দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







তেলুগু রামায়ণ - রচনা বৈশিষ্ট্য ও বাল্মীকির সাথে পার্থক্য

সত্যান্বেষী
0


তেলুগু রামায়ণ - রচনা বৈশিষ্ট্য ও বাল্মীকির সাথে পার্থক্য
 
অন্ধ্রপ্রদেশে তেলুগু ভাষায় রামকথার বহুল প্রচার হয়েছে। তবে প্রথম সাহিত্যকৃতি শুরু হয় একাদশ শতকের মধ্যভাগে নন্নয় ও নারায়ণ ভট্টের রচিত 'মহাভারত' দিয়ে। নন্নয়ের অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন তিক্কন ও এররাপ্রগড-যাঁরা তেলুগু সাহিত্যে 'কবিত্রয়' নামে খ্যাত।
তেলুগুভাষীদের রামভক্তির পরিচায়ক হলো অন্ধ্রের বহু রামমন্দির, বিখ্যাত গীতিকার ত্যাগরাজের (১৭৬৭-১৮৪৭ খ্রিঃ) রামভজন, জনপ্রিয় রামভজনম নৃত্য, রামের জন্মদিন রামনবমী ব্রত অনুষ্ঠান এবং স্থান ও মানুষের নামকরণ। মায়েরা শিশুদের স্নান করানোর সময় বলেন, 'শ্রীরাম রক‌ষা, নুরেল্লু, আয়ুস্‌স' অর্থাৎ শ্রীরাম তোমায় রক্ষা করুন, শতায়ু হও। চিঠিপত্রের শিরোনামা হিসাবে লেখা হয় 'শ্রীরাম জয়ম্। বিবাহের সময়ে মঙ্গলসূত্র পরাতে 'আনন্দময় আনন্দময়' বলে যে গান গাওয়া হয়, তা শ্রীরাম ও সীতার বিবাহের স্মারক। অনেক লোকগাথায় রামকথা-যেমন ঊর্মিলার নিদ্রা, লক্ষ্মণের হাস্য, লবকুশের জয় প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে।
রামায়ণ কাহিনিকে অবলম্বন করে সৃষ্টি হয়েছে অনেক প্রবাদ। যেমন,
১. সীতা পুট্‌টে, লঙ্কা চেডে অর্থাৎ সীতার জন্ম হল, লঙ্কার ধ্বংস হল।
২. কাট্‌টে, কোট্‌টে, টেচচে, অর্থাৎ তৈরি হল (সেতুবন্ধ), নিহত হল (রাবণাদি) এবং আনীত হল (সীতা)। সংক্ষেপে সমগ্র রামায়ণ।
৩. ইনটিগুটু লঙ্কাকু চেটু অর্থাৎ গোপন কথা প্রকাশের জন্য লঙ্কার ধ্বংস-বিভীষণের সমালোচনা।
তেলুগুতে শতাধিক রামায়ণ ও রামকথাশ্রিত গ্রন্থ আছে। সাহিত্যের বিভিন্ন শৈলীতে পূর্ণাঙ্গ কিংবা আংশিক, রামকথা পাওয়া যায়। কাব্য, দ্বিপদ, যক্ষগান (নৃত্যনাট্য), শতক দণ্ডক, গেয় (গান), সংকীর্তন, চাটু (বিক্ষিপ্ত স্তবক), নাটক, গদ্য প্রভৃতিতে রামকথা লিখিত হয়েছে। লোকগীতেও রামকথা আছে। সংস্কৃত ললিত ও ধার্মিক রামকথাও তেলুগুতে অনূদিত হয়েছে।
তিক্কনের (নির্বচনোত্তর রামায়ণের কবি) পর শ্রেষ্ঠ রামায়ণকার হলেন গোন বুদ্ধ রেড্ডি (Gona Budda Reddy)-যাঁর গ্রন্থ 'রঙ্গনাথ রামায়ণ' নামে পরিচিত। গ্রন্থটির রচনাকাল কেউ বলেন ১২৪০ খ্রিঃ, আবার কেউ বলেছেন ১২৮০-১৩০০ খ্রিঃ-র মধ্যে। দ্বিপদ ছন্দে লেখা কাব্যটিতে আছে ৩৪,৫৮০ পঙক্তি। এ রামায়ণ গান করা চলে। এর তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: প্রথমত, এ রামায়ণ তোলুবোমমলতের (puppetry) সঙ্গে গীত হয় বলে জনপ্রিয়। দ্বিতীয়ত, জনসাধারণের বোধ্য এবং তৃতীয়ত, এতে কিছু ঘটনা ও বর্ণনার অনুপুঙ্খ আছে, যা মূল রামায়ণে নেই।
লক্ষণীয় হলো, রঙ্গনাথ রামায়ণে যে সব পরিবর্তন আনা হয়েছে তার মূল লক্ষ্য ছিল কিষ্কিন্ধ্যা ও লঙ্কার চরিত্রগুলির নৈতিক মানোন্নয়ন। বাল্মীকি রামায়ণে অর্ধশ্লোকে ইন্দ্রজিৎ-পত্নীর উল্লেখমাত্র আছে, নাম নেই। রঙ্গনাথ রামায়ণে তাঁর নাম সুলোচনা। সতী সাধ্বীরূপে তাঁর যে চিত্র রঙ্গনাথ এঁকেছেন তা সীতার সমতুল্য। আদিশেষের কন্যা সুলোচনা যেভাবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইন্দ্রজিতের মৃতদেহ নিয়ে আসেন, তাতে রাবণও বিস্মিত হন। পরে সুলোচনা সতী হন। এই বীরাঙ্গনা ও সাধ্বী চরিত্রের অনুকরণে মধুসূদন দত্ত তাঁর 'মেঘনাদ বধ কাব্যে'র প্রমীলা চরিত্র এঁকে থাকতে পারেন।
মন্দোদরী চরিত্রও উজ্জ্বল বর্ণে রঞ্জিত। প্রথমে তিনি রাবণকে সীতা প্রত্যার্পণের কথা বলেন। পরে যখন রাবণ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন, তখন কিন্তু তিনি স্বামীকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যই উৎসাহিত করেন। তাঁর আত্মমর্যাদা কত তীক্ষ্ণ ছিল-তাই দেখানো হয়েছে।
রাবণ এখানে মহাবীর। তাঁর পার্শ্বচরিণীর কণ্ঠহার রাম যখন তাকে আহত না করেই ছেদন করেন, তখন রাবণ তীরন্দাজ হিসাবে রামের প্রভূত প্রশংসা করেন-যা তাঁর বীরধর্মের সাক্ষ্য বহন করে। কুম্ভকর্ণকেও তিনি রামের হাতে মৃত্যুবরণের ইচ্ছার কথা বলেন। কুম্ভকর্ণও এখানে অমানুষিক যন্ত্ররাক্ষসের মতো চিত্রিত নয়। শ্রেষ্ঠ চরিত্র অবশ্যই সীতা ও রাম।
রঙ্গনাথ কিষ্কিন্ধ্যার রাণী তারার চরিত্রেরও উদ্দেশ্যমূলক সংস্কার করেছেন। কম্বনের মতো পাতিব্রত্য ও শুদ্ধ বৈধব্য জীবন যাপনের কথা না বলে তিনি তাঁকে সমুদ্রোথিতা অপ্সরারূপে দেখিয়েছেন। সমুদ্র-মন্থনের সময়ে বালী ও সুগ্রীব দেবতাদের সাহায্য করেন। লক্ষ্মী ও চন্দ্রমার উদয়ের পরে আবির্ভূত হন দেবকন্যারা। তাঁদের মধ্যে থেকে তারাকে দেওয়া হয় বালী ও সুগ্রীবকে। বাল্মীকি রামায়ণে তারা বালী ও সুগ্রীব দুজনকেই গ্রহণ করেন। তাঁর এই দ্বিচারিতাকে সহজ ও লঘু করে দেওয়ার জন্যই এই অপ্সরাজন্মের অভিনব পরিকল্পনা। কিষ্কিন্ধ্যা নারীর প্রতিভূ কিষ্কিন্ধ্যারাণী তারার পক্ষে যা কলঙ্কজনক, অপ্সরা তারার প্রতি সেই মানবিক নীতির মানদণ্ড প্রযোজ্য নয়।
রঙ্গনাথ রামায়ণে রাম পূর্বে মন্থরার পা ভেঙে দেন এবং লক্ষ্মণ শূর্পণখার পুত্র জম্বুকুমারকে হত্যা করেন। তাই রাম-বনবাস ও রাম-রাবণের যুদ্ধ যারা ঘটিয়েছিল, তাদের নিপীড়িত রূপে দেখানো হয়েছে এবং তাদের বৈরকে সকারণ করে তোলা হয়েছে।
রঙ্গনাথ রামায়ণে আরও কয়েকটি ঘটনা আছে, যা বাল্মীকি রামায়ণে বা কম্ব রামায়ণে পাওয়া যায় না। যেমন:
১. লক্ষ্মণ কুটির ছেড়ে যাওয়ার আগে কুটিরের চারদিকে সাতটি রেখা আঁকেন এবং সীতাকে তার বাইরে যেতে নিষেধ করেন।
২. রাম ও লক্ষ্মণ যখন নাগপাশে বদ্ধ হন, তখন সীতাকে যুদ্ধক্ষেত্রে আনা হয়।
৩. হনুমানের সঞ্জীবনী লতা আনার সময়ে কালনেমী নানাভাবে বাধা দানের চেষ্টা করেন।
৪. লক্ষ্মণের মূর্ছাভঙ্গের সংবাদ পেয়ে রাবণ শুক্রাচার্যের কাছে যান রামনিধনের উপায় জানতে। শুক্রের নির্দেশে তিনি ভূগর্ভস্থ গুহায় হোম করেন।
৫. রাবণের কাটা মাথা ও হাতের নব সংযোজন হতে দেখে রাম বিস্মিত হন। রাবণের নাভিকুণ্ডে অমৃত থাকার গোপন রহস্য বিভীষণ রামকে জানিয়ে দেন-রাম শরাঘাতে সে অমৃত শুষ্ক করলে রাবণের মৃত্যু হয়।
৬. ব্রাহ্মণ রাবণকে নিহত করার জন্য রাম রামেশ্বরমে শিবপ্রতিষ্ঠা করেন।
রঙ্গনাথ রামায়ণের উত্তরকাণ্ড লেখেন কবির দুই পুত্র গোন কাচ এবং বিটঠল্লাজু।
উল্লেখযোগ্য পরবর্তী রচনা হলো 'ভাস্কর রামায়ণ'। রঙ্গনাথেরই সমসাময়িক বলে অনেকে মনে করেন। ছয় কাণ্ডের মাঝে মাঝে গদ্য আছে। ভাস্করের নামে প্রচলিত থাকলেও ভাস্কর শুধু অরণ্য কাণ্ড ও যুদ্ধকাণ্ডের কিছু অংশ লেখেন। অন্য কাণ্ডগুলি রচনা করেন তাঁর পুত্র মল্লিকার্জুন ভট্টু, তাঁর শিষ্য কুমার রুদ্র দেব এবং তাঁর বন্ধু আয়য়ালার। অনেকের মতে, কবি কাকতীয় রাজ দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্রের (১২৯৬-১৩২৩ খ্রিঃ) সভাকবি ছিলেন।
রঙ্গনাথ রামায়ণের খ্যাতির প্রতিসূধী ভাস্কর রামায়ণ চম্পু পদ্ধতিতে লেখা; সংস্কৃত মিশ্রিত ভাষায় লেখা সাহিত্যিক সৌকর্যের জন্য এই গ্রন্থ পণ্ডিত সমাজে সমাদৃত। রঙ্গনাথ রামায়ণের মতো অবাল্মীকীয় প্রসঙ্গও আছে। যেমন,
১. ভরতের ননিহাল যাওয়ার কথা নেই, যা বাল্মীকি ও রঙ্গনাথ রামায়ণে পাওয়া যায়।
