✅ মহাভারতে নীতিশিক্ষা - নিজের বেলায় ষোল আনা আর আমার বেলায় পুরোটাই মিথ্যা? এ তো নাস্তিককেও ভীত করতে বাধ্য‼️
মহাভারতের আদিপর্বে মহারাজ দুঃষন্ত ও ভরতজননী মহারানী শকুন্তলা দেবীর কথোপকথন থেকে আমরা ভগবান ব্যাসদেব মহর্ষির লেখনীতে নিম্নের শ্লোকগুলো পাই। এই শ্লোকগুলো আমাদের দেখায় কীভাবে দুর্জনগণ সমাজে সজ্জন বলে পরিচিত মহাশয়দের প্রতি মিথ্যার জাল বেষ্টন করে তাঁদের মর্যাদাহানির চেষ্টা করে এবং এই দূর্জনরা কীভাবে নিজেরাই নিজেদের মুখোশ উন্মোচন করে ফেলে তারও আকর্ষণীয় বিবরণ রয়েছে এখানে। সম্পূর্ণ বিবরণ পড়ুন নিম্নের অনুবাদে-
শকুন্তলোবাচ॥
সত্যশ্চাপি প্রবাদোঽয়ং যং প্রবক্ষ্যামি তেঽনঘ।
নিদর্শনার্থং ন দ্বেষাত্তচ্ছ্রুত্বা ক্ষন্তুমর্হসি॥৫॥
→ শকুন্তলা বললেন, হে নিষ্পাপ মহারাজ! আমি এস্থলে দ্বেষ প্রেরিত হয়ে নয় বরং উদাহরণস্বরূপ এক সত্য লৌকিক প্রবাদ উল্লেখ করছি, আপনি রুষ্ট না হয়ে তা শ্রবণ করে (আমার অপরাধ হয়ে থাকলে) আমাকে ক্ষমা করুন।
বিরূপো যাবদাদর্শে নাত্মনঃ পশ্যতে মুখম্।
মন্যতে তাবদাত্মানমন্যেভ্যো রূপবত্তরম্॥৬॥
→ কুরূপ ব্যক্তি যতক্ষণ না পর্যন্ত আয়নায় নিজের মুখ দেখে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে সর্বাপেক্ষা রূপবান বোধ করে;
যদা তু মুখমাদর্শে বিকৃতং সোঽভিবীক্ষতে। তদেতরং বিজানাতি আত্মানং নেতরং জনম্॥৭॥
→ কিন্তু যখন আয়নায় একবার নিজের বিকৃত মুখশ্রী নিরীক্ষণ করে ফেলে, তখন সে নিজের মনকে এ এক অন্য ব্যক্তি বলে আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করে।
অতীব রূপসম্পন্নো ন কিঞ্চিদবমন্যতে।
অতীব জল্পন্দুর্বাচো ভবতীহ বিহেঠকঃ॥৮॥
→ অত্যন্ত সুশ্রী ব্যক্তি কখনো অন্যের অনাদর করেন না। যে অধিক কটু বাক্য প্রয়োগ করে লোকে তাকে নিন্দুক ও পরপীড়ক বলে।
মূর্খো হি জল্পতাং পুংসাং শ্রুত্বা বাচঃ শুভাশুভাঃ।
অশুভং বাক্যমাদত্তে পুরীষমিব সূকরঃ॥৯॥
→ যেমন শূকর নানাবিধ সুখাদ্য (মিষ্টান্ন প্রভৃতি) পরিত্যাগ করে কেবল বিষ্ঠা খুঁজে বেড়ায়, সেরূপ মূর্খলোকেরাও কোন বক্তার শুভাশুভ বাক্য শ্রবণ করার পর শুভ বাক্য পরিত্যাগ করে কেবল অশুভ বাক্যসমূহই গ্রহণ করে;
প্রাজ্ঞস্তু জল্পতাং পুংসাং শ্রুত্বা বাচঃ শুভাশুভাঃ।
গুণবদ্বাক্যমাদত্তে হংসঃ ক্ষীরমিবাম্ভসঃ॥১০॥
→ অন্যদিকে হংস যেমন সজল দুগ্ধ থেকে অসার জলীয়াংশ পরিত্যাগপূর্বক দুগ্ধরূপ সারাংশই গ্রহণ করে, সেরূপ জ্ঞানী ব্যক্তিরা লোকের শুভাশুভ বাক্য শ্রবণ করে তা হতে শুভ গুণযুক্ত বাক্যই গ্রহণ করেন।
অন্যান্পরিবদন্সাধুর্যথা হি পরিতপ্যতে।
তথা পরিবদন্নন্যাংস্তুষ্টো ভবতি দুর্জনঃ॥১১॥
→ সজ্জনেরা পরের নিন্দা শ্রবণ করে অতিশয় দুঃখিত হন, কিন্তু দুর্জনেরা পরের নিন্দা করে যারপরনাই সন্তুষ্ট হয়।
অভিবাদ্য যথা বৃদ্ধান্সন্তো গচ্ছন্তি নির্বৃতিম্।
এবং সজ্জনমাক্রুশ্য মূর্খো ভবতি নির্বৃতঃ॥১২॥
→ সাধু ব্যক্তিরা মান্য লোকদের সম্মান করে যেরূপ সুখী হন, অসাধুগণ সজ্জনগণের অপমান করে ততোধিক সন্তোষ লাভ করে।
সুখং জীবন্ত্যদোষজ্ঞা মূর্খা দোষানুদর্শিনঃ।
যত্র বাচ্যাঃ পরৈঃ সন্তঃ পরানাহুস্তথাবিধান্॥১৩॥
→ কোনটি দোষ, তা মূর্খগণ জানে না কিন্তু তারপরেও অন্যের দোষ-উৎঘাটনকারী সেজে মনের সুখে কালাতিপাত করে; তারা যে দোষের কারণে পণ্ডিতদের মধ্যে নিন্দনীয় হয়, পণ্ডিতদেরও সেই একই দোষে দোষী সাজিয়ে তাদের নিন্দা করতে থাকে।
এ শ্লোকে মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ কিছুটা ভিন্ন, সম্ভবত শ্লোকের ভিন্ন পাঠভেদ থাকায় এই ভিন্নতা এসেছে: অদোষদর্শী সাধু ও দোষৈকদর্শী [কেবল পরচ্ছিদ্রানুসারী] অসাধু উভয়েই সুখে কালাতিপাত করে; কারণ, অসাধু সাধু ব্যক্তির নিন্দা করে, কিন্তু সাধু ব্যক্তি অসাধু কর্তৃক অপমানিত হইয়াও তাহার নিন্দা করেন না।
অতো হাস্যতরং লোকে কিঞ্চিদন্যন্ন বিদ্যতে।
যত্র দুর্জন ইত্যাহ দুর্জনঃ সজ্জনং স্বয়ম্॥১৪॥
→ স্বয়ং দুর্জন ব্যক্তি যখন সজ্জনকেই দুর্জন বলে, এর থেকে অধিক হাস্যকর কথা সংসারে আর কী হতে পারে?
সত্যধর্মচ্যুতাৎপুংসঃ ক্রুদ্ধাদাশীবিষাদিব।
অনাস্তিকোঽপ্যুদ্বিজতে জনঃ কিং পুনরাস্তিকঃ॥১৫॥
→ ক্রুদ্ধ সাপ যেমন ভীতির কারণ, সেরূপই সত্য ধর্মচ্যুত ব্যক্তিকে যখন নাস্তিকও ভয় পায় তখন তাদের থেকে যে আস্তিকরাও ভীত হবে এতে আর আশ্চর্যের কী আছে?
তথ্যসূত্র: ১। BORI প্রকাশিত ক্রিটিকাল এডিশন আদিপর্ব। অধ্যায় ৬৯। শ্লোক ৫-১৫
২। মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারতে আদিপর্বের ৭৪তম অধ্যায়।
বি: দ্র: মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ ও শ্রীপাদ দামোদর সাত্ত্বলেকর মহাশয়ের অনুবাদ অবলম্বনে উপরোক্ত শ্লোকগুলোর মৌলিক অনুবাদ প্রস্তুত করা হয়েছে।
🖊️ অনুবাদ ও উপস্থাপনায়
শ্রীমান সৌরভ নন্দী (সত্যার্থী)
©️ বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক