দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







বেদে গোরক্ষা অথবা গোহত্যা ? - পর্ব ২

অমৃতস্য পুত্রা
0

গোঘাতকদের আণবিক বোমা-
গো হিংসা সমর্থনকারীদের সব থেকে বড় অস্ত্র (১) গোঘ্নহতিথি : এবং (২) গোমধ যজ্ঞ। আমাদের কাছে এটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, কিভাবে অত্যন্ত চাতুরীর দ্বারা উপরোক্ত প্রয়োগ দুটি মাংসাহারের স্বপক্ষ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
গোঘ্নো অতিথঃ মহামুনি পাণিনির ন্যায় বৈয়াকরণ-এ পৃথিবীতে কেউ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন নি। তার সূত্র হল-


দাশগগাগ্নৌ সম্প্রদানে” (অষ্টা ০ ৩-৪-৭৩)
এর সরল অর্থ হল—“দাশ ও গোঘ্নশব্দ দুটি সম্প্রদানে নিপাতনদ্বারা নিষ্পন্ন করা হয়।
গোঘ্নকে এই প্রকারে সম্প্রদান কারকে ব্যাখ্যা করা হয়।
গৌহণ্যতে তস্মৈ গোঘ্নঃএই হণ্যতে শব্দের অর্থ মাংসাহারীরা এভাবে করেন, “হ্যতে হত্যা করা হয় গৌণ্যতে যস্মৈ বা তস্মৈ স গোঘ্নঃ এই ব্যাখ্যাতে না আছে কোন ত্রুটি, না আছে মতভেদ। কিন্তু হণ্য শব্দটি কেবল হত্যার জন্যই ব্যবহৃত হয়না। হণ্যতের অর্থ গম্যতে। প্রাপ্যতে রূপেও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ গৌণ্যতে-গাভীকে প্রাপ্ত করানো হয় কিংবা দান করা হয়। সুতরাং কিভাবে?
এই ধাতুর অর্থ কেবল হত্যানয়, এর অর্থ গতিও হয়। আচার্য পাণিনি ধাতুপাঠে হন্ধাতুর পাঠও দিয়েছেন। 
হন হিংসাগত্যোঃ
অর্থাৎ হ-এর প্রয়োগ দুপ্রকার অর্থে করা হয়—(১) হিংসা এবং (২) গতি৷ গতির অর্থও তিন প্রকারের- গতেস্রযোহর্থাঃ জ্ঞানং গমনং প্রাপ্তিশ্চজ্ঞান, গমন ও প্রাপ্তি। সুতরাং গৌর্হণ্যের অর্থ গৌর্গম্যতে অথবা গৌঃপ্রাপ্যতে। অতিথির নিকট গাভীকে প্রাপ্ত করানো হয়, অতএব একে সম্প্রদান বলা যায়, বধতো বলা যায় না। আরও একটি বাক্যের বিচার করা যাক- গোঘ্নো অতিথিঃ, এর প্রয়োগ দেখা যায়। যদি হন্যতের অর্থ হত্যা হয়, তাহলে গোহত্যা চণ্ডাল কিংবা অন্যান্য মাংসাহারীদের ক্ষেত্রেও হত্যা করা হবে। কিন্তু গোঘ্নো অতিথির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, চণ্ডালাদির নিমিত্ত নয়। প্রসিদ্ধ বৈয়াকরণ কাশিকাকার লিখছেন যে, চণ্ডালাদি গোঘ্ন নয়, গোঘ্নতো অতিথি।
গোঘ্নো অতিথিঃ ন তু চণ্ডালাদিঃ
অতএব গোঘ্নঃ শব্দের অর্থ হত্যা হবেনা, প্রদান, প্রাপ্ত করানোই হবে। হন্যতে-এর অর্থ বহু স্থানে গম্যতে-প্রপ্যতে হয়। মহাবৈয়াকরণ পাণিনির একটি সূত্র আছে।
উপগ্ন আশ্রয়ে”  (অষ্টা0 ৩/৩/৮৫)
এর উদাহরণ হলপর্বতোপগ্নঃব্যাখ্যা-পৰ্বতেনোপহন্যতে সমীপ্যেন গম্যতে অর্থাৎ পর্বতের সমীপে যায়। এস্থানে এর অর্থ গমন। হন্ ধাতুর অন্যান্য গত্যর্থক প্রয়োগ আছে। অথর্ববেদে হন্ ধাতুর গত্যর্থক প্রয়োগ নিম্নরূপ-
যথাঙ্গবর্ধতাং শেপস্তেন যোষিতমিজ্জহি
                                                    (অথর্ব ৬-১০১-১) 
অর্থাৎ হে পুরুষ। তুমি পৌরুষ সম্পন্ন হয়ে আপন পত্নীর নিকট যাও (যোষিতম্+হত্+জহি)এই জহি হন্ ধাতুরই রূপ এবং সকল ভাষ্যকারগণ এর অর্থ গচ্ছ=যাও এভাবেই বর্ণনা করেছেন। অতএব এর কেবলমাত্র একটি অর্থ হত্যাই নয়।


গোঘ্ন শব্দের বিচার-
কোন বেদেই গোঘ্ন শব্দ অতিথি অর্থে প্রয়োগ করা হয়নি, সাহিত্য গ্রন্থেও বোধহয় কোথাও নেই। এটি বিদ্বানগণের অন্বেষণের প্রসঙ্গ যে গোঘ্নোহতিথিঃ- এর প্রয়োগ কোথায় করা হয়েছে? কোন প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য আচার্য পাণিনি দাশগোঘ্নৌ সম্প্রদান সূত্রের দ্বারা নিপাতনকরেছেন। নিপাতনের অর্থই হল যে, সামান্য ব্যাকরণ থেকে সরে এসে আচাৰ্য অপবাদ রূপে শব্দকে স্বীকার করেন।
গোঘ্ন শব্দের ব্যাকরণ এবং সাহিত্যের মধ্যে প্রয়োগ সম্মত অর্থ আছে। গাং হন্তি অসৌ এই অর্থের প্রয়োগ বহু পাওয়া যায়। কিন্তু সম্প্ৰদান কারকে, অতিথি অর্থে বৈদিক সংহিতায় এবং অন্য ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় না। অবশ্য গোহত্যাকারী অর্থে গোঘ্ন শব্দ বেদে এক আধ স্থানে পাওয়া যায় এবং লৌকিক সাহিত্যেও এর প্রয়োগ দেখা যায়।
বেদে হত্যাকারী অর্থে গোঘ্ন -ঋগ্বেদে নিম্ন পাঠ পাওয়া যায়-

আরে তে গোঘ্নমুত পূরুষঘ্নম্” (ঋগ্বেদ ১/২১৪/১)
অর্থাৎ যে গোঘ্ন’, গোহত্যাকারী এবং যে পুরুষঘ্ন সে মানব হত্যাকারী, তারা তোমাদের থেকে দূরে থাকুক। প্রয়োগ ও সাহচর্যের দ্বারা এ বিষয়টি এমনভাবে মনের মাঝে ধারণার সৃষ্টি করে যে, বৈদিক বর্ণনায় গোহত্যা মানব হত্যার সমান। 
রামায়ণের মধ্যেও হত্যারাঅর্থে গোঘ্ন-
বাল্মীকি রামায়ণে কিষ্কিন্ধা কাণ্ডের একটি শ্লোকে গোঘ্নশব্দের প্রয়োগ দেখা যায়।
গোঘ্ন চৈব সুরাপে চ, চৌরে ভগ্নব্রতে তথা
                                                      কিষ্কিন্ধ ৩৪/১২ 
এখানে গোঘ্ন শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে গোহত্যাকারী, সুরাসক্ত, চোর ও ব্ৰতভঙ্গকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। হত্যাকারী অর্থে আরও অনেক শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যেতে পারে কিন্তু অতিথি অর্থে গোঘ্ন শব্দের প্রয়োগ কোন বেদ কিংবা লৌকিক সাহিত্যে পাওয়া যায় না।


ইতিহাসে আতিথ্যের জন্য গোহত্যার কথা নেই-
বৈদিক এবং লৌকিক সাহিত্যের বিশাল ও সুবিস্তৃত ভাণ্ডার আছে। রামায়ণ, মহাভারত, রঘুবংশ আদি অন্যান্য অনেক উত্তমোত্তম গ্রন্থে হাজারো স্থানে অতিথি সৎকারের বর্ণনা পাওয়া যায়। অথচ কোন অতিথিকে খাওয়ানোর জন্য গোহত্যা করা হয়েছে এমন নিদর্শন কোথাও পাওয়া যায় না। অবশ্য ! উত্তর রামচরিতম্’-এর মধ্যে ভবভূতি পরিহাসাত্মক প্রসঙ্গ অবশ্য উপস্থিত করেছেন। অন্যথা, ঋষিগণ রাজাদের নিকট আসা যাওয়া করতেন। কিন্তু গো হত্যার বর্ণনা তো কোথাও পাওয়া যায়নি, উপরন্তু পাদ্য, অর্ঘ্য ইত্যাদি সামগ্রীর উল্লেখ পাওয়া গেছে।
বাইবেলের তৌরেতে আব্রাহিম ঈশ্বরের আতিথ্য করার সময় একটি মুলায়ম বাছুরের মাংস এবং রুটির আহার করিয়েছিলেন। এটি খৃষ্টান সংস্কৃতি। কিন্তু ভারতের সহস্ৰ অতিথি সকারের বর্ণনায় কোথাও গোমাংসের বর্ণনা পাওয়া যায় না। এই অনার্য সংস্কারগুলি আর্যগণের মধ্যে প্রচলিত করার চেষ্টা বহুদিন যাবৎ চলে আসছে। কোন কথাকাহিনীকে কোথায় কে কখন ধারণ করে, তার ঠিকানা কে রাখে। রাজা রন্তিদেবের কাহিনীও ঠিক ঐ প্রকার। আফগানিস্থান, বেলুচিস্থান পর্যন্ত আর্যদের প্রগাঢ় সম্বন্ধ তো ছিলই। কিন্তু আরও পশ্চিম আরব, ইউনানী প্রভৃতির সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এই সকল পশ্চিমী দেশ সাংস্কৃতিক দিক থেকে ততটা পবিত্র ছিলনা। কিন্তু বৈদিক অথবা ভারতীয় সংস্কৃতিতে অতিথি সৎকারের জন্য গোহত্যা কখনও স্বীকৃত হতে পারে না।



অতিথিগ্বঃ
অতিথি কতিপয় বিদ্বান অতিথিগ্ব’-এর অর্থ করেন অতিথিগণকে গোমাংস পরিবেশনকারী। এ সকল ব্যক্তিদের বিচারে অতিথিগ্বএক প্রকার সম্মানসূচক উপাধি ছিল। এঁদের মধ্যে ভারতীয় বিদ্যাভবনের প্রতিষ্ঠিত বিদ্বান শ্ৰী কনহৈয়ালাল মাণিলাল মুন্সী হলেন প্রধান। শ্ৰী সায়ণাচার্য
এবং স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী এর অর্থ লিখেছেন
অতিথীন্ প্রতি সেবাৰ্থং গচ্ছন্অর্থাৎ সেবা করার জন্য অতিথিগণের নিকট গমন করা। এখানে গোমাংসের কথা কোথা থেকে আসছে? ইউরোপীয় বিদ্বানেরাও অতিথিশব্দের অর্থ হিংসা অর্থে করেন নি।
প্রোফেসর মোনিয়র উইলিয়ম্ অতিথিগ্ব-র অর্থ করেছেন—‘To whom guests should go' যার নিকট অতিথিগণ গমন করেন।
প্রোফেসর ব্লুমফীল্ড অতিথিগ্ব-র অর্থ করেছেন—‘Presenting cows to guests. অতিথিদের গাভীরূপ উপহার প্রদানকারী, অর্থাৎ গোদাতা।।
এই সকল প্রমাণ বিচার করার পর স্বীকার করতেই হয় যে সমাজের পরম্পরা থেকে উপলব্ধ ভাবনা, জনসাধারণের সংস্কার, যে কোনও পুস্তক থেকে অথবা যে কোন বিদ্বান ব্যক্তির থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ অপেক্ষাকৃত বলশালী। একদিকে যেমন, কিছু মাংসাহারী আছে অপরদিকে ঠিক তেমনই কিছু শুদ্ধ শাকাহারী রয়েছে। যারা মাংস আহার রূপে গ্রহণ করেন না, তাদের গোমাংসের প্রতি ঘৃণা অবশ্যই আছে কিন্তু মাংসাহারীদের মধ্যেও ৯৯% ভাগেরও অধিক ব্যক্তিগণ গোমাংস খাদ্যরূপে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করেন না। মাংসাহারী কিংবা শাকাহারী উভয় শ্রেণীর ব্যক্তিগণ গোমাংস ত্যাজ্য বলে মনে করেন এবং গো-কে মাতৃতুল্য পূজনীয় বলে স্বীকার করেন।
গবো বিশ্বস্যমাতরঃগাভী বিশ্বের মাতা।
গোমেধ যজ্ঞঃ
বেদ সংহিতায় ২০০০০-এর অধিক মন্ত্ৰ আছে, কিন্তু কোথাও গোমেধ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়না। অবশ্য কর্মকাণ্ডের যজ্ঞ বিধানসমূহের মধে গোমেধ এবং অশ্বমেধের বর্ণনা পাওয়া যায়।
অশ্বমেধ এবং গোমেধ এদুটি এমন যজ্ঞ যে, যার সঙ্গে পশুহত্যার বিষয়কে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কোন রাজা অথবা ঋষি গোমেধ যজ্ঞ করেছেন এমন কোন প্রমাণ রামায়ণ-মহাভারত আদি ইতিহাস গ্রন্থে কিংবা রঘুবংশ ইত্যাদি ঐতিহাসিক কাব্যে পরিলক্ষিত হয়না। অবশ্য প্রাচীনকালে প্রসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতেন। মধ্যকালে বেদজ্ঞানে অজ্ঞ কর্মকাণ্ডী সাম্প্রদায়িগণ অশ্বমেধ-এর সঙ্গে পশুবধ যুক্ত করেছেন এবং এ বিষয়ে তাঁরা মহীধরাচার্যের ন্যায় তান্ত্রিক বামমার্গী আচার্যের সাহায্য পেয়েছিলেন। রামায়ণ থেকে শুরু করে মহাভারত পর্যন্ত অনেক অশ্বমেধ যজ্ঞের বর্ণনা পাওয়া যায়, কিন্তু যজ্ঞকুণ্ডে কোন ঘোড়ার আহুতি প্রদান কোন আর্য রাজার দ্বারা সম্পাদিত হয়নি। রাক্ষসদের কথা অবশ্য ভিন্ন ছিল। মাংস ভক্ষণ এবং চর্বির আহুতি প্রদান করা ছিল রাক্ষসী আচরণ।
অশ্বমেধ যজ্ঞতো রাষ্ট্রের সংগঠন। শতপথ ব্ৰাহ্মণে অশ্বমেধের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ :
(১) রাষ্ট্রং বৈ অশ্বমেধঃ, রাষ্ট্রই অশ্বমেধ।
(২)তস্মাদ রাষ্ট্রী অশ্বমেধে যজেত, অতএব রাষ্ট্রবাদীর অশ্বমেধ যজ্ঞ করা উচিৎ।
(৩)অশ্বমেধ যাজী সর্ব দিশো অভি জয়ন্তি’, অশ্বমেধকারী সকল দিক জয় করেন।
শ্রীরামের পূর্বজ রঘু অশ্বমেধ করেন। শ্রীরামও অশ্বমেধ করেন, যুধিষ্ঠিরও করেছিলেন। যে কোন চক্রবর্তী সম্রাট যিনি রাষ্ট্রের সংগঠন করেছেন, তিনিই অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করেছেন। রাজার ঐশ্বৰ্য্য ও বচস্বের প্রতীক ঘোড়া সকল দিকে পরিক্রমা করে আসত। ঐ ঘোড়াকে হত্যা করে টুকরো করে কখনও তো কেউ আহুতি দেয়নি। মহীধরাচার্য একজন তান্ত্রিক আচার্য ছিলেন। তিনি বেদমন্ত্রকে ভেঙ্গেচুরে অন্যরূপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন। সাণাচাৰ্য মহীধরাচার্য এঁরা ঋষি যুগের কয়েক হাজার বৎসর পরে আবির্ভূত হন। ততক্ষণে বিদেশী সংস্কৃতি-সমূহের মিল-মিশ হওয়ার অনেক সুযোগ এসে গেছে। পশুহিংসা বিদেশী সংস্কৃতির মিশ্রণের ফল। যা বেদ ব্যতীত অন্য শাস্ত্রের মধ্যে বিদেশী  শাস্ত্রের মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। বেদ যজ্ঞকে অধ্বর বলে অভিহিত করে। নিরুক্তের সর্বমান্য আচার্য যাস্ক অধ্বরের ব্যাখ্যা করেছেনধ্বরতীতি হিংসা কৰ্মা, তৎপ্রতিষেধঃ অধ্বরঃ হিংসার ত্যাগ হল অধ্বর। বেদে অনেক স্থানে যজ্ঞের জন্য অধ্বর শব্দের প্রয়োগ করা হছে। অতএব বেদে ঘোড়া, গরু, ছাগল ইত্যাদি যে কোন পশুহিংসার আদেশ কিংবা বিধান নেই।
এখানে আমরা গোমেধ যজ্ঞের বিষয়ে আলোচনা করছি। গোমেধ যজ্ঞতিনটি শব্দের দ্বারা সম্পূর্ণ হয়। (১) গো, (২) মেধ ও (৩) যজ্ঞ। এই তিন শব্দের প্রথম শব্দের বিবেচনা করা উচিত।
গো : গরু চতুষ্পদ দুগ্ধ-প্রদানকারী পশু। কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে গো”-এর অনেক অর্থ হয় এবং সকল প্রকার অর্থই সাহিত্যে এবং সমাজের মধ্যে সুলভ প্রয়োগ পাওয়া যায়। হলযুধ সংস্কৃত কোষে একটি শ্লোক পাওয়া যায়-
দিগ্দৃষ্টি দীধিতস্বর্গবজ্ৰ বাগ্বাণবারিষু। 
ভূমৌ পশৌ চ গো শব্দো বিদ্বদ্ধির্দশসু স্মৃতঃ৷৷
                                        (হলা ০ অভিধান ০ ক০ ৫-৬)
অর্থাৎ বিদ্বানগণ গো শব্দের দশ প্রকার অর্থ করেন। ১) দিশা, ২) দৃষ্টি, ৩) দীধিতি = কিরণ, ৪) স্বৰ্গ, ৫) বজ্র, ৬) বাক্ = বাণী, ৭) বাণ = তীর, ৮) বারি = জল, ৯) ভূমি, ১০) পশু (গো নামক পশু)।
গোমেধ যজ্ঞে বাক্ = বাণী এবং ভূমি = পৃথিবীর পরম্পরা অনুযায়ী প্রয়োগ পাওয়া যায়। অন্য প্রয়োগও হতে পারে।
গৌ-এর এই অর্থ বৈদিক কোষ নিঘন্টু দ্বারা সমর্থিত। যাস্কাচার্য নিঘন্টুর ব্যাখ্যা তিনি তার নিরুক্তে লিখেছেন।
১) গৌঃইতি পৃথিব্যা নামধেয়ম্
(ক) যদ্ দূরংগতা ভবতি ; পৃথিবী দূর পর্যন্ত বিস্তৃত তাই গৌ পৃথু বিস্তারে)।
(খ) যচ্চ অস্যাং ভূতানি গচ্ছন্তি-এর উপর আরূঢ় হয়ে প্রাণী অনেকদূর পর্যন্ত গমন করে।
২) গৌঃ মাধ্যমিকা বাণীশাস্ত্রে বাণীর ভেদ চার প্রকার, (১) পরা, (২) পশ্যন্তি, (৩) মধ্যমা, (৪) বৈখরী। এর মধ্যে মধ্যমা বাণীর নাম গৌ।।
(ক) গেীঃ এতস্যা মাধ্যমিকায়াঃ বাচঃ” (অ ০৬) 
(খ) গৌঃ বাগেষা মাধ্যমিকা” (0 ১১ খ ০৪২) 
সুতরাং গো-এর দুটি অর্থ আমরা গ্রহণ করছি। 
(১) গো = পৃথিবী, এবং (২) গো = বাণী।।
মেধ-মেধ-এর তিন প্রকার অর্থ ধাতুপাঠ দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে।
১) মেধ থেকে মেধা, মেধাবি, “যাং মেধাং দেবগণাঃ পিতরশ্চোপাসতেএস্থানে মেধা = বুদ্ধি জ্ঞান ইত্যাদি।
২) মেধের সংগমন, সমন্বয়, সংগতিকরণ আদি অর্থও হয়।
৩) মধের অর্থ হিংসাও হয় কিন্তু এর প্রয়োগ বিরল, হিংসা অর্থে প্রয়োগ অত্যন্ত কম।
যজ্ঞ- যজ্ঞ শব্দ যজ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়। এরও তিনটি অর্থ আছে
১) দেবীপূজা (পূজন্নাম সৎকারঃ)
২) সংগতিকরণ অর্থাৎ কোন বস্তুর সমন্বয়-সামঞ্জস্য-সংস্কার দ্বারা তাকে অধিক উপযোগী করা।
৩) দান করা। 
শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে অন্নং হি গৌঃ লিখিত আছে। আজ থেকে প্রায় সোয়া শত বৎসর পূর্বে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী মহারাজ নিজ অদ্বিতীয় ধর্ম-মীমাংসার গ্রন্থ সত্যার্থপ্রকাশে সর্বপ্রথম উক্ত পাঠের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করান। সুতরাং খড়কুটোর বেড়ার আড়ালে থাকা পর্বত প্রকাশ্যে এললা। এখন গো+মেধ+যজ্ঞ এই তিন শব্দ একত্রিত করলে বিষয়টা সহজ বোধগম্য হয় যে, পৃথিবীকে উর্বর করে অন্নউৎপন্ন করা গোমেধ যজ্ঞ। ভারতীয় পরম্পরায় গোদান এবং গোচারণ ভূমির দান বহুবার একই সঙ্গে সম্পাদিত হত। শ্রী রঘুলাল শর্মা তাঁর নিজ প্ৰসিদ্ধ গ্রন্থ বৈদিক সম্পত্তিতে লিখেছেন- (বৈদিক সম্পত্তি পৃ. ৩০৪)।
শতপথ ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধ যুগীয় গ্রন্থের উল্লেখ থেকে T. W. Phys Davis, LL.D., Ph.D. আপন পুস্তকে লিখেছেন যে পশুচারণ ভূমি ও জঙ্গল বিষয়ে অধিক ধ্যান দেওয়া হত। পুরোহিত সর্বদা এই বিষয়ের প্রতি দাবি রাখতেন যে যজ্ঞাদির পরিবর্তে তার ঐ প্রকার ভূমির প্রাপ্তি হােক। দানপত্র লেখার সময় এ বিষয়ে বিশেষ ধ্যান রাখা হত যে, ঐ প্রকার এক আধ পশুচারণ ভূমি অথবা জঙ্গলের কথা যেন ঐ পত্রে উল্লেখ থাকে। ডেভিস-এর ইংরেজি উদ্ধৃতি-
"Great importance was attached to these rights of pastures and forestry. The priest claimed to be able, as one result of performing a particular sacrifi e to ensure that a wide tract such land should be provided (Sat13.37), and it is often made a special point, in describing the grant of a village to a priest, that it contains such common lands.” ( The Stories of the Nation, Buddhist India—T. W. Rhys Davis Dialogue of Buddha.)
গোমেধ যজ্ঞ ব্যবস্থায় ধার্মিক কর্মকাণ্ড একটি শব্দ রূপে পরিগণিত হতে শুরু করে। বর্তমান অর্থশাস্ত্রের ভাষায় Land Reclamation ভূমিকে কৃষিযোগ্য করে গড়ে তোলা বোঝায়। স্বামী দয়ানন্দজী তো সোয়াশত বৎসর পূর্বেই গোমেধ শব্দের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা দূরীভূত করেছিলেন। তিনি অন্নং হি গৌঃ শতপথ ব্রাহ্মণের প্রমাণের উদ্ধৃতি দিয়ে এর সম্বন্ধ কৃষি ও অন্ন উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। এদিকে পারসীদের পবিত্র পুস্তক সমূহের অধ্যয়নের মাধ্যমে ডাঃ মার্টিন হাগ বলেন যে, গোমেধ-এর অর্থ গোবধ নয়। পক্ষান্তরে, এর অর্থ-ভূমিকে উর্বর করে বনস্পতি উৎপন্নযোগ্য করা। তিনি এ ধরণের কল্পনাই শুধু করেন নি, পরন্তু আবেস্তা ভাষা দ্বারা গোমেধ-এর অপভ্রংশ গোমেজ” (Gomez) শব্দ অন্বেষণ করে উপস্থিত করেন। এই শব্দের দ্বারা গোমেধশব্দের উপর অত্যন্ত উত্তম প্রভাব বিস্তার করে।

ডাঃ হাগ লিখছেন, “পারসী ধর্মে কৃষিকার্য ধর্ম বলে মনে করা হয়। অতএব কৃষি-ধর্মের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষাকারী সমস্ত ক্রিয়াকলাপের নামগোমেজ’-—“The Parsi religion enjoins agriculture as religious duty and this is the whole meaning of Gomez” (From Essays on the Sacred Language--Writings and
Religion). ( বেদে কা যথার্থ স্বরূপ আচার্য ধর্মদেব বিদ্যামাৰ্তণ্ড পৃ-১৯২।)

আমরা সংস্কৃতের হলায়ুধ কোষ এবং যাস্কাচার্যের নিরুক্ত প্রমাণের মাধ্যমে এটাই দেখিয়েছি যে গো শব্দের অনেক অর্থের মধ্যে বাণীও একটি অর্থ। কয়েকজন আচার্য মধ্যমাবাণীর সংজ্ঞা গোশব্দ রূপে বর্ণনা করেছেন। মেধের অর্থ সংগমন এবং যজ্ঞের অর্থ সংগতিকরণই হয়। সুতরাং গোমেধ’-এর অর্থ হবে বাণীর অর্থ ও ভাবের সঙ্গে সংগমন-সংগতিকরণ। আত্মা থেকে পরাবাণী মনের সংকল্পের দ্বারাপশ্যন্তীরূপ নিয়ে উচ্চারণের পূর্বে মধ্যমারূপ দ্বারা বৈখরী বাণীকে প্রস্ফুটিত করে। এই সামঞ্জস্য, সংগতিকরণ ভাষাকে, বাণীকে প্রভাবশালী করে তোলে।
মহর্ষি গাৰ্গায়ণ কৃত প্রণববাদে গোমেধ যজ্ঞের ব্যাখ্যা নিম্নরূপে পাওয়া যায়-

গোমেধস্তাবচ্ছমেধ (শব্দ+মেধ) ইত্যগম্যতে, গাং বাণীং মেধয়া সংয়োজনমিতি তদৰ্থাৎ। শব্দশাস্ত্ৰ জ্ঞানমাত্ৰস্য সর্বেভ্যঃ প্রদানমেব। গোমেধো যজ্ঞঃ” (প্রণববাদ-প্রকরণ ৩, তরঙ্গ ৬)                    
অর্থাৎ বাণীকে মেধার সঙ্গে সংযুক্ত করা, অন্য সকল ব্যক্তিকে শব্দ শাস্ত্রের শিক্ষা দেওয়া, অর্থাৎ ব্যাকরণ পড়ানো = গোমেধ যজ্ঞ করা।
বেদ শাস্ত্র, ঋষি পরম্পরায় সত্যনিষ্ঠা দ্বারা বিচার করা হলে মাংস, মদ্য গোবধ ইত্যাদির কোন প্রকার রূপ পাওয়া যায় না। ঠিক এই কারণবশতঃ আজও আর্য হিন্দুদের মধ্যে এই সকল বিষয় ঘৃণার বস্তু। এবং কদাচার হিসেবে পরিগণিত হয়।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি আলোচ্য বিষয় আছে যে, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত সব কিছুই প্রমাণ নয়। সত্যযুগের সময়ে সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও, ত্রেতায় বিশেষভাবে মহারাজ রঘুর সময় থেকে আসুরী সংস্কৃতির আদান প্রদান সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। রাবণ অহিরাবণ আদির পূর্বেও আসুরিক আচার বিচারের মিশ্রণ হতে থাকে। অসুরদের যাগ যজ্ঞে রক্ত মাংসের প্রচলন তো ছিলই উপরন্তু যখন আসুরিক সংস্কৃতিতে প্রভাবান্বিত আচাৰ্য্যগণ গভীর ভাবে মিশ্রণের প্রভাবকে গ্রহণ করতে শুরু করেন তখন মহর্ষি ব্যাস, পিতামহ ভীষ্ম প্রভৃতি প্রতিটি মানুষকে সাবধান করানোর বিষয়টি অনুভব করেন যে, বেদে মাংস ভক্ষণ ও মদ্যপানের উল্লেখ নেই।
সুরা মৎস্যাঃ মধু মাংসমাসবং কৃশরৌদনম্। ধূর্তৈঃ প্রবর্তিতং যজ্ঞে নৈতদ বেদেষু বিদ্যতে৷৷
                                                    (শান্তি পৰ্ব-২৬৫-৯) 
অর্থাৎ মদ, মাংস, মৎস ইত্যাদি যজ্ঞে প্রদান করার প্রচলন ধূর্তগণের প্রচার, এই প্রকার বিধান বেদের কোথাও পাওয়া যায়না।
বিপরীতভাবে মুসলমানযুগে আজ থেকে প্রায় ৭০০ বৎসর পূর্বে এবং ঋষি-মুনিদের পরম্পরা সমাপ্ত হবার বহু পরে সাণাচার্যদ উব্বাটাচার্য, মহীধরের বেদ ভাষ্য রচিত হয়, যার মধ্যে বেদ এবং ঋষি পরম্পরার বিরুদ্ধে পশুবধ আদির বর্ণনা পাওয়া যায়, যদ্যপি ঋষি-পরম্পরার মধ্যে এসকল প্রমাণ নেই।
দ্বাপরের শেষকালে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়ে। জরাসন্ধের জামাতা কংস বেদ ব্রাহ্মণ, গাভী, যজ্ঞ এদের সকলকে নষ্ট করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এ বিষয়ে শ্ৰীমদ্ভাগবৎ-এর একটি শ্লোক বিচার্য-
তস্মাৎসর্বাত্মনা রাজন্ ব্ৰাহ্মণান্ ব্ৰহ্মবাদিনঃ।। 
তপস্বিনো যজ্ঞশীলান্ গাশ্চ হন্মো হবিদূৰ্ঘা।।
                                                             (দশম-৪-৪০) 
কংসকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যে বেদপাঠী, বেদোপদেশক, যজ্ঞের যাচক যজমান, তপস্বী ব্রাহ্মণ এবং যজ্ঞের জন্য প্রয়োজনীয় দুগ্ধ ঘৃত প্রদানকারী গাভীগণের হত্যা করার জন্য সম্পূর্ণ চেষ্টা করা হোক।
মহাভারতের পরবর্তী সময়ে বেদবাণী, বেদ প্রচারক ব্রাহ্মণগণের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এবং পশ্চিমের আসুরী সংস্কৃতির মিশ্রণ হতে থাকে। মুসলমান যুগে বৈদিক গ্রন্থ নষ্ট করা হয় এবং তীব্রভাবে ইস্লামী মিশ্রণ করা হয়। অল্লোপনিষদ্ রচিত হল এবং এটি অথর্ববেদের শাখা বলে বর্ণনা করা হল। সেখানে আল্লাকে পরমেশ্বর রূপে প্রার্থনা করার শিক্ষা দেওয়া হল।
অল্লো জেষ্ঠং শ্রেষ্ঠং পরমং পূর্ণং ব্ৰহ্মাণম্ অল্লাম।।২।। অল্লো রসুল মহামদঃ অকবরস্য অল্লো অল্লাম্ ॥৩৷৷ অল্লা ঋষীণাং সর্ব দিব্যাং ………………………….
৷৷৬৷৷ ওম্ অল্লা ইল্লাল্লা অনাদি স্বরূপায় অথর্ব০ ৷৷
…………………… অদৃষ্টং কুরু কুরু ফট্ ৷৷৯৷৷
…………............ অল্লো রসূল মহমদ আকবরস্য অল্লো অল্লাম্ ইল্লল্লেতি ইলল্লাঃ ॥১০৷৷
যখন স্বামী দয়ানন্দজী এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে অথর্ববেদে কোথায় এর বর্ণনা আছে একথা জানতে চেয়ে দ্বন্দ্বে আহ্বান করলেন তখন এই প্রকার ষড়যন্ত্রে ইতি পড়ল। পীর পয়গম্বর দরবেশ, মাজার, গাজী মিঞার চোগা-চাপকান ইত্যাদির পূজা শুরু হল এবং আর্য সমাজ জাতি ধর্ম জাগরণের জন্য এর বিরোধ করল, ফলস্বরূপ আর্য সমাজকে সাম্প্রদায়িক, দ্বন্দ্বপ্রিয় অসহিষ্ণু এবং আরও অনেক কিছু বলা হতে লাগল। কিন্তু
জ্যোঁ শ্বান ভূকতে হ্যায় খড়ে, হাতি জাতা হ্যায় চলা, ক্যা মশকোঁ কী হুংকার সে, খগপতি ডরতা হ্যায় ভলা ?
গান্ধীজী একদা আর্যসমাজের আলোচনা করায় সকলে অবাক হয়েছিলেন কিন্তু দেশজাতীর রক্ষক ঐ পক্ষপাতদুষ্ট আলোচনায় নিরুৎসাহী হননি।
ইসলামী যুগ ছিল বর্বর নিষ্ঠুর। খৃষ্টান যুগের আগমনে বিদ্যাও উন্নত হয়। পরিচ্ছন্ন কায়দায় রাষ্ট্রদ্রোহী খৃষ্টানগণ সভ্যতার জামা পরে উপস্থিত হন। ভারতীয় বিচার ও চিন্তাধারায় মিশনারীগণ আক্রমণ করেন। বিদ্যা, ইতিহাস ও মান্যতার ক্ষেত্রে ছল কপটতা চলতে থাকে। পুরা বিদ্যা, ভারতীয় বিদ্যা, ঐতিহাসিক তথ্য সমূহকে খৃষ্টানগণ ভেঙ্গে চুরে পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেন। তারা বলতে শুরু করেন, আর্যগণ আক্রমণকারী, সিন্ধু সভ্যতা অনার্যদের, হিন্দু দ্ৰাবিড়, ভিন্ন। ভারতীয় পরম্পরার ইতিহাসের উপেক্ষা, মিথ্যা প্ৰতিপন্ন করা, সংস্কৃত বিদ্যার রূপ বিকৃত করা ইত্যাদি ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ইংরেজদের দ্বারা নতুন ভাবে ইতিহাস লেখানো হয! নতুন নতুন অভারতীয় মান্যতার সংযোজন হয়। ওদের সঙ্গে যুক্ত হয় সমাজবাদী সাম্যবাদী ইত্যাদি বরুবাদী। ভারতীয় পরম্পরার বিদ্বানগণের উপেক্ষা এবং ইংরেজ মনোভাবাপন্ন দাসেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক পদে নিযুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও পরম্পরা প্রাপ্ত ভারতীয়তা বিরোধী কার্যের গড় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্বান নিৰ্মাণ কাৰ্য্য চলতে থাকল।
যে যত উগ্রতার মাধ্যমে ভারতীয়তার বিরোধ করতে সক্ষম তাকে ততই উচ্চ আসন এবং সারস্বত পুরস্কার প্রদান করা হত। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ রক্ষা করাই ছিল ইংরেজদের স্বার্থ। খৃষ্ট ও খৃষ্টীয়তা ছিল একমাত্র হাতিয়ার।
অল্লোপনিষদের ন্যায় খৃষ্টোপনিষও রচিত হয়েছিল। একটি প্রচলিত শ্লোক-
নরকুল কুলষঘ্নো মোক্ষদঃ প্ৰেম মূৰ্তিঃ। 
বিজিত নরক রাজ্যঃ স্বর্গরাজ্যৈক মার্গঃ৷৷
সকল ভুবন ভৰ্ত্তা পাতু নঃ খ্ৰীষ্টযীশুঃ৷৷” 
এ সকল হিন্দুদের খৃষ্টান করার নীতি ছিল। যীশুকে পরমেশ্বরের রূপে সংস্কৃত ভাষায় শ্লোকের মাধ্যমে স্তুতি প্রার্থনা করা থেকে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)