২. রাম মন্থরাকে পূর্বে পদপ্রহার করেন।
৩. লক্ষ্মণ শূর্পণখার পুত্র জম্বুকুমারকে বধ করেন-যে কথা রঙ্গনাথ রামায়ণে আছে।
৪. যুদ্ধপূর্বে বিভীষণের লঙ্কারাজ্যে অভিষেকের সময়ে সুগ্রীব রামকে প্রশ্ন করেন যে, রাম শরণাগতের রক্ষক, রাবণ তাঁর শরণ নিলে তিনি কী করবেন। রাম বলেন, সেই পরিস্থিতিতে তিনি বিভীষণকে অযোধ্যা রাজ্য দিয়ে দেবেন।
৫. অঙ্গদ রামের দূতরূপে রাবণের সভায় যান এবং রাবণকে ক্ষমা প্রার্থনা করে সীতাকে প্রত্যার্পণ করতে বলেন। রাবণকে তিনি বিভীষণকে রাজ্যদানের কথাও বলেন।
৬. কালনেমীর কথা এবং ভরতের দুঃস্বপ্নের কথা আছে।
৭. অগস্ত্য রামকে আদিত্য-হৃদয় মন্ত্র দিতে গিয়ে তাঁকে বিষ্ণুরূপে স্তুতি করেন।
৮. সীতাকে রামের হাতে তুলে দিতে গিয়ে অগ্নি বলেন যে, সংসারের পবিত্রকারক আমি সীতার স্পর্শে পবিত্র হয়েছি।
ভাস্কর রামায়ণে অনেক কথাই রঙ্গনাথ রামায়ণ থেকে নেওয়া হয়েছে, যা বাল্মীকি রামায়ণে নেই।
চতুর্দশ শতকে আর একটি রামায়ণ লেখেন এক্সপ্রেগড। কবিত্রয়ের মধ্যে এরন্ন বলেই যাঁর খ্যাতি। লেখাটি পাওয়া যায়নি। তবে কবি-বৈয়াকরণ কুচিমাঞ্চি টিম্মা কবি (১৭৫৬) তাঁর 'সর্বলক্ষণসার সংগ্রহমু' গ্রন্থে 'এরন্ন রামায়ণ' থেকে নয় ছত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। অন্ধ্র কবিতা-পিতামহ বলে খ্যাত পিনা ভিমানও (চতুর্দশ শতক) এক রামায়ণ লেখেন যা বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। আরও কয়েকটি রামায়ণ অজানা কারণে লুপ্ত হয়ে গেছে; যেমন, ভিওডিকুচি রামায়ণম, সকলবর্ণন পূর্ণম রামায়ণম।
বিখ্যাত গীতিকার অন্নমাচার্য (১৪২৪-১৫০৩ খ্রিঃ) তাঁর একটি গানে সংক্ষেপে রামায়ণ কাহিনি বর্ণনা করেছেন। তাঁর দ্বিপদ ছন্দে লেখা রামায়ণ পাওয়া যায়নি।
দ্বিপদ ছন্দে রামায়ণ লেখেন অন্য দু'জন কবি-কট্ট ভরদরাজু (১৬৫০ খ্রিঃ) এবং ভোসলা একোজি (১৭৩৫ খ্রিঃ)। কট্ট ভরদরাজুর রামায়ণে ৪৬৩৪০ পঙক্তি আছে। দ্বিপদ ছন্দে লেখা সর্ববৃহৎ রামায়ণ। মূল বাল্মীকি রামায়ণের অনুসরণে লেখা। এখানে রামসীতার বিবাহের বিস্তৃত বর্ণনা আছে। রাম বিবাহের সময়ে সীতার কণ্ঠে মঙ্গলসূত্র বেঁধে দেন-এ কথা অন্য রামায়ণে নেই। পঞ্চবটীতে যাওয়ার সময়ে জটায়ু রামের সঙ্গে ছিলেন।
অয়লরাজু রামভদ্রদু'র (১৫১০-১৫৮০ খ্রিঃ) 'রামভ্যুদয়ম'-এ রামায়ণের সংক্ষিপ্ত কাহিনি আছে। কবি বিখ্যাত অষ্টদিগঞ্জের (আটজন কবি) অন্যতম। তিনি রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সভায় ছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ শৈলীতে রামকথা সংক্ষেপণের প্রয়াস প্রশংসার্হ। এখানে রাণী কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রার সঙ্গে রাজা দশরথের বসন্তকালীন উদ্যানবিহারের কথা আছে। সেতুবন্ধের পরে রামের নির্দেশে হনুমান দেব ও গন্ধর্ব স্ত্রীদের রাবণের কারাগার থেকে মুক্ত করে। এখানে রামের রাজ্যাভিষেক পর্যন্ত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
কুমোর জাতিভুক্ত মহিলা কবি মোল্ল (১৪শ শতক) ছয় কাণ্ডে সরস, সরল ও সংক্ষিপ্ত এক রামায়ণ লেখেন, যা জনপ্রিয় হয়। এখানে মন্থরার পরামর্শে নয়, কৈকেয়ী নিজেই ভরতের সিংহাসনপ্রাপ্তি ও রামের চতুর্দশ বৎসর বনবাসের বর চেয়ে নেন।
কুচিমাঞ্চি তিম্ম কবি (১৬৮৪-১৭৫৭ খ্রিঃ) আটচা তেলুগু (খাঁটি তেলেগু) ভাষায় এক রামায়ণ লেখেন। তাঞ্জোরের রঘুনাথ নায়ক, অনন্তরাজু জন্নয়, মিক্কিলি মল্লিকার্জুনুদু প্রভৃতির রামায়ণও পাওয়া যায়।
কবিত্রয়ের অন্যতম তিক্কন (১২৬০ খ্রিঃ) প্রথম রামায়ণের উত্তরকাণ্ড লেখেন। তাঁর গ্রন্থ 'নির্বচনোত্তর রামায়ণ' ১২৬০ শ্লোক ১০টি কাণ্ডে বিভক্ত। একমতে, এঁরই পিতামহ ছিলেন রামায়ণকার কবি ভাস্কর। তিক্কনের উত্তরকাণ্ডের বিশেষত্ব হলো-প্রথমেই তিনি ক্ষুদ্রাকারে কাহিনিটি বিবৃত করেছেন, তবে রামের মৃত্যুর কথা লেখেননি। তিক্কনের রাম আদর্শ মানব এবং প্রাজ্ঞ শাসক। রাবণ ও রম্ভার কথোপকথন, রাম ও সীতার উদ্যানবিহার এমনই সৌন্দর্যের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে, খণ্ডকাব্য রূপে অভিহিত হওয়ার দাবি রাখে। সমালোচকেরা দুঃখ করেন যে, এই মহৎ কবি সমগ্র রামায়ণ রচনা করেননি। জয়ন্তী রামভট্ট পরবর্তীকালে তিক্কনের অলিখিত একটি পর্ব রচনা করেন।
কণকন্তি পাপরাজু আর একজন কবি, যিনি উত্তরকাণ্ড লেখেন। সম্ভবত তিনি সপ্তদশ শতকে জীবিত ছিলেন। মূলের অনুসরণে তাঁর অনুবাদে তিক্কন পরিত্যক্ত সব কাহিনি গৃহীত হয়েছে। তাঁর গ্রন্থে ৩০০০ কাব্যপঙক্তি এবং কিছু গদ্য পরিচ্ছেদ আছে।
অন্যান্য রামায়ণের মধ্যে শ্যামরায় কবির (১৯ শতক) রামায়ণ বচনের তিনটি কাণ্ড পাওয়া গেছে। গোপীনাথম বেনকট কবি (১৮৩২-১৮৯০ খ্রিঃ) প্রথম বাল্মীকি রামায়ণ শুদ্ধ তেলুগু ভাষায় রচনা করেন। অন্য অনুবাদ হলো সুব্বা রাও-এর (১৮৬৩-১৯৩৯ খ্রিঃ) 'শ্রীমন্ত অন্ধ্র বাল্মীকি রামায়ণসু'। তিনি এর একটি মূল্যবান ভাষ্য (মন্ধরস) লিখেছেন। তাঁকে 'অন্ধ্র বাল্মীকি' বলা হয়।
রামকথা নিয়ে অনেক খণ্ডকাব্যও তেলুগুতে লেখা হয়েছে। ধরণী দেবল রামাস্‌সার 'দশাবতার চরিত্রমু'তে শ্রীরাম অবতারের বিশদ বর্ণনা আছে। রাম-মাহাত্ম্য নিয়ে লেখা শতকের মধ্যে ভক্ত রামদাসের [Kancharla Gopanna] (ভদ্রাচলম) 'দাশরথী শতকম্' এবং যক্ষগানের মধ্যে কন্দুকুরি রুদ্রকবির [Kandukur Rudra Kavi] (১৬ শতক) লেখা 'সুগ্রীব বিজয়ম্' উল্লেখযোগ্য রচনা।
তেলুগু লোকগীতেও রাম কথা আছে। একটি গানে সীতাকে 'পদ্মজা' বলা হয়েছে। পদ্মটি নিজের কানন-সরোবর থেকে রাবণ সংগ্রহ করলে একটি অদৃশ্য কণ্ঠ বলে ওঠে-আমি তোমায় হত্যা করবো। মন্দোদরী তার মধ্যে শিশুকন্যা সীতাকে পান এবং বিভীষণকে বলেন যে, এ হলেন অতি লক্ষ্মী-শ্রীরামের স্ত্রী হবেন। কন্যাটিকে মঞ্জুষা করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে জনক তাকে কৃষিক্ষেত্রে কুড়িয়ে পান।
তেলুগু ভাষায় শতস্কন্ধ রামায়ণ, অদ্ভুত রামায়ণ, বিচিত্র রামায়ণ পাওয়া যায়। রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে দ্ব্যর্থী কাব্য 'রাঘব পাণ্ডবীয়ম্' লিখেছেন পিঙ্গলি শূরণ। এ ধরনের অন্যান্য কাব্য হলো-'শিবরামভ্যুদয়ম্', 'শ্রীরামকৃষ্ণোপাখ্যায়াম্', 'অচলাত্মজা', 'পরিণয়ম্' ইত্যাদি। এরকম ত্রয়র্থী 'রাঘব-যাদব-পাণ্ডবীয়', এবং চতুর্থীও লেখা হয়েছে। তেলুগুতে 'অধ্যাত্ম রামায়ণ', 'যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ', 'আনন্দরামায়ণ', 'রঘুবংশ' প্রভৃতির অনুবাদ হয়েছে।
অন্ধ্রপ্রদেশে রামভক্তি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শুধু কাব্য-প্রবাদ, নৃত্যগীতে নয়, রামকথা পাথরে বাত্ময় হয়ে আছে শিলাস্তম্ভ, গুহা ও মন্দিরের রামায়ণী দৃশ্যে। নাগার্জুনকোণ্ডা, মুঘলরাজপুরম ও আনুডাবল্লীর গুহায়, আলমপুরের স্তম্ভে, নবব্রহ্মা, রামাপ্পা ও ত্রিকূটালার মন্দিরে রামায়ণের কত দৃশ্য রূপ ধরেছে। চিত্তোরের রামস্বামী মন্দির, পুষ্পগিরির মহেশ্বর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রামসীতা ও অযোধ্যা ভ্রাতাদের পূজা হয়। এখানে ভদ্রাচলমে যে রামমন্দির আছে, তা নির্মাণ করেন গোলকুণ্ডার নবাবের রামদাস নামে এক কর্মচারী।
▪️মূল: রামায়ণ চর্চা বহির্ভারতে (কোরক)
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)