
উত্তরঃ আমি আর্য।


উত্তরঃ
প্রাচীন অর্থ হিসেবে নিরুক্ত ৬।২৬-এ আমরা পাই, ‘আর্য ঈশ্বরপূত্রঃ’ অর্থাৎ ঈশ্বরের সন্তানদেরকে আর্য বলা হয়। বারাণসীর চৌখম্বা প্রেস থেকে প্রকাশিত নিরুক্ত-ভাষ্যে পৌরাণিক বিদ্বান জমুনাপাঠক, আর্য শব্দের অর্থ লিখেছেন, ‘ঈশ্বরের সন্তান, বেদ অনুসরণকারী’। (পৃ০ ৪৪৮)



এবং মান্য, মারিষ = আদরণীয়, শ্রদ্ধেয় [অমরকোষ ১. ৭. ১৫ (আর্যস্তু মারিষঃ)]


২. ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিভাষায়- আর্যাবর্তের মূলনিবাসী ব্যক্তিকে ‘আর্য’ নামে অভিহিত করা হয়।

উত্তরঃ সনাতন ধর্ম বা বৈদিক ধর্ম।

উত্তরঃ যে ‘সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত’ অর্থাৎ ‘সার্বভৌমিক ও সার্বজনিক ধর্ম’ সকলে সর্বদা মেনে এসেছে, এখনও মানে এবং ভবিষ্যতেও মানবে তথা যে ধর্মের বিরোধী কেউই হতে পারে না তাকে ‘সনাতন’ = নিত্যধর্ম বলে। (সত্যার্থ প্রকাশ, স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশ)

উত্তরঃ দুই ভেদ নয়, যাই সনাতন ধর্ম তাই বৈদিক ধর্ম। শাস্ত্রে যেমন সনাতন পাওয়া যায় তেমনি শঙ্করাচার্য তাঁর বিবেকচুড়ামণি গ্রন্থে “বৈদিকধর্মমার্গপররতা” [শ্লোক-২] বলে বৈদিক ধর্ম নামও নির্দেশ করেছেন। অতএব বলা যায়, “হিন্দুধর্ম বেদমূলক; বেদ সনাতন-নিত্য; এই হেতু এই ধর্মের প্রকৃত নাম বৈদিক ধর্ম বা সনাতন ধর্ম।” [শ্রীগীতা, শ্রী জগদীশ ঘোষ, ভূমিকা, পৃ০৩]

উত্তরঃ আমার মত ‘বেদ’ অর্থাৎ যা কিছু বেদোক্ত তার সবটুকুই আমি মানি। (সত্যার্থ প্রকাশ, ৭ম সমুল্লাস)। “অর্থাৎ বেদ যা যা গ্রহণ করতে শিক্ষা দিয়েছে সেগুলি যথাবৎ পালন করা ও যা যা বর্জন করতে শিক্ষা দিয়েছে সেগুলোকে বর্জন করা উচিত বলে মানি। যেহেতু বেদ আমাদের জন্য মান্য সেহেতু আমাদের মত বেদ।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ৩য় সমুল্লাস)।
এই মতই সনাতন ধর্ম কেননা- “পরমেশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত বেদোক্ত বাক্যই সনাতন। যা বেদবিরুদ্ধ তা কখনও সনাতন হতে পারে না। এরূপ সকলেরই স্বীকার করা ... অবশ্য কর্তব্য।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ৪র্থ সমুল্লাস)

উত্তরঃ বৈদিক মত ভিন্ন সনাতন ধর্মের বিভিন্ন মত-মতান্তর এবং সনাতন ধর্মের বাইরের বিভিন্ন মত-মতান্তর নবীন ও কপোলকল্পিত।
“এ কথা প্রমাণসিদ্ধ যে পাঁচ সহস্র বৎসর পূর্বে বেদ-মত ব্যতীত অন্য কোন মত ছিল না। বেদোক্ত সমস্ত বিষয় জ্ঞানের অবিরুদ্ধ। বেদের প্রতি অপ্রবৃত্তি উৎপন্ন হওয়ায় মহাভারতের যুদ্ধ ঘটে এবং এতেই পৃথিবীতে অবিদ্যান্ধকার বিস্তৃত হয়। ফলে মনুষ্যের বুদ্ধি ভ্রমযুক্ত হয় এবং যাঁর মনে যেরূপ চিন্তার উদয় হল, তিনি সেরূপ মতই প্রচলন করলেন। সকল মতের মধ্যে চারটি মত অর্থাৎ বেদবিরুদ্ধ পৌরাণিক, জৈন, খ্রিষ্টান এবং মুসলমান মত অন্য সমস্ত মতের মূল। এ সকল মত ক্রমান্বয়ে একটির পর একটি করে চলে আসছে। এখন এই চারটি মতের শাখা এক সহস্রের কম নয়।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ১১শ সমুল্লাস)

উত্তরঃ ১. বেদ-মত সকলকে উদ্ধারকারী। (সত্যার্থ প্রকাশ, ১২শ সমুল্লাস)। আবার- “পরমেশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত বেদোক্ত বাক্যই সনাতন। যা বেদবিরুদ্ধ তা কখনও সনাতন হতে পারে না। এরূপ সকলেরই স্বীকার করা ... অবশ্য কর্তব্য।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ৪র্থ সমুল্লাস)

উত্তরঃ “ভালো তো কেবল বেদমার্গ। যদি পার তো অনুসরণ কর; নতুবা সর্বদা হাবুডুবু খেতে থাকবে।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ১৪শ সমুল্লাস)

উত্তরঃ “এ সকল মূঢ়-কল্পিত মতবাদ পরিত্যাগ করে বেদোক্ত ধর্ম গ্রহণ করাই সকলের কর্ত্তব্য। আৰ্যমার্গ অর্থাৎ উন্নতচরিত্র লোকদের পথে বিচরণ করা এবং দস্যু অর্থাৎ দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের পথ হতে দূরে থাকাই শ্রেয়ঃ...।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ১৪শ সমুল্লাস)
“যদি তোমার সত্য-মত গ্রহণের ইচ্ছা থাকে, তবে বৈদিক মত গ্রহণ কর।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ১৪শ সমুল্লাস)

উত্তরঃ না। বেদমত নতুন নয় বরং এটিই সর্ব পুরাতন। এবং “যেহেতু বেদ আমাদের মান্য, সেহেতু আমাদের মত বেদ। এরূপ মেনেই সকল মনুষ্যের বিশেষতঃ আৰ্যদের একমত হয়ে থাকা উচিত।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ৩য় সমুল্লাস)।
কারণ- “যতদিন মানবজাতির মধ্যে মিথ্যা মত-মতান্তরের বিরুদ্ধে বাদ দূর না হবে, ততদিন পর্যন্ত পরস্পরের মধ্যে আনন্দ থাকবে না। যদি আমরা সকলে বিশেষতঃ বিদ্বান ব্যক্তিরা, ঈর্ষা, দ্বেষ পরিত্যাগ ও সত্যাসত্যের নির্ণয় করে সত্যগ্রহণ ও অসত্যবর্জন করতে ও করাতে ইচ্ছা করি, তবে তা আমাদের পক্ষে অসাধ্য নয়।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ১১শ সমুল্লাস)।
সুতরাং যদি ঐক্য চাও তবে- “তোমরাও যদি আমাদের ন্যায় বৈদিক মার্গ অবলম্বন কর তাহলে বিভিন্ন কুকর্ম হতে অব্যাহতি পেতে পার; নতুবা নয়।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ১১শ সমুল্লাস)।
কোন নির্দিষ্ট ভিত্তি ছাড়া ঐক্য নয়না। আর সনাতনী হতে গেলে যেহেতু বেদকে মানতেই হয় সেক্ষেত্রে বেদই এই ঐক্যের ভিত্তি হওয়ার যোগ্য।সুতরাং, সকলে বেদ মান্য করে জীবন পথে অগ্রসর হলেই ঐক্য আসবে। এই ঐক্য বেদের শক্ত ভিত্তির উপরে স্থিত হওয়ায় ক্ষণভঙ্গুর নয়।

উত্তরঃ আচ্ছা, এতদিন যা হওয়ার হয়েছে এবার “এই মিথ্যাপ্রপঞ্চ প্রভৃতি কুকর্মগুলি পরিত্যাগ করে পরমেশ্বরোক্ত সুন্দর বেদবিহিত সুপথে চলে স্বীয় মানব জীবন সফল কর এবং ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ — এই চতুবর্গ ফল লাভ করে ইহলোক ও পরলোকে আনন্দ ভোগ কর।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ১১শ সমুল্লাস)।

উত্তরঃ “না, কিন্তু তোমার বিপরীত বুদ্ধিকে না মেনে খণ্ডনও করছি। ... তুমি পাঁচ অথবা সাত পুরুষের আচারকে সনাতন রীতি মনে করছ। আর আমি বেদ এবং সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত মান্য আচারকে পরম্পরা স্বীকার করছি।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ৪র্থ সমুল্লাস)

উত্তরঃ “ঈশ্বর এবং যাবতীয় পদার্থ সম্বন্ধে বেদাদি সত্য শাস্ত্রসমূহে যাহা লেখা আছে এবং ব্রহ্মা থেকে শুরু করে জৈমিনি মুনি পৰ্যন্ত মুনিঋষিগণ যা বিশ্বাস করতেন আমিও তাই বিশ্বাস করি।” (সত্যার্থ প্রকাশ, স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশ) - এই আমার পরম্পরা, আর্ষ পরম্পরা।

উত্তরঃ ভুল শুনেছেন। বৈদিকগণ বেদকে স্বতঃপ্রমাণ = স্বয়ংপ্রমাণ, অন্যান্য ঋষিকৃত গ্রন্থকে বেদমূলক হওয়ার সাপেক্ষে পরতঃপ্রমাণ = সাপেক্ষ প্রমাণ এবং বেদবিরুদ্ধ মনুষ্যরচনাকে অপ্রমাণ জ্ঞান করে। আমরা, “চার ‘বেদ’কে অর্থাৎ বিদ্যা, ধর্মযুক্ত, ঈশ্বর প্রণীত, সংহিতা মন্ত্রভাগকে অভ্রান্ত ও স্বতঃপ্রমাণ বলিয়া বিশ্বাস করি। অর্থাৎ যা স্বয়ং প্রমাণরূপ, যার প্রমাণ অন্য কোন গ্রন্থ সাপেক্ষ নয়। যেমন, সূৰ্য্য ও প্রদীপ স্বভাবতঃ স্ব স্ব স্বরূপ স্বয়ং প্রকাশ করে এবং ভূমণ্ডল প্রভৃতিরও প্রকাশক, চার বেদও সেইরূপ। চারটি বেদের ব্রাহ্মণ, অঙ্গ ছয়টি, উপাঙ্গ ছয়টি, উপবেদ চারটি এবং এগার শত সাতাশটি শাখা আছে যা ব্রহ্মাদি মহর্ষি রচিত বেদব্যাখা স্বরূপ, তাদেরকে পরতঃপ্রমাণ হিসেবে মানি। অর্থাৎ এগুলি বেদানুকূল হলেই প্রমাণ এবং তন্মধ্যে বেদবিরুদ্ধ বচনগুলিকে অপ্রমাণ মনে করি।” (সত্যার্থ প্রকাশ, স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশ)
“পরন্তু তা (বেদ) ভিন্ন আরো যেসব গ্রন্থ বিভিন্ন মানুষের রচিত, সেগুলোও বেদের অনুকূল হওয়ার সাপেক্ষে পরতঃপ্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য। যেহেতু, বেদ ঈশ্বর রচিত এবং তিনি সর্বজ্ঞ, সর্ববিদ্যাযুক্ত তথা সর্বশক্তিমান্ এজন্য ঈশ্বরের বাক্যই কেবলমাত্র নির্ভ্রান্ত ও (স্বয়ং)প্রমাণের যোগ্য হতে পারে। নচেৎ জীবের রচিত গ্রন্থ কদাপি স্বয়ংপ্রমাণ হতে পারে না, যেহেতু জীব সর্ববিদ্যাযুক্ত ও সর্বশক্তিমান নয়, এজন্য তাদের সকল বাক্য (কদাপি) স্বতঃপ্রমাণ যোগ্য হতে পারে না।” (ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, গ্রন্থ প্রামাণ্যাপ্রামাণ্য বিষয়ঃ)।
“বেদ নিজের জ্যোতিতে প্রকাশিত হয়ে অন্যকেও প্রকাশিত করে। এ দ্বারা সিদ্ধ হয় যে, যে সকল গ্রন্থ বেদবিরুদ্ধ তা কদাপি প্রামাণিক বা স্বীকারণীয় হইবার যোগ্য নহে এবং বেদের সাথে অন্য গ্রন্থের বিরোধ দৃষ্ট হলেও, বেদ কদাপি অপ্রামাণিক হতে পারে না, যেহেতু বেদ স্বয়ংই স্বতঃপ্রমাণ স্বরূপ হয়ে থাকে।” (ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, গ্রন্থ প্রামাণ্যাপ্রামাণ্য বিষয়ঃ)।
“পূর্বোক্ত প্রকরণানুযায়ী উপরোক্ত গ্রন্থসকল স্বতঃ ও পরতঃ প্রমাণরূপে গ্রহণ করা ও পরকে উপদেশ দিয়ে গ্রহণ করানো তথা ঐ সকল গ্রন্থের পঠন পাঠন করা সকলের কর্তব্য।” (ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, গ্রন্থ প্রামাণ্যাপ্রামাণ্য বিষয়ঃ)
“স্বতঃপ্রমাণ অথবা পরতঃপ্রমাণ গ্রন্থ ছাড়া, অপর গ্রন্থকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করা কর্তব্য নয়, কারণ যে সকল গ্রন্থ পক্ষপাতী, ক্ষুদ্রবুদ্ধিযুক্ত, অল্প বিদ্যাসম্পন্ন, অধার্মিক, অসত্যবাদী প্রভৃতি গুণযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা বেদবিরুদ্ধ ও যুক্তিপ্রমাণরহিত ভাবে লিখিত হয়েছে, তা কদাপি প্রমাণ রূপে গ্রাহ্য হতে পারে না।” (ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, গ্রন্থ প্রামাণ্যাপ্রামাণ্য বিষয়ঃ)

উত্তরঃ “মহাশয় মহর্ষিগণ যেরূপে গম্ভীর বিষয়গুলি সরলভাবে স্ব-স্ব গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন, ক্ষুদ্রাশয় মনুষ্যগণের কল্পিত গ্রন্থে সেরূপ প্রকাশ করা কীরূপে সম্ভব হতে পারে? মহর্ষিদের ভাব যথাসম্ভব সুগম এবং অল্প সময়ে আয়ত্ত করা যায়। কিন্তু ক্ষুদ্রাশয় ব্যক্তিগণের ইচ্ছা এই যে, যতদূর সম্ভব রচনাকে কঠিন করা, যাতে বহু পরিশ্রমের মাধ্যমে পাঠ করেও অল্প লাভ হয়। এ যেন পাহাড় কেটে কপর্দক লাভ। আর আর্য গ্রন্থ পাঠ করা যেন একবার ডুব দিয়াই বহুমূল্যবান মণি-মুক্তা লাভ করা।” (সত্যার্থ প্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস) “ঋষিপ্রণীত গ্রন্থ এই জন্য পাঠ করবে যেহেতু তাঁরা পরম বিদ্বান, সর্বশাস্ত্রবিদ এবং ধর্মাত্মা ছিলেন। আর যাঁরা অনৃষি অর্থাৎ অল্পশাস্ত্র পড়েছেন ও যাঁদের আত্মা পক্ষপাতদুষ্ট তাহাদের রচিত গ্রন্থও সেইরূপই হবে।”(সত্যার্থ প্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস)

উত্তরঃ “মানি। কিন্তু সত্যকে মানি, মিথ্যাকে নয়।
ব্রাহ্মণানীতিহাসান্ পুরাণানি কল্পান্ গাথা নারাশাংসীরিতি॥ [তৈত্তিরীয় আরণ্যক ২।৯] অর্থাৎ, যা ঐতরেয়, শতপথ প্রভৃতি ব্রাহ্মণ গ্রন্থে লিখিত হয়েছে তাদেরই ইতিহাস, পুরাণ, গাথা, নারাশংসী এই পাঁচটি নাম। শ্রীমদ্ভাগবতাদির নাম পুরাণ নয়।” (সত্যার্থ প্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস)

উত্তরঃ “এসকল গ্রন্থে যে যে সত্য আছে, তা বেদ প্রভৃতি বিভিন্ন সত্য শাস্ত্রের কথা আর যা মিথ্যা আছে তা তাদের নিজের কথা। বেদ প্রভৃতি বিভিন্ন সত্য শাস্ত্রের কথা স্বীকার করলে সকল সত্যই গৃহীত হয়। যদি কেউ এই মিথ্যাগ্রন্থগুলো থেকে সত্য গ্রহণ করতে চায়, তবে মিথ্যাও তার গলায় আটকে যাবে। এইজন্য ‘অসত্যমিশ্রং সত্যং দূরতস্ত্যাজ্যমিতি’ অসত্যযুক্ত গ্রন্থস্থ সত্যকে বিষযুক্ত অন্নের ন্যায় পরিত্যাগ করবে।” (সত্যার্থ প্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস)।
আবার
“এসকল (মিথ্যা)গ্রন্থ দ্বারা সত্যগ্রহণের আশা করলে সত্যার্থপ্রকাশক বেদাদি গ্রন্থ লুপ্ত হতে থাকে। এজন্য এইসব সত্যগ্রন্থসমূহের প্রচারার্থে ঐসকল মিথ্যা গ্রন্থসমূহ পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্তব্য।” (ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, গ্রন্থ প্রামাণ্যাপ্রামাণ্য বিষয়ঃ)

উত্তরঃ অবশ্যই ঠিক। এ কাজের “মুখ্য প্রয়োজন সত্য-অর্থের প্রকাশ করা অর্থাৎ যা সত্য তাকে সত্য এবং যা মিথ্যা তাকে মিথ্যাই প্রতিপাদন করাকে আমি সত্যার্থের প্রকাশ বলে বুঝেছি।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ভূমিকা)।
“কারও মনে ব্যথা দেওয়া বা কারও অনিষ্ট করা আমার অভিপ্রায় নয়; কিন্তু যাতে মনুষ্য জাতির উন্নতি ও উপকার হয় এবং মনুষ্যগণ সত্যাসত্য জেনে সত্যগ্রহণ ও অসত্য পরিত্যাগ করে তাই আমার অভিপ্রায়; কেননা সত্যোপদেশ ব্যতীত মানবজাতির উন্নতির অপর কোনও উপায় নেই।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ভূমিকা)।
এজন্যই আমরা মনে করি- “উপদেশ বা লেখার দ্বারা সব মানুষের সম্মুখে সত্যাসত্যের স্বরূপ উপস্থিত করাই বিদ্বান্ এবং আপ্ত-পুরুষদের মুখ্য কর্ম। এর পর মনুষ্যগণ সকলে নিজনিজ হিতাহিত বুঝে নিজেরাই সত্যার্থ গ্রহণ ও মিথ্যার্থ বর্জন করিয়া সর্বদা আনন্দে থাকবেন।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ভূমিকা)

উত্তরঃ না। কারণ-
“আমি কোন মত বিশেষের প্রতি পক্ষপাতী হলে আধুনিক মতবাদীরা যেমন স্বমতের স্তুতি, মণ্ডন ও প্রচার করতে এবং পরমতের নিন্দা, হানি ও প্রতিরোধ করতে তৎপর হয়, আমিও সেইরূপ করতাম কিন্তু এই কাজ মনুষ্যত্বের বহির্ভূত।”(সত্যার্থ প্রকাশ, ভূমিকা)।
“এরূপ বহু হঠকারী ও দুরাগ্রহী ব্যক্তি আছেন, যাঁরা বক্তার অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধ কল্পনা করে থাকেন। বিশেষত মতালম্বীরাই এরূপ করে থাকেন। কারণ মতের প্রতি আগ্রহবশতঃ তাঁহাদের বুদ্ধি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে নষ্ট হয়ে যায়।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ভূমিকা)।
সুতরাং আমার মনে হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য স্থাপিত করতে চাইলে- “আজকাল প্রত্যেক মতেই বহু বিদ্বান ব্যক্তি আছেন, যদি তাঁরা পক্ষপাত পরিত্যাগ করে সৰ্ব্বতন্ত্র-সিদ্ধান্ত অর্থাৎ যে সকল বিষয় সকলের অনুকূলে এবং সকল মতে সত্য, সেসব গ্রহণ করে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধ বিষয়সমুহ বৰ্জন করে পরস্পর প্রীতিপূৰ্ব্বক আচরণ করেন ও করান তাহলেই জগতের পূর্ণ হিত সাধিত হবে। কেননা, বিদ্বান ব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধ হলে অবিদ্বান ব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বহুবিধ দুঃখের বৃদ্ধি ও সুখের হানি হয়ে থাকে।” (সত্যার্থ প্রকাশ, ভূমিকা)।

উত্তরঃ “আমি জানি যে, যা তিন কালে সকলের পক্ষে সমভাবে বিশ্বাসের উপযুক্ত, তাই আমার মত। কোন নবীন কল্পনা বা মত প্রচলিত করব, এমন উদ্দেশ্যের লেশমাত্রও আমার নাই; কিন্তু স্বয়ং সত্য বিশ্বাস করা এবং অপরকেও সত্য বিশ্বাস করতে প্রবৃত্ত করানই আমার উদ্দেশ্য। আমি যদি পক্ষপাত করতাম, তাহলে আৰ্যাবর্তের প্রচলিত মতসমূহের মধ্যে কোন একটির প্রতি বিশেষ আগ্রহশীল হতাম। কিন্তু আমি আৰ্যাবর্ত কিংবা অপর কোন দেশের ধর্ম-বিরুদ্ধ আচার-ব্যবহার গ্রহণ করিনা এবং সঙ্গত আচার-ব্যবহার বর্জন করিনা, কিংবা গ্রহণ-বর্জনের ইচ্ছাও করি না; কারণ তা করা মানবতার বহির্ভূত।” (সত্যার্থ প্রকাশ, স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশ)

উত্তরঃ “বিদ্যা ও ধর্ম প্রাপ্তির কাৰ্যসমূহ প্রথম করার ক্ষেত্রে বিষতূল্য কিন্তু পরে অমৃততুল্য হয়ে থাকে” (সত্যার্থ প্রকাশ, ভূমিকা)।
কিন্তু “সৰ্বদা সত্যের বিজয় এবং অসত্যের পরাজয় হয় এবং সত্যের দ্বারাই বিদ্বানদের পথ প্রশস্ত হয়। এই দৃঢ় নিশ্চয়ের অবলম্বন দ্বারা আপ্তপুরুষগণ পরোপকারে উদাসীন হইয়া কখনও সত্যার্থ-প্রকাশ করতে পশ্চাৎপদ হন না।”(সত্যার্থ প্রকাশ, ভূমিকা)।
“যিনি মননশীল হয়ে সকলের সুখ দুঃখ ও লাভালাভ নিজের ন্যায় মনে করেন এবং যিনি শক্তিশালী অন্যায়কারীকে ভয় করেন না, কিন্তু দুর্বল ধর্মাত্মা হতেও ভীত হন, তাকেই মনুষ্য বলে।”(সত্যার্থ প্রকাশ, স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশ)
তাই আমার মতে,
“যতদূর সম্ভব, অন্যায়কারীদেরকে সর্বতোভাবে হীনবল এবং ন্যায়কারীদিগকে শক্তিশালী করার জন্য দারুণ দুঃখভোগ, এমন কি অকালে প্রাণ বিসর্জন করতে হলেও এই মানবতারূপ ধর্ম সাধনে পশ্চাৎপদ না হওয়াই মনুষ্যের কর্তব্য।” (সত্যার্থ প্রকাশ, স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশ)
সৰ্বাত্মা, সৰ্বান্তর্যামী, সচ্চিদানন্দ পরমাত্মা নিজ কৃপায় এই উদ্দেশ্যকে প্রসারিত ও চিরস্থায়ী করুন।
॥ অলমতিবিস্তরেণ বুদ্ধিমদ্-বিদ্বদ্বরশিরোমণিষু ॥