উত্তর: বিবাহ সংস্কারে প্রধান হোমে ১২টি রাষ্ট্রভৃৎ আজ্যাহুতির পরে ১৩টি আহুতি দেওয়া হয়। পারস্কর গৃহ্যসূত্র ১.৫.৯-এ এই বাক্যসমূহের উদ্ধৃতি ও বিধান দেওয়া হয়েছে। এই বাক্যসমূহ সামান্য পাঠভেদসহ তৈত্তিরীয় সংহিতা ৩.৪.৪-তেও বিদ্যমান। 'প্রজাপতির্জয়ানিন্দ্রায়...' তথা ১৩তম বাক্যে বিদ্যমান জয়া পদের জন্য এই সম্পূর্ণ আহুতিকে জয়াহোম বলা হয়।
কর্ক, জয়রাম, হরিহর, গদাধর প্রভৃতি টীকা-ভাষ্যকারদের মতে এগুলো দেবতাবাচক পদ নয় তাই এর চতুর্থ্যন্ত প্রয়োগ হবে না। যদিও বিশ্বনাথ 'চিত্তায়' আদি চতুর্থ্যন্ত রূপে প্রয়োগ করেছেন। গদাধরের ভাষ্যে দেখা যায়, 'ইমানি শাখান্তরোপদিষ্টানি দেবতাপদানি এষাং প্রয়োগকালে সম্প্রদানলক্ষণেন সম্প্রয়োগশ্চিত্তায় স্বাহেত্যাদীতি ভর্তৃযজ্ঞঃ নেতি কর্কাদয়ঃ। ন চেমানি দেবতাপদানি কিং তর্হি মন্ত্রাশ্চৈতে তে চ যথাম্নাতা এব প্রযোক্তব্যা' অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রাচীন ও অনুপলব্ধ পারস্কর গৃহ্যসূত্র বৃত্তিকার ভর্তৃযজ্ঞও এই প্রয়োগ মানতেন। কিন্তু কর্কাদির মতই এখানে দেবতবিচারে অধিক যুক্তিযুক্ত।
প্রতিটি আহুতির মন্ত্রের শুরুতে 'ও৩ম্' পদ দ্বারা প্রার্থনা করা হচ্ছে,
হে সর্বরক্ষক পরমেশ্বর! হে সচ্চিদানন্দ- হে অনন্তস্বরূপ! হে নিত্য শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব! হে কৃপানিধে! হে ন্যায়কারী! হে অজ নিরঞ্জন নির্বিকার! হে সর্বান্তর্যামী! হে সর্বাধার জগৎপিতা জগদুৎপাদক! হে অনাদি বিশ্বম্ভর সর্বব্যাপী! হে করুণামৃতবারিধে!
আমরা আজ পতি-পত্নী হিসেবে সমগ্র জীবনের জন্য পরস্পরের প্রেমবন্ধনে আপদ্ধ হচ্ছি। এই শুভকর্মে আমরা আপনার কৃপাপ্রার্থী। আপনি আমাদের এই বিবাহ সংস্কারে কৃপাপূর্বক দান করুন - কী দান করবেন ? আমরা আহুতির মাধ্যমে আপনার কাছেই চাই, কেননা আপনিই একমাত্র দাতা-
১. ও৩ম্ চিত্তং চ স্বাহা। ইদং চিত্তায় ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, চিত্তে জ্ঞান দিন। আমরা যেন এই চিত্ত জয়ী হই।
২. ও৩ম্ চিত্তিশ্চ স্বাহা। ইদং চিত্যৈ ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, হৃদয়ে চেতনা দিন। আমরা যেন চেতনার বলে বলীয়ান হই।
৩. ও৩ম্ আকূতঞ্চ স্বাহা। ইদমাকূতায় ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, সংকল্পের প্রেরণা দিন, আমরা যেন যা সংকল্প করবো তাতে সফল হই।
৪. ও৩ম্ আকূতিশ্চ স্বাহা। ইদমাকূত্যৈ ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, কর্মে সংকল্প শক্তি দিন, অর্থাৎ কোনো কাজে যেন স্পৃহা না হারাই।
৫. ও৩ম্ বিজ্ঞাতং চ স্বাহা। ইদং বিজ্ঞাতায় ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, বিবিধ জ্ঞান দিন, যেন জ্ঞাত সমস্ত বস্তু অর্জন করতে পারি।
৬. ও৩ম্ বিজ্ঞাতিশ্চ স্বাহা। ইদং বিজ্ঞাত্যৈ ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, বিজ্ঞানের শক্তি দিন, ব্রহ্মবিদ্যাই সর্বোত্তম বিজ্ঞান।
৭. ও৩ম্ মনশ্চ স্বাহা। ইদং মনসে ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, সুখ-দুঃখের চিন্তার সাধন মন= অন্তঃকরণ ও মানসিক শক্তি দিন
৮. ও৩ম্ শক্বরীশ্চ স্বাহা। ইদং শক্বরীভ্যঃ ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, কর্মেন্দ্রিয়ে বল দিন; হাত, পা, বাক, পায়ু, উপস্থ এসব কর্মেন্দ্রিয় যেন শক্তিশালী হয়
৯. ও৩ম্ দর্শশ্চ স্বাহা। ইদং দর্শায় ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, অমাবস্যার যজ্ঞ তথা দর্শেষ্টি করার সুযোগ দিন
১০. ও৩ম্ পৌর্ণমাসঞ্চ স্বাহা। ইদং পৌর্ণমাসায় ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, পূর্ণিমার যজ্ঞ তথা পৌর্ণমাসী করার সুযোগ দিন
১১. ও৩ম্ বৃহচ্চ স্বাহা। ইদং বৃহতে ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, উদার চিন্তার অধিকারী করুন
১২. ও৩ম্ রথন্তরঞ্চ স্বাহা। ইদং রথন্তরায় ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, সামবেদীয় রথন্তর সাম তথা বেদপাঠের সুযোগ দিন
১৩. ও৩ম্ প্রজাপতির্জয়ানিন্দ্রায় বৃষ্ণো প্রায়চ্ছদুগ্রঃ পৃতনা জয়েষু । তস্মৈ বিশঃ সমনমন্ত সর্বাঃ স উগ্রঃ স ইহব্যো বভূব স্বাহা । ইদং প্রজাপতয়ে জয়ানিন্দ্রায় ইদন্ন মম॥
অর্থাৎ, যজ্ঞফল তথা ইষ্টসিদ্ধির কৃপাবর্ষক পরমাত্মা জীবাত্মার জন্য এই জয় দানকারী মন্ত্র উত্তমভাবে আগেই দিয়েছেন। এই জয় মন্ত্রের প্রভাবেই জীবাত্মা শক্তিশালী হয়ে মানসিক-বাহ্যিক শত্রুদের জয় করতে সক্ষম হয়। এই কারণেই বাকি সব জীব তাকে প্রণিপাত করে। যে জয় লাভ করে সেই শক্তিশালী হয়। আর সেই জীবাত্মাই সকলের দ্বারা গৃহীত তথা বরণীয় হয়। এই ইষ্টসাধন যজ্ঞে সকলই পরমপ্রেমময় ভগবানেরই দান, আমার কিছুই নয়।
জয়া হোমের ১৩টি আহুতি কেবলমাত্র একটি বৈদিক বৈবাহিক সংস্কারগত আচার নয়, বরং এটি বিবাহ নামক পবিত্র বন্ধনের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক, মানসিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রতিফলন। এই আহুতিগুলির মাধ্যমে নবদম্পতি ঈশ্বরের কাছে জীবনের বিভিন্ন স্তরে জ্ঞান, শক্তি, সঙ্কল্প, ও সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করে। বিশেষ করে ১৩তম 'জয়া' আহুতি বিজয়ের প্রতীক, যা নবদম্পতির সম্মিলিত জীবনের পথচলায় সমস্ত বাধা অতিক্রম করে জয়ী হবার আশীর্বাদ নিয়ে আসে। অতএব, জয়া হোম বিবাহ সংস্কারের একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অংশ, যা দাম্পত্য জীবনের শুদ্ধতা, স্থায়িত্ব ও ঈশ্বরচিন্তায় নিবিষ্ট থাকার দিক নির্দেশ করে।
জীবনের এক নবদিগন্তে, পতি-পত্নীর মিলনের পবিত্র লগ্নে জয়া হোম পরমাত্মার থেকে আশীর্বাদের আহ্বান। অগ্নিতে আহুতির পাশাপাশি এড়ি জীবনের মানসপটেও এক একটি অক্ষয় প্রার্থনা—চিত্তের জাগরণ, জ্ঞানের দীপ্তি, সংকল্পের দৃঢ়তা, কর্মের বল, এবং আত্মিক বিজয়ের পথরেখা।
এই ১৩টি মন্ত্রের ধ্বনি যেন নবদম্পতির জীবনে এক আধ্যাত্মিক সংগীতের মতো বেজে ওঠে—যেখানে প্রেম, কর্তব্য, ও ধার্মিকতার মেলবন্ধনে বোনা হয় একটি শাশ্বত যাত্রার সূচনা। জয়া হোমের অন্তিম আহুতি, যেখানে প্রজাপতির পরমাত্মার শাশ্বত আশীর্বাদ বলে—“হে নবযাত্রীদ্বয়, জয়ী হও সংসারের মহাযুদ্ধে, থাকো ধৈর্যে, থাকো সত্ত্বগুণে পরিপূর্ণ।”
এইভাবে, জয়া হোম শুধু একটি বৈদিক আচার নয়, বরং এক শুভাশিসময় সোপান, যার উপর দাঁড়িয়ে নবদম্পতি জীবনের বিরাট অভিযানে প্রবেশ করে, ঈশ্বরচিন্তা ও পরস্পরের প্রতি অটুট আস্থা নিয়ে। এটি এক শুভ সূচনা, যা যুগল প্রাণকে এগিয়ে নিয়ে যায় মিলনের পবিত্র পথে, বিজয়ের অমল আলোকে।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর