

ও৩ম্,
কর্মপ্রধান বেদ যজুর্বেদ। যজুর্বেদ = যজুঃ + বেদ। সনাতন ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু মহর্ষি দয়ানন্দ স্বামীজীর ভাষায় যজুর্বেদের সংজ্ঞায়ন নিম্নরূপ- “যা দ্বারা মনুষ্য ঈশ্বর ও ধার্মিক বিদ্বানদের পূজা করে তথা সর্ব ক্রিয়ার সঙ্গতি, শিল্পবিদ্যার সঙ্গ, বিদ্যা প্রভৃতি শুভ গুণসমূহের দান, যথাযোগ্য সকলের উপকার তথা শুভ ব্যবহার এবং বিদ্বানদের জন্য দ্রব্য প্রভৃতির ব্যয় করে তাকে যজুঃ বলে।” [সূত্রঃ যজুর্বেদ-ভাষ্য ভূমিকাভাগ] এবং “বেদ অর্থাৎ যা এই সত্য সত্য জ্ঞানের হেতু।” [সূত্রঃ ঋগ্বেদ-ভাষ্য ভূমিকাভাগ]
একইভাবে যজুর্বেদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সংক্ষেপে স্বামীজী বলেছেন, “জীবকে গুণ-গুণীর বিজ্ঞান উপদেশ করার জন্য পরমেশ্বর ঋগ্বেদে সকল পদার্থের ব্যাখ্যা করেছেন। এখন [যজুর্বেদে] এসব পদার্থ দ্বারা মনুষ্যকে ঠিক-ঠিক উপযোগ নেয়ার জন্য কীভাবে কর্ম করা উচিত, এই উপদেশ করা হয়েছে। কর্ম করার জন্য যে যে অঙ্গ এবং সাধনের আবশ্যকতা রয়েছে, সেসকল যজুর্বেদে প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রিয়াত্মক জ্ঞান (practical knowledge) অর্জিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত উত্তম সুখও অর্জিত হয় না।” ... “যে-যে কর্ম বিজ্ঞানযুক্তভাবে সম্পাদিত হয় সে-সে কর্ম সুখ উৎপন্নকারী হয়। এজন্য মনুষ্যদের বিজ্ঞানপূর্বকই কর্মানুষ্ঠান করা উচিত।” [সূত্রঃ যজুর্বেদ-ভাষ্য ভূমিকাভাগ]
অর্থাৎ, এই বেদের মূখ্য উদ্দেশ্য মানুষকে যজ্ঞ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ কর্মের তত্ত্ব ও কৌশল বিষয়ক উপদেশ প্রদান করে জাগতিক সুখ ও মোক্ষের পথে ধাবিত করা। তাই এর প্রথম মন্ত্রেই পরমেশ্বর আমাদের প্রথমে যজ্ঞ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ কর্ম করা এবং এর মাধ্যমে ভৌতিক সুখ ও মোক্ষের পথে ধাবিত হওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন। এরপরেই তিনি আমাদের গোজাতি সহ অন্য সকল পশু-পাখিদের প্রতি কর্তব্যের চমৎকার ও বিস্তারিত উপদেশ প্রদান করেছেন। আমাদের আলোচ্য বিষয় মন্ত্রের দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি। মন্ত্রটি নিম্নরূপ -
পরমেষ্ঠী প্রজাপতির্ঋষিঃ॥ সবিতা দেবতা॥
(১) স্বরাড্ বৃহতী ছন্দঃ, মধ্যমঃ স্বরঃ। (২) ব্রাহ্মী উষ্ণিক্ ছন্দঃ, ঋষভঃ স্বরঃ॥
ই॒ষে ত্বো॒র্জে ত্বা॑ বা॒য়ব॑ স্থ দে॒বো বঃ॑ সবি॒তা প্রার্প॑য়তু॒ শ্রেষ্ঠ॑তমায়॒ কর্ম॑ণ॒ঽআপ্যা॑য়ধ্বমঘ্ন্যা॒ঽইন্দ্রা॑য় ভা॒গং প্র॒জাব॑তীরনমী॒বাঽঅ॑য়॒ক্ষ্মা মা ব॑ স্তে॒নঽঈ॑শত॒ মাঘশ॑ꣳসো ধ্রু॒বাঽঅ॒স্মিন্ গোপ॑তৌ স্যাত ব॒হ্বীর্যজ॑মানস্য প॒শূন্ পা॑হি॥ [যজুর্বেদ ১।১]
এখন মন্ত্রের “আপ্যা॑য়ধ্বমঘ্ন্যা॒ঽইন্দ্রা॑য় ভা॒গং প্র॒জাব॑তীরনমী॒বাঽঅ॑য়॒ক্ষ্মা মা ব॑ স্তে॒নঽঈ॑শত॒ মাঘশ॑ꣳসো ধ্রু॒বাঽঅ॒স্মিন্ গোপ॑তৌ স্যাত ব॒হ্বীর্যজ॑মানস্য প॒শূন্ পা॑হি॥” - অংশটুকুকে আর্যসমাজের চতুর্বেদ ভাষাভাষ্যকার আচার্যবর মীমাংসাতীর্থ পণ্ডিত শ্রী জয়দেব শর্মা বিদ্যালঙ্কার কৃত ভাষাভাষ্য অনুযায়ী বিশ্লেষণ করে আমরা পাই-

