পৌরাণিকগণ তাদের পুরাণসর্বস্ব জ্ঞান নিয়ে বেদাধ্যয়ন করতে এসে বেদের অর্থ বিকৃত করে গুলিয়ে ফেলে। বেদে রুদ্র, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি শব্দ দেখে আগেপিছে না ভেবে তাদের পৌরাণিক দেবতা বলে চালিয়ে দিতে চায়।
এরা
আবার না বুঝে ই সব জায়গায় মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কে কুপ্রশ্ন করতে ছাড়ে না। অজ্ঞের মত " দয়ানন্দ সরস্বতী শুধু একপক্ষীয় ভাষ্য, উনি বাদে বাকি সব
ভাষ্যকার এটা মেনেছেন, ওটা মেনেছেন" বলে নিজের অজ্ঞতা জাহির করে।
তাদের এহেন প্রতিবাদে আমরাও অনুপ্রাণিত। তাই এই লেখায় দয়ানন্দ সরস্বতী ভাষ্য ব্যবহার করব না, বরং পৌরাণিক ভাষ্যকার সায়নাচার্য ও রমেশচন্দ্র দত্তের ভাষ্য ও আচার্য যাস্কের নিরুক্ত ব্যবহার করে ই উদ্দেশ্য সাধন করব।
রুদ্র বেদের উল্লেখযোগ্য দেবতা। তাঁর নামে প্রচুর মন্ত্র বা সুক্ত আছে। কোনো মন্ত্রে রুদ্র বৈদ্যার্থে, কোনো মন্ত্রে রুদ্র পুরুষার্থে বা কোনো মন্ত্রে মেঘার্থে প্রযুক্ত।
সাধারণত আধিভৌতিক অর্থের
মন্ত্রগুলোতে রুদ্র অর্থ জাগতিক বস্তু যেমন পুরুষ, সেনাপতি বা মেঘ। আমাদের
দুটো লেখা তে রুদ্রের বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
ও
রুদ্রের স্বরূপ প্রসঙ্গে যাস্কাচার্য বলেন,
রুদ্রো
রৌতীতি সতঃ, রোরূয়মানো দ্রবতীতি বা রোদয়তের্বা যদ রুদত্তদ্ রুদ্রস্য
রুদ্রত্বমিতি কাঠকম্, যদরোদীত্তদ্ রুদ্রস্য রুদ্রত্বমিতি হরিদ্রবিকম্।
(নিরুক্ত ১০.৫)
রুদ্র রু ধাতু থেকে নিষ্পন্ন। শব্দ করেন বলে তিনি রুদ্র।
অথবা
রু ও দ্রু ধাতু থেকে নিষ্পন্ন। তিনি শব্দ করতে করতে গমন করেন জন্য তিনি রুদ্র।
অথবা
শত্রুগণকে রোদন করান অর্থে তিনি রুদ্র।
কাঠক সংহিতায় বলা আছে, যেহেতু তিনি রোদন করেন সেহেতু তিনি রুদ্র।
মৈত্রায়নী সংহিতা মতে, যেহেতু তিনি রোদন করেছিলেন, সেহেতু তিনি রুদ্র।
রুদ্রের একটি অর্থ উক্ত অংশ থেকে মেঘ বলে ই প্রতীয়মান হয়। ঝড়ের সোঁ সোঁ গর্জন ই রুদ্রের কান্না বা প্রবল ঝড় জীবের রোদনের কারণ।
ঋগ্বেদে রুদ্র মরুদগণের পিতা।
"পিতর্মরুতাম্ "ঋগ্বেদ ২.৩৩.১
মরুদগণের স্বরূপ নিয়ে নিরুক্তে কথিত,
মরুতো মিতরাবিণো বা মিতরোচিনো বা মহৎ দ্রবস্তীতি বা। ( নিরুক্ত ১১.১৩)
অর্থাৎ মরুদগণ মিতরাবী বা পরিমিত শব্দকারী, মিতরোচী বা দীপ্তিশালী অথবা দ্রুতগামী।
উভয় শর্ত শুধু সূর্যালোকের জন্য ই প্রযোজ্য হয়।
কিন্তু বেদমতে সূর্য, বিদ্যুৎ ও অগ্নি এই তিন অভেদ।
অগ্নির তিন শির বা তিন রূপ দেখা যায়। অগ্নি, বিদ্যুৎ ও সূর্য। অগ্নি, বিদ্যুৎ বা বজ্র ও সূর্য তিনটি ই বেদে রুদ্র নামে কথিত।
দ্রষ্টব্যঃ
তাহলে মরুদগণের অর্থ দাঁড়ালো সূর্যালোক বা মেঘের বিদ্যুৎ।
● রুদ্র = বজ্র হলে মরুৎ হল মেঘ থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ।
● রুদ্র= সূর্যাগ্নি হলে ই মরুৎ সূর্যালোক।
রুদ্রের
রুদ্র নামকরণের কারণ তাঁর রোদন। এই রোদনের ঘটনা দেখা যায় শতপথ 1/7/4 এ
যেখানে রুদ্র তাঁর পিতা প্রজাপতি কে হত্যা করে রোদন করেন।
উপাখ্যানের তাৎপর্য নিম্নের লিঙ্কঃ
এই
ব্রাহ্মণে প্রজাপতি সূর্য হিসেবে স্তুত। প্রজাপতি সূর্য হলে রূদ্র অবশ্যই
তাঁর পুত্ররূপ সূর্যাগ্নি। যিনি তাঁর থেকে জাত সন্তানরূপ মরুৎ বা সূর্যালোক
দ্বারা সূর্য কে পৃথিবী তে পতিত করেন। আবার, বিকল্প ব্যাখ্যায় তিনি
বজ্ররূপ আলো দ্বারা সূর্য কে পৃথিবীতে পতিত করেন।
রুদ্রকে
দেবপক্ষে থাকা অবস্থায় অগ্নি অর্থ করার পক্ষে বেদে প্রচুর প্রমাণ আছে।
বেদমতে রুদ্রের উপর প্রযুক্ত সকল বৈশিষ্ট্য ই অগ্নির উপর খাটে। অগ্নি কে
সরাসরি রুদ্র বলা আছে একাধিক ক্ষেত্রে।
ঋগ্বেদ 1/27/10
জরাবোধ তদ্বিবিভূতি বিশে বিশে যজ্ঞিয়ায়। স্তোমং রুদ্রায় দৃশীকম্।
হে অগ্নি তুমি স্তুতি দ্বারা জাগরিত হও, ভিন্ন ভিন্ন যজমান কে যজ্ঞার্থে যজ্ঞস্থলে প্রবেশ করাও। তুমি রুদ্র, তোমাকে স্তুতি করিতেছি।
এ প্রসঙ্গে আচার্য যাস্কের নিরুক্তে কথিত,
অগ্নিরূপি রুদ্র উচ্চতে।
নিরুক্ত 10/7
কখনো কখনো অগ্নি ও রুদ্র।
আ রোদসী বেবিদানাঃ প্ররুদ্রিয়া জভ্রিরে যজ্ঞিয়াসঃ
বিদন্মর্তো নেমধিতা চিকিত্বানগ্নিং পদে পরমে তস্থিবাংসাম।
.ঋগ 1/72/4
যজ্ঞার্হ
দেবগণ বৃহৎ দ্যুলোক ও পৃথিবী তে থাকিয়া রুদ্রের উপযুক্ত স্তোত্র রচনা
করিয়াছিলেন। মরুদগণ ইন্দ্রের সাথে নিহিত অগ্নি কে জানিয়া তাঁহাকে লাভ
করিয়াছিলেন।
এই সুক্তে সায়নাচার্য ও রমেশচন্দ্র উভয়েই রুদ্র অর্থ অগ্নি ই করেছেন।
এছাড়া অগ্নির বাকি দুই গৌণ রূপ বিদ্যুৎ আর সূর্য হিসেবে ও বেদে রুদ্র উল্লিখিত।
বৃহদ্দেবতাতে বর্ণিত রুদ্রের স্বরূপ থেকে পাই,
অরোদীদন্তরিক্ষে যদ্বিদ্যুদ্বৃষ্টিং দদণ্ণৃণাং। চতুর্ভি ঋষিভিস্তেন রুদ্র ইত্যভিসংস্তুত। .
(বৃহদ্দেবতা–2/25)
যিনি অন্তরীক্ষে রোদন করেন, মানুষের কাছে বিদ্যুৎ ও বৃষ্টি প্রদান করেন, চারজন ঋষি তাঁকেই রুদ্র নামে স্তব করেছেন।
এখানে রুদ্র কে বিদ্যুৎ বা সূর্য উভয়রূপে ধরলে ই বৈশিষ্ট্যসমূহ সিদ্ধ হয়।
আবার,
যজুর্বেদের 16/7-8 এ মহীধর রুদ্র অর্থ করেছেন সূর্য।
অতএব অগ্নির তিন রূপ= রুদ্রের তিন রকম ব্যাখ্যা। তাই বলা চলে রুদ্র ও অগ্নি আসলে অভেদ।
আবার,
কৌষিতকী ব্রাহ্মণে রুদ্রের অষ্ট নাম কথিত, যার আটটি ই অগ্নির জন্য ও খাটে।
- প্রথম নাম ভবঃ। ভবঃ হচ্ছে জল তথা অন্তরীক্ষলোকের সমার্থক।
অগ্নি অন্তরীক্ষের অধীপতি। গর্ভো যো অপাং গর্ভো বনানাং গর্ভোশ্চ স্থাতাং
গর্ভোশ্চবথাং।অগ্নৌ চিদস্মা অন্তর্দুুবোণে বিশাং ন বিশ্ব অমৃতঃ স্বাধীঃ।
(ঋগ্বেদ 1/70/2) যে অগ্নি জলের গর্ভস্বরূপ, তিনি ই অরণ্যের গর্ভস্বরূপ,
তিনি স্থাবর জঙ্গমের গর্ভরূপে সকলের অন্তরে অবস্থিত, সেই অগ্নি গৃহে বা
পর্বতে হবি লাভ করেন।
নিঘণ্টু 1/ 3 মতে অপ= অন্তরীক্ষ।
দ্বিতীয় নাম শর্ব যা সরাসরি অগ্নি।
তৃতীয় নাম পশুপতি।
অগ্নি পশুপতি। ধামং তে বিশ্বং ভুবনমধি শ্রিতমন্তঃ সমুদ্রে হৃদ্যন্তরাষুষি।
অপামনীকে সমিথে য আভৃযস্তমশ্যাম মধুমন্তং ত উর্মিম্।যজু 17/99।
হে অগ্নি, এই বিশ্ব তোমার ধামে স্থিত, অন্তরীক্ষে সূর্যরূপে; সকল প্রাণির
হৃদয়ে জঠরাগ্নিরূপে, আয়ুতে প্রাণরূপে, জলের সঙ্ঘাতে বিদ্যুতাগ্নিরূপে,
সংগ্রামে শৌর্য অগ্নি রূপে সকল স্থানে তোমায ধামরূপ অগ্নি আমরা লাভ করব।
চতুর্থ নাম উগ্র
উগ্র অর্থে ওষধি বা বনস্পতি।
অগ্নি ওষধির ও পতি। গর্ভো অস্যোষধীনাং গর্ভো বনস্পতীনাম।গর্ভো বিশস্ব
ভূতস্যাগ্নে গর্ভো অপামসি( যজু 12/37) হে অগ্নি, তুমি ওষধীর গর্ভে,বনস্পতির
গর্ভে, সকল জীবকূলের গর্ভে ও জলের গর্ভে বিরাজমান।
পঞ্চম নাম মহাদেব।মহাদেব অর্থে আদিত্য।
অগ্নির রূপ তা বুঝতে অষ্টম নামের অংশ দ্রষ্টব্য।
ষষ্ঠ নাম রুদ্র। রুদ্র কে সরাসরি অগ্নি বলা হয়েছে পূর্বেই ।
অগ্নিরূপি রুদ্র উচ্চতে।
নিরুক্ত 10/7
কখনো কখনো অগ্নি ও রুদ্র।
সপ্তম নাম ঈশান। ঈশান শব্দে অন্ন।
অগ্নি অন্নের পতি। অগ্নিরন্নাদোহন্নপতি। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ 1/8।
এষ হি বাজানাং পতি। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ 2/5
অষ্টম নাম অশনি।অশনি শব্দে বজ্র বা বিদ্যুৎ। বজ্র বা বিদ্যুৎ অগ্নির তিনটি প্রধান
রূপের একটি।।।অস্য বামসং বননীয়স্য পলিতস্য পালয়িতুর্হোতৃর্হ্লাতব্যস্য
তস্য ভ্রাতা মধ্যমোহস্তত্যশনঃ। ভ্রাতা ভরতের্হরিতকর্মণো হরতে ভাগং ভর্তব্যো
ভবতীতি বা। তৃতীয়ো ভ্রাতা ঘৃতপৃষ্ঠোহস্যায়মগ্নিঃ। তত্রাপশ্যং সর্বস্য
পাতারং বা পালয়িতারং বা বিশপতিং সপ্তপুত্রঋ সপ্তমপুত্রং সর্বণপুত্রমিতু বা।
সপ্ত সৃপ্তা সঋখ্যাসপ্তাদিত্যরশ্ময় ইতি বদন্তি।।
নিরুক্ত(4/26)
শ্রেষ্ঠ
ও ত্যাগকারী এই হোতার দ্বিতীয় ভ্রাতা বিদ্যুৎ। তার তৃতীয় ভ্রাতা
ঘৃতপৃষ্ঠ। এখানে বিশ্বস্রষ্টা তাঁর সপ্তপুত্র নিয়ে অবস্থান করছেন।
এই
হোতার দ্বিতীয় ভ্রাতা বিদ্যুৎ যে আবাহনযোগ্য। যে শ্রেষ্ঠ। যে
সন্মানীয়।ভ্রাতা ভ্র ধাতু হতে উৎপন্ন যার অর্থ গ্রহণ। ভ্রাতা পিতৃপ্রদত্ত
ধনের ভাগ গ্রহণ করেন। অথবা ভ্রাতা কে ভরণপোষণ করতে হয়। তার তৃতীয় ভ্রাতা
ঘৃতপৃষ্ঠ অগ্নি। অতঃপর আমি বিশ্বের প্রভু কে তার সপ্তসন্তানসহ দর্শন করি।
অথবা সপ্তমসন্তানসহ দর্শন করি। অথবা সর্বত্রব্যাপী সন্তানসহ দর্শন করি।
সপ্ত একটি বর্ধিত সংখ্যা। নিরুক্তকারের অভিমত, সূর্য সপ্তরশ্মি বিশিষ্ট।
অতএব রুদ্রের আট নাম বা তিন নাম সবক্ষেত্রে ই বৈশিষ্ট্য অগ্নির সাথে মিলে যায়।
এত মিল থাকার পর দেবপক্ষে রুদ্র অগ্নি ছাড়া আর কি হতে পারে?
সারমর্মঃ
বেদের এক মন্ত্রের একাধিক ভিন্ন ধরনের অর্থ সম্ভব। আধিভৌতিক অর্থে রুদ্র
সেনাপতি, বৈদ্য, মেঘ প্রভৃতি। এবং আধ্যাত্মিক অর্থে রুদ্র হল অগ্নি, কোনো
পৌরাণিক দেবতা নয়।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি