সেক্যুলার হিন্দু কিভাবে হয়?
বাঙালী ঐতিহ্যগতভাবে মননে ও চিন্তায় সেক্যুলার এবং সংস্কৃতিমনা। বাঙ্গালি হিন্দু বঙ্কিমের আনন্দমঠ বা রাজসিংহ অথবা ঈশ্বরগুপ্ত না পড়লেও সকলে রবীন্দ্রনাথ পড়েছি। আর রবীন্দ্রনাথ বাঙালীকে উন্নত করেছে, বিশ্বমানব করেছে। রবীন্দ্রনাথ এর কারনে আজ বাঙালী উন্নত এটা অনস্বীকার্য। কিন্তু সমস্যা হলো উন্নত মানুষ অসভ্যের সাথে লড়তে পারে না। জীবক প্রাচীন অবৈদিক সাহিত্যে বলেছিলেন, যে পালায় সে বাচে। তাই এই উন্নত বাঙালী পালায় শুধু বাঁচার জন্য। কখনো কলকাতায়, কখনো আন্দামানে, কখনো দন্ডকারণ্যে, কখনো মরিচঝাপিতে। অনেকসময় বাঁচতেও পারে না। মরে যায়। কিন্তু লড়াই করতে পারে না।
কেন লড়াই করতে পারে না?
কারন আমরা মননে উন্নত। আমরা ছোটবেলায় বীরপুরুষ কবিতা পড়লেও আত্মস্থ করেছি প্রেমিক অমিতকে। পূজা পর্ব আর প্রেম পর্বের গান আমাদের আধ্যাত্মিক চিন্তা ও ঈশ্বরভক্তি, মানবপ্রেম জাগালেও লড়াই করার মনোবৃত্তি জাগ্রত করেনি। এরপর পড়েছি জীবনানন্দ। মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে যা আমাদের অন্তর স্পর্শ করে। সেখান থেকে আমরা চলে যাই শহরের উষ্ণতম দিনের প্লেটোনিক ভাবালুতায়। এছাড়া হুমায়ুন আহমেদ পড়েছি সাহিত্য হিসেবে। আমরা অনেক পড়েছি। শ্যামাসংগীত হয়তো শিখেছি, গেয়েছিও কিন্তু রামপ্রসাদি ও নজরুল দুটোতে বিভেদ করিনি। কারন আমরা শিখেছি লেখকের ধর্ম হয়না। ওরা কিন্তু লাল পিপড়া, কালো পিপড়াতেও ধর্ম খোঁজে।
এখানে একটা সভ্যতার সংকট তৈরি হয়ে গেছে।
আমরা মনে করি নজরুল শ্যামাসংগীত লিখেছে, কিন্তু ওরা দেখায় নজরুল প্রমীলা দেবিকে বিয়ে করেছে। শ্যামা সংগীত লিখে যদি হিন্দু বিয়ে করা যায় তাতে দোষ কি, দিনশেষে অন্যধর্মের ই তো লাভ সংখ্যায় লাভ,আত্মতুষ্টিতেও। আমরা রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ পড়ে বিশ্বমানব হই। আমাদের শিল্পীরা তপন মাহমুদ (ভট্টাচার্য থেকে), অনিমা রায়, রন্টি দাশ, কুমার বিশ্বজিৎ, সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর সুমন, সকলেই প্রকাশ্যে বা গোপনে ধর্মান্তরিত হয় কিন্তু কোন অহিন্দু শিল্পী হিন্দু হয়না। আমাদের ৯০% হিন্দু মিডিয়াব্যক্তিত্ব গোপনে বা প্রকাশ্যে নামে হিন্দু হলেও কর্মে ও চিন্তায় অহিন্দু। মিডিয়াব্যক্তিত্ব ছাড়াও সংস্কৃতিমনা অনেকেই মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান জপে অন্য বৃন্তে গমন করে।
কারণ কি?
অনেক কারণ আছে। তবে মোটাদাগে বলা যায় আমাদের ছোটবেলা থেকে শিখে আসা সেক্যুলার শিক্ষা, সংস্কৃতি আমাদেরকে নিজের অস্তিত্ব, সত্ত্বা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এই সভ্যতার সংকট থেকে উত্তরণের উপায় আমাদেরই খুজতে হবে।
একটা উপায় হতে পারে কেবল বিশ্বমানব না হয়ে বাঙালী হিন্দু সত্ত্বাটাকেও একইসাথে ধরে রাখা।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
অনেক সেক্যুরা বলতে পারে, বাঙালীর মধ্যে বিভেদ কেন? আমরা সবাই বাংলায় কথা বলি, বাঙালী।বিশেষ করে কলকাতার আত্মীয়স্বজনেরা যারা তাড়া খেয়ে পালিয়েছিল তারা এই জ্ঞানী বয়ান দেন। আমরাও রবীন্দ্রসংগীত গাই, তারাও গায়। তাহলে পার্থক্য কি?
উত্তর হল, ভাষা দিয়ে যদি জাতিসত্ত্বা নির্ধারিত হতো তাহলে সার্বিয়ান ভাষায় কথা বলা এক তৃতীয়াংশ বসনিয়ান স্বাধীনতা চাইতো না। তাদের ভাষা এক হলেও জাতিসত্ত্বা ভিন্ন। বসনিয়ানদের খাদ্যাভ্যাস ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, ইতিহাস ভিন্ন। শুধু কিছু অংশের ভাষা সার্ব। তাই বলে তারা সার্বিয়ান হননি। স্কটিশরা যেমন ইংরেজির একটা ডায়ালেক্ট বললেও নিজেদের ইংরেজ বলে না, স্কটিশ বলে। আইরিশরাও তাই। তাদের ধর্ম যদিও এক। ঠিক যেরকম আমি ইংরেজি বলতে পারি বলেই ইংরেজ হয়ে যাই না।
তাই ভাষা দিয়ে জাতীয়তা যাচাই করা মুর্খামি।
চলবে...
বিজয় সিংহ