দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







মহাকালের গল্পে গল্পে মানব বিবর্তনের ইতিহাস; পর্ব ৪

Arindam
2





 যোৎযং সন্দৃশ্যতে নিত্যং লোকে ভূতক্ষয়

প্রতিনিয়তই এই লোকে বয়ে চলেছে ধ্বংসলীলা


আজ থেকে প্রায় ৬.৬ কোটি বছর আগের কথা।তখন পৃথিবীতে চলছে ডাইনোসরদের রাজত্ব। সে যেমন তেমন কথা নয় কিন্তু,এক প্রকাণ্ড ব্যাপার! সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের নতুন একটি প্রজাতি তালিকাভুক্ত করেছেন।কুইন্সল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রথম এই প্রজাতির কঙ্কাল পাওয়া যায়।ডাইনোসরের নতুন এই প্রজাতির নাম দেওয়া হয়েছে অস্ট্রালোটাইটান কুপারেনসিস বা দ্য সাউদার্ন টাইটান।এতদিন শুধুই দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যেত এমন ডাইনোসর, যাদের Titanosaurs বলা হয়, তাদের গোত্রেই পড়ল এই নতুন আবিষ্কৃত ডাইনোসর।Titan শব্দের অর্থ বৃহৎ,শক্তিশালী।গ্রীক মিথোলজিতে শক্তিশালী ১২ জন টাইটান দেবতার নাম হতে এই টাইটান নামের উৎপত্তি। শনিগ্রহের উপগ্রহ অন্যান্য সকল উপগ্রহের চেয়ে বড় বলে এর নাম Titan. অত্যন্ত শক্তিশালী ও বৃহৎ বলেই Titanic জাহাজের এই নামকরণ।


তাহলে বুঝতেই পারছেন যে ডাইনোসরের নাম Titanosaur তা কত বড় আর শক্তিশালীই না হবে! এদের আকার ছিল একটি বাস্কেটবল কোর্টের  সমান। ব্যাখ্যা করলে এর উচ্চতা দাঁড়ায় সাড়ে ৬ মিটার (প্রায় ২১ ফুট) ও দৈর্ঘ্য ৩০ মিটার (প্রায় ৯৮ ফুট)! এদের ওজন কত হতো গড়ে জানেন? প্রায় ১০০-১১০ টন আর ১ টন কিন্তু প্রায় ১০০০ কেজির সমান! একবার ভেবে দেখুন কত বিশাল ছিল এই প্রাণীগুলো আর আজ থেকে ৬.৬ কোটি বছর ধরে এরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল পৃথিবী। তখন মানুষ তো দূরে থাক মানুষের কাছাকাছি দেখতেও কোনকিছুর ই অস্তিত্ব ছিলনা।শুধু একদম প্রাচীন কিছু Mammal বা ইঁদুরের মতো দেখতে কয়েক প্রজাতির ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল যার একটি হলো Megazostrodon.  আর ডাইনোসররা বেঁচে থাকলে এই প্রজাতি বা কোন প্রজাতিই পৃথিবীতে তেমন টিকতে বা প্রভাব বিস্তার করতে পারতনা।কারণ ডাইনোসরের মতো এতবড় বিশাল খাদক প্রাণীরা থাকতে অন্য প্রজাতির কোন সুযোগ ই নেই! তাহলে মানুষ নামক প্রজাতিটি কী করে এই পৃথিবীতে এলো? এখানেই উলটে গেল এক পাশার দান।


বিশালাকার সব প্রভাব বিস্তারকারী ডাইনোসর,আর তাদের কাছ থেকে অনেক কষ্টে প্রাণ টিকিয়ে চলা ছোট ছোট ইঁদুর আকৃতির Mammal বা স্তন্যপায়ী প্রাণী Megazostrodon, কী ঘটবে Megazostrodon এর ভাগ্যে? শেষ পর্যন্ত প্রকাণ্ড খাদক ডাইনোসরের পেটের খাবার হতে হতে হয়তো একসময় বিলুপ্তই হয়ে যাবে তারা।আর একবার সেই ইঁদুরের মতো দেখতে প্রাচীন স্তন্যপায়ী প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেলে সব শেষ,আজকের দিনের আমাদের পরিচিত প্রায় সব প্রাণী গরু,ছাগল,হাঁস,মুরগী,বানর,হনুমান,গরিলা,

শিম্পাঞ্জি, কুকুর,বিড়াল,আমরা সবাই ই তো স্তন্যপায়ী বা Mammal, সেই প্রাচীন ও একমাত্র স্তন্যপায়ীগুলো যদি ডাইনোসরের প্রবল প্রতাপে বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আমাদের এই জগতে আসার আর কোন উপায় ই থাকবেনা! আর হয়তোবা হতোও তাই,কিন্তু প্রকৃতি বড় বিচিত্র!


আজ থেকে ৬.৬ কোটি বছর আগে হঠাৎ একদিন,মেক্সিকো উপসাগর তীরবর্তী ইউকাটান উপদ্বীপ এলাকা,সব শান্তশিষ্টভাবে চলছিল।অকস্মাৎ এক প্রকাণ্ড দূর্যোগ এসে উপস্থিত হলো।মহাশূন্যে ঘুরতে থাকা বিশালাকৃতির একটি গ্রহাণু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির সীমানায় চলে এলো,আর ব্যস! প্রবল গতি নিয়ে তা ছুটে আসতে লাগল পৃথিবীর দিকে! বিশালাকৃতি সেই উল্কার ব্যাস ছিল প্রায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার।প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসার ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে এটি পরিণত হলো জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে।ভেবে দেখুন প্রায় ১৫ কিলোমিটার আকৃতির হাজার হাজার কিলোমিটার গতিতে ছুটে আসা এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড পৃথিবীর গায়ে আঁছড়ে পড়ল!গবেষকরা বলছেন, এত জোরে এটি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল যে তাতে ২০০ কিলোমিটার চওড়া এবং ২০ কিলোমিটার গভীর একটি গর্ত বা জ্বালামুখ তৈরি হয়েছিল।

মেক্সিকো উপকূলে সৃষ্ট সেই প্রচণ্ড জ্বালামুখ,চিকশুলুব খাদ নামে পরিচিত




খোলা জায়গায় থাকা হাজার হাজার ডাইনোসর এবং অন্যান্য প্রাণী এই আগুনে সে সময় জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বৃক্ষরাজি। গ্রহাণুর আঘাতের ফলে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। দেখা দেয় সুনামি। বৃক্ষ হারিয়ে যায়, পৃথিবী হয়ে পড়ে প্রায় প্রাণশূন্য। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়,পরিবেশে বাড়তে থাকে আগুনের দহন থেকে উৎপন্ন বিশাক্ত গ্যাস,অক্সিজেন কমতে থাকে, দেখা দেয় চরম খাদ্যাভাব। জীবন হয়ে পড়ে দুঃসহ। বিশাল এই প্রাণীগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্য দরকার, সেটা সেই সময়ে ছিল না। এই অসহনীয় পরিবেশে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেল অতিকায় এই প্রাণীটি,শুধু তারাই নয়,তৎকালীন সময়ে পৃথিবীতে থাকা প্রায় ৮০ শতাংশ প্রজাতি ই ওই এক বিশাল গণবিলুপ্তিতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আর এই গণবিলুপ্তি কিন্তু ১-২ দিনে হয়নি,লেগেছিল সহস্র সহস্র বছর!এই গণবিলুপ্তি Cretaceous যুগের সমাপ্তি ঘটায় আর শুরু করে Mesozoic যুগের যার প্রথম ভাগের নাম Paleozene,আর তাই এই গণবিলুপ্তিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় Cretaceous-Paleogene Extinction Event. বড় ঝড়ে সবসময় বড় গাছ উপরে পড়ে,ছোট গুল্ম টিকে যায়,এখানেও তাই হলো।প্রায় ১০৭৮ টি ভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসর সহ ৮০ শতাংশ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে। তম আসীত্তমসা,নেমে এলো যেন ঘন অন্ধকার।


কিন্তু অনন্ত প্রকৃতি কখনো থেমে থাকেনা। আকৃতি ছোট হবার কারণে টিকে গেল কিছু প্রজাতি, আর তাদের একটিই এই নতুন Paleogene যুগের নতুন রাজা হিসেবে আবির্ভূত হলো। কোন সেই প্রজাতি? হ্যাঁ, একটু আগেই যাদের কথা বলছিলাম, Mammal বা স্তন্যপায়ীরা!যারা এতদিন ডাইনোসরের দাপটে ছিল ভীত,সন্ত্রস্ত,দূর্বল,ছোট এবার তাদের রাজত্বের পালা। এবার শুরু হবে আসল কাহিনী।


Early Mammals যেমন Morganucodontids, Megazostrodon, সেই ২১ কোটি বছর আগে থেকে যারা ডাইনোসরের ভয়ে, প্রবল রাজত্বে ছোট ইঁদুরের আকারে ঘুরে বেড়াত অগোচরে প্রাণভয়ে, ডাইনোসরদের বিলুপ্তিতে তারা এখন সুযোগ পেয়ে গেল।আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল Mammals বা স্তন্যপায়ীদের সংখ্যা।


একদম স্থুলভাবে বললে Mammals বা স্তন্যপায়ীদের ৩ টি গ্রুপ, Eutheria,Metatheria এবং Monotreme যা গতপর্বেও আপনাদের বলেছি।আমরা হলাম Eutheria গোত্রের যাদের মায়ের গর্ভে তথা জরায়ুতে অমরা বা Placenta নামক রক্ষাকবচ থাকে।মহর্ষি কপিলের সাংখ্যদর্শনেও(৫.১১১) প্রজাতিসমূহের এই শ্রেণীবিন্যাস পাওয়া যায়- উষ্ণজাণ্ডজজরায়ুজ... যেখানে অণ্ডজ হলো Monotreme এবং জরায়ুজ হলো Eutheria&Metatheria.


যাই হোক সেই যে ডাইনোসরদের সাথে ছিল স্তন্যপায়ীরা কোনরকমে টিকে, ডাইনোসরের বিলুপ্তির পর দ্রুত বংশবৃদ্ধি কালে এরা অনেকগুলো শাখা প্রশাখায় ভাগ হলো,পাল্টে যেতে লাগল এদের বিভিন্ন শাখার একেকটি প্রজাতির দেহবৈশিষ্ঠ্য থেকে শুরু করে অনেক কিছুই।সবগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করবনা কারণ আমাদের উদ্দেশ্য মানুষ।এই অনেকগুলো শাখা প্রশাখার মধ্যে Eutheria গোত্রের Mammal দের একটি উপশাখা হলো Plesiadapiforms,৬.৬ কোটি বছর আগে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেলে পরবর্তী ১ কোটি বছর ধরে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে দ্রুত সংখ্যা বাড়তে লাগল এদের।৫.৫ কোটি বছর আগের ফসিল রেকর্ডে দেখা গেল ধীরে ধীরে Mammals দের থেকে বিবর্তিত  Proto Primate প্রজাতিদের দেখা পাওয়া শুরু হলো।Mammal আর Primate,এই দুটোর মধ্যবর্তী একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রজাতি বলা যেতে পারে Proto-Mammal দেরকে।এই পর্যায়ে জানতে হবে Mammal আর Primate এই দুইটির মধ্যে পার্থক্য কী।


