প্রায়ই আপনার মুসলমান বন্ধুদের কাছে
আপনাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি
হতে হয় – হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে
ফেলে? কবরও তো দিতে পারতো বা
অন্যকিছু করতে পারতো। পুড়িয়ে
ফেলা কি অমানবিক নয়?
আপনাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি
হতে হয় – হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে
ফেলে? কবরও তো দিতে পারতো বা
অন্যকিছু করতে পারতো। পুড়িয়ে
ফেলা কি অমানবিক নয়?
আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা প্রশ্নটির
সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হই। প্রথমে যে
ইনফরমেশনটি আপনার জানা প্রয়োজন তা
হলো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ
হিন্দু-বৌদ্ধ রীতি অনুসরণ করে অর্থাত
মৃতদেহ পুড়িয়ে সৎকার করে।
পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপান
থেকে শুরু করে চীন, কুরিয়া, ভারত
অন্যান্য জাতি এই রীতি অনুসরণ করে।
তাহলে আপনি প্রথমত: পাল্টা প্রশ্ন করতে
পারেন :
১. পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপানিরা কি
তাহলে অমানবিক ? পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ
কি অমানবিক ? যদি এই অর্ধেক মানুষ অমানবিক
হয় তবে এদের মধ্যে কেন আমরা
সবচেয়ে কম হানাহানি দেখতে পাই ?
আসুন এবার প্রকৃত উত্তরের দিকে যায়।
১. হিন্দুধর্মে কবর দেয়া বা সমাধি দেয়া
নিষিদ্ধ নয়। স্মৃতিশাস্ত্রে স্পষ্টভাবেই এটা
অনুমোদিত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে
এখনও এটা প্রচলিত আছে। যেমন- নাথ বা
যোগী সম্প্রদায় এবং সন্ন্যাসীদেরকে
সমাধি দেয়া হয়। অনেক জায়গায় দেখা যায়
কারও অপমৃত্যু হলে তার শব সমাধি দেয়া হয়,
পোড়ানো হয় না।
২. আমরা কথ্য ভাষায় ‘লাশ পোড়ানো’ বলি,
কিন্তু শাস্ত্রীয় ভাষায় এটা ‘অন্ত্যেষ্টি
ক্রিয়া’। এটা আবার কী? অন্ত
+ইষ্টি=অন্ত্যেষ্টি। ইষ্টি মানে যজ্ঞ।
অন্ত্যেষ্টি হলো জীবনের শেষ
যজ্ঞ।
আমরা জানি, আমাদের সুপ্রাচীন
পূর্বপুরুষদের বৈদিক সমাজ ছিল যজ্ঞপ্রধান।
জীবনের শুরু ‘গর্ভাধান’ থেকে
জীবনের শেষ ‘দেহত্যাগ’ সবই হতো
ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে। জীবৎকালে
প্রতিদিনই পঞ্চমহাযজ্ঞ করতে হতো
(এখনও করার বিধান)। এছাড়া অগ্নিহোত্র
যজ্ঞের মতো বিবিধ যজ্ঞে ঈশ্বরের
উদ্দেশ্যে ‘হবি’ (বর্তমানে পূজায় অর্ঘ্য
নিবেদনের মতো) উৎসর্গ করা হতো।
এ হলো ঈশ্বরের দেয়া জীবন ও দেহ
দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রকৃতির উপাদানসমূহ
ভোগ করার প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের
উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতাপূর্বক তাঁর উপাসনা
করা। তাই অন্ত্যেষ্টি তথা জীবনের শেষ
যজ্ঞে ঈশ্বরপ্রদত্ত এই দেহখানি
ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই ‘হবি’ বা অর্ঘ্যরূপে
উৎসর্গ করা হয়। এটা সত্যিই চমৎকার একটা
ব্যাপার!
৩. প্রাচীন দর্শন অনুযায়ী বিশ্বচরাচর তথা
আমাদের দেহও পাঁচটি ভূত বা উপাদান দ্বারা তৈরি।
একে ‘পঞ্চভূত’ বলে। এগুলো হলো-
ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ
(বাতাস), ব্যোম (আকাশ বা শূন্যস্থান)। যারা
বলেন ‘মাটির দেহ’ বা দেহ শুধু মাটি দিয়ে
তৈরি, তাই একে মাটির সাথেই মিশিয়ে দেয়া
উচিৎ, তারা অবশ্যই ভুল বলেন। বাস্তবে
দেহ এই পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। শবদাহ করার
মাধ্যমে দেহকে এই ৫টি উপাদানেই
মিশিয়ে দেয়া হয় প্রত্যক্ষভাবে। দাহ
শেষে অবশিষ্টাংশ জলে বিসর্জন দেয়া
হয়। এজন্য শ্মশান সর্বদাই জলাশয়ের পাশে
হয়ে থাকে।
অপরদিকে সমাধি বা কবর দিলে দেহ
পঞ্চভূতে লীন হয় বটে, তবে
পরোক্ষ ও ধাপে ধাপে। কারণ দেহ মাটির
সাথে মেশে পঁচন প্রক্রিয়ায়। কোটি
কোটি অনুজীব, পোকা-মাকড়ের খাবারে
পরিণত হয় দেহ। এভাবে পঁচে গলে
মাটিতে মেশানোই বরং দাহ করার চেয়ে
বেশি অমানবিক মনে হয়।
একটা মজার তথ্য দিই। অনেক সময় আমরা
বলি, লোকটা তো মরে ভূত হয়ে
গেছে। প্রকৃতপক্ষে সে প্রকৃতিতে
(পঞ্চভূতে) লীন হয়েছে -এটাই বুঝতে
হবে।
৪. মৃত্যু হয় দেহের; আত্মার নয়। অবিনাশী
আত্মা অজর, অমর, অক্ষয়, অব্যয়। এটা
জগদীশ্বর পরমাত্মার অংশ। (‘বিদ্রোহী’
কবিতার কয়েক লাইন মনে পড়ে কি?) জড়
প্রকৃতির পঞ্চভূতে গড়া দেহ ফিরে যায়
পঞ্চভূতে, আর জীবাত্মা ফিরে যায়
পরমাত্মাতে। (মৃত্যুর পরে অবশ্যই আর
কখনোই আপনি পুরনো দেহে ফিরে
আসবেন না, বা কোন প্রকার শাস্তি/আজাব
ভোগ করবেন না। শবদাহ করার পরে/
মাটিতে মিশে যাওয়ার পরে নিশ্চয়ই লীন
হওয়া দেহকে শাস্তি/আজাব যৌক্তিকভাবে
সম্ভব নয়। )
৫. মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শোকের কোন
ব্যাপার নয়। তীর্থস্থান বেনারস বা
কাশীতে মৃত্যুও একটা উৎসবের ব্যাপার।
“জাতস্য হি ধ্রুবর্মৃত্যো ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য
চ”-গীতা।
যে জন্মেছে তার মৃত্যু নিশ্চিত, যে
মরেছে তার জন্মও নিশ্চিত।
অতএব, দেহান্তরের নিছক সাধারণ ঘটনায়
শোক কেন? বরং জরাজীর্ণ
রোগশোকে আক্রান্ত দেহ ছেড়ে
জীবাত্মার নতুন সুস্থ-সুন্দর দেহে
জীবন আরম্ভের প্রাক্কালে মৃতকে
হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানানোই উচিত।
©বাংলাদেশ অগ্নিবীর