
(১) ঈশ্বর এক এবং এর মুখ্য নাম 'ও৩ম্'। নিজের বিভিন্ন গুণ-কর্ম-স্বভাবের কারণে তিনি অনেক নামে পরিচিত।
(৩) ঈশ্বর অনাদি, অজন্মা ও অমর। তিনি জন্ম নেন না, মৃত্যুবরণও করেন না ।
(৪) ঈশ্বর 'সচ্চিদানন্দস্বরূপ' অর্থাৎ তিনি সর্বদা আনন্দমুখর থাকেন । স্বীয় স্বার্থে কখনোই রাগ করেন না ।
(৫) জীবকে তাদের কর্মানুসারে যথাযোগ্য ন্যায় প্রদান করেন বলে তাকে 'অর্যমা= ন্যায়কারী' বলা হয়ে থাকে। যদি ঈশ্বর জীবকে তাদের কুকর্মের দণ্ড না দেন, তাহলে তিনি অন্যায়কারী সিদ্ধ হবেন।
(৬) ঈশ্বর 'ন্যায়কারী' হওয়ার পাশাপাশি দয়ালুও বটে, অর্থাৎ তিনি জীবকে এজন্যে দণ্ড দেন যাতে অপরাধে জড়িত হয়ে তারা দুঃখভোগ না করে । দণ্ড , সদ্বুদ্ধি প্রদান , কৃপা এসবই ঈশ্বরের দয়া ।
(৭)কণায়-কণায় ব্যাপ্ত থাকায় তিনি 'সর্বব্যাপক', অর্থাৎ তিনি সব জায়গায় উপস্থিত।
(৮) ঈশ্বর কাউকে ভয় পান না, তাই তিনি 'অভয়'।
(৯) ঈশ্বর 'প্রজাপতি' এবং 'সর্বরক্ষক'।
(১০) ঈশ্বর সর্বদা 'পবিত্র' অর্থাৎ তার স্বভাব 'নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্ত'।
(১১) ঈশ্বরকে তার নিজের কর্ম করার জন্য অন্য কারো সহায়তার দরকার পড়ে না। ঈশ্বর 'সর্বশক্তিমান' অর্থাৎ তিনি তার সামর্থ্য দ্বারা সৃষ্টির উৎপত্তি, পালন এবং প্রলয় করে থাকেন। তিনি তার কোনো কার্যই অপূর্ণ রাখেন না।
(১২) ঈশ্বর 'সর্বজ্ঞ' অর্থাৎ তার জন্য সব কালই এক । তিনি জীবের কর্মফল প্রদান সাপেক্ষে ত্রিকালজ্ঞ । ভূত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এসব কাল মনুষ্যদের জন্য । ঈশ্বর তো 'নিত্য', তিনি সর্বকালেই উপস্থিত।

(১) জীবাত্মা, ঈশ্বর থেকে আলাদা এক চেতন সত্তা।
(২) জীবাত্মা অনাদি, অজন্মা ও অমর। সে নতুন করে উৎপত্তিরূপ জন্ম নেয় না, মৃত্যুবরণও করে না । কেবল নব শরীর ধারণ করে ।
(৩) জীবাত্মা অনেক এবং অপ্রসন্ন থাকে । তার শক্তি ও জ্ঞানে স্বল্পতা আছে ।
(৪) জীবাত্মা দেহে আকার দ্বারা সীমাবদ্ধ, তার কোনো লিঙ্গ নেই । স্বরূপতঃ নিরাকার ও অণু পরিমাণ ।
(৫) শরীরের মৃত অবস্থা অর্থ জীবাত্মা এক শরীর ছেড়ে অন্য শরীরে চলে যায়।
(৬) জীবাত্মা কর্ম করায় স্বতন্ত্র । কর্মসমূহের ফল ঈশ্বরের ন্যায় ব্যবস্থায় হয়ে থাকে।
(৭) যদি জীবাত্মা স্বল্পজ্ঞতা থেকে মুক্ত হয়ে সদা আনন্দ কামনা করে তো তাকে শারীরিক ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হতে হবে, যাকে মোক্ষ বলে ।

(১) প্রকৃতি জড় পদার্থ । এটা সর্বদাই বিদ্যমান ছিলো এবং সর্বদা বিদ্যমান থাকবে।
(২) প্রকৃতি সর্বব্যাপী না, কারণ এই সৃষ্টির বাইরে এমনও স্থান আছে যেখানে না প্রকৃতি আছে, না জীব আছে, আছে শুধু ঈশ্বর আর ঈশ্বর।
(৩) ঈশ্বর প্রকৃতির আধার । ঈশ্বরই প্রকৃতির স্বামী।
(৪) প্রকৃতি জ্ঞানরহিত। প্রকৃতি ঈশ্বরের সহায়তা ছাড়া সঞ্চালিত হতে পারে না।
(৫) সংসারে এমন কোনো ঘটনাই নাই যাকে জাদু বলা যেতে পারে। সব ঘটনা ঈশ্বর দ্বারা নির্ধারিত নিয়মানুযায়ী ঘটে। প্রকৃতিরও বিভিন্ন ঘটনা যেমন সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী প্রভৃতির চলন ঐশ্বরিক অটল নিয়মানুযায়ী হয়ে থাকে। এই ঋত = চিরন্তন নিয়ম বদলায় না, সর্বদা একই থাকে।

ঈশ্বর ও জীবাত্মা উভয়েই চেতন, অনাদি, অজর (জীবাত্মা তত্ত্বগত), অমর (জীবাত্মার দেহ সংযোগ-বিয়োগই জন্ম-মৃত্যু), নিরাকার (কিন্তু জীবাত্মা অণুপরিমাণ), ভারহীন, সক্রিয়, অলিঙ্গ

ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, কর্মফলদাতা, আনন্দময় সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কর্তা, সর্বরক্ষক,সর্বব্যাপক, অন্তর্যামী, সুখস্বরূপ, রোগ-বিয়োগ রহিত, শুদ্ধ-সম্পূর্ণ, নির্লিপ্ত, নিষ্কাম, নির্লোভ, নিরাকার, নির্দ্বন্দ, অনুপম, অপরাজিত, অদ্বিতীয়, পাপনাশক, পরমপূজ্য, অবিদ্যারহিত, বেদদাতা, সর্বগুরু ; জীবাত্মা অণুপরিমাণ, সর্বেশ্বর নয়, অল্পজ্ঞ, কর্মফল ভোক্তা, মুক্ত অবস্থাতেও জগৎ সৃজনাদি কাজের সক্ষমতা থাকে না, স্বরূপগতভাবে আনন্দময় নয়, রোগ-শোক ভোগ করে, অবিদ্যাগ্রস্ত হয় তাই প্রকৃত আনন্দলাভে ঈশ্বরকে পেতে চায়; ঈশ্বর এক কিন্তু জীবাত্মা বহু।

পরমাত্মা সকল জীবাত্মার মাতা ও পিতা আর সকল জীবাত্মা পরমাত্মার সন্তান স্বরূপ। পরমাত্মা সর্বস্বামী, রাজা, উপাস্য, সাধ্য, ন্যায়াধীশ, জন্মপ্রদাতা আর জীবাত্মা সেবক, প্রজা, উপাসক, সাধক, ন্যায়প্রার্থী, জন্মগ্রহীতা। পরমাত্মা সূক্ষ্মতম বলে জীবাত্মার ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র ব্যাপক, কিন্তু জীবাত্মা পরমাত্মার মধ্যে ব্যাপক। পরমাত্মা বরণীয়, যজনীয়, শরণ, লক্ষ্য, স্তুত্য, দেব, ভগবান, সুখশান্তিদাতা, দণ্ডদাতা, পুরস্কারদাতা, নিয়ন্ত্রক, মুক্তিদাতা, প্রেরক, ভোগপ্রদাতা, প্রার্থিত, রক্ষক, উপকারী, অনুগ্রহকারী, পুরোহিত, ধ্যেয়, জ্ঞেয়, মন্তব্য, নিদিধ্যাসিতব্য, কমনীয়, জনক, তারক। জীবাত্মা যথাক্রমে বরণকর্তা, যাজক, শরণাগত, পথিক, স্তোতা, পূজারী, ভক্ত, আনন্দভোক্তা, দণ্ডিত, পুরস্কৃত, মুক্তিগৃহীতা, প্রেরিত, ভোগ-ভোক্তা, প্রার্থয়িতা, রক্ষিত, উপকৃত, অনুগৃহীত, যজমান, ধ্যাতা, জ্ঞাতা, মন্ত্রা, নিদিধ্যাসিতা, কামনাকারী, জন্য ও তর্তা।

ঈশ্বর চেতন হলেও প্রকৃতি জড়। প্রকৃতি রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শযুক্ত, ঈশ্বর তা নন। প্রকৃতির নিজের কিছু করার স্বরূপতঃ ক্ষমতা নেই, ঈশ্বর নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হয়। প্রকৃতির কর্মফল দানের কোনো ক্ষমতা নেই। ঈশ্বর লাভে পাওয়া সুখ অর্থাৎ ব্রহ্মানন্দ সর্বোত্তম, নিত্য, শান্তিদায়ক, অনন্ত, সর্বদা উপলব্ধ, বাহ্যিক উপাদান নির্ভশীল নয়, বুদ্ধিবর্ধক, শুদ্ধ। কিন্তু প্রকৃতি থেকে পাওয়া সুখ ক্ষণস্থায়ী, আসক্তি তৈরি করতে পারে, অনিত্য, অশান্তি তৈরি করতে পারে, অল্প, সর্বত্র অপ্রাপ্য, সাধন বা উপাদান নির্ভর, পরিণাম-তাপ-সংস্কার-গুণবৃত্তি বিরোধ দুঃখ তৈরি করে।

৩টিই অনাদি

ঈশ্বর জীবাত্মাকে তার কর্মফল দিয়ে দেহযুক্ত করেন, দেহটি প্রকৃতির উপাদানে নির্মিত। প্রকৃতি ত্রিগুণাত্মক জড় বস্তু, তার চেতনা নেই বলে প্রকৃতি থেকে একাকী কোনো কাজ হয় না। তাই সাম্যাবস্থা তথা প্রকৃতি থেকে জগৎ ঈশ্বর ব্যতীত তৈরি হয় না। প্রকৃতি সর্বব্যাপক নয় বরং ঈশ্বর এর থেকেও অধিক ব্যাপ্ত, জীবাত্মা দেহে একদেশী। এজন্যই ঈশ্বর জগৎ-স্রষ্টা এবং যদিও জীবাত্মা ও প্রকৃতি অনাদি কিন্তু তাদের ঈশ্বরের ন্যায় সামর্থ্য নেই বলে তারা ঈশ্বরেরই অধীন। ঈশ্বর সকলের প্রভু ও বিধাতা। ঈশ্বর তার নিজের অসীম শক্তিবলে এই জড় জগৎ সংসার নির্মাণ করেন এবং তাতে জীবাত্মাকে তার কর্ম অনুযায়ী জন্ম ও অন্যাদি ফল প্রদান করেন। প্রকৃতি থেকে যে সুখ জীবাত্মা পায় তা অনিত্য ও ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ঈশ্বর থেকে প্রাপ্ত ব্রহ্মানন্দ নিত্য ও প্রকৃত সুখ। জগৎ স্থূল, প্রকৃতি সূক্ষ্ম, জীবাত্মা সূক্ষ্মতর, পরমাত্মা সূক্ষ্মতম- এজন্য পরমাত্মা সর্বপ্রবিষ্ট এবং জীবাত্মা ও প্রকৃতি থেকে পৃথক হওয়া সত্ত্বেও সর্বব্যাপক।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর