প্রচারের কামনা এবং সত্যের প্রতি আগ্রহের মতো গুণাবলিতে পূর্ণ হওয়া উচিত। এই উৎসব থেকে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পরিশেষে এই উৎসব উপলক্ষে সবাইকে আমাদের শুভকামনা।
 
লেখক- মনমোহন কুমার আর্য

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)