ডাইনোসরদের বিলুপ্তির পর ব্যপক আকারে বাড়তে থাকে স্তন্যপায়ীরা



আমরা সাধারণভাবে মনে করি Mammal আর Primate শব্দদুটো এক,দুটোর অর্থই স্তন্যপায়ী।আসলে ব্যপারটা তা নয়।অনেক শাখা প্রশাখার মধ্যে Eutheria গোত্রের স্তন্যপায়ী বা Mammal যারা তাদের মধ্যে Primate একটি উপশাখা। কিন্তু Eutheria গোত্রের স্তন্যপায়ীদের দের মধ্যে আরও অনেক শাখা আছে যারা Primate না যেমন Rodents(ইঁদুর, বেজি,প্রেইরি ডগ,গিনিপিগ ইত্যাদি) এরাও Eutheria শাখার Mammal কিন্তু এরা Primate নয়,আলাদা একটি শাখা।


Primate রা কোন কোন শারীরিক দিক থেকে অন্য Mammal দের চেয়ে আলাদা?


  • তাদের পায়ের বুড়ো আঙ্গুল অন্য সব আঙ্গুল থেকে আলাদা এবং বড়।তাদের হাতের বুড়ো আঙ্গুলও অন্য সব আঙ্গুল থেকে বড় এবং বাঁকানো যায় যার ফলে হাত ব্যবহার করেই তারা এক গাছের শাখা থেকে অন্য গাছের শাখাতে লাফ দেবার সময় গাছের শাখা হাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা যায়।
  • Brachiation Movement.এর মাধ্যমে Primate রা Arm Swinging বা হাত কাঁধের জয়েন্টের মধ্যে সহজেই ওঠানামা করতে পারত,ফলে গাছে চড়া সহজ হতো।
  • Stereoscopic Vision, এর ফলে চোখের দৃষ্টির দ্বারা গভীরতা,দূরত্ব নির্ণয় এসব অনেক বেড়ে গেল। প্রাইমেটদের দুটো ভিজুয়াল ফিল্ড থাকে,এটি মূলত বায়োলজি ও মেডিকেল সায়েন্সর বিষয় তাই হয়তো ব্যপারটা বুঝা কঠিন।তবে সহজ ভাষায় বলতে গেলে এর দ্বারা কোন বস্তুর দূরত্ব,ভর,গভীরতা,গতি ইত্যাদি আমরা দৃষ্টির মাধ্যমে অনেক প্রশস্ত রেঞ্জে পরিমাপ করতে পারি এবং 3D ছবি তৈরী করতে পারি মস্তিস্কে। Primate দের Post-Orbital Bar থাকে যা মুখমণ্ডলের Frontal এবং Zygomatic Bone এর বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যমে তৈরী হয় এবং এতে চোখের পজিশনটা সামনের দিকে থাকে যা Stereoscopic Vision এ সহায়তা করে।ডান চোখ ও বাম চোখ একে অপরের ভিজুয়াল ফিল্ডের আলাদা মোট চারটি ক্ষেত্র কভার করে,কিন্তু দেখে কে? চোখ? না।দেখে চোখ হতে পৃথক আমাদের মস্তিস্কের অক্সিপিটাল লোব নামক অংশটি।ন্যায়সূত্রে দার্শনিক অর্থে বলা হলেও খুব অদ্ভূতভাবে একটি শ্লোকের বক্তব্য এই ঘটনাটির সাথে মিলে যায়।সব্যদৃষ্টস্যেতরেণ প্রত্যভিজ্ঞানাৎ,বাম চোখ যা দেখে তা ডান চোখ প্রত্যাভিজ্ঞ করে,আর দৃষ্টির জ্ঞান অনুভূত ও গৃহীত হয় দুইচোখ হতে পৃথক স্থানে,আত্মায়! (ন্যায়সূত্র ৩.১.৭)
  • নখের সৃষ্টি।এর আগে Mammal দের থাকত থাবা, Proto Primate দের উপরোক্ত ৩ টা বৈশিষ্ট্য থাকলে তখনো নখ গজায়নি,থাবা রয়ে গিয়েছিল। Proto Primate থেকে যখন True Primate তৈরী হলো তখন তাদের থাবা নখ দিয়ে স্থানান্তরিত হয়ে গেল। সবচেয়ে আদিম একটি Proto-Primate প্রজাতির নাম হলো Purgatorius,এদের তখনও নখের বদলে থাবা ছিল।


অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে ডাইনোসর যুগের Eutheria Mammal দের একটি শাখা সৃষ্টি হলো যার নাম Plesiadapiformis, সেই Plesiadapiformis এর অনেকগুলো শাখার একটি হলো Proto-Primate বা Primate এর পূর্ববর্তী ধাপটি। এরপর True Primates দেখা দেয়া শুরু করল প্রায় ৫.৩ কোটি বছর আগে।


এই True Primate রা আবার মূলত ২  শাখায় ভাগ হলো-

Strepsirrhines এবং Haplorhines.


এরমধ্যে Strepsirrhines কারা? এদেরকে প্রচলিত ভাষায় বলা হয় Wet Nose. কারণ এদের নাকের সামনের দিকের অংশটায় কোন লোম থাকেনা বলে সেটা ভেজা ভেজা থাকে,এই ভেজা অংশকে বলে Rhinarium. নাকের সামনে লোমহীন এই ভেজা অংশ অবশ্য অন্য কিছু প্রাণীতে থাকে,যেমন বিড়াল।বর্তমানে মাদাগাস্কার দ্বীপে বসবাসকারী লেমুর নামক প্রজাতিটি এই Strepsirrhines এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

Cat Rhinarium



বাকী রইল, Haplorrhines,এরাও আবার দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। একভাগ Simian, একভাগ Tarsiers.


Tarsier গোত্রের প্রাণীদের এখন কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই পাওয়া যায়।একদম ছোট আকারের বৃক্ষচারী প্রাণী এরা।


অন্য গোত্রটি Simian, আর এরাই আমাদের আসল গন্তব্য,আমরা আমাদের পরিচয়ের কাছাকাছি চলে এসেছি অনেকটা।


আজ থেকে প্রায় ৪ কোটি বছর আগে Simian রা দুইভাগ হয়ে একভাগ হলো  Catarrhini, আরেকভাগ হলো Platyrrhiny.


Platyrrhiny শব্দটার অর্থ হলো Flat Nose বা চাপা নাক।এদের নাকের ছিদ্র দুটো দুপাশে তাক করা।এদেরকে প্রচলিত ভাষায় New World Monkey ও বলা হয় কারণ এরা আফ্রিকা থেকে একটা সময় সরু জলপথ পার হয়ে মেক্সিকো,সেন্ট্রাল ও সাউথ আমেরিকার নতুন পৃথিবীতে চলে আসে। সাউথ আমেরিকান Marmoset,Capuchin, Squirrel Monkey,Night Monkey,Wooly Monkey এরা Platyrrhiny গোত্রের বর্তমানে টিকে থাকা বংশধর।এদের Trichromatic Vision বা মৌলিক ৩ রং এর দৃষ্টিচ্ছবি নেই,দাঁতের পাটিতে Premolar দাঁত আছে ১২ টি।


বাকী আরেক গ্রুপ Catarrhini,এখানেই আমাদের পূর্বজদের গোত্র।এদের নাক সরু,নাকের ছিদ্র নিচের দিকে, আছে আজকের আমাদের মতো Trichromatic Vision, আছে আজকের আমাদের মতো ৮ টি Premolar দাঁত।এরা তাদের পূর্বের পুরনো আবাসভূমি আফ্রিকাতেই রয়ে গেল,এজন্য আগের গ্রুপের সাথে তুলনা করে এদের ডাকা হতো Old World Monkey.সবচেয়ে প্রাচীন একটি Catarrhini প্রজাতি হলো Aegyptopethicus


এভাবে আরও অনেক জটিল শাখা প্রশাখা তৈরী হলো লক্ষ লক্ষ বছর ধরে।চলে গেল আরও ১.৫ কোটি বছর।আজ হতে প্রায় ২.৫ কোটি বছর আগে Catarrhini এর Old World Monkey ছাড়াও আরেকটি পৃথক শাখার তৈরী হলো যাদেরকে বলা হয় Ape.তবে তা সরাসরি নয় বরং মধ্যবর্তী Proconsul নামক একটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে। আর এই Ape থেকেই আমাদের সৃষ্টি।খুব জনপ্রিয় একটি অপপ্রচার হলো বানর থেকে নাকি মানুষের সৃষ্টি।আসলে বানরের সাথে মানুষের কোন সম্পর্কই নেই।আমরা একটু আগেই দেখেছি বানর হলো Platyrrhini গোত্রের অংশ,আর আমরা হলাম Catarrhini গোত্রের Ape এর প্রশাখা।


Ape দের থেকে মোট ৪ টি আলাদা গোত্রের সৃষ্টি হলো। ১.৩ কোটি বছর আগে ওরাং ওটাংদের পূর্বজ গোত্র আলাদা হয়ে গেল Ape হতে যার নাম Ponginae, ১.২ কোটি বছর আগে গরিলাদের পূর্বজ গোত্র আলাদা হয়ে গেল আরেকটি শাখা হয়ে যার নাম Gorillae,৭০ লক্ষ বছর আগে শিম্পাঞ্জি ও বোনোবোদের পূর্বজ গোত্ররা আলাদা হয়ে গেল আরও একটি শাখা হয়ে যার নাম Pan। সবেধন নীলমনি হয়ে আরেকটি শাখা অর্থাৎ ৪র্থ শাখা বাকী রইল Ape দের। নামটা শুনে একটু কাছের কাছের লাগবে,মনে হবে যেন পরিচিত নামটা হলো Hominin,আমাদের পূর্বজ এরাই! আর ৭০ লক্ষ বছর আগের সেই সময়কার একটি Hominin প্রজাতি বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন যার নাম Sahelanthropus Tchadensis.


আর এই এক Ape দের থেকেই আমাদের সবার সৃষ্টি বলে ওরাং ওটাংদের সাথে ৯৭ শতাংশ,গরিলাদের সাথে ৯৮.৪ শতাংশ ও শিম্পাঞ্জি-বোনোবোদের সাথে ৯৮.৮ শতাংশ DNA আমাদের একই! আর এজন্যেই ভ্যাক্সিন সহ বিভিন্ন ওষুধ আবিস্কারে এই Ape সহ আমাদের নিকটস্থ প্রাইমেটদের গুরুত্ব অসীম। আমাদের উৎস এক অভিন্ন উৎস হতে বলেই ভ্যাক্সিনসহ বিভিন্ন ওষুধ ট্রায়ালের প্রথম পর্যায়ে এদের উপর প্রয়োগ করা হয় কারণ এদের জিনসহ শারীরবৃত্তীয় প্রায় সবকিছুই আমাদের সাথে হুবহু এক হওয়ায় এদের শরীরের রেসপন্স দেখে আমাদের শরীরে সেই ভ্যাক্সিন বা ওষুধের রেসপন্স এক প্রকার হবে।

Simian বৃক্ষ থেকে Ape এর প্রশাখা বিস্তার

Encyclopedia Britannica তে Ape দের শ্রেনীবিভাগ Illustration 

মানুষের সাথে বিভিন্ন প্রজাতিগুলোর ডিএনএ এর সাদৃশ্যের তুলনা





এবার একটু পেছনে ফিরে যাব আবার। Cretaceous-Paleogene Extinction এর সময় ডাইনোসরসহ অধিকাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, Plesiadipiformes, এর পর Proto-Primate Purgatorius এর মত অতি অল্প কিছু, দেখতে ছোট ইঁদুরের মত স্তন্যপায়ী প্রাণী টিকে গেল, তাদের ই অসংখ্য শাখা প্রশাখার একটি হলো Catarrhini. আগে ইঁদুর আকৃতির সেই Purgatorius রা ছোট ছোট পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকলেও বিশাল সেই গণবিলুপ্তির কারণে প্রাণীজ খাবার একদম কমে যায়, আর তখন ত্রাতারূপে আবির্ভূত হয় উদ্ভিজ্জ ফল। আস্তে আস্তে সেই ইঁদুরের আকারের প্রাণীরা গাছে উঠে পাকা ফল খাবার প্রচেষ্টা করতে থাকে,এভাবে পেরিয়ে গেল লক্ষ কোটি বছর, একটা সময়ে চতুষ্পদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর ইঁদুর সদৃশ প্রজতিটি আস্তে আস্তে আমাদের Catarrhini হতে নরবানর তথা Ape এ পরিণত হলো গাছে উঠার,এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফানোর সুবিধার্থে।বিভিন্ন প্রাচীন ফসিলে পাওয়া আমাদের মস্তিস্কের খুলিতে অবস্থিত বিশালাকার ছিদ্র তথা Foramen Magnum এর অবস্থানের ক্রমশ পরিবর্তন তার একটি প্রমাণ,এটি প্রমাণ করে ক্রমশ আমাদের স্পাইনাল কর্ড বা সুষুম্নাকাণ্ডের Angle বা কোণের অবস্থানের পরিবর্তন (সোজা হয়ে বসা বা গাছে উঠার জন্য) যার ফলে মাথার খুলির সেই ছিদ্রটিরও অবস্থান পরিবর্তন করতে হচ্ছিল।এখন আর কোন ডাইনোসর নেই,তাই প্রবল প্রতাপশালী আমাদের সেরকম বড় কোন শত্রুও আর তেমন নেই।ছোট ইঁদুরের মত প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়ে আমাদের আকার হয়েছে অনেক বড়,আমরা গাছে চড়তে শিখেছি,ফল খেতে শিখেছি। ৭০ লক্ষ বছর আগে শিম্পাঞ্জি ও বোনোবোদের পূর্বপুরুষরা আলাদা হয়ে যাবার সময় আমরা এই গাছে চড়া,ফল খাওয়া Arboreal জীবনে একদম অভ্যস্ত ছিলাম।কিন্তু না, প্রকৃতির পরিকল্পনা ছিল অন্য কিছু।






যে বৈশ্বিক উষ্ণতার কথা আজ আমরা প্রতিদিন বলছি,আতংকগ্রস্ত হচ্ছি তা এবার ই প্রথম ঘটবেনা,ঘটছেনা।তবে সমস্যাটি কীভাবে ঘটেছিল তা বুঝতে হলে আপনাদেরকে জানতে হবে কিছু অন্য গল্প।আমাদের আজকের এই পৃথিবীতে আছে ৭ টি মহাদেশ যারা একে অপরের হতে মহাসাগর দিয়ে আলাদা আলাদা হয়ে আছে।এশিয়া থেকে এন্টার্কটিক,দুইয়ের মাঝখানে কি বিশাল প্রশান্ত মহাসাগর,আফ্রিকা থেকে আমেরিকা মহাদেশ আলাদা হয়ে আছে প্রকাণ্ড আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বারা।ইউরোপ থেকে আমেরিকা আলাদা হয়ে আছে আর্কটিক সাগরের মাধ্যমে।এইসব ই আমরা আমরা সবাই জানি।কিন্তু খুব অল্প মানুষ ই জানে আগে আসলে এই ৭ টি মহাদেশ বলতে কিছু ছিলনা,সারা দুনিয়ার সব মহাদেশ,সব দেশ,সব ভুখণ্ড ছিল একইসাথে যুক্ত,গোটা বিশাল একটা মহাদেশ যার নাম প্যানজিয়া(Pangea),সাগরও ছিল শুধু একটি, যার নাম প্যানথেসিয়া(কেবল চীন ব্যাতিত,চীন আলাদা ভুখণ্ড ছিল যার নাম ছিল Cathysia)





এর কারণ হল পৃথিবীর ভুপৃষ্ঠের নিচের স্তর (অশ্বমণ্ডল) আসলে অনেকগুলো বিশাল বিশাল প্লেট দ্বারা নির্মিত,এদেরকে টেকটোনিক প্লেট বলে এবং এরা গতিশীল, খুব খুব ধীরে ধীরে চলমান যা খালিচোখে হয়তো আমরা বুঝতে পারিনা। এই প্লেটগুলোর উপরেই সব মহাদেশগুলো অবস্থিত।এই প্লেটগুলো গুরুমণ্ডলের আংশিক তরল অংশের ওপরে ভাসমান অবস্থায় আছে। ভূত্বকীয় প্লেটগুলোকে মূলত ৭ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যেমন—আফ্রিকান প্লেট, এন্টার্কটিক প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট, ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট, উত্তর আমেরিকান প্লেট, প্যাসিফিক প্লেট, দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট। এই প্লেটগুলো প্রতিবছর কয়েক সেন্টিমিটার কোনো এক দিকে সরে যায়। কখনো একে অন্যের দিকে আসে, কখনো আবার কয়েক মিলিমিটার ওপরে ওঠে বা নিচে নামে। যখন একটি প্লেটের সঙ্গে আরেকটি প্লেট ঘষা বা ধাক্কা খায় তখন ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির উদগিরণের ঘটনা ঘটে। ধারণা করা হয়, প্লেটগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে ঘষা বা ধাক্কা খেলে সেখানে প্রচুর তাপ সৃষ্টি হয়। তাপে ভূ-অভ্যন্তরের পদার্থ গলে যায়। এ গলিত পদার্থ চাপের ফলে নিচ থেকে ভূ-পৃষ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসে। একেই আগ্নেয়গিরির উদগিরণ বলে। উদগীরণের সময় বেরিয়ে আসা গলিত তরল পদার্থ ম্যাগমা নামে পরিচিত। একইভাবে প্লেটগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে ধাক্কা খেলে পৃথিবী কেঁপে ওঠে। একেই ভূমিকম্প বলে।এই প্লেটগুলোর একে অপরের থেকে সরে যাবার কারণেই একটি বিশাল ভুখণ্ড ভেঙ্গে তৈরী হয়েছিল ৭ টি আলাদা মহাদেশের,আজ থেকে প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে।না এমনটি মনে করার কোন কারণ নেই যে এটা রাতারাতি আলাদা হয়ে গেছে,এই আলাদা হবার গতি এতই ধীর ছিল যে এটি হতে লেগেছিল প্রায় ১৩ কোটি বছর!মজার বিষয় হল অতীতে এরকম আরও ৪ বার পৃথিবীর সব মহাদেশ একসাথে একটা ভুখণ্ড ছিল,প্রতিবার ই তারা আবার ভেঙে আলাদা হয়ে গিয়েছে,ভবিষ্যতেও হয়তো অনেক কোটি বছর পরে আমরা আবার এক হব!







যাই হোক আমরা কিন্তু আমাদের মূল গল্প হতে সরে গিয়েছি। আমাদের আদিপুরুষদের সামনে এই প্লেট টেকটোনিকের চলাফেরার কারণে আরেকটা বিপদ এসে উপস্থিত হল।আজ থেকে প্রায় ২.৫ কোটি বছর আগে আফ্রিকান আর ইন্ডিয়ান প্লেট দুটো একে অপরের থেকে সরে গেল কিছুটা,ফলে মাঝখানের অংশে ভূখণ্ড নিচু হয়ে উৎপন্ন হল বিখ্যাত একটি উপত্যকার,The Great East African Rift Valley বলে যাকে আমরা চিনি আর সেখানে উদ্ভব হল নতুন পর্বতসারির। এই African Rift Valley নামক ৩০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফাটল দিন দিন বড় হচ্ছে।বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী আরও ১ কোটি বছর পর এই ফাটল সম্পূর্ণ হয়ে আফ্রিকা ২ ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং মাঝখানে এক নতুন সমূদ্রের সৃষ্টি হবে।

এতে যে সমস্যাটা হলো তা হচ্ছে আগে ভারত সাগরের মৌসুমী বায়ু বিনাবাধায় আফ্রিকা অঞ্চলে প্রবাহিত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটাত।কিন্তু এখন দুই মহাদেশের মাঝে এই নতুন পর্বতসারির কারণে সেই বায়ু বাঁধা পেল।পর্বতসারির জন্য এক পাশের বনাঞ্চলও হয়ে গেল আলাদা,আবার বৃষ্টিপাত কমে যাবার কারণে ফল,বৃক্ষ এদের সংখ্যাও কমে গেল।


African Rift Valley 



African-Indian Plate সরণে সৃষ্ট African Rift Valley 


এভাবেই প্রায় ২.৫ কোটি বছর আগে বিশাল বিপদে পড়ে গেল আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন তারা Catarrhine থেকে Proconsul নামক মধ্যবর্তী পর্যায়ের মধ্য দিয়ে Ape নামক আলাদা একটি শাখায় ভাগ হয়ে যাচ্ছিল।

সেই ফলভোজী,লাফিয়ে লাফিয়ে বা ডিঙ্গিয়ে গাছে চড়া,লেজযুক্ত প্রাণীদের জীবনে এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী কী পরিবর্তন হলো?তারা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গাছ থেকে গাছে সোজা হয়ে লাফিয়ে এবং অনেকটা সময় গাছে না চড়ে ২ পায়ে ভর দিয়ে মাটিতে বিচরণ করে খাবার সংগ্রহ করার অভ্যেস গড়ে তুলতে লাগল জীবনের তাগিদে কারণ গাছে খাবার কমে গেছে,টিকে থাকতে হলে এখন মাটিতে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং অধিক সংখ্যক গাছে সোজা হয়ে Brachiation Movement এর মাধ্যমে চলাচল করে খাবার জোগাড় আবশ্যক। 


যেহেতু এখন আর আগের মতো চারপায়ে চলার অভ্যেস নেই তাই মাথার ভার সামঞ্জস্য করার জন্য লেজের দরকারও নেই।অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ লালন করা অর্থ হলো অপ্রয়োজনীয় ক্যালরি সেই অঙ্গ বহনের জন্য ব্যয় করা।আবার শিকারী প্রাণীদের সেই অঙ্গের মাধ্যমে আপনাকে ধরা তুলনামূলক সহজতর।আর যখন ই আপনি সোজা হয়ে দুই পায়ে হাঁটবেন তখন লেজ থাকলে তা বারবার আপনার পায়ের মাঝে এসে পড়বে।অর্থাৎ এটি সবদিকেই অযোগ্য এসময় আর টিকে থাকার।



প্রায় ২-২.২ কোটি বছর আগে Proconsul পর্যায়ে থাকা অবস্থাতেই তাই তখন অনেক লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলে তাদের লেজ আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে গেল কিন্তু রয়ে গেল তার অবশিষ্ট যাকে আমরা বলি Coccyx (পুচ্ছদেশ,কোমড়ের নিচের হাঁড়ের অংশ)।এখনো যদি গর্ভাবস্থায় ৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবতী মায়ের আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করান তাহলে দেখতে পাবেন এখনো সেই লেজ আমাদের রয়ে গেছে যা কয়েক কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে এখন গর্ভাবস্থাতেই সেই ছোট অবস্থাতেই রয়ে যায় এবং Coccyx নামক হাড় হিসেবে ধ্বংসাবশেষের মতো করে তার প্রাচীন অস্তিত্বের সাক্ষী বহন করে চলেছে এখনো আমাদের শরীরে। এই Coccyx হাড়টির অপর নাম তাই Tail Bone. আর তাই দেখবেন মানুষ, শিম্পাঞ্জি,বোনোবো,ওরাংওটাং এবং গরিলা এই Ape দের কারোই লেজ নেই কারণ Ape হবার ঠিক আগের পর্যায়ে (Proconsul) তারা লেজ হারিয়ে ফেলেছিল।

Coccyx বা Tail Bone,মেরুদণ্ডের সর্বশেষ অংশ

ভ্রূণাবস্থায় মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদের Tail



আগে লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে চড়ার বদলে কম শক্তি খরচ করে গাছে উঠার জন্য আমাদের হাত পা আরও বড় ও পেশীবহুল হল,জলবায়ুর পরিবর্তন চিরতরে পরিবর্তন করে দিল আমাদের আদিপুরুষদের।কি,আপনি ভাবছেন এই পরিবর্তনগুলো এভাবেই ধুমধাম হয়ে গেল! এ কিভাবে সম্ভব! এটা কি ব্ল্যাকম্যাজিক নাকি? না,বাস্তবতা হল  লক্ষ লক্ষ প্রজন্ম ধরে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের ফসল এই পরিবর্তনগুলো, আর এগুলো হতে সময় লেগেছিল প্রায় ৩০ লক্ষ বছর।আর এভাবেই আজ থেকে প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের আর রইলনা লেজ,রোমশ এক ফলভোজী নরবানর তখন তারা।



তাহলে আমরা দেখলাম আপাতত ইস্ট আফ্রিকান উপত্যকার কারণে সৃষ্ট সমস্যায় তৈরী চরম খাদ্যসংকট থেকে তো বাঁচার তাগিদে অনেক লক্ষ বছর ধরে ধীরে ধীরে হলো পরিবর্তন। Ape থেকে হলো কয়েকটি শাখা ভাগ(Hominin,শিম্পাঞ্জি-বোনোবো,ওরাংওটাং,গরিলা)।


Hominin এর সবচেয়ে প্রাচীন প্রজাতি Sahelanthropus Tchadensis,আজ থেকে প্রায় ৭০-৭৫ লক্ষ বছর আগের।এরপর এলো Ardipithecus Ramidus এবং Ardipithecus Kadabba যাদের প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায় প্রায় ৫৬ লক্ষ বছর আগে,যারা মাত্র গড়ে ৪ ফুট লম্বা, ৩৫ কেজি ওজনের, কমলার আকৃতির মস্তিস্কযুক্ত।এদের ফসিল পাওয়া গিয়েছিল ইথিওপিয়ায়।আজ থেকে প্রায় ৪৪ লক্ষ বছর আগে এই Ardipithecus প্রজাতি ইতিহাসের এক অনন্য অসামান্য কর্মের প্রথম সাধন করল।১৯৯৪ সালে ইথিওপিয়ায় প্রাপ্ত এদের ফসিল থেকে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করলেন যে তারাই Hominin দের মধ্যে প্রথম প্রজাতি যারা পুরোপুরি Arboreal( গাছে চড়ে জীবন নির্বাহ) বৈশিষ্ট্য থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ  Bipedal বা দুই পায়ে চলাফেরার অভ্যেস গড়ে তুলেছিল।অপরদিকে বাকী Ape রা(গরিলা,শিম্পাঞ্জি ইত্যাদি) পুরোপুরি Arboreal স্বভাব ত্যাগ করতে পারেনি।





প্রথমবারের মত ইতিহাসে কোন একটি প্রাইমেট স্তন্যপায়ীর সম্পূর্ণ দুই পায়ে ভর করে হাঁটার অভ্যেস শুরু হলো। খুব সামান্য বিষয় মনে হচ্ছে?  মোটেও তা নয় আসলে। এই দুই পায়ে হাঁটতে শেখাটাই সূচনা করেছিল এক নতুন ইতিহাসের,মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীর।একটি প্রাণী চলাফেরার জন্য চার হাত পা ব্যবহারের পরিবর্তে কেবল ২ পায়ে হাঁটার কারণে অন্যান্য সকল প্রজাতির চেয়ে সে অসংখ্য দিকে এগিয়ে গেছে।যেমন-


  • দৃষ্টিসীমা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেল।এতদিন জীবন ছিল গাছে,এখন ঘাসের মাটিতে জীবন।চার হাতপায়ে ভর দিয়ে চললে দূরের শিকার ও শিকারী দৃষ্টিগোচর করতে অনেক অসুবিধা হতো যা দুই পায়ে চলাফেরা শুরু করার কারণে অনেকটাই দূর হয়ে গেল দৃষ্টিসীমা বৃদ্ধির ফলে।
  • দুই হাতকেও এতদিন চলাফেরার সময় শরীর ভর দেবার কাজে ব্যবহার করতে হতো যা এখন আর হচ্ছেনা।ফলে সেই দুই হাতে পাথরের তৈরী অস্ত্র বহন করা,খাদ্য বহন করা,শত্রুর সাথে লড়াইয়ে ব্যবহার করা গেল। স্বাভাবিকভাবেই আপনি চার হাত পায়ে ভর দিয়ে চললে যতদূর পর্যন্ত দেখতে পাবেন কেবল দুই পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালে তারচেয়ে অনেক বেশীদূর পর্যন্ত দেখতে পাবেন।
  • শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে গেল কারণ সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ফলে সূূর্যালোক শরীরের ৬০ শতাংশ কম ক্ষেত্রফলে পতিত হতে লাগল,অধিক বাতাস সরবরাহ হতে লাগল শরীরের বহির্ভাগে।
  • তুলনামূলক বেশী দূরত্বের পথ তুলনামূলক কম শক্তি ও সময় খরচের মাধ্যমে পার হওয়া সহজ হলো চার হাত পা এর বদলে দুই পায়ে হাঁটার ফলে।

আর এই সুবিধাগুলো Hominin দের অন্য সব প্রজাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব বিস্তারে অভুতপূর্ব সাহায্যকর বলে পরিগণিত হলো অদূর ভবিষ্যতে।

Bipedal এ রূপান্তরিত হবার ফলে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সুবিধা

Bipedal হবার সুবিধাসমূহ 



Ardipithecus রা প্রথমদিকে পুরোপুরি আমাদের পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য অর্জন করেনি,এর মানে হল Ardipithecus দের দুই পায়ে হাঁটার বৈশিষ্ট্য(Bipedality) যেমন ছিল আবার Arboreality অর্থাৎ গাছে চড়ে ফল খাবার বৈশিষ্ঠ্যও ছিল। এদের মানুষদের মত না ছিল দুই পায়ে ভর করে হাঁটার ক্ষেত্রেও খুব বেশী দক্ষতা,না ছিল বেশী এপদের মত গাছে উঠে উঠে ফল খাবার দক্ষতা,দুটোই মাঝারি পরিমাণে ছিল।সেখান থেকে প্রায় ১২ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হতে হতে তারা এই সম্পূর্ণ Bipedalism এর পর্যায়ে আসল।অর্থাৎ একটা আপাতদৃষ্টিতে ছোট পরিবর্তন হতেই সময় লেগেছিল ১২ লক্ষ বছর।এর আগে দেখেছি লেজ বিলুপ্ত হতে সময় লেগেছে প্রায় ৫০ লক্ষ বছর! অর্থাৎ প্রতি ১ প্রজন্মে পরিবর্তন এতই অনু-পরমাণু আকৃতির হয় যে আমরা তা খালি চোখে কখনোই বুঝতে পারবনা যে আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলেছে বিবর্তন! Hominin দের দুই পায়ে হাঁটতে শিখিয়েছে জীবনের প্রয়োজন, খাদ্যের প্রয়োজন।বেঁচে থাকার স্পৃহা তাকে তার চিরাচরিত অভ্যেস থেকে বের করে নিয়ে এসে দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করেছে।আগামী পর্বে আমরা দেখব কীভাবে Ardipithecus থেকে Australopethicus হয়ে Homo Erectus ও আমাদের পরম পরিচিত Homo Sapiens এর উদ্ভব হলো।



বাতেবাজুর্যা নদ্যেব রীতিরক্ষী ইব চক্ষুষা যাতমর্বাক।

হস্তাবিব তন্বে শাম্ভবিষ্ঠা পাদেব নো নয়তং বস্যো অচ্ছ।।
(ঋগ্বেদ ২.৩৯.৫)



চিরতরুণ প্রাচীন সে বায়ুধারা বয়ে যায়,সতত সে নদীধারা স্রোতময়,এই উন্মীলিত চক্ষুদ্বয় তা অবলোকন করে চলেছে সর্বদা,এই হস্তদ্বয় সম্মুখে এসে আমাদের সুরক্ষা হোক,এই পদদ্বয় সম্মুখে গিয়ে আমাদের সম্মুখযাত্রা হোক।


এভাবেই যতকাল ধরে বায়ু বহমান,যতকাল ধরে জলধারা স্রোতময়,ততকাল ধরে চিরন্তন মানুষ ও তার পূর্বপুরুষরা,সকল প্রজাতিরা সংগ্রাম করেছে নিজ বাহুবলে,পদযোগে টিকে থাকার সম্মুখযুদ্ধে।এতদিন তো আমরা ছিলাম গন্তব্যের অনেক দূরে,এখন চলে এসেছি অতি নিকটে! আগামী পর্বেই আমরা পেয়ে যাব Hominin হতে আধুনিক মানুষ Homo Sapiens কী করে হলো আর সেই থেকে দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে পবিত্র বেদ পর্যন্ত আমরা কী করে এলাম।ততদিন পর্যন্ত বিদায়!





ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি

Post a Comment

2Comments
  1. বিবর্তনের ৫ম পর্ব খুজে পাচ্ছি না,, নাকি এখনো আপলোড তরা হয়নি???

    ReplyDelete
  2. সবগুলোই খুব ভালো লাগলো, ৫ম চাই

    ReplyDelete
Post a Comment