[১] (অঘ্ন্যাঃ) সর্বদা বধের অযোগ্য এবং যজ্ঞযোগ্য [= ভূতযজ্ঞের উপর্যুক্ত] গোজাতিসকল! সকলে (আপ্যায়ধ্বম্) অত্যন্ত পরিপুষ্ট হোক।

অর্থাৎ পরমেশ্বর আমাদের প্রথমেই জানাচ্ছেন, হে আমার মানব সন্তানগণ শোনো! গো প্রভৃতি পশুগণ তোমাদের দ্বারা সর্বদা বধের অযোগ্য বলে জানবে। অতএব কখনো তাদের বধ করোনা। সর্বদা তোমাদের নিত্য করণীয় পঞ্চমহাযজ্ঞের অন্যতম ভূতযজ্ঞ ও অন্যান্য উত্তম কর্মের মাধ্যমে তাদের সেবা শুশ্রূষা করো যাতে তারা পরিপুষ্ট হতে থাকে এবং তোমাদের বিভিন্ন উপকারে আসে।
এখানে অঘ্ন্যা শব্দের দ্বারা অনেকে মনে করেন এখানে শুধু গাভীকে বুঝিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি ভুল। ‘অঘ্ন্যা’ পদটি দ্বারা যেমন গাভীকে বোঝায় তেমনি বৃষ অর্থাৎ ষাঁড়, বলদ প্রভৃতিকেও বোঝায় এর প্রমাণ বেদ স্বয়ং প্রস্তুত করেছে। যেমন অথর্ববেদ ৯।৪।১৭ তে দেখুন, “গবাং য়ঃ পতিরঘ্ন্যঃ”। আরো দেখুন যজুর্বেদ ১২। ৭৩ মন্ত্রে - “বিমুচ্যধ্বমঘ্ন্যা দেবয়ানা” অর্থাৎ হে বিদ্বানগণ! (অঘ্ন্যাঃ) সর্বদা বধের অযোগ্য, রক্ষার যোগ্য, (দেবযানাঃ) দেব অর্থাৎ দিব্য ভোগসমূহ লাভে সহায়তাকারী বৃষ-বলদের (বি মুচ্যধ্বম্) সন্ধ্যাবেলা মুক্ত করো। অর্থাৎ সন্ধ্যাবেলায় বৃষদের জোয়াল থেকে মুক্ত করো। তারপর সকাল হলে তাদের আবার কৃষিকাজে নিযুক্ত করো। [ভাষ্যকার - ঐ] এছাড়া আমরা আরো পাই অথর্ববেদ ৯।৪।১৯ এ- “ব্রাহ্মণেভ্য ঋষভং দত্ত্বা বরীয়ঃ কৃণুতে মনঃ। পুষ্টিং সো অঘ্ন্যানাং স্বে গোষ্ঠেঽব পশ্যতে॥” এখানেও ঋষভ অর্থাৎ বৃষ এবং অঘ্ন্যা উভয়ের প্রয়োগ স্পষ্ট বিদ্যমান। যদিও আচার্যগণ এই মন্ত্রটিকে পরমেশ্বর অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন কারণ এর মূল উদ্দেশ্য পরমেশ্বরই। তবে এর দ্বারা যে বৃষের বর্ণনাও অভিপ্রেত তা স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন আচার্য বিশ্বনাথ বেদালঙ্কার তিনি লিখছেন - “এই মন্ত্রগুলিতে বৃষের উল্লেখও অভিপ্রেত, যা মন্ত্রপাঠের সময় আপনা-আপনি প্রকাশিত হয়। তবে মন্ত্রগুলির মূল উদ্দেশ্য পরমেশ্বরই।” এখানে আর্যসমাজের অন্য আচার্যরা সবাই একারণে আধ্যাত্মিক ভাষ্য করেছেন তবে পদ্মভূষণ শ্রীপাদ দামোদর এই মন্ত্রে বৃষপরখ ভাষ্যই করেছেন। এইজন্যই মহাভারতে মহর্ষি ব্যাসদেব বালব্রহ্মচারী ভীষ্ম মহারাজের উপদেশকে নিম্নবাক্যে উপস্থাপন করে স্পষ্টভাবে লিখছেন- “অঘ্ন্যা ইতি গবাং নাম ক এতা হন্তুমর্হতি। মহচ্চকারাকুশলং বৃষং গাং বাঽঽলভেৎ তু যঃ॥” [মহাভারত (গীতাপ্রেস সং.) শান্তিপর্ব, ২৬২ অধ্যায়, ৪৭ শ্লোক] অনুবাদঃ গোজাতিকে অঘ্ন্যা বলা হয়েছে, এরপরও কে তাদের হত্যা করার চিন্তা করবে? যে ব্যক্তি গাভী এবং বৃষ প্রভৃতির হত্যা করে সে মহাপাপ করে।
সুতরাং আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি সকল প্রকার গোজাতিকে হত্যা করাই বেদ অনুযায়ী নিষিদ্ধ। তারা সর্বদাই পালনপোষণের যোগ্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ বিশ্বের সর্বাধিক আর্য জনগোষ্টীর দেশ ভারতবর্ষ তার সংবিধানে শুধুমাত্র গৃহপালিত গোজাতি অর্থাৎ বর্তমানের ভারতীয় জেবু গরু (Bos Indicas) কে উন্নয়ন, পালন ও হত্যার অযোগ্য বলে সংরক্ষণে জোড় দিলেও অন্যান্য গোজাতির ক্ষেত্রে তারা নিরব। এই নামকাওয়াস্তে আইন আবার রাজ্য দ্বারা আরোপিত হবে এমন উল্লেখ থাকায় অনেক রাজ্য এ ব্যাপারে শুধু নিরব থেকেই সন্তুষ্ট নয়, তাদের অনেক নেতা-মন্ত্রীরা গো-চোরাচালান প্রভৃতি গোবিধ্বংসী অপকর্মের মাধ্যমে নিত্য গোজাতির ক্ষয় করে যাচ্ছেন। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমাদের অনেক পৌরাণিক ভাইগণও Bos Indicas ভিন্ন অন্যান্য গোজাতিকে বলি হিসেবে তথাকথিত পূজার নামে উৎসর্গ করে। কোথাও কোথাও মহিষ, বৃষ, বলদ প্রভৃতিকেও উৎসর্গ করে। এ কী বেদাজ্ঞা উল্লঙ্ঘন করা নয়? এ কী বেদাজ্ঞা উল্লঙ্ঘনরূপ নাস্তিকতা নয়? ধর্মপ্রাণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উচিত এ ব্যাপারে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সোচ্চার হওয়া। মনে রাখতে হবে সকল প্রকার গোজাতিই বেদ অনুসারে পবিত্র।

[২] তারা (ইন্দ্রায়) ঐশ্বর্যবান ব্যক্তি অথবা রাজার জন্য বা পরমৈশ্বর্য প্রাপ্তির জন্য (ভাগম্) সেবার যোগ্য অথবা লাভ করার যোগ্য ভাগ হবে।

সাধারণভাবে উল্লেখ করার পর আবার বিশেষ উল্লেখের দ্বারা বিশেষভাবে কর্তব্য প্রতিপাদন করার রীতি ধর্মশাস্ত্রে বহুল ব্যবহৃত। এর দ্বারা উল্লেখিত ব্যক্তিদের প্রতি কর্তব্যে অধিক গুরুত্ব দেয়াকে উপস্থাপন করা হয়। নিশ্চয়ই ভগবান মনু প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রকারগণ এই বেদোক্ত রীতিই ধর্মশাস্ত্রে প্রয়োগ করেছেন। সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি এই কর্মের প্রতিপাদন করার পর আবার আলাদাভাবে ঐশ্বর্যবান ব্যক্তি ও রাজাকে উল্লেখের মাধ্যমে পরমাত্মা তাদের প্রতি উক্ত কর্তব্যকে সামষ্টিক ও জাতীয় পর্যায়ে পালন করার বিশেষ নির্দেশনাই দিয়েছেন।

[৩] গো প্রভৃতি পশুগণ! সকলে (প্রজাবতীঃ) প্রজা, বৎস, পূত্র প্রভৃতি সহ (অনমীবাঃ) রোগমুক্ত, (অযক্ষ্মাঃ) রাজযক্ষ্মা থেকে মুক্ত থাকুক।

অর্থাৎ তাদের জন্য সেবাকেন্দ্র, পশু চিকিৎসালয় প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের পর্যাপ্ত আহার-বিহারের জন্য যথাযথ পশুশালা, উদ্যান প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। সম্ভবত বেদের এই নির্দেশনা অনুসারেই আয়ুর্বেদজ্ঞগণ পশুচিকিৎসা শাস্ত্রের নির্মাণ করেছিলেন। এই কাজ ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্ভব না হলেও ঐশ্বর্যবান ব্যক্তিদের দ্বারা সামষ্টিকভাবে এবং রাজার দ্বারা জাতীয় পর্যায়ে সম্পন্ন করা অসম্ভব নয়। শুধু সদিচ্ছার প্রয়োজন। ধন্য বিশ্ব মানবতার মহান আচার্য ঋষি দয়ানন্দ যিনি হাজার বছরের অবসরে উপলব্ধি করেছিলেন, বেদ সমস্ত বিদ্যার আকর, কিন্তু বেদ বীজরূপে বা মূল সূত্ররূপে সমস্ত বিদ্যা প্রদান করে। এমন শিক্ষা বিশ্বের আর কোন সভ্যতা উপলব্ধি করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে?

[৪] (বঃ) তাদের উপরে [যেন] (স্তেনঃ) চোর, ডাকাত প্রভৃতি দুষ্ট পুরুষ (মা ঈশত) প্রভুত্ব লাভ করতে না পারে।
[৫] (অঘঃ-শংসঃ) নিজে পাপ-চর্চাকারী, অন্যকে পাপ, হিংসা প্রভৃতি করতে প্রেরণাদানকারী নীচ ব্যক্তিও (বঃ মা ইশত) [যেন] তাদের স্বামী না হয়।

এ আজ্ঞার অন্তর্নিহিত ভাব আমরা মনু মহারাজের নিম্নোক্ত শ্লোকে [মনুস্মৃতি ৫।৫১] পাই - “অনুমন্তা বিশসিতা নিহন্তা ক্রয়বিক্রয়ী। সংস্কর্ত্তা চোপহর্তা চ খাদকশ্চেতি ঘাতকাঃ॥” অর্থাৎ, কোন প্রাণীকে হত্যার জন্য অনুমতিদাতা, মাংস কর্তনকারী, পশু হত্যাকারী, হত্যার জন্য পশু ক্রেতা ও বিক্রেতা তথা মাংসের ক্রয় বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, রাধুনী, পরিবেশনকারী এবং ভোজনকারী এরা সবাই ঘাতক = পশু হত্যাকারী ও পাপী অর্থাৎ হত্যা ও হত্যায় ভাগীদার হওয়ার কারণে পাপী। উপরোক্ত মন্ত্রে এই ব্যক্তিদের থেকেই পশুসম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রেরণা দিয়েছেন ঈশ্বর।
বর্তমানে পশুসম্পদ বিনষ্টের এক অন্যতম কারণ এই চোর, ডাকাত বা চোরাচালানকারীগণ। প্রায়ই দেখা যায় এরা বিভিন্ন পশু সম্পদ অবৈধভাবে বিক্রি বা পাচার করে যা পরবর্তীতে মাংস উৎপাদন প্রভৃতি অপকর্মে ব্যবহৃত হয়। পরমাত্মার নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের সকলকে এই চোরাচালান রোধ ও চোরাচালানকারীদের যথাযথ শাস্তি প্রদানের বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। এ কাজে নিয়োজিত রাজশক্তিকে যথাযথভাবে সহায়তা করতে হবে।
এরপর পশুসম্পদ বিনষ্টের কারণ হিসেবে আমাদের মাংসলোলুপতাকে উল্লেখ করা যায়। এর জন্য পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রচুর পরিমানে গোজাতি প্রভৃতি বিভিন্ন পশু-পাখি হত্যা করা হচ্ছে। তাদের সাথে অবিচার করা হচ্ছে৷ সুতরাং ঈশ্বরীয় আজ্ঞা মানতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই মাছ, মাংস, ডিম বর্জন করতে হবে৷ আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য বিকল্প উদ্ভিজ্জ প্রোটিন এবং বিভিন্ন দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহণে মনোনিবেশ করতে হবে। নিজে ভালো হলেই জগতের উন্নতি হবে, নশ্চেৎ নয়।
অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় বানিজ্যিকভাবে ডিম ও মাছ-মাংস উৎপাদনের জন্য আমরা অনেকেই বিভিন্ন খামার তৈরি করি বা সেগুলোতে নিজেদের অর্জিত অর্থ বিনিয়োগ করি। অনেকক্ষেত্রে পশুকে হত্যার উদেশ্যে উচ্চমূল্যে বিক্রির জন্য লালন-পালন করি এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে উক্ত কাজগুলোও পাপ। উক্ত কাজ করার মাধ্যমেও আপনি ঈশ্বরের বেদাজ্ঞা লংঘনকারী নাস্তিক হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন। সুতরাং হত্যার উদ্দেশ্যে বিক্রি করার জন্য এবং কশাই প্রভৃতি কাজ থেকে আমাদের দূরে আসতেই হবে।
এজন্য সামষ্টিক ও রাজশক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে এই জাতীয় কাজ নিষিদ্ধ করা ও উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিদের থেকে গো প্রভৃতি পশুসম্পদকে রক্ষা করার জন্য পরমাত্মা বলছেন- নিজে পাপ-চর্চাকারী, অন্যকে পাপ, হিংসা প্রভৃতি করতে প্রেরণাদানকারী নীচ ব্যক্তিও যেন তাদের স্বামী না হয়। মনে রাখবেন - “পাপ যে করে আর পাপ যে সহে দুজনেই সমান পাপী এই ভব সংসারে।”

[৬] তারা সকলে (গোপতৌ) গৌ অর্থাৎ গোজাতি ও ভূমির পালক রাজা এবং রক্ষক পুরুষের অধীনে (ধ্রূবাঃ) স্থিররূপে (বহ্বীঃ) বহু সংখ্যায় (স্যাত) বৃদ্ধি পেতে থাকুক।

এরূপ সভার অন্তর্নিহিত ভাব হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় আমরা বলতে পারি- “... আমরা মুখে গোজাতি সম্বন্ধে দয়া প্রকাশ করি, অথচ প্রত্যহ সেই গোরুর সহস্র অনাবশ্যক কষ্ট নিতান্ত উদাসীনভাবে নিরীক্ষণ করে থাকি। আমার কাছে এইরূপ মিথ্যা ও শূন্য ভাবুকতা অপেক্ষা লজ্জাকর ব্যাপার জগতে আর কিছুই নেই। আমাদের সভা থেকে যদি এর কোনো প্রতিকার করতে পারি তবে আমাদের সভা ধন্য হবে।...” [প্রজাপতির নির্বন্ধ/চিরকুমার-সভা - চতুর্থ অঙ্ক - প্রথম দৃশ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

[৭] হে বিদ্বান মানব! তুমিও (যজমানস্য) যজ্ঞকারী, দানশীল আত্মা ও যজ্ঞকর্তা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির (পশুন্ পাহি) পশুদের লালন-পালন করো।


এর উত্তর বেদমন্ত্রে দেয়ার আগে আমরা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বর্তমানে কোন মানুষ অন্য মানুষের বা সম্পদের ক্ষতি করলে তাঁর প্রতিকার করার দায় যেমন রাষ্ট্রের তেমনি উক্ত পশুদের ক্ষেত্রেও সেই একই বিধান। আপনি তাদেরকে রাষ্ট্রকে সমর্পন করতে পারেন বা উক্ত কাজে রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে পারেন এর বেশি কিছু নয়। তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের, আপনার নয়। যেমন বেদ ভগবান বলছেন-
“কোন মনুষ্য সকলের উপকারী পশুপাখিদেরকে কখনও হত্যা করবে না কিন্তু ইহাদের সঠিকভাবে রক্ষা করবে এবং তাদের থেকে উপকার গ্রহণ করে সকল মনুষ্যকে আনন্দ দান করবে। যে বন্য পশুপাখিগুলির দ্বারা গ্রামের পশু, কৃষি ও মনুষ্যের ক্ষতি হয়, শুধুমাত্র তাদেরকে রাজপুরুষগণ বধ করবে বা বন্দী করে রাখবে।” - [যজুর্বেদ ১৩। ৪৭] (ঋষি দয়ানন্দ-ভাষ্যানুসারে)

“... ৫০/৬০ বৎসর পূর্ব্বে গ্রামে গ্রামে গোয়াল-পোনা গরু থাকিত। গোচারণেরও অনেক মাঠ ছিল এবং বর্ষাকালে গরুর খাদ্যোপযোগী যথেষ্ট পল, বিচালী সংগ্রহ থাকিত। এখন পাটের চাষ বাহুল্য হওয়ায় এবং সকল শ্রেণীর একমাত্র উপজীব্য কৃষি হওয়ায় সমস্ত গোচারণের মাঠ ঘেরাও হইয়াছে। এখন আর ধর্ম্মের ষাঁড় দেখা যায় না। উপযুক্ত বৃষের অভাবে গোজাতি দিন দিন অবনতি প্রাপ্ত হইতেছে। গোজাতি যেমন আকারে খর্ব্ব, তেমনই অস্তিকঙ্কালসার। খুলনা শহরে বর্ষাকালে টাকায় দেড় সের দুই সের দুধ, তাহাও মিলা ভার। পাড়াগাঁয়ে অনেক সময় টাকায় ৩/৪ সের দুধ, তাহাও আবার দুষ্প্রাপ্য। ফল কথা, দুধের অভাবে শিশু সন্তান পুষ্টিলাভ করিতে পারে না এবং বাঙ্গালী জাতি ক্রমশঃই হীনবীৰ্য্য হইয়া পড়িতেছে।...”
[আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী, পৃ. ৩৮২]
তাই আসুন সকলে বেদের ভাষায় উচ্চকণ্ঠে বলি-
মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসূনাং স্বসাদিত্যানামমৃতস্য নাভিঃ। প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায় মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট॥ [ঋগ্বেদ ৮। ১০১। ১৫; ভাষ্যকার - পূর্বোক্ত]
সরলানুবাদ - দুষ্টদের দমনকারী বীর পুরুষদের দুগ্ধ পান করিয়ে পুষ্টি জোগানো, রোগনাশক ঘৃত, দুগ্ধ প্রভৃতি উৎপাদনকারী জননী হল এই গাভী; আর বীরদের উৎপাদনকারী ও রোগনাশক ঔষধ উৎপন্নকারী জননী এই গোমাতা হলো ভূমি। দুষ্টদের বিনাশকারী বীরদের এবং প্রাণযুক্ত জীবের মা এই কন্যারূপ মাতৃশক্তি হলো গাভী। সে রাষ্ট্রে বা জগতে বসবাসকারী সকল জীবকে সমস্ত সুখ দান করে, আদান-প্রদানে নিয়োজিত ব্যবসায়ী বৈশ্য সম্প্রদায়ের জন্য সে সমস্ত সুখদানকারী, ভগিনীর সমান এবং অমৃতসম দীর্ঘজীবনের উৎস যেন এক আশ্রয়স্থল। আমি এই সমস্ত তথ্যজ্ঞানীদেরকে নিশ্চিতভাবে ও বলপূর্বক বলছি যে, এমন নিষ্পাপ গোজাতিকে এবং ভূমিবৎ, মাতা-পিতাবৎ, পূত্র-পূত্রিবৎ গোজাতিকে কখনও হত্যা করো না।
টীকা: বেদের এই প্রবল অহিংসা প্রতিপাদক আহ্বান শ্রবণ করে ঘোর হিংসক ব্যক্তিও গোজাতির প্রতি তোলা হাত ফিরিয়ে নিন। [এই হলো বেদাজ্ঞা, এর অবমাননাই নাস্তিকতা।] পরমপিতা পরমাত্মা আমাদের সকলকে বেদাজ্ঞা যথাযথভাবে পালনের প্রেরণা দান করুন।
বিশেষ - সম্পূর্ণ মন্ত্রটির আচার্য প. জয়দেব শর্মা, বিদ্যালঙ্কার, মীমাংসাতীর্থ কৃত সম্পূর্ণ ভাষাভাষ্যানুবাদ-
[বিষয়ঃ- পরমেশ্বরের কাছে অন্ন, বলের প্রার্থনা। রোগরহিত পশুসম্পদের কামনা। দুষ্ট মনুষ্যদের বিনাশ।]
হে পরমেশ্বর! আমরা (ইষে) অন্ন, উত্তম বৃষ্টি প্রভৃতি পদার্থসমূহের প্রাপ্তি এবং (ঊর্জে) সর্বোত্তম, পুষ্টিকারক রস লাভ করার জন্য (ভাগং) সর্বোপাস্য (ত্বা ত্বা) তোমার উপাসনা করি, তোমার আশ্রয় গ্রহণ করি। হে প্রাণ এবং প্রাণিগণ! তোমরা (বায়বঃ স্থ) সকলে বায়ুরূপ, বায়ু দ্বারা প্রাণ ধারণ করো। (বঃ) সেই সকলের (সবিতা) উৎপাদক পরমেশ্বরই (দেবঃ) পরম দেব, সকল সুখ ও পদার্থের প্রকাশক এবং প্রদানকারী। তিনি (শ্রেষ্টতমায়) অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম (কর্মণে) কর্ম, নিঃশ্রেয়স, মোক্ষ লাভের জন্য (প্র অর্পয়তু) প্রেরণা দেন এবং (অঘ্ন্যাঃ) সর্বদা বধের অযোগ্য, ইন্দ্রিয়স্থ প্রাণগণ এবং যজ্ঞযোগ্য [= ভূতযজ্ঞের উপর্যুক্ত] গোজাতিসকল ও পৃথিবী প্রভৃতি লোক! সকলে (আপ্যায়ধ্বম্) অত্যন্ত পরিপুষ্ট হোক। তারা (ইন্দ্রায়) ঐশ্বর্যবান পুরুষ অথবা রাজার জন্য বা পরমৈশ্বর্য প্রাপ্তির জন্য (ভাগম্) সেবার যোগ্য অথবা লাভ করার যোগ্য ভাগ হবে। প্রজাসমূহ অথবা গো প্রভৃতি পশুগণ! সকলে (প্রজাবতীঃ) প্রজা, বৎস, সন্তান প্রভৃতি সহ (অনমীবাঃ) রোগমুক্ত, (অযক্ষ্মাঃ) রাজযক্ষ্মা থেকে মুক্ত থাকুক। (বঃ) তাদের উপরে [যেন] (স্তেনঃ) চোর, ডাকাত প্রভৃতি দুষ্ট পুরুষ (মা ঈশত) প্রভুত্ব লাভ করতে না পারে। (অঘঃ-শংসঃ) নিজে পাপ-চর্চাকারী, অন্যকে পাপ, হিংসা প্রভৃতি করতে প্রেরণাদানকারী নীচ ব্যক্তিও (বঃ মা ইশত) [যেন] তাদের স্বামী না হয়। তারা সকলে (গোপতৌ) গৌ অর্থাৎ গোজাতি ও ভূমির পালক রাজা এবং রক্ষক পুরুষের অধীনে (ধ্রূবাঃ) স্থিররূপে (বহ্বীঃ) বহু সংখ্যায় (স্যাত) বৃদ্ধি পেতে থাকুক। হে বিদ্বান মানব! তুমিও (যজমানস্য) যজ্ঞকারী, দানশীল আত্মা ও যজ্ঞকর্তা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির (পশুন্ পাহি) পশুদের লালন-পালন করো।
ইত্যোম্ শম্॥
সর্বপ্রাণির কল্যাণকামনায় নিবেদক,
যজুর্বেদীয় আলম্বায়ন গোত্রীয়, পরম্পরাক্রমে গোজাতি তথা চতুর্বর্ণের পালক বৈশ্যকুলোদ্ভব - সত্যার্থী শ্রীমান সৌরভ নন্দী

সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক