আমরা সবাই পড়েছি,শুনেছি এবং সিরিয়ালে দেখেছি যে শ্রীরাম তাঁর স্ত্রী যাকে আমরা মাতা সীতা বলে শ্রদ্ধা করি তাঁর সতীত্ব নিয়ে সন্দেহ করেছিলেন এবং তাঁকে অমানবিকভাবে আগুনে ঝাপ দিতে বলেছিলেন।কিন্তু মা সীতা তো আর নিজ ইচ্ছেতে অপহৃত হননি!তাহলে এখানে তাঁর তো দোষ ছিলনা কোন।এ নিয়ে "রামের মতিভ্রম", " রামের সুমতি" সহ বিভিন্ন কটুকথা বামপন্থী, অহিন্দু এমনকি খোদ হিন্দুরাও আমাদের প্রাণপুরুষ শ্রী রামচন্দ্রকে নিয়ে বলেন।কিন্তু মজার বিষয় হল এই অগ্নিপরীক্ষা নামক বিষয়টি মূল রামায়ণের অংশ ই নয়,অগ্নিপরীক্ষা নামক কাল্পনিক গল্পটি কখনো ঘটে ই নি।আর কিভাবে ভারতের অপর একটি পাণ্ডুলিপি গবেষণা সংস্থা বরোদা ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট এই অসাধারণ আবিস্কারটি করল তাই আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
বরোদা ইন্সটিটিউট এর গবেষকগণ সারা ভারত,নেপাল খুঁজে প্রাচীন ৮৬ টি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যেগুলোকে তাঁরা ৩৭ টি আলাদা শ্রেণীতে ভাগ করে চালিয়েছিলেন মূল রামায়ণ খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা।আর এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো পাণ্ডুলিপি ছিল নেপালের কাঠমুন্ডুর বীর গ্রন্থাগারে পাওয়া নেওয়ারি লিপিতে লেখা তালপাতার পাণ্ডুলিপি।পাণ্ডুলিপিতেই লেখা ছিল বিখ্যাত পণ্ডিত শ্রী শ্রীকরের ছেলে শ্রী গোপথ এই পাণ্ডুলিপিটি ১০২০ সালের আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী তিথিতে সম্পাদনা করা সমাপ্ত করেন।মজার বিষয় হল আমরা এখন যে বাল্মিকী রামায়ণ পড়ি তাতে প্রথম খণ্ড আদিকাণ্ডে ৭৭ টি অধ্যায় থাকলেও এই পাণ্ডুলিপিতে আদিকাণ্ড মাত্র ৬১ অধ্যায় যুক্ত।সমসাময়িক অনেক পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে যাতে আদিকাণ্ডে মাত্র ৪৯ টি অধ্যায়ও রয়েছে!অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন আগের কথা বাদ দিলেও গত মাত্র ১০০০ বছরের মধ্যেই প্রচুর পরিমাণে প্রক্ষিপ্ত কথা,প্রক্ষিপ্ত অধ্যায় রামায়ণে ঢুকানো হয়েছে যা মহর্ষি বাল্মিকী লিখিত মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের প্রকৃত জীবনী "বাল্মিকী রামায়ণ" এ ছিলনা।ইতিমধ্যেই গবেষণকগণ প্রমাণ করেছেন যে রামায়ণ ৭ কাণ্ড বলে আমরা জনসাধারণ জানলেও আসলে প্রকৃত বাল্মিকী রামায়ণ ৫ কাণ্ডের,প্রথম কাণ্ড আদিকাণ্ড ও শেষকাণ্ড উত্তরকাণ্ড আসলে বাল্মিকী রামায়ণের অংশ ই নয়,এগুলো গত ১-২ হাজার বছরে লিখা কিছু গল্প মাত্র,শ্রী রামচন্দ্রের প্রকৃত জীবনীতে এসবের কিছু ঘটেনি।
এখন কিভাবে গবেষণকরা বের করলেন অগ্নিপরীক্ষা একটি গল্প মাত্র,এটা মূল রামায়ণে ছিলনা?
আদি রামায়ণ কেমন ছিল তা স্তরে স্তরে কিছু প্রমাণ এর মাধ্যমে গবেষণকরা নির্ণয় করেন।এই উৎস হল রামায়ণ লিপিবদ্ধ করার পূর্বকালের এবং সমসাময়িককালের লিখিত অন্যান্য কিছু বই যাতে রামায়ণের ঘটনা বিবৃত করা ছিল।এই বইগুলোর রামায়ণ অংশের সাথে তুলনা করে বোঝা যায় যে কিভাবে পর্যায়ক্রমে রামায়ণকে বিকৃত করা হয়েছিল।
স্তর ১- এই রামায়ণের পাণ্ডুলিপিগুলোর অনেক আগেই লিখা মহাভারতের বনপর্ব ৩.২৫৬-২৭৬ এবং ৩.১৪৭ এ রামায়ণের মূল কাহিনীসার লেখা রয়েছে যা রামোপাখ্যান নামে খ্যাত।(খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকের)
স্তর ২- হরিবংশ,প্রথম খণ্ড,৪১ তম অধ্যায়
(খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় শতক )
স্তর ৩- বিষ্ণু পুরাণ চতুর্থ খণ্ড,চতুর্থ অধ্যায়
(৩-৫ শতক)
স্তর ৪- অগ্নি পুরাণ, অধ্যায় ৫,(৭-১২ শতক)
স্তর ৫- পদ্ম পুরাণ পাতাল খণ্ড, অধ্যায় ৩৬
(৪-১০ শতক)
স্তর ৬- স্কন্দ মহাপুরাণ, অধ্যায় ৩০, (৮-১২ শতক)
এবং সবশেষে রামায়ণ এর পাণ্ডুলিপি।আমরা একদম প্রথমে আজ থেকে ২৫০০ বছর আগের মহাভারতে লিখা রামোপাখ্যান যদি দেখি তাহলে ৩.২৭৫.১৩ এ দেখতে পাই সেই আদি রামায়ণে অগ্নিপরীক্ষা বলে কিছু নেই!
শ্রীরাম যখন ভয় পাচ্ছিলেন যে প্রজারা সীতাকে নিয়ে যদি খারাপ কথা বলাবলি করে তখব কি হবে।সেখানে বলা হচ্ছে অগ্নি,বায়ু,কুবের সকলে মিলে রামের অন্তরে বললেন সীতা পবিত্র,তাকে নিয়ে সুখে রাজত্ব কর।৩.২৭৫.২৬ এও স্পষ্ট বলা হচ্ছে "বায়ু এসে রামের কানে কানে বললেন সীতা পবিত্র,তাকে নিয়ে সুখে রাজত্ব কর।" অর্থাৎ রূপকার্থে নিজের বিবেক ই রামচন্দ্রকে বলেছিল কারো এসব কথা কানে না নিতে।
দেখা গেল একমাত্র খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের পরে পাওয়া স্তরের গ্রন্থগুলোতেই এই অগ্নিকুণ্ডে সীতার ঝাঁপ দেয়ার কথা পাওয়া যায়।এর পূর্বের স্তরে অগ্নিপরীক্ষা বলে কোন কিছু রামায়ণে লেখা ছিলনা।এ থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায় যে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের পরেই এই জনপ্রিয় গল্পটি রামায়ণকে আরও আকর্ষণীয় কাব্য করে তুলবার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল যা মূল রামায়ণে ছিলনা।
আরও বেশ কিছু মজার তথ্য পাওয়া যায় পাণ্ডুলিপি পর্যবেক্ষণ থেকে।যেমন ধরুন বর্তমান রামায়ণে আমরা দেখি কুম্ভকর্ণ রামের হাতে নিহত হয়েছিলেন,কিন্তু মূল রামায়ণে তিনি আসলে লক্ষ্মণের হাতে বধ হয়েছিলেন।আমরা বর্তমানে জানি রাবণের ভাই বিভীষণ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন কিন্তু মূল রামায়ণ অনুযায়ী শুধু বিভীষণ ই নয় বরং রাবণের অন্যতম মন্ত্রী অবিন্ধ্যও শ্রী রামের পক্ষে ছিলেন।রাবণ যখন "রাম নিহত হয়েছে" এই মিথ্যা তথ্য দিয়ে সীতার মনোবল ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন তখন এই অবিন্ধ্য ই সীতার কাছে আসল সত্য ফাঁস করে দেন।এছাড়া পরাজয় নিশ্চিত জেনে রেগেমেগে রাবণ যখন মা সীতাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন তখন এই অবিন্ধ্য ই রাবণকে আঁটকিয়েছিলেন এই বলে যে "নারীর গায়ে হাত তুলা ক্ষত্রিয়ের অধর্ম"।অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যাক্তিকে বর্তমান হিন্দু সমাজে কেউ চিনেইনা!আর চিনেই বা কি হবে!ধর্মের পক্ষে থাকায় আমরা তো বিভীষণকে " ঘরশত্রু" বলেই ডাকি বর্তমানে!কেন বিভীষণ বর্তমান হিন্দুদের মত চরিত্রহীন ছিলেন না এটাই বোধহয় তার দোষ!
আরও চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায় মহাভারতের বনপর্বের রামোপাখ্যান থেকে,আমরা বর্তমানে জানি যে ঋষি বিশ্বামিত্র রাম ও লক্ষ্মণকে নিয়ে গিয়েছিলেন রাক্ষস মেরে যজ্ঞ নষ্ট হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে।সেখানে অনেক মাথাওয়ালা রাক্ষস,কেউ উড়ে আসছে,কেউ বিভিন্ন জাদু দিয়ে যুদ্ধ করছে এ ধরনের অদ্ভুত কাল্পনিক কাহিনী পাওয়া যায়।কিন্তু মূল রামায়ণ অনুযায়ী এগুলো নিতান্তই গল্প,মূলত বিশ্বামিত্র একজন ঋষি হলেও তিনি ছিলেন বিখ্যাত একজন অস্ত্রবিদ আর তিনি শ্রীরাম ও ভ্রাতা লক্ষ্মণকে নিয়ে গিয়েছিলেন অস্ত্রবিদ্যা শেখাতে!
অর্থাৎ আমরা একদম একনজরে দেখলে দেখতে পাই রামায়ণে যেসকল অদ্ভুত,আজগুবি কাল্পনিক কাহিনী দেখে আমরা মনে করি রামায়ণ আসলে গল্প,সত্যি ঘটনা নয় সেইসব আজগুবি কাহিনী আসলে মূল রামায়ণে নেই ই!মূল রামায়ণ বাস্তবসম্মত,শ্রী রামচন্দ্রের প্রকৃত জীবনী যেখানে একজন সত্যবাদী, প্রজাদরদী,ধার্মিক ও বীর রাজা কিভাবে শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কখনো ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হননি সেই ইতিহাস ই তুলে ধরা হয়েছে।মূল রামায়ণে শ্রী রাম কোন অগ্নিপরীক্ষা দেননি,মা সীতার কোন বনবাস হয়নি,হনুমানরা আসলে লেজয়ালাও প্রাণী হনুমান ছিলনা বরং দক্ষিণ ভারতের এক উপজাতি গোষ্ঠী ছিল,হনুমান এক লাফে উড়ে নয় বরং ব্রজেন দাস যেভাবে ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ইংলিশ চ্যানেল পারি দিয়েছিল ঠিক তেমনি ইংলিশ চ্যানেলের চেয়ে অনেক অনেক ছোট মাত্র ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-শ্রীলংকার মধ্যেকার পক প্রণালী জলযানে বা সাতার কেঁটেই তিনি পারি দিয়েছিলেন।আর কাজটা আরও সোজা হয়ে গিয়েছিল
সমুদ্রপথের মাঝখানে বেশ কয়েকটি ভাসমান দ্বীপ থাকায় যাতে তিনি যাত্রাবিরতি ও বিশ্রাম নিতে পেরেছিলেন।
প্রকৃত রামায়ণ জানুন,না জেনে রামায়ণকে গল্প মনে করে শ্রী রামকে নিয়ে কটুক্তি করবেন না,তিনি এমনি এমনি মর্যাদা পুরুষোত্তম তথা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হননি,তৎকালীন সময়ে যখন ছিলনা কোন মোবাইল,ইন্টারনেট বা প্রচার মাধ্যম তখনও অসাধারণ চরিত্রবলেই ভারত,
পাকিস্তান,বাংলাদেশ,শ্রীলংকা,আফগানিস্তান,
মালয়েশিয়া,ইন্দোনেশিয়া,লাওস,থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া,ভিয়েতনাম,চীন,জাপান পর্যন্তও তাঁর খ্যাতি বিস্তৃত ছিল যা ওই দেশগুলোর প্রাচীন ইতিহাস ও সাহিত্য গ্রন্থেই পাওয়া যায় এখনো!একজন ব্যাক্তি কতটা অসামান্য হলে সেই প্রাচীন যুগেও পুরো একটা মহাদেশজুড়ে এত বিখ্যাত হওয়া সম্ভব তার প্রমাণ হলেন ইক্ষাকু বংশজাত সনাতন সভ্যতার প্রাণপুরুষ শ্রী রামচন্দ্র।
জয় শ্রী রাম
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
Khub sundor""Sotto bolar jonno thanks
ReplyDeleteEi topic er bisoy age jantam na. Thanks
ReplyDelete