সনাতন ধর্মে কি মাংস খাওয়ার অনুমতি আছে ?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: সনাতন ধর্ম পরিপূর্ণ জীবনবিধান। আমাদের আচার-ব্যবহার থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ই শাস্ত্রানুকূল হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং যে শাস্ত্রবিধি না মেনে ইচ্ছা মতো কাজ করে তার ইহকাল ও পরকাল নেই, মুক্তি তো নেই-ই-এমনই ভগবদ্বাক্য শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় [১৬।২৩-২৪] রয়েছে। তাই যারা নামে মাত্র সনাতনী ও শাস্ত্রীয় বিধানের আদর করেন না, বেদ - বৈদিক শাস্ত্র তথা উপনিষদ্-স্মৃতি-গীতা মানে না তারা সযতনে নিবন্ধটি এড়িয়ে যাবেন।
পূর্বসূচনা: আমরা এই নিবন্ধে কোনো শাস্ত্রেই কোনো ধরনের প্রক্ষিপ্ততা আছে কিনা এই বিতর্কে যাইনি। বরং যা আছে সেই অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। সুধীজনের বিবেচনার জন্য উন্মুক্ত সুযোগ বিদ্যমান।
পূর্বপক্ষ: সনাতন ধর্মে মাংসাহার নিষিদ্ধ নয়। মনুস্মৃতিতে [৫।৩৯] বলা হয়েছে যজ্ঞের জন্যই পশুর সৃষ্টি 'যজ্ঞার্থং পশবঃ সৃষ্টাঃ'। যজ্ঞ করে উক্ত প্রাণীর হুতাবশেষ আহার করা যায় [৫।৩১]। তাই যদি বলি প্রদান করে কেউ আহার করে তবে তা দোষের নয়।
উত্তরপক্ষ: মনুস্মৃতিতে মাংসাহারের যে বিধি দেওয়া হয়েছে বিস্তারিতভাবে নিম্নরূপ -
১। ৫.৭,২৭,৩১ অনুযায়ী যজ্ঞ করেই মাংসাহারের বিধান দেওয়া হয়েছে। ৩২ শ্লোকে সৌন=কেনা মাংস নিষিদ্ধ করেছেন মেধাতিথি। কেননা কেনা মাংস আহুতির অবশেষ নয়। তাই দোকান থেকে বর্তমান সনাতনীরা যে মাংস কেনেন তা নিষিদ্ধ ও পাপজনক প্রমাণিত। ৫.৩৩ অনুযায়ী বিধিবিহিত অনুষ্ঠান ব্যতীত প্রাণসংশয় স্থান ছাড়া [৫.২২] মাংসাহার নিষিদ্ধ। অতএব দৈনন্দিন জীবনে সামগ্রিক সকল মাংসাহার পাপজনক প্রমাণিত।
২। ৫.২২,২৭-৩০ যে জীবগণকে অন্ন হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে তাদের মাংসও ২৩ শ্লোক অনুযায়ী যজ্ঞ করেই খেতে হবে 'পুরোডাশা ভক্ষ্যাণাং'। বর্তমানে পুরোডাশরূপহীন মাংসাহার নিষিদ্ধ প্রমাণিত।
৩। ৫.৩১ অনুযায়ী, যজ্ঞের হুতাবশিষ্ট মাংসাহারকে দৈব প্রবৃত্তি ও নিজের জন্য পশুবধ করে মাংসাহারকে 'রাক্ষসের আচার' বলা হয়েছে - রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে। ৫.৫২ অনুযায়ী দেবার্চন ও পিতৃলোক অর্চন ব্যতীত নিজের দেহের বৃদ্ধির জন্য মাংসাহার নিষিদ্ধ। অতএব নৈমিত্তিক বিনাবিচারে মাংসাহার পাপজনক প্রমাণিত।
৪। ৫.৪১ অনুযায়ী মধুপর্কে পশুবধ করা যাবে। মধুপর্ক মূলত ঘি-মধু-দধি দিয়ে তৈরি করা হয়। এখানে পশুবধের প্রসঙ্গ আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র [১।২৪।২৬ ও সর্বটীকা] অনুযায়ী গোমাংসের কথা বুঝিয়েছে, যদিও আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের টীকাকারগণ কলিযুগে এই কর্ম নিষিদ্ধ বলেছেন, কিন্তু যদি এই শ্লোক স্বীকার করা হয় তবে প্রমাণিত হয় পূর্বপক্ষ গোমাংসাহার শাস্ত্রসিদ্ধ মানেন। যদি তা স্বীকার না করেন তবে মনুস্মৃতিতে মধুপর্কে মাংসাহারের শ্লোক অপ্রামাণিক স্বীকার করতে হবে। মেধাতিথিও বলেছেন, 'মধুপর্কো ব্যাখ্যাতঃ। তত্র গোবধো বিহিতঃ'। মনুসংহিতার ৩।১১৯ শ্লোকে যে কয়েক প্রকার ব্যক্তিকে মধুপর্ক প্রদান করার বিধি উল্লেখ করেছেন, সেখানেও মেধাতিথি গোবধ সিদ্ধ মেনে বলেছেন— "ইত্যাতিথ্যেষ্টিব্রাহ্মণম্ গোবধো মধুপর্কবিধাবুক্তো গোঘ্নোঽতিথিরিতি পুরুষরাজবিষয়ং দর্শয়তি।" অতঃপর গোমাংস বেদবিরুদ্ধ বলে মধুপর্কে গোমাংসাহার পাপজনক প্রমাণিত।
৫। ৫.৪১ 'এষ্বর্থেষু', ৫.৪৩ 'নাবেদবিহিতাং', ৫.৪৪ 'যা বেদবিহিতা হিংসা' ইত্যাদি স্থানে শাস্ত্রীয়ভাবে যেখানে পশুবধের অনুমিত আছে তা ব্যতীত সর্বত্র পশুবধ নিষিদ্ধ বলা হয়েছে। তাই প্রাত্যহিক মাংসাহার পাপজনক প্রমাণিত হয়।
প্রসঙ্গত, উক্ত অধ্যায়ে খেতে অনুমতি আছে ও নিষেধ সব প্রাণী (পশু,পাখি) নাম রয়েছে। কিন্তু যেহেতু এসবেরই গ্রহণযোগ্যতা যজ্ঞাবশিষ্ট হওয়ার পরেই বিহিত তাই আলোচনা করা হলো না।
পূর্বপক্ষ: মনুস্মৃতি [৫.৫৬] ও কুলার্ণব তন্ত্র [১.৬৯] অনুযায়ী অনিষিদ্ধ মাংসভোজনে কোনো দোষ নেই, মদ্যপানেও ক্ষত্রিয়ের কোনো দোষ নেই, বৈধ মৈথুনেও কোনো পাপ নেই এগুলো স্বাভাবিক। তবে নিবৃত্ত হওয়াই মহাফলা। ৫.৪০ মতে, পশুবধ হলে পশুরই উপকার কেননা তারা উচ্চযোনি লাভ করে।
উত্তরপক্ষ: পূর্বে [মনু০ ৫.৩৬,৪৩] আমরা দেখেছি, মাংসাহারের জন্য 'যজ্ঞ বাধ্যতামূলক' এবং যজ্ঞাবশেষ মাংস ব্যতীত সব মাংসাহার অত্যন্ত পাপজনক ও নরকের হেতু। পাশাপাশি দেবকার্য লিখিত হওয়ায় অতিথি ও ভূতযজ্ঞে এই বিধি নেই প্রমাণিত, না বিনিয়োগও দৃষ্ট হয়। এজন্যই মেধাতিথি [সংস্কারো জাতো যন্ন কিঞ্চিন্মাংসমশিতব্যম্ = যেসব মাংস যজ্ঞে অনুমোদিত] ও কুল্লুকভট্ট [যথাধিকারমবিহিতাপ্রতিষিদ্ধভক্ষণাদৌ ন কশ্চিদ্দোষঃ] ৫.৫৬ শ্লোকের টীকায় গণহারে সর্ববিধ মাংসাহারের কথা বলে অনিষিদ্ধ তথা যা যজ্ঞে বধ অনুমোদিত তার কথাই বলেছেন। পাশাপাশি নিবৃত্তিই মহাফলা বলা হয়েছে। অতঃ বর্তমানে যজ্ঞহীন(?) মাংসাহার ও অবিহিত মাংসাহার পাপজনকই প্রমাণিত।
পূর্বপক্ষ: মাংসাহার যজ্ঞের মাধ্যমে করা হলেও মৎস্যাহার বিষয়ে ভগবান মনু [৫।১৬] বলেছেন, পাঠীন = বোয়াল মাছ, রোহিত = রুই মাছ, রাজীব = ডোরাকাটা দাগযুক্ত মাছ, সিংহতুণ্ড = যে মাছের মুখের আকৃতি সিংহের মতো এবং আঁশযুক্ত সব মাছ 'দেব-পিতৃকার্যে' নিবেদনের পর খাওয়া যায়।
উত্তরপক্ষ: যদি সেটিই হয় তবে প্রমাণিত হলো -
১। নৈমিত্তিক মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ, কেননা নৈমিত্তিক কেউই শ্রৌতযজ্ঞ করে মাছ নিবেদন করে না বা শ্রাদ্ধ করেনা।
২। আঁশহীন সব মাছ এবং চিংড়ির ন্যায় যেসব প্রাণী রয়েছে সকলই নিষিদ্ধ।
৩। ঠিক এর আগের শ্লোকে তথা ৫.১৫ অনুযায়ী যে মাছ খায় সব সর্বমাংসভোগী অর্থাৎ তাকে গোমাংসভোজীও বলা যায়। মেধাতিথি বলেন, 'যস্তু মৎস্যাদঃ স সর্বমাংসাশী ভবতি। গোমাংসাদ ইত্যপি ব্যপদেষ্টুং যুক্তঃ'। কুল্লুকভট্ট 'সর্বমাংসভক্ষকত্বেন ব্যপদেষ্টুং যোগ্যঃ তস্মান্মৎস্যান্ন খাদেৎ'। অতঃ প্রাত্যহিক নির্বিচারে মাছ খাওয়াও শাস্ত্রানুযায়ী নিষিদ্ধ ও পাপজনক প্রমাণিত।
উল্লেখ্য, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ [শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড ১১৫।১১১] অনুযায়ী কলিযুগে অশ্বমেধ, গোমেধ ও শ্রাদ্ধে মাংসাদানাদি নিষিদ্ধ।
অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্।
দেবরেণ সুতোৎপত্তিং কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ॥
যদিও স্মৃতি পুরাণের তুলনায় বলবান কিন্তু বাদী অশ্বমেধ ও গোমেধের কলিযুগে অপালনীয় প্রমাণে এই প্রমাণ উদ্ধৃত করেন বিধান এটিও স্বীকৃত যে যেহেতু পিতৃকার্যে নিষিদ্ধ তাই মাছ খাওয়া সর্বৈব পরিত্যাজ্য। অগ্নিপুরাণ [অ০ ১৬৮] অনুযায়ী মুরগীও অনুমোদনহীন, যজ্ঞে আহুতির বিধান তো নেই-ই।
পূর্বপক্ষ: এখন যদি আমি পূর্বোক্ত বিধি অনুযায়ী, বৈদিক যজ্ঞ করে একটি পশু-পাখি বধ করে তার আহুতি দিয়ে আহার করি তবে সেটিই কি অনুমোদিত নয় ? স্মৃতি ও তন্ত্রে উভয়স্থলেই তো বলির উল্লেখ পাওয়া যায়।
উত্তরপক্ষ: না। স্মৃতিগ্রন্থ ও তন্ত্রে পশুবলির ভিন্নতা রয়েছে। স্মৃতিগ্রন্থ যে যজ্ঞের উল্লেখ করে তা শ্রৌতযজ্ঞ। শ্রৌতযজ্ঞে পশুকে শ্বাসরোধ করে বধ করা হয়। এরপর পশুর বপা=মেদ কেটে নিয়ে তা যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হয়। বিস্তারিত-
'শামিত্র' নামে স্থানে পৌঁছে সেখানে উল্মুকটি রেখে আগ্নীধ্র চলে আসেন। শমিতা এক আচ্ছাদিত স্থানে পশুকে শ্বাসরোধ করে বধ করেন। এই কর্মের নাম সংজ্ঞপন। সংজ্ঞপনের পরে 'সংজ্ঞপ্তহোম' ও কতকগুলি প্রায়শ্চিত্তহোম করে দুটি বপাশ্রপণী নিয়ে অধ্বর্যু পশুর কাছে গিয়ে নাভির পাশের যে মেদ বা আমাশয়ের কাছে চামড়ার মতো পাতলা যে বপা তা কেটে নিয়ে একটি বপাশ্রপণীর উপর ঐ বপা ছড়িয়ে রাখেন। অন্য একটি বপাশ্রপণী দিয়ে তা ঢেকে আহবনীয়ে। কাছে এনে ঐ বপাশ্রপণী দুটি প্রতিপ্রস্থাতার হাতে দেন। বপা পাক করে প্লক্ষশাখার উপরে তিনি তা রেখে দেন। আহুতি দেওয়া হয় আহবনীয়েই এবং জুহুরই সাহায্যে। বপাহোমের পরে ঐ অগ্নিতে বপাশ্রপণীদুটি ফেলে দেওয়া হয়। এর পর সকলে চাত্বালে গিয়ে হাত ধুয়ে নেন। তার পর হয় পশুপুরোডাশযাগ। যে দেবতার উদ্দেশে পশুর অঙ্গগুলি আহুতি দেওয়া হবে সেই দেবতারই উদ্দেশে এই পুরোডাশযাগ করতে হয়। পুরোডাশের জন্য যখন নির্বাপ করা হয় তখন পশুর অঙ্গ-গুলি ছুরি (স্বধিতি) দিয়ে কেটে নিয়ে একটি মাটির পাত্রে রেখে শামিত্র অগ্নিতে তা পাক করতে হয়। একদিকে শামিত্র অগ্নিতে পাক চলত থাকে, আর অপর দিকে আহবনীয়ে পুরোডাশের আহুতিও চলতে থাকে। হহৃৎপিণ্ড অবশ্য সিদ্ধ করা হয় না, একটি শূলে রেখে সেঁকা হয়। পুরোডাশযাগের যে ইড়া তা প্রতিপ্রস্থাতা ছাড়া যজমানসমেত অপর সকলেই ভক্ষণ করবেন।
সূত্র: আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র [১ম কণ্ডিকা ৭ম প্রশ্ন] , আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র [৩।৪-৫, ১২।৯]
আপনি কি প্রত্যহ এভাবে শ্রৌতযাগ করেন বা করবেন ? না। প্রত্যক গৃহস্থ গৃহ্যসূত্র অনুযায়ী "পঞ্চমহাযজ্ঞ" করে যাতে পশুর আহুতির কোনো বিধানই নেই [যাগ ব্যতিক্রম ব্যতীত, আশ্ব০ গৃ০ ২।৩-৪ ইত্যাদি]। তাই আপনার আহারও অসম্ভব।
কিন্তু, তন্ত্রে বা শাক্তপূজায় বলির বিধান সম্পূর্ণ ভিন্ন। কালিকাপুরাণে অধ্যায় ৫৫, ৬৭-তে ~
১. বলির অস্ত্রকে অভিমন্ত্রিত করতে হবে, বলিদানে যেসব অস্ত্রবিহিত তার বাইরের অস্ত্র দিয়ে বলি দিলে দেবী তা গ্রহণ করেন না ও বলিদানকর্তার মৃত্যু হয়।
২. স্ত্রী পশু-পাখি, ত্রুটিযুক্ত পশু, শারীরিক বিকলাঙ্গ কিংবা বিকৃতাঙ্গ পশু বলিযোগ্য নয়।
৩. ৩ মাসের কম বয়সের পশু ও ৩ সপ্তাহের কম বয়সী পাখি বলি দেওয়া যাবে না।
৪. বলির পশু যুবা, রোগশূন্য, শিংযুক্ত, হৃষ্টপুষ্ট, অঙ্গদোষহীন হবে। যদি পশু শিশু অর্থাৎ কমবয়সী হয় তবে বলিদাতার পুত্র মারা যাবে, অধিকাঙ্গী হলে বংশ নাশ, হীনাঙ্গী হলে পরিবার নাশ হবে ইত্যাদি [ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ প্রকৃতিখণ্ড ৬৪।৯৬-৯৯]।
৫. বিষ্ণুক্রান্তার নিবন্ধ তন্ত্রানুযায়ী এক কোপেই পশুবলি দিতে হবে [যদ্যপ্যেকেন ঘাতেন বলিচ্ছেদো ন জায়তে... এক খড়্গ প্রহারেণ পশুর্যত্র ন হন্যতে তদা বিঘ্নং...], নতুবা নানা বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু শ্রৌতযাগে আমরা পাচ্ছি শ্বাসরোধ করে বপা সংগ্রহ। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভিত্তিই আলাদা।
পূর্বপক্ষ: মনুস্মৃতির ২য় অধ্যায়ের প্রারম্ভে টীকায় কুল্লুকভট্ট বলেছেন, শ্রুতি দুই ধরনের - তান্ত্রিক ও বৈদিক 'বৈদিকী তান্ত্রিকীশ্চৈব দ্বিবিধা শ্রুতিকীর্তিতাঃ'। আমি তন্ত্র অনুযায়ী করবো।
উত্তরপক্ষ: মাংস-সাধনায় কোন কোন জন্তুর মাংস প্রশস্ত -
১। যোগিনীতন্ত্র অনুযায়ী, যেসব প্রাণীর মাংস গ্রহণীয় তারা ভূচর ও খেচর-ভেদে দ্বিবিধ। আবার ভূচর পশু বনজ ও গ্রামজ-ভেদে দ্বিবিধ। প্রশস্ত ভূচর পশু দশটি। তার মধ্যে ছাগ আর মেষ গ্রামজ। আর বরাহ, শল্যক অর্থাৎ শজারু, রোজ, রুরু, হরিণ, খঙ্গী, গোধা এবং শশক বন্য। রুগ্ন ও মৃত পশু বর্জনীয়। কোমল সর্বাঙ্গপুষ্ট প্রাণী সর্বোত্তম। প্রশস্ত খেচরও দশটি, যথা-গ্রাম্য কুক্কুট, আরণ্য কুক্কুট, ময়ূর, তিতির, চক্রবাক, সারস, রাজহংস, জলকুক্কুট, হংস ও চটক।
সূত্র: পরশুরামকল্পসূত্র বৃত্তি ১০।৬২
২। মহামাংস কী ? শ্যামারহস্যে [৩য় পরিচ্ছেদ] উদ্ধৃত যামলবচনে গো, নর, ইভ, অশ্ব, মহিষ, বরাহ, অজ এবং মৃগের মাংসকে মহামাংস বলা হয়েছে। আর এই অষ্ট মহামাংসকে দেবতার প্রীতিকর বলা হয়েছে। বৃহৎতন্ত্রসার-ধৃত ভৈরব-তন্ত্রবচনেও এই অষ্ট মহামাংসের উল্লেখ আছে, তবে ইভের স্থলে মেষের নাম করা হয়েছে।
৩।।কাঁটাশূন্য, তৈলাক্ত এবং স্বাদু—এই চার রকমের মাছ মধ্যম। মধ্যম মাছ দেবীর প্রীতিকর [শ্যামরহস্য পরি০ ৩] । উত্তম ব্যক্তিরা বলেন, মৎস্য ক্ষুদ্র হলেই অধম। মহানির্বাণতন্ত্রের [৬।৮] মতে, অধম মৎস্য বহু কণ্টকযুক্ত তবে উত্তমরূপে ভাজা হলে তাও দেবীকে প্রদান করা যায়। কচ্ছপও এর অন্তর্ভুক্ত পরশুরাম কল্পসূত্রবৃত্তি [১০।৬৩] অনুযায়ী।
মহানির্বাণ তন্ত্র [৯.২৮৩] অনুযায়ী, মনুস্মৃতির অনুকরণেই বলা হয়েছে যদিও মাংস-মাছ বিহিত কিন্ত সেগুলোকে নিয়ম অনুযায়ী পূজায় দিয়ে অর্থাৎ দেবীকে ভোগ দিয়ে তারপর খেতে হবে। একই কথা শ্রীমদ্ভাগবতের [১১।৫।১১] শ্রীধর স্বামীর টীকাতেও আছে, 'হুতশেষং ভক্ষয়েৎ'-যজ্ঞাবশিষ্ট আমিষ ভক্ষণ করবে.. যজ্ঞাবশেষ মাংস ভিন্ন অন্য মাংস আহার করবে না।
পরশুরাম কল্পসূত্র [১০.৬৩] অনুযায়ী, সাধক ( যে কোনো সাধারণ মানুষ নয়) মাছ-মাংস খাবেন, কিন্তু নিজে বধ করবেন না, অন্য কেউ করে দিবে। যদি কাউকে না পান নিজেই আগে পূজায় বধ করে তারপর নিবেদন করে খাবেন। মন্ত্রপাঠ করে সংস্কার করে নিতে হবে। মাছ খাওয়ার পূর্বেও মন্ত্রপাঠ করে মাছের প্রাণনাশ করতে হবে [প০ ক০ সূ০ ১০।৬৩, রামেশ্বরবৃত্তি]। অত্যন্ত কৌতুহলজনক বিষয়, মাছের শোধনে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের বিনিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
পূর্বপক্ষ: তাহলে এভাবেই তো আমরা মাংস-মৎস্যাহার করতে পারি। স্মার্তশাস্ত্রাদির কী আবশ্যকতা এই কলিযুগে।
উত্তরপক্ষ: বাদীপক্ষের উচিত তারা কোন শাস্ত্র প্রামাণিক মনে করেন তা ঘোষণা করা। যদি বৈদিক শাস্ত্র মানেন, তবে তন্ত্রের কী আবশ্যকতা ? যদি তন্ত্র মানেন কলিতে তবে অহেতুক বৈদিক শাস্ত্র থেকে প্রমাণ প্রদর্শন কেন ? [যেহেতু তন্ত্র ও বেদ ভিন্ন পথ] আর যদি দুটোই মানেন তবুও আপনাকে একটি পথই বেছে নিতে হবে। এটা আপনার আচার্যদেরই সিদ্ধান্ত। মিশ্রিত ধারা গ্রহণ করলেও সুনির্দিষ্টভাবে আচরণ করতে হবে নিজ সম্প্রদায় অনুযায়ী দীক্ষিত হয়েই। যদি অদীক্ষিত হয়ে থাকেন তবে এই বিষয়ে আপনার অনধিকার চর্চা না করাই উত্তম।
পূর্বপক্ষ: তন্ত্রানুযায়ী আহার কি সর্বজনীন নয়?
উত্তরপক্ষ: তন্ত্র অনুযায়ী অবশ্যই তা সর্বজনীন। তবে-
১. যদি তন্ত্রানুসারী ও দীক্ষিত না হন তবেও এই আচার আপনার জন্য পাপজনক ও আপনি এই প্রচার করতে পারেন না যে 'এভাবে বিহিত আছে বলে আহার করি'।
২. যেহেতু পঞ্চতত্ত্ব অনুযায়ীই দেবীপূজা বিহিত [কামাখ্যাতন্ত্র ৬।১৫] ও সেই নিয়মানুসারেই তত্ত্বগ্রহণ করতে হয় তাই যথেচ্ছাচার এখানেও অনুমোদিত নয়।
পূর্বপক্ষ: তাহলে দীক্ষিত হয়ে আহার করলেই হবে।
উত্তরপক্ষ: হ্যাঁ করতে পারেন। যদি সেটা করে মদ্যাদি-মাংসাহার করেন সেটা ব্যক্তিগত। কিন্তু আমাদের আলোচ্য সনাতন ধর্ম তা সমর্থন করে কিনা? যেহেতু আপনি বেদকে নিষ্ফল বলেছেন ইতোমধ্যেই আপনি সনাতন ব্যতীত ভিন্নমতে রয়েছেন। অধিকন্তু যদি দীক্ষিতের প্রশ্ন তোলেন, তবে দরকার দুইটি বিষয় - গুরু ও শিষ্য। তা যথাবিধি শাস্ত্রানুযায়ী আপনি হবেন। এখানে মূল বিষয় - রুদ্রযামলতন্ত্র [উ০প০ ৩], গৌতমীয় তন্ত্র [৫], মৎস্যসূক্ত, বৃহৎ তন্ত্রসার, শারদাতিলক তন্ত্র [৪।১] রাঘবভট্টকৃত টীকা ইত্যাদি অনুযায়ী অদীক্ষিতদের পূজার্চনায় অধিকার নেই। তাই যত্রতত্র মাংস-মাছ কিনে পূজায় ভোগ ও মন্ত্রপাঠ করলে হবে না।
অর্থাৎ, আপনি যদি তন্ত্রানুসারী হয়ে বা মাতৃভক্ত হয়ে মাংস-মাছ খেতে চান তবে আপনাকে স্পষ্টভাষায় বলতে হবে আপনি বেদানুযায়ী বিধান মানেন না এবং কেবল নামেমাত্র শাক্ত না বরং তন্ত্র অনুযায়ী পূর্ণ দীক্ষিত হয়ে সর্ব-আচার পালন করে আহার গ্রহণ করছেন। নতুবা আপনার বক্তব্য ও যুক্তি উভয়ই ব্যর্থ।
▪️সারসংক্ষেপ:
১। যদি আপনি নামে মাত্র হিন্দু হন এবং ভাবেন যে "ধর্ম কেবল খাবার ও রান্নাঘরে সীমাবদ্ধ কিনা" তাহলে আপনি ভ্রান্ত। ধর্ম যেভাবে মানবের নৈতিকতা শেখায় তেমনি সকল প্রাণীর প্রতিই কর্তব্য শেখায়। যদি আধুনিকতার বলে শাস্ত্রবিধান অগ্রাহ্য করেন তবে সেই অগ্রাহ্য বিবাহসংস্কার ব্যতীত যৌনসমাগমের সাথেই তুল্য, মানতে হলে সবটুকুই যথাসম্ভব মানতে কিংবা অন্তত স্বীকার করতে হবে। কেননা যে শাস্ত্র এক ক্ষেত্রে মানে কিন্তু স্বেচ্ছাচারী হয়ে নিজের প্রতিকূল ক্ষেত্রে অস্বীকার করে সে দ্বিচারিতা করে।
২। যদি আপনি শাস্ত্রে শ্রদ্ধাশীল সনাতনী হন তবে প্রশ্ন -
(১) আপনি কি তান্ত্রিক দীক্ষায় দীক্ষিত ও সর্বাচার পালন করেন? যদি না করেন তবে তন্ত্রের বলি নিয়ে আপনার কী আসে যায়? কেননা আপনি যে বর্ণেরই হোন না কেন দীক্ষিত ও সাধক না হয়ে খেয়ে পাপই করছেন।
(২) আপনি কি বেদবিধি স্বীকার করে মাংসাহার প্রতিপন্ন করতে চান? আপনি পশুকে শ্বাসরোধ করেন না তাহলে কীভাবে তা শ্রৌতযাগের অনুমোদিত হলো ও আপনি খেলেন? এখানেও পাপই করছেন।
(৩) চিংড়ি কি মাছ? এর অনুমতি যেহেতু শাস্ত্রে নেই তা বিহিত কীভাবে ? মুরগী যা খাচ্ছেন যেভাবেই তা তো দেবীকে দিচ্ছেন না বা মুরগীমেধ বলেও হয়না কিছু, এখানে শাস্ত্রীয়তা দেখাচ্ছেন না কেন ?
(৪) খাসি হলো কৃত্রিমভাবে অণ্ডকোষহীন ছাগ। ত্রুটিপূর্ণ পশু বলির যোগ্যই না। তাহলে যে পশু বলির যোগ্যও না তা আহার করছেন কীভাবে?
(৫) ডিম কি কোনো যজ্ঞে বা পূজায় হোক তা তান্ত্রিক বা বৈদিক দেওয়া হয় ? তাহলে তা বিহিত কীভাবে?
(৬) পশুবলি যদি আপনার নিকট আদরণীয় হয় তবে নিজে পশুবধ করলে তা অহিংসা-অবধ আর অন্য মতের কেউ পশুবধ করলে মানবতাবাদী হন ও সাময়িক পশুপ্রেম জেগে উঠে কেন? এটা কি দ্বিচারিতা ও ভণ্ডামি নয়?
পরিশেষে, যদি আপনি শাস্ত্র না মানতে পারেন ও সেজন্য মাংসাহারী হন তবে তা দুঃখজনক তবে আমরা আশা করব আপনি ধর্মানুসরণ করবেন, কিন্তু কখনোই শাস্ত্রকে নিজের অক্ষমতা ঢাকতে ব্যবহার করা যাবে না। আপনার যদি মনে হয় আপনি শাস্ত্র না মেনে খাবেন আপনার ইচ্ছা সেটা - স্বাধীনতা, বরং মানতে অপারগ হলে তা স্বীকার করতে হবে। কিন্তু তা করে আপনি বৈদিক (?) বা তান্ত্রিক (কু-)যুক্তি প্রদর্শন করলে তা আপনার জন্যেই হানিকারক হবে।
[সতর্কতা: বৈদিক শাস্ত্রে পশুবলি আদি নেই, হয় তা কদর্থ বা প্রক্ষিপ্ত ~ বেদবিরুদ্ধ হওয়ায় অমান্য। তবে যেহেতু এটি সর্বজনীন নিবন্ধ তাই সেই বিষয়টি না ধরেই আলোচনা করা হয়েছে]
🖋️ শ্রী দীপংকর সিংহ দীপ
ব্যাকরণ - বেদান্ত - স্মৃতি - পৌরহিত্যতীর্থ
শিক্ষা ও শাস্ত্রার্থ সমন্বয়ক
চিত্র: অর্ণব কান্তি মণ্ডল
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর