শঙ্কা: যখন ঈশ্বর পাপকে ক্ষমা করেন না, তখন এই স্তব ও প্রার্থনা ঈশ্বর কেন তাঁর ভক্তকে দিয়ে করাচ্ছেন? কী তিনি ভক্তদের ভ্রমে রাখতে চান ?
সমাধান: প্রথমেই আপনার এমন একটি মন্ত্রের অর্থটি সম্পূর্ণ করি, যাতে বোঝা সহজ হয়-
অব নো বৃজিনা শিশীহ্যৃচা বনেমানৃচঃ।
নাব্রহ্মা যজ্ঞ ঋধগ্জোষতি ত্বে॥
ঋগ্বেদ ১০.১০৫.৮
ভাবার্থ: হে প্রভু! আপনি আমাদের পাপগুলো আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিন। স্তবের [গুণবর্ণনার] দ্বারা স্তবনযোগ্য [অর্থাৎ প্রশংসনীয়] নয় এমন কর্মকে জয় করি। ঈশ্বরের গুণ-কীর্তন করতে করতে আমরা যেন এমন কর্ম থেকে দূরে থাকি, যা প্রশংসনীয় তথা ঈশ্বর কর্তৃক অনুমোদিত নয়। অপ্রশংসনীয় যজ্ঞ আসলেই পরব্রহ্মকে প্রীত করে না। পরমাত্মা কি স্তবের কামনা করেন ? না, এতে তার নিজের কোনো স্বার্থ নেই। কিন্তু স্তবহীন যজ্ঞে যজ্ঞকর্তার ‘অহং’ তথা অহংকার জন্মাবার আশঙ্কা থাকে। এমন যজ্ঞ সংযমহীন হওয়ায় সাত্ত্বিক থাকে না। যজ্ঞের অহংকার যজ্ঞের উৎকর্ষ নষ্ট করে দেয়। যজ্ঞের সঙ্গে স্তব যুক্ত হলে আমরা সেই যজ্ঞকে প্রভুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্পন্ন হওয়া বলে অনুভব করি এবং তাতে আমাদের মনে অহংকার জন্মায় না।
উপর্যুক্ত বেদমন্ত্রে আমরা ঈশ্বরকে শুধু প্রার্থনা করছি, “আমাদের পাপ আমাদের থেকে দূর করুন।” এর অর্থ এই নয় যে ঈশ্বর আমাদের করে ফেলা পাপ ক্ষমা করবেন। যদি পাপ ক্ষমা হয়ে যায় তবে ঈশ্বর কীভাবে ন্যায়পরায়ণ থাকেন?
এইভাবে হলে তো মানুষ পাপ করতে থাকবে এবং ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকবে। এতে তো তার স্বভাবই পাপ করা ও ক্ষমা চাওয়ায় পরিণত হবে।
শুধু বেদমন্ত্র পড়ে গেলেই সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ হবে না। সেটি তখনই সম্ভব, যখন মানুষ মন্ত্রকে বুঝবে এবং তার অনুযায়ী আচরণ করবে। বেদমন্ত্র বোঝা কোনো শিশুর খেলা নয়; এর জন্য গভীর অধ্যয়ন করতে হয়।
উপরের মন্ত্রে আমাদের বেদ-ভগবান এই শিক্ষা দিচ্ছেন যে, আমরা আপনার (ঈশ্বরের) স্তবনার মাধ্যমে কুকর্মকে জয় করি এবং সুকর্ম করে সৎপথে চলি। আমাদের অন্তরে যেন কখনো অহংকার জন্ম না নেয়; অন্যথায় আমাদেরও রাবণের মতো পতন ঘটবে, যে অহংকারের কারণে ধ্বংস হয়েছিল।
আমরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের ভেতরে যেন অহংকার কখনো জন্ম না নেয়, আমরা যেন কখনো পাপ না করি।
মানুষ আত্মসমালোচনা ও আত্মসংযমের দ্বারা শুদ্ধ ও আলোকিত হয়। এমন মানুষ এমন শক্তি লাভ করে যে, সে পাপ থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হয়। তার জীবনে নতুন শক্তির সঞ্চার হয় এবং সে উন্নতির পথে অগ্রসর হয়।
বেদ-ভগবান অত্যন্ত সুন্দর শব্দের মাধ্যমে আমাদের এই ইঙ্গিত করছেন যে, আপনি (ঈশ্বর) সর্বদা আমাদের কুকর্ম থেকে মুক্ত করে আমাদের সাহায্য করুন এবং আমরা যেন পাপ থেকে বাঁচতে পরি-
১. প্রাণিজগতের রক্ষক, বিশুদ্ধ জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রভু, আমাদের পাপ থেকে মুক্ত করুন। [অথর্ববেদ ৪.২৩.১]
২. হে সর্বব্যাপক প্রভু! যেমন মানুষ নৌকার দ্বারা নদী পার হয়, তেমনি আপনি আমাদের দ্বেষরূপী নদী পার করান। আমাদের পাপ আমাদের থেকে পৃথক হয়ে দগ্ধ হয়ে যাক। [অথর্ববেদ ৪.৩৩.৭]
৩. হে জ্ঞানময় প্রভু! আপনি আমাদের অজ্ঞতা দূর করুন, আমাদের পাপ দূর করুন। [ঋগ্বেদ ৪.১১.৬]
অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্ ।
যুয়োধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো ভূয়িষ্ঠাং তে নমউক্তিং বিধেম ॥
ঋগ্বেদ ১.১৮৯.১
ভাবার্থ: এই বেদমন্ত্রে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে, ‘হে জ্যোতির্ময় পরমেশ্বর! আমাকে সুপথে পরিচালিত করুন। আমি যেন সৎপথে চলতে চলতেই ধন ও ঐশ্বর্যের অধিকারী হই। আমাকে সেই পথেই চালান, যেই পথে জ্ঞানী, সিদ্ধ ও আদর্শ মানুষগণ গেছেন। আবার ভক্ত প্রার্থনা করে—আমার অন্তরে যে কুটিলতা, কুবিচার ও পাপকর্ম আছে, তা দূর করার শক্তি দিন। আপনার স্তবগান আমার জীবনে সর্বদা বজায় থাকুক। প্রতিটি পরিস্থিতিতে আমি যেন আপনার স্তব করতে পারি। ধনের লোভ, সংসারের প্রতিকূলতা যেন আমার ভক্তিতে বাধা না দেয়। শরীরের ব্যাধি, গৃহের কলহ যেন আপনার ভক্তিতে প্রতিবন্ধক না হয়। অর্থাৎ আপনার ভক্তির জন্য আমাকে সর্বদা সুযোগ দিন এবং আমি আপনার ভক্তিগান গেয়ে যাই।’
ইংরেজি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে "Prevention is always better than cure" অর্থাৎ, প্রতিরোধ চিকিৎসার চেয়ে সর্বদা উত্তম।
দুঃখ, অশান্তি ইত্যাদি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো, ঈশ্বর প্রদত্ত পথে চলা এবং পাপকর্ম থেকে দূরে থাকা। বেদভগবানের বাণীকে জীবনে আত্মস্থ করেই এটি সম্ভব।
🖋
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর