
ভগবান শ্রীরাম কি মাংস ভক্ষণ করেছিলেন?
১| চন্দ্র
২| অভ্যু
৩| ইন্দু
৪| লালা তসল্লী (লাঃ তসঃ)
৫| ঠাকুর
৬| কবীর
৭| রাম
৮| শেঠ
কথোপকথন আরম্ভঃ
অভ্যুঃ কাল রাত বেশ মজার ঘটনা ঘটেছে।
অভ্যুঃ আপনি জানেন যে আমি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
লাঃ তসঃ হ্যাঁ! আপনি তো আগেই বলছিলেন।
অভ্যুঃ কালকে একটি নৈশভোজ ছিল। বহু ধনী ব্যক্তিরা জড়ো হয়েছিলেন। মাংস এবং মদ সবই ছিল। আমি খেতে অস্বীকার করলাম। এতে বেশ হাসাহাসি হল। সবাই বলতে লাগল যে অভ্যুদয় সিংহ তো বণিক হয়ে গেছন। ইনি কি ধরণের ক্ষত্রিয়? ইনি ক্ষত্রিয়দের নাম ডুবিয়ে দিলেন। জৈনদের মত হিংসা হিংসা করতে থাকেন।
লাঃ তসঃ তারপর আপনি কি করলেন?
অভ্যুঃ- আমি খাইনি ঠিকই, তবে আমাকে লজ্জিত হতে হয়েছিল। তারা সবাই আমাকে নিয়ে কৌতুক করতে থাকল।
চন্দ্রঃ আপনি তাকে নিয়ে কৌতুক করলেন না কেন?
অভ্যুঃ আমি কি করব! তারা অনেকজন ছিল, আমি একলা।
ইন্দুঃ আপনি অবশ্যই কাঁচা ক্ষত্রিয়।
অভ্যুঃ- আপনিও এরকম বলছেন?
চন্দ্রঃ বলবো না কেন? একজন ক্ষত্রিয় অনেকজন ক্ষত্রিয়কে দেখে ভয় পেয়ে গেল, লজ্জিত হয়ে পড়ল! যখন তাদের ব্যঙ্গতেই ভীত হয়ে পড়লেন তাহলে তলোয়ার থাকলে কি অবস্থা হতো?
অভ্যুঃ- কিছু বলুন ভাই। বিষয় তো এটাই যে আমার কাছে কোন উত্তর ছিল না।
চন্দ্রঃ দেখুন ঠাকুর সাহেব! প্রথমে তো দেখা দরকার যে ক্ষত্রিয় কাদের বলা হয়। 'ক্ষতাত্ ত্রায়তে স ক্ষত্রিয়ঃ।' যারা প্রাণীদেরকে দুঃখ থেকে রক্ষা করেন তারাই ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়কে 'নৃপ'ও বলা হয়, কারণ তারা মানুষের রক্ষা করেন। ক্ষত্রিয়ত্ব এবং মাংস-ভক্ষণের কোন সম্পর্ক নেই। যেসব লোক সারাজীবন মাংস এবং মদ্যের সেবন করে, অসংখ্য প্রাণীদের হিংসা করে এবং অন্য কারোর রক্ষা করে না তারা ক্ষত্রিয় কিভাবে হতে পারে? তারা তো মহা অক্ষত্রিয়।
অভ্যুঃ- ক্ষত্রিয়রা তো সিংহ।
চন্দ্রঃ ক্ষত্রিয়দের উপমা সিংহের সঙ্গে করা বড় ভ্রমাত্মক। প্রাচীন সময়ে ভারতবর্ষে ক্ষত্রিয়দের নামে হিংসা হত না। রাজা দশরথ, দশরথসিংহ ছিলেন না। রাজা যুধিষ্ঠির যুধিষ্ঠিরসিংহ ছিলেন না। রাজা দিলীপ দিলীপসিংহ ছিলেন না। রাজা অজ অজসিংহ ছিলেন না। যেদিন থেকে ক্ষত্রিয়গণ নিজেদের নামের সাথে 'সিংহ' যুক্ত করা শুরু করেছিল, তখন থেকে তারা শুধুই সিংহই হয়ে গেছে।
অভ্যুঃ এতে ক্ষতি কিসের?
চন্দ্রঃ ক্ষতি তো অনেক হয়েছে। আদর্শ পতন হয়েছে। উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়েছে।
অভ্যুঃ- কিভাবে?
চন্দ্রঃ দেখুন! সিংহকে বনের রাজা বলা হয় কেন?
অভ্যুঃ তার বলের কারণে।
চন্দ্রঃ কেমন বল? পাশবিক বল অথবা নৈতিক বল অথবা আত্মবল।
অভ্যুঃ বল তো বলই।
চন্দ্রঃ না। পাশবিক বল কোন মানুষকে রাজা বানাতে পারে না। রাজার জন্য, প্রজার পালন আবশ্যক। সিংহ সবাইকে ভক্ষণ করে নেয়, কারোর রক্ষা করে না। সিংহের রাজত্বে কারোর শক্তি অথবা স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয় না। সিংহ কাউকে 'অদীনাঃ স্যাম শরদঃ শতম্'-র পাঠ পড়তে দেয় না। হত্যা এবং ভক্ষণ সিংহের কাজ। যখন থেকে ক্ষত্রিয়গণ সিংহ হয়ে গেছে, তখন থেকে তারা প্রজাপালন ছেড়ে দিয়েছে। তারা ভোজনবীর হয়ে গেছে। নীতি এবং ধর্মের সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এরা ধর্মশাস্ত্রকে ভুলে গিয়েছে। এদের মধ্যে কেবল পাশবিক বলটাই থেকে গিয়েছে। আত্মবল চলে গিয়েছে। এরা ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে গিয়েছে। অহংকারে ডুবে থাকে, দ্বেষভাব বেড়ে গেছে।
অভ্যুঃ তাহলে আপনি কি মহারাণা প্রতাপের মত ক্ষত্রিয়ের অবহেলা করেন?
চন্দ্রঃ না, মহাশয়! মহারাণা প্রতাপের মধ্যে কি ক্ষত্রিয়ের সমস্ত গুণ নেই? মহারাণা প্রতাপের নাম এইজন্য বিখ্যাত যে তিনি সবকিছু ত্যাগ করে হিন্দুজাতির উত্থানের প্রচেষ্টা করেছেন, কিন্তু কয়জন ক্ষত্রিয় এমন? আপনি একটু ক্ষত্রিয়দের অভ্যন্তরীণ জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। একজন ইংরেজ ফরাসী নীতিজ্ঞ রান্নার বিষয়ে বলেছেন-
চার চীজন্ত বর-রইসাং ফর্জ।
পালকী গুড়গুড়ী তবাঈফ কর্জ ।।
অর্থাৎ ধনী লোকের চারটি লক্ষণ আছে
(১) পালকী (২) হুক্কা (৩) বেশ্যাগিরি (৪) ঋণ।
ঠাকুর সাহেব ক্ষত্রিয়দের গর্ব এই কথায় নয় যে নিজের জীবনে কতগুলি ডিম খেয়েছে, কতগুলি ছাগল হত্যা করেছে, কতগুলি খরগোশের শিকার করেছে। কতগুলি কোয়েলের ডানা ছাড়িয়েছে অথবা কতগুলো ভেড়া হালাল করেছে। প্রশ্ন তো এটা হওয়া উচিত যে নিজের জীবনে কতগুলো প্রাণীকে বিপত্তি থেকে রক্ষা করেছে। রাজা দিলীপ কি বলেছিলেন? মনে করুন কালীদাসের শব্দগুলিকে -
যশঃ শরীরে ভবমে দয়ালুঃ
অর্থাৎ আমার নিজের শরীরের পরোয়া নেই। কীর্তির পরোয়া আছে। দেখ আমার কীর্তিতে দাগ না লেগে যায়। সেই স্থান মনে আছে, যেখানে দিলীপ কথা বলেছিলেন।
ইন্দুঃ হ্যাঁ, মনে আছে। গাভীর জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবনকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন।
চন্দ্রঃ ঠিক! এটাই তো আমি বলছি।
অভ্যুঃ আপনি তো ঠিক বলেছেন, কিন্তু যদি ক্ষত্রিয়রা মাংস না খায় তবে শিকারের অভ্যাস দূর হয়ে যাবে আর শিকার না করলে রক্ষা কিভাবে সম্ভব?
চন্দ্রঃ ঠাকুর সাহেব! ক্ষমা করবেন। আসলে আপনি তো হলেন কলিযুগের ক্ষত্রিয় তাই না। এইজন্য আপনার বিচারও কলিযুগী। আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।
অভ্যুঃ- কি?
চন্দ্রঃ যতক্ষণ না মানুষের মধ্যে দয়াভাব আসে সেই সময় পর্যন্ত কোন মানুষ কি কারোর রক্ষার জন্য তৎপর হতে পারে?
অভ্যুঃ না, পালনের জন্য দয়া থাকা উচিত।
চন্দ্রঃ দয়ার অভ্যাসও থাকা প্রয়োজন।
অভ্যুঃ- হ্যাঁ।
চন্দ্রঃ সেই অভ্যাস শৈশবকাল থেকেই শেখা উচিত।
অভ্যুঃ- হ্যাঁ।
চন্দ্রঃ তাহলে কি সেই ক্ষত্রিয় বালক, যার বাল্যকাল থেকেই গু*লি দ্বারা পাখি হত্যার অভ্যাস করানো হয়, সে দয়ার অভ্যাস করে নাকি নিষ্ঠুরতার?
অভ্যুঃ- নিষ্ঠুরতার।
চন্দ্রঃ তাহলে এই নিষ্ঠুরতার অভ্যাসের ফল দয়া কিভাবে হতে পারে? সে তো নিষ্ঠুরই হবে। দয়ার যে অঙ্কুর তার হৃদয়ে থাকে সেটাও শুকিয়ে যায়।
অভ্যুঃ এমনই তো মনে হয়।
চন্দ্রঃ এইজন্যই তো বর্তমানের ক্ষত্রিয়গণ নিজেদের বিলাসিতা আরামই বোঝে। প্রজা পালন নয়। রাতে নৃত্য-রঙ্গ, মদ্য এবং কোলাহল। দিনের বেলায় ঘুমানো অথবা শিকার করা। প্রজাদের কল্যাণ কে করবে? রাজ-কর্মচারীগণ রাজাকে দেখে তার অনুরূপই হয়ে যায়, রাজাদের খুশি করা এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি। গর্ব অধিক, কর্মহীন। তাহলে সিংহ কিসের? সার্কাসের সিংহ যেগুলোর উপর বিদ্যুতের ডান্ডা বসায়। আপনি তাদের সিংহ বলবেন নাকি সিংহের বাবা। এদের মধ্যে যতক্ষণ না আত্মবলের উদয় হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এদেরকে ক্ষত্রিয় বলা যায় না। হ্যাঁ-
যথা কাঠময়ো হস্তী যথা চর্মময়ো মৃগঃ
অর্থ: কাষ্ঠের হস্তীর সমান হস্তী অবশ্যই। ক্ষত্রিয়ের সন্তান তো অবশ্যই, কিন্তু ক্ষত্রিয় নয়।
ঠাঃ অভ্যুঃ শিকার ক্রীড়া কি ক্ষত্রিয়গণের কার্য নয়?
চন্দ্রঃ রাজা মনু তো ক্ষত্রিয় ছিলেন?
ঠাঃ অভ্যুঃ হ্যাঁ।
ইন্দ্রঃ আপনার থেকে উত্তম ক্ষত্রিয়?
ঠাঃ অভ্যুঃ হ্যাঁ ছিলেন।
চন্দ্রঃ তিনি তো শিকার অথবা মৃগয়াকে ক্ষত্রিয়দের গুণ নয় বরং দোষ বলেছেন। দেখুন-
ইন্দ্রিয়াণাং জপে যোগং সমাতিষ্ঠেদ দিবানিশম্।
জিতেন্দ্রিয়ো হি শক্লোতি বশে স্থাপয়িতুং প্রজাঃ ।।
দশা কাম সমুখানি তথাষ্টো ক্রোধজানি চ।
ব্যসনানি দুরস্তানি প্রয়তেন বিবর্জয়েৎ।।
মৃগয়াক্ষো দিবাস্বপ্নঃ পরীবাদঃ প্রিয়ো মদঃ।
তীর্যত্রিকং বৃথাদ্যা চ কামজো দশকো গণঃ ।।
[মনুসংহিতা ৭।৪৪-৪৭]
ঠাঃ এর অর্থ বোঝান।
চন্দ্রঃ রাজার উচিত দিন রাত্রি ইন্দ্রিয়কে বশিভূত করার চেষ্টা করে। যিনি জিতেন্দ্রিয়, তিনিই প্রজাকে নিজের আয়ত্তে করতে পারেন।
এটা হল প্রথম শ্লোকের অর্থ। আপনি কি মদ্যপান তথা বেশ্যাগিরি কে এই প্রকারের মধ্যে ফেলতে পারবেন? তারা কি ক্ষত্রিয়, যারা কুড়িটা বিবাহ করে আর তৎপশ্চাৎ অন্য রকমের বিলাসিতায় ডুবে থাকে?
অভ্যুঃ না।
চন্দ্রঃ- দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্লোকের অর্থ শুনুন - রাজার উচিত যে কাম দ্বারা উৎপন্ন দশটি অত্যন্ত নিষিদ্ধ আসক্তির ত্যাগ করা।
অভ্যুঃ- কাম থেকে উৎপন্ন দশটি আসক্তি কি কি?
চন্দ্রঃ- তৃতীয় শ্লোকে এগুলোই বলা হয়েছে-
(১) মৃগয়া শিকার।
(২) অক্ষ জুয়া।
(৩) দিবাস্বপ্নঃ দিবানিদ্রা।
(৪) পরিবাদ অন্যের নিন্দা করা।
(৫) স্ত্রিয়ঃ স্ত্রৈণ হওয়া।
(৬) নেশা।
(৭) গান।
(৮) বাজনা।
(৯) নৃত্য।
(১০) ব্যর্থ (অকারণে) ভ্রমণ করা।
রামঃ এগুলো সবই তো বর্তমান সময়ের ক্ষত্রিয়দের মধ্যে পাওয়া যায়।
চন্দ্রঃ মনুজী তো মানুষের স্বভাব জানতেন। তাঁর জানা ছিল যে ক্ষত্রিয় রাজাগণের কাছে অর্থ কম থাকে না। চাকরদের অভাব থাকে না। তাদের শিক্ষা দেবার সাহস কাদের আছে। পুরোহিত এবং পণ্ডিত তাদের দক্ষিণার পাত্র। সেইসব অসহায়গণ কি বলবে? এইজন্য রাজাগণের মধ্যে অবগুণ থাকা স্বাভাবিক। এইসব কারণের জন্যই মনুজী রাজাদেরকে বিশেষ করে এইসব অবগুণ থেকে দূর করেছেন।
অভ্যুঃ- তাহলে কি ক্ষত্রিয়রা হিংসক পশুদের হত্যা করবে না?
চন্দ্রঃ অবশ্যই হত্যা করবে! শুধুমাত্র হিংসক পশুদেরই নয় বরং মনুষ্যকেও, কিন্তু নিরাপরাধ পশুদের হত্যা করে হাতের কৌশল দেখাবে কেন আর সেটাও জিহ্বার স্বাদের জন্য?
অভ্যুঃ- হত্যা বিনা অভ্যাস কিভাবে হবে?
চন্দ্রঃ তাহলে কি চোর ডাকাতদের হত্যার যোগ্যতা প্রাপ্ত করার জন্য ছোট নিরাপরাধ শিশুদের থেকে অভ্যাস করা দরকার? এটা তো বিচিত্র বিষয় হয়ে গেল। অভ্যাস করতে হবে, দুষ্টদের হত্যা করার জন্য, হিংসক পশুদের নষ্ট করার জন্য নিরাপরাধ প্রাণীদের হত্যা করে ভক্ষণ আরম্ভ করে। কেউ কি বেশ্যাবৃত্তির অভ্যাস করে ইন্দ্রিয় দমন শিখতে পারে?
কবীরঃ কখনোই নয়।
চন্দ্রঃ তাহলে তো ছাগলকে হত্যা করে সিংহের শিকার হতে পারে না। আপনারা ফরাসী ভাষায় ভীতুকে বুজদিল বলেন।
রামঃ 'বুজদিল, কি?'
কবীরঃ 'বুজ' বলা হয়, ছাগলকে। বুজদিল তাদের বলা হয় যাদের ছাগলের মত দুর্বল হৃদয় থাকে।
চন্দ্রঃ- তাহলে ছাগলের মত দুর্বলের হত্যা করে সিংহের হত্যা করা কিভাবে হতে পারে?
লাঃ তঃ সিংহ ছাগলকে খায়। এটা ভাবে যে যে ছাগল খাবে সেই সিংহ হয়ে উঠবে।
চন্দ্রঃ আমার একটি কথা মাথায় এসেছে। ইংল্যান্ডের কিছু অংশের লোক কণ্ঠস্বরকে তীব্র করার জন্য ঝিঝির (Crickets) সুপ পান করত, তারা ভাবত যে ঝিঝির শব্দ তীব্র হয়, তেমনই তাদের হয়ে যাবে।
অভ্যুঃ এমনও কি সম্ভব ছিল?
চন্দ্রঃ না মহাশয়! সেটা তাদের ভ্রম ছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ ছাগল ভক্ষণ করে এবং তাদের সিংহের একটিও গুণ আসে না। অসংখ্য রোগ প্রবেশ করে। আর নিষ্ঠুরতা তথা আসক্তির অভ্যাস পৃথকভাবে লেগে যায়।
অভ্যুঃ - মাংসভক্ষী লোকেরা সাহসী হয়?
চন্দ্রঃ আবশ্যক নয়। এমন হলে তো ঐ, গ্রীণল্যান্ডের লোক অধিক সাহসী হত। সাহসিকতার জন্য আত্ম-বল দরকার। আপনি জানেন কি, বর্নার্ডশ কি বলে।
লাঃ তসঃ সেই বর্নার্ডশা।
চন্দ্রঃ- হ্যাঁ! তিনি।
অভ্যুঃ- কি বলেন?
চন্দ্রঃ- যখন তাকে কেউ আমন্ত্রণ জানায় তখন তিনি বলে দেন, যে লোকেরা যেখানে নিষ্ঠুরভাবে প্রাণীদের মাংস এবং হাড় চিবোয়, তাদের সঙ্গে আমি ভোজন করতে পারব না।
অভ্যুঃ তাহলে কি মাংসাহারীদের সঙ্গে ভোজন করা উচিত নয়।
চন্দ্রঃ আমি এটা বলছি না! এটা তো পরিস্থির উপর নির্ভর করে, কিন্তু মাংসাহারীদের অবগুণ থেকে অবশ্যহ দূরে থাকা উচিত।
রামশরণঃ স্বামী দয়ানন্দ ক্ষত্রিয়গণকে মাংস-ভক্ষণের আদেশ দিচ্ছেন।
ইন্দুঃ কোথায়?
রামশরণঃ দেখুন -
প্রশ্ন- সবাই অহিংসক হলে ব্যাঘ্রাদি পশু এত বৃদ্ধি পাবে যে, তারা সমস্ত গবাদি পশুকে হত্যা করে ভক্ষণ করবে। তোমাদের পুরুষকার ব্যর্থ হবে?
উত্তর- অনিষ্টকারী পশুদের এবং মানুষদের দণ্ডদান করা এবং বধ করা রাজপুরুষগণের কর্তব্য।
প্রশ্নঃ তবে কি এ সকল পশুর মাংস ফেলে দেবে?
উত্তরঃ ইচ্ছা হয় ফেলে দেবে। যদি চাও কুকুরাদি মাংসাহারীদের ভক্ষণ করাবে অথবা জ্বালিয়ে দেবে। অথবা কোন মাংসাহারীকে ভোজন করাবে তাতে সংসারের কোন ক্ষতি হবে না, কিন্তু সেই মানুষের স্বভাব মাংসাহারী হয়ে হিংসক হতে পারে। যে সব ভোজ্য বস্তু হিংসা, চুরি, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ছল, শঠতাদি দ্বারা প্রাপ্ত হয়, সেগুলো অভক্ষ্য এবং অহিংসা ও ধর্ম প্রভৃতি কর্মাদি দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া
[সত্যার্থপ্রকাশ ১০ম সমুল্লাস]
চন্দ্রঃ এখানে তো ক্ষত্রিয়দের মাংস ভক্ষণের আদেশ দেওয়া নেই, উপরন্তু নিষেধ করেছেন। কেবল ক্ষত্রিয়দেরই এই আদেশ দিয়েছেন
(১) যাতে তারা হিংসক পশু এবং মানুষকে দণ্ডদান করে এবং বধ করে।
(২) তাদের মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেয় অথবা মাংসাহারী কুকুরকে খাইয়ে দেয়।
(৩) অথবা কোন মাংসাহারী মানুষ ভক্ষণ করলে সে নিজেই হিংসক স্বভাবের হয়ে যাবে।
এবার দেখা দরকার যে কোন পশুদের বধ করা উচিত লেখা আছে? হিংসক যেমন সিংহ, নেকড়ে ইত্যাদি! এদেরকে কারা ভক্ষণ করবে? বর্তমানের ক্ষত্রিয়? না। এরা তো নিরাপরাধ পশুদের হত্যা করে আর ভক্ষণ করে। একটু ভেবে দেখুন যে সংসারের মূখ্য-মূখ্য নগরে অনেক কসাইখানা আছে। এখানে কাদের বধ করা হয়? নেকড়ে? না। সিংহ? না। সর্প? না। যতগুলি হিংসক জীব আছে, তাদের তো কোনটিই নয়, তবে কোনগুলি? ছাগল, ভেড়া, গাভী, বৃষ, মহিষ। এগুলো কি হিংসক? না।
থাকল হিংসক মানুষ যেমন ঘাতক, নৃশংস, হত্যাকারী। এদের মাংস আপনি কাদের খাওয়াতে চান? সাধারণত এই স্থানে স্বামীজীর সংকেত হিংসক প্রাণীদের দিকে। সেটাই প্রশ্ন ছিল। তাদের না তো কোন ক্ষত্রিয় ভক্ষণ করে আর না শূদ্র? তাহলে কি আপনি পরের অংশ পড়েননি যে অহিংসা দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া খাদ্য ভক্ষ্য আর হিংসা দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া অভক্ষ্য? প্রধানত স্বামীজী মাংসকে এত প্রবল শব্দে নিষেধ করেছেন যে তার মতামতের আধারেই ক্ষত্রিয়ের মাংস ভক্ষণের কোন সুযোগ থাকে না! আমি মনে করি যতক্ষণ মাংস-ভক্ষণের প্রচার থাকবে প্রকৃত ক্ষত্রিয়ত্বের শেকড় গাড়া কঠিন হবে। এটা মাংস-ভক্ষণের প্রবৃত্তিই, যার কারণে সভ্য বলা জাতিরা স্বার্থবশে অধর্মযুক্ত যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের সংহার করে দেয়। সংসারের শান্তি এইজন্যই ভঙ্গ হচ্ছে। উপরন্তু মন থেকে শান্তি-শান্তি ডাকতে থাকে, কিন্তু কাজ করে অশান্তির। যখন ১৯৪৫-এর মে মাসের ভীষণ মহাযুদ্ধে যখন মিত্র-রাজ্যের বিজয় হল এবং বিজয়ে আনন্দ উল্লাস করা হলে বার্নার্ডশা বলেছিলেন, "আমি কিসের জন্য আনন্দ করব? এখনও তো মানুষ সংহারের দিক থেকে হাত গুটিয়ে নেয়নি, উপরন্তু আমরা অন্যের প্রাণ নেওয়াকেই নিজ স্বভাব বানিয়ে রেখেছি, তাই আমাদের অন্য প্রাণী দূরে থাক মানুষের উপরেও দয়া আসে না আর আসবেও বা কি করে? বায়ুমণ্ডল তো হিংসার ভাবে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। আপনি বিবাহাদি উৎসবে দেখুন। আপনি কিভাবে আনন্দ করেন? অসংখ্য প্রাণীদের হত্যা করে তাদের মাংস রন্ধন করে। আপনাদের বড় (অনুষ্ঠান) দিবস খুশির উৎসবে কত পশুকে তাদের প্রাণকে আহুতি দিতে হয়। আপনাদের ঘরে শিশু জন্ম হলে ছাগল বধ হয়, মুণ্ডন হলে ছাগল বধ হয়। ছেলে-মেয়েদের বিবাহ হলে ছাগলের জীবনের উপরেই হয়।
কারোর প্রাণ যাওয়া আপনাদের জন্য মজার বিষয়।
অভ্যুঃ এটা ঠিক। আমার উপরে আপনার উক্তির প্রভাব আছে, সেইজন্যই তো আমি মাংস-ভক্ষণ ত্যাগ করে দিয়েছি, কিন্তু বুঝি যে হিংসা বিনা যুদ্ধ হয় না এবং যুদ্ধ বিনাও কাজ চলে না। সুর-অসুর সংগ্রাম চলতেই থাকে। বেদ এবং ব্রাহ্মণের মধ্যে সেটার উল্লেখ আছে। দুষ্টদের হত্যা করার জন্য বেদের মধ্যে পরিস্কার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
চন্দ্রঃ আমি আপনার সঙ্গে একেবারে সহমত। আমি বলি না যে দুষ্টদের শাস্তি না দেওয়া হোক, অথবা আততায়ীদের দমনের জন্য যুদ্ধ না করা হোক, কিন্তু এর সাথে মাংস ভক্ষণের কিসের সম্পর্ক? আমি আগেও বহুবার বলেছি যে আততায়ীদের মাংস কেউ ভক্ষণ করে না। কাউকে প্রাণদন্ড দেওয়া এক কথা এবং তার মাংস ভক্ষণ অন্য কথা! একজন অপরাধীকে হত্যা করা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, কিন্তু তাকে অথবা অন্য কাউকে হত্যার যোগ্যতা উৎপন্ন করার জন্য কোন অন্য নিরাপরাধীর মাংস খাওয়া মহাপাপ। যদি মাংস ভক্ষণের পরম্পরা তুলে দেওয়া হয় তাহলে শীঘ্রই অনেক হিংসা হ্রাস পাবে, কারণ মনুষ্য প্রায়ঃ অসুর-দমনের জন্য হিংসা করে না, উপরন্তু জিহ্বার দাসত্বের কারণে! আমি তো এখনই বললাম যে সংসারের কসাইখানায় প্রতিদিন কোটি-কোটি পশু বধ হয়। তারা না তো অপরাধী না তো অত্যাচারী। না অসুর, না আততায়ী? এর মধ্যে তো অধিকাংশ তারাই, মানুষ যাদেরকে নিজের হাতে ঘাস-দানা খাইয়ে হৃষ্ট-পুষ্ট করেছে। সেই অসহায়গুলি মনে করে যে, এরা আমাদের মিত্র। ওরা তাদের হাত চাটতে এবং তাদের পিছনে চলতে থাকে, তাদের শিশুদের সঙ্গে খেলা করে। তারা কি জানে যে, এই ক্রুর এবং নিষ্ঠুর মানব বন্ধুত্বের আবরণে থাকা শত্রু। এরা আমাদের ঘাস এবং দানা এইজন্য দিচ্ছে যে একদিন তারা আমাদের মাংস ভক্ষণ করতে পারবে? কসাইগণ হত্যার একদিন পূর্বে ছাগলকে ছোলা খাওয়ায় এবং ডেকে-ডেকে কসাইখানা পর্যন্ত নিয়ে যায়। এই সব ব্যবহারে ক্ষত্রিয়ত্ব কোথা থেকে প্রবেশ করল? কাপুরুষতা, কৃতঘ্নতা, প্রবঞ্চনা, নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতার নাম ক্ষত্রিয়ত্ব নয়। ক্ষত্রিয়দের তো বিশেষ করে মাংস ত্যাগ করা উচিত, যাতে ন্যায়পূর্বক দন্ড দানে তার মধ্যে ক্রোধ না আসে এবং সে শান্তিতে বিচার করতে পারে যে অমুক প্রাণী শাস্তির অধিকারী অথবা নয়। আমি এখানে একটি উদাহরণ দেব যা আমার অর্থকে অধিক স্পষ্ট করবে।
অভ্যুঃ দিন। আমি শুনছি। আপনার কথায় মজা পাচ্ছি।
চন্দ্রঃ বিচারকদের আপনি ফাঁসির আদেশ দিতে শুনেছেন হয়ত।
অভ্যুঃ হ্যাঁ! অনেকবার।
চন্দ্রঃ তিনি ন্যায়ের তুলাতে ওজন করে আদেশ দেন।
অভ্যুঃ ঠিক! আমার একটি ভাই দায়রা বিচারক। সে বলে যে যখন কাউকে ফাঁসির শাস্তি দিই তখন খুবই ভয় লাগে যে কোন নির্দোষীর ফাঁসি না হয়ে যায়? ঈশ্বরকে ভয় করা উচিত। আমরা প্রাণ নিতে পারি, দিতে পারি না। ফাঁসির মঞ্চে ঝোলাতে পারি, কোন মৃতকে জীবিত করতে পারি না।
চন্দ্রঃ ঠিক! এটাই ক্ষত্রিয়ত্ব। আপনার ভ্রাতাকে প্রকৃত ক্ষত্রিয় মনে হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষত্রিয়ের মধ্যে এই ভাবনা থাকা উচিত।
অভ্যুঃ - ঠিক!
চন্দ্রঃ আমি একটা কথা বলতে চাইছিলাম। যদি সেই বিচারকের বিষয়ে এটা প্রমাণিত হয়ে যায় যে তিনি ক্রোধের বশে প্রাণদন্ডের আদেশ দেন তাহলে কি হবে?
অভ্যুঃ- সেই বিচারক শাস্তির যোগ্য। প্রকৃত বিচারক তিনিই, যিনি শান্ত হৃদয়ে এবং শান্ত মনে অপরাধের তদন্ত করেন। ক্রোধ, দ্বেষ অথবা ঈর্ষাকে আসতে দেন না।
চন্দ্রঃ সেইজন্যই তো মনুজী অক্রোধকে ধর্মের একটি অঙ্গ বলেছেন। বিচারকগণ যদি ক্রোধের বশীভূত হয়ে দণ্ডদান করতে থাকেন তাহলে তাদের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যাবে এবং অন্য ন্যায়ের পূর্ণ তদন্ত করতে অক্ষম হবেন।
অভ্যুঃ- এটা তো আমিও মানি, এইজন্য ফাঁসির মামলার নির্ণয়ের জন্য পক্ষপাতরহিত বিচারক নিযুক্ত করা হয়।
চন্দ্রঃ যদি বিচারকদের এই স্বাধীনতা থাকে যে তারা ফাঁসির অপরাধীদের মৃতদেহকে ফাঁসি দেবার পর ভক্ষণ করবে তাহলে কি হবে জানেন তো?
কবীরঃ তোবা! তোবা! এটা কি বললেন!!
চন্দ্রঃ মৌলবী সাহেব! আপনার ঘৃণাসূচক শব্দ সর্বদা ঠিক, কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, যে ঘৃণা আপনি মানুষের মাংসের প্রতি দেখাচ্ছেন, গাভী অথবা ছাগলের সময় প্রকট করেন না কেন? আমি তো এমন ঘাতকদের মাংসের উল্লেখ করেছি যারা নিষ্ঠুরতার বশে কুড়িজনের প্রাণ নিয়েছে। ছাগল এবং গাভী তো তবুও নির্দোষ।
লাঃ তসঃ ঠিক আছে। বলুন আপনি কি বলছিলেন?
চন্দ্রঃ আমার বক্তব্য এটাই যে যদি কখনও বিচারকদের এই আদেশ হয় যে তারা ফাঁসি প্রাপ্ত মৃতদেহকে ভক্ষণ করবে তাহলে বিচারকেরা ফাঁসির শাস্তিও বার-বার দিতে থাকবে। স্বার্থীরা অজুহাত খুঁজে নেয়।
মুখার্জীঃ- হ্যাঁ। এটা তো অবশ্যই। আমার একটা ঘটনা মনে পড়ছে।
শেঠঃ বলুন।
মুখার্জীঃ বলা হয় যে পাকা মাংস ভক্ষণের প্রথা চীন থেকে শুরু হয়েছে। প্রথমে মাংস রান্নাকে পাপ মনে করা হত। চীনের লোক কাঁচা মাংস ভক্ষন করত। একদিন কারোর ঘরে আগুন লেগে গেল এবং একটি শূকর জ্বলে গেল। কেউ তার মাংস স্বাদ নিলে সে মজা পেল। তারপর আর কি? সেই ঘরে বারংবার আগুন লাগতে থাকল, এমনকি অন্যরাও তার অনুকরণ করল।
চন্দ্রঃ এরকমই বিষয় ক্ষত্রিয়ের। এদের রসনা ইন্দ্রিয়কে মাংসের অভ্যাস লাগিয়ে দিয়েছে এবং এরা খাওয়ার অজুহাত খুঁজে নেয়। ক্ষত্রিয়ত্ব এবং মাংস-ভক্ষণের কোন সম্পর্ক নেই। না শিকারের সঙ্গে আছে! শিকার এইজন্য করা হয় না যে কাউকে কষ্ট থেকে রক্ষা করা যায়, বরং নিজের স্বাদের জন্য করা হয়।
ঠাঃ অভ্যুঃ খরগোশের শিকার তো ভালো, কারণ এর দ্বারা ক্ষেতের হানি হয়।
চন্দ্রঃ কারোর শিকারই ভালো নয়। এতে নিষ্ঠুরতা এবং স্বৈরাচারের অভ্যাস বৃদ্ধি পায়। ইংল্যান্ডে খরগোশের শিকার বড় প্রথা আছে এবং ভারতীয়রা তাদের থেকেই এই অভ্যাস শিখেছে। ইংল্যান্ডের রন্ধনশালায় এই অভ্যাস এত অধিক যে তারা উদ্যানেই খরগোশকে সুরক্ষিত রাখে এবং ধনীদের ছাড়া খরগোশ হত্যার অনুমতি কারোর থাকে না। যদি ক্ষেতের রক্ষাই খরগোশ হত্যার উদ্দেশ্য হত তাহলে খরগোশের রক্ষা কেন করা হয় এবং অন্যদের হত্যা করতে নিষেধ করা হয় কেন? মূলত মনোবিনোদনই শিকারের উদ্দেশ্য। এই মনোবিনোদন নিকৃষ্ট শ্রেণীর, কারণ সেই মনোবিনোদন কি যাতে অন্যের প্রাণ চলে যায়? আপনি ইংল্যান্ডের প্রাচীন গল্প তো পড়েছেন যে লুকিয়ে খরগোশের শিকারকারীদের পোচর (Poacher) বলা হয় এবং তারা সেই শাস্তিই ভোগ করে যা চোরেরা পায়।
মুখঃ হ্যাঁ! হ্যাঁ! বলা হয় যে লুসী নামক ধনী ব্যক্তি শেক্সপিয়ারকে এই অপরাধের শাস্তি দিয়েছিলেন।
চন্দ্রঃ- ঠিক! আমার তাৎপর্য এটাই যে মাংস-ভক্ষণ এবং শিকারের আসক্তি এমন দুটি অবগুণ, যেগুলো ক্ষত্রিয়কে ক্ষত্রিয় থাকতে দেয়নি। রক্ষক থেকে ভক্ষক বানিয়ে দিয়েছে, এইজন্যই তো সংসারের শাসন-বিধি ঠিক হতে পারে না। শাসক ভক্ষক হয়ে গেলে কে রক্ষা করবে? মদের বোতলে দুগ্ধও মদ হয়ে যায়। অনেক বীর ক্ষত্রিয়দের মধ্যে দয়ার ভাব আছে। অঙ্কুর আছে, কিন্তু মাংস-ভক্ষণের কারণে দূষিত হয়ে গেছে। পরমার্থে স্বার্থের মিশ্রণ হয়ে গেছে।
ঠাঃ অভ্যুঃ- রাজা রামচন্দ্র কি শিকার করতেন না?
চন্দ্রঃ করেছেন হয়ত! এটা একটি স্বতন্ত্র প্রশ্ন। কোন একটি ব্যক্তির করাতে দোষ গুণেতে পরিবর্তন হয়ে যায় না। হয় রাজা রামচন্দ্র শিকার করতেন না অথবা যদি করেই থাকেন তাহলে মনু শাস্ত্র অনুসারে সেটা অধর্ম?
শেঠঃ আপনি কি শ্রীরামচন্দ্রজীকে অধর্মী বলবেন?
চন্দ্রঃ আমি কেন বলব? ইতিহাস ইতিহাস এবং ধর্মশাস্ত্র ধর্মশাস্ত্র! আমি বলছি না যে রামচন্দ্র অধর্মী ছিলেন, কিন্তু যদি কেউ বলে যে তিনি শিকার করতেন তাহলে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে মানব ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী তিনি খারাপ কাজ করেছেন।
রামঃ আপনার কি সন্দেহ আছে যে শ্রীরামচন্দ্র শিকার করতেন?
চন্দ্রঃ অনেক কিছুই? দেখুন মারীচ-বধের সম্পর্কে কি লেখা আছে? মারীচকে দেখে সীতাজী বলছেন-
আর্যপুত্রাভিরামোসো মৃগো হরতি মর মনঃ।
আনয়ৈনং মহাবাহো ক্রীড়ার্থ নো ভবিষ্যতি ।। ১।।
ইহাশ্রমপদ্যেস্মাকং বহবঃ পুণ্যদর্শনাঃ।
মৃগাশ্চরন্তি সহিতাশ্চমরাঃ সৃমরাস্তথা ।।২।।
ঋক্ষাঃ পৃষতসংধাশ্চ বানরাঃ কিন্নরাস্তথা।
বিহরন্তি মহাবাহো রূপশ্রেষ্ঠা মহাবলাঃ ।।৩।।
নো চান্যঃ সদৃশো রাজন দৃষ্টঃ পূর্বং মৃগো ময়া।
তেজসা ক্ষময়া দীপ্ত্যা যথায়েং মৃগসত্তমঃ ।।৪।।
নানাবর্ণবিচিত্রাঙ্গো রত্নভূতো মমাগ্রতঃ।
দ্যোতয়ন্ বনমব্যগ্রং শোভতে শশিসন্নিভঃ ।।৫।।
অহো রূপমহো লক্ষ্মীঃ স্বরসং পঞ্চশোভনা।
মৃগোস্তুতো বিচিত্রাঙ্গো হৃদয়ং হরতীব মে ।।৬৷৷
যদি গ্রহণমভ্যেতি জীবন্নেব মৃগস্তব।
আশ্চর্যভূতং ভবতি বিস্ময়ং জনয়িষ্যতি ।।৭।।
সমাপ্তবনবাসানং রাজ্যস্থানাং চ নঃ পুনঃ।
অন্তঃ পুরে বিভূষার্থো মৃগ এবং ভবিষ্যতি ।।৮।।
ভরতস্যার্যপুত্রস্য শ্বশুণাং চ মম প্রভো।
মৃগরূপমিদং দিব্যং বিস্ময়ং জনয়িষ্যতি।।৯।।
জীবন্ন যদি তেভ্যেতি গ্রহণং মৃগ সত্তমঃ।
অজিনং নরশাদুল রুচিরং তু ভবিষ্যতি ।। ১০।।
[বাল্মীকি রামায়ণ অরণ্য কান্ড, ৪৩।১০-১৯]
অর্থঃ হে আর্যপুত্র, এই মৃগ এমন সুন্দর যে আমার মন হরণ করছে। আপনি ওটাকে ধরে নিন। আমি ওর সঙ্গে খেলা করব ।। ১।।
আমাদের আশ্রমে অনেক রকমের মৃগ, চমর, সৃমর (কৃষ্ণসার মৃগ), ভাল্লুক, বানর, কিন্নরাদি আসে, কিন্তু এমন সুন্দর মৃগ কখনও আসেনি ।।২,৩,৪।।
এটা তো আমার সম্মুখে অনেক বর্ণে বিচিত্র অঙ্গযুক্ত চন্দ্রমার ন্যায় শোভমান এবং বড় মনোহর ।।৫,৬।।
যদি আপনি এটাকে ধরে নিয়ে আসেন তাহলে আমার জন্য এক অদ্ভুত ব্যাপার হবে এবং বনবাস সমাপ্ত করে যখন নিজের রাজ্যে ফিরে যাব তখন আপনার ভ্রাতা ভরত এবং আমার শাশুড়ি এটাকে দেখে আনন্দিত হবেন ।।৭,৮,৯।।
যদি এটাকে জীবিত ধরা নাও যায় তাহলে এর চর্ম খুব সুন্দর হবে ।। ১০।।
ইন্দ্রঃ হ*ত্যা উদ্দেশ্য ছিল না। এতে তো এটাই প্রমাণিত হয় যে হরিণের শিকার উদ্দেশ্য ছিলো না।
চন্দ্রঃ আরোও একটি বিষয় আছে। কবিরা বহু মনগড়ন কথা লিখে দিয়েছেন। শ্রী তুলসীদাসজীর দুটি পদই যথেষ্ট-
মীন পীন পাঠীন পুরানে
ভর ভর ভার কহারন আনে।
[তুলসী রামায়ণ, অযোধ্যা কান্ড ১৯৪]
এতে প্রমাণিত হয় যে শ্রী ভরতজী অধিক মৎস ভক্ষণ করতেন। তুলসীদাসজীর নিজের সময়ের কোন রাজপুত জমিদারের কথা মনে এসেছিল হয়ত।
আরো লিখেছেন-
স্রক্ চন্দন বনিতাদিক ভোগা।
দেখি পরষ বিস্ময় সব লোগা।।
[অযোধ্যা ২১৬।৪]
বলুন! মালা এবং চন্দন তো বোঝা গেল, কারণ এটা আতিথেয়তার বস্তু হতে পারে, কিন্তু 'বনিতা'র অর্থ কি? কোন অতিথির জন্য 'বনিতা'র ভোগ পৌঁছানো কোন সৎকারের রীতি? যে ভরতজী কি বিষয়ী ছিলেন? ভরতজী নিজের তপস্যার জন্য বিখ্যাত ছিলেন, সেই ভরতজীর আতিথ্যের জন্য বনিতাদের পাঠানো! কিন্তু কবি তো কবিই। অতীতের মধ্যে বর্তমানকে প্রবেশ করানো কবিদের কাজ। পুরানো বোতলে নতুন মদে পূর্ণ করা কবিগণের অভ্যাস। তুলসীদাস তো নিজেও সাধু ছিলেন। তিনি নিজের সমকালীন ক্ষত্রিয়দের স্বভাবের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ভেবেছেন হয়ত ক্ষত্রিয়দের জন্য মনুজী লিখেছেন-
ন মাংস ভক্ষণে দোষঃ ন মদ্যে ন চ মৈথুনে।
তাঁর সময়ে দয়ানন্দজীর সত্যার্থপ্রকাশ তৈরী হয়নি। এটা স্বামী দয়ানন্দেরই কাজ ছিল যে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে লিখেছেন যে এটা প্রক্ষেপ। কোন বামমার্গীদের দ্বারা মিশ্রণ হয়েছে। এইরকম বাল্মীকি রামায়ণেও বহু প্রক্ষেপ আছে। মারীচের সমস্ত কথায় কতটা সত্য আছে আর কতটা মিথ্যা আছে এটা বিচারযোগ্য। যদি রাম শিকারই করতেন তাহলে তাঁর আশ্রমে নির্ভীকতার সঙ্গে তারা কিভাবে আসত? পরে লিখেছেন যে রাম মারীচকে শত্রু ভেবে মেরেছিলেন, কারণ লক্ষ্মণ পূর্বেই বলে দিয়েছিলেন যে এটা মৃগ নয়, বরং মারীচ -
যদি বায়ং তথা যন্মাৎ ভবেদ বদসি লক্ষ্মণা।
মায়েষা রাক্ষসস্যেতি কর্তব্যোস্য বধো ময়া ।।
[বাল্মীকি রামায়ণ, অরণ্যকাণ্ড ৪৩।৩৮]
মাংস-ভক্ষণের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।

