ত্রৈতবাদ
হচ্ছে বেদভিত্তিক একটি দর্শন । এই দর্শন অনুসারে , পরমাত্মা , জীবাত্মা
এবং প্রকৃতি– এই তিনটি সত্তা অনাদি , নিত্য ও পৃথক ৷ এদের মধ্যে পরমাত্মা
এই সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ , প্রকৃতি উপাদান কারণ এবং জীবাত্মা সাধারণ কারণ ৷
এই দর্শন অনুসারে , পরমাত্মা এক , অদ্বিতীয় , চেতন , সর্বজ্ঞ , সর্বব্যাপী
, আনন্দময় , একরস , বিকারশূন্য । অপরদিকে জীবাত্মা বহু , চেতন , একদেশী
অল্পজ্ঞ । আর প্রকৃতি অচেতন , সর্বব্যাপী নয় ।
মনুস্মৃতিতে ত্রৈতবাদ ——
ঈশ্বর
মনুস্মৃতিতে
ব্রহ্ম বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে সেই পরমব্রহ্ম একাক্ষর [ 1 ] অর্থাৎ "
ও৩ম্ " নাম দ্বারা অভিহিত হয়েছে । সেই ব্রহ্মের স্বয়ম্ভূ, ভগবান এবং
অব্যক্ত নাম সমূহ দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে -- তিনি এই সৃষ্টিকে প্রকাশিত
করেন, তাঁর ওজ পৃথিবী, জল তেজ আদি মহাভূত সমূহে বিদ্যমান, তিনিই
প্রকৃতিকে প্রেরিত করে থাকেন । [ 2 ]
তিনি ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রাহ্য
নন, সূক্ষ্ম, অব্যক্ত তথা সনাতন, সম্পূর্ণ ভূতসমূহে ব্যাপ্ত অচিন্ত্য এবং
স্বয়ম্ভূ তিনি । [ 3] তিনিই নিজ শরীর ( প্রকৃতি ) দ্বারা বিবিধ
প্রজাগণকে সৃষ্টি করে থাকেন । [ 4 ] এই প্রসঙ্গে এক পরমাত্মার অনেক নাম
এবং গুণের বর্ণনা করা হয়েছে ।
তিনিই এই সৃষ্টির নিমিত্তকারণ তথা প্রকৃতিকে প্রেরণা দানকারী । তিনি নিত্য পরমব্রহ্ম ।
জীবাত্মা
দেহী
শব্দ বহুবচনে জীবাত্মাকে নির্দেশ করে মনুস্মৃতিতে বর্ণিত হয়েছে । এক
স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যেসব জীবাত্মা পূর্ব কল্পের কর্মকে নতুন
সর্গেও প্রাপ্ত করে থাকে । [ 5 ]
ব্রহ্ম এইসব জীবাত্মাকে ধর্ম এবং
অধর্মের কর্মানুসারে সুখ এবং দুঃখ দ্বারা যুক্ত করে থাকেন । [ 6 ] এখানে
স্পষ্ট যে ব্রহ্ম কর্মফল প্রদাতা এবং জীবাত্মা তার নিজের কর্মানুসারে
সুখ-দুঃখ এর ভোক্তা ।
ব্রহ্ম ধর্ম এবং অধর্ম কর্মসমূহের ঊর্ধ্বে । এই
জীবাত্মা তার কর্মানুসারে বিবিধ প্রকার শরীর প্রাপ্ত হয়ে থাকে । এই
বিষয়ে মনুস্মৃতিতে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে । [ 7 ]
এই প্রকারে
মনুস্মৃতিতে জীবাত্মাকে নিত্য, কর্মফল ভোক্তা, সুখ-দুঃখ এর বন্ধনে যুক্ত
শরীরের বন্ধন দ্বারা বদ্ধ ; ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন সত্তা মানা হয়েছে ।
জীবাত্মা সাধনার মাধ্যমে সেই পরমব্রহ্মকে প্রাপ্ত করে থাকে । [ 8 ]
প্রকৃতি
প্রলয়কালে প্রকৃতির অবস্থার বর্ণনা মনুস্মৃতিতে ——
এই জগত ( প্রলয়াবস্থায় ) তমস্ ( প্রকৃতি ) রূপে লক্ষণ রহিত তর্কের অযোগ্য, অবিজ্ঞেয় এবং নিদ্রিত ছিলো । [ 9 ]
কুল্লুক
ভট্ট এখানে " তমস " শব্দ প্রকৃতি অর্থে বর্ণনা করেছেন । মনুস্মৃতিতে
একটি শব্দে পরমাত্মাকে নির্দেশ করে " তমোনুদঃ " [ 10 ] প্রযুক্ত হয়েছে ।
এই শব্দ দুইটি ভাগে বিভক্ত ;
" তমস+নুদঃ ' নুদ ' শব্দ তুদাদিগণের ' নুদ
' প্রেরণে ধাতু দ্বারা গঠিত হয়েছে, যার অর্থ প্রেরণাকারী । " তমোনুদঃ "
এর অর্থ জগতের উৎপত্তির সময় প্রকৃতিকে প্রেরণা দানকারী ।
কুল্লুক ভট্টও প্রদত্ত শব্দের একই অর্থ বর্ণনা করেছেন । অতএব এখানে ' তমস ' শব্দের অর্থ প্রকৃতিই গ্রহণ করা উচিত । [ 11 ]
হরগোবিন্দ
শাস্ত্রীও তমস শব্দের অর্থ প্রকৃতি করেছেন । [ 12 ] এক স্থানে বর্ণনা
করেছেন, সেই ব্রহ্ম তাঁর শরীর দ্বারা বিবিধ প্রজাগণকে সৃষ্টি করে থাকে । [
13 ] এখানে ব্রহ্মের শরীর বলতে প্রকৃতিকে নির্দেশ করা হয়েছে কেননা
প্রকৃতি প্রলয়কালে ব্রহ্মের মধ্যে ব্যাপক রূপে অবস্থান করে ।
যদি
ব্রহ্ম তাঁর চেতনরূপ দ্বারা সৃষ্টি করে থাকে তাহলে তিনি পরিণামী সিদ্ধ
হবেন পরন্তু ব্রহ্ম অপরিণামী । পরিণাম ধর্ম প্রকৃতির অতএব এটাই মানতে হবে
যে ব্রহ্ম প্রকৃতি দ্বারা জগত সৃষ্টি করে থাকেন ।
এই বিষয়ে মহর্ষি
মনু একটি শ্লোকে স্পষ্ট বর্ণনা করেন —— " যা অব্যক্ত কারণ ( প্রকৃতি )
তাকে নিত্য এবং সদসদাত্মক বলা হয় ; [ 14 ] তার ( প্রকৃতি ) দ্বারা এই
সৃষ্টি রচনাকারীকে পুরুষ ব্রহ্ম বলা হয় । [ 15 ]
এখানে প্রকৃতিকে
জগতের মূল উপাদান কারণ এবং ব্রহ্মকে নিমিত্ত কারণ মানা হয়েছে । এভাবে
এখানে স্পষ্টভাবে প্রকৃতিকে নির্দেশ করা হয়েছে ।
মনুস্মৃতিতে
ব্রহ্ম, জীবাত্মা এবং প্রকৃতি এই তিনটি সত্তার স্পষ্ট বর্ণনা বিদ্যমান ।
তিনটি সত্তা একত্রিত না হয়ে ভিন্ন-ভিন্ন তথা অনাদি হিসেবে বর্ণিত হয়েছে
; অতএব মনুস্মৃতিতেও " ত্রৈতবাদ " সিদ্ধান্ত প্রতিপাদিত হয়েছে ।
তথ্যসূত্র
১. একাক্ষরং পরং ব্রহ্ম।। (মনু. ২/৮৩)
২.ততঃ স্বয়ম্ভুর্ভগবানব্যক্তো ব্যঞ্জয়ন্নিদম্। মহাভূতাদিবৃত্তৌজাঃ প্রাদুরাসীৎ তমোনুদঃ।। (মনু. ১/৬)
৩. যোহসাবতীন্দ্রিয়গ্রাহ্যঃ সূক্ষ্মোহব্যক্তঃ সনাতনঃ। সর্বভূতময়োহচিন্ত্যঃ স এব স্বয়মুদ্বভৌ।। (মনু. ১/৭)
৪. সোহভিধ্যায় শরীরাৎ স্বাৎ সিসৃক্ষুর্বিবিধাঃ প্রজাঃ। (১/৮)
৫. স্বানি স্বান্যভিপদ্যন্তে তথা কর্মাণি দেহিনঃ।। (১/৩০)
৬. কর্মণাঞ্চ বিবেকার্থং ধর্মাধর্মৌ ব্যবেচয়ৎ। দ্বন্দ্বৈরযোজয়চ্চেমাঃ সুখদুঃখাদিভিঃ প্রজাঃ।। ( মনু. ১/২৬)
৭. মনু. (১/৩৭-৪০) তথা ৪৩-৪৬
৮. স ব্রহ্ম পরমভ্যেতি।। (মনু. ২/৮২)
৯. আসীদিদং তমোভূতমপ্রজ্ঞাতমলক্ষণম্। অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং প্রসুপ্তমিব সর্বতঃ।। (মনু. ১/৫)
১০. ইন্দংজগৎ তমোভূতং তমসি স্থিতং লীনমাসীৎ। তমঃ শব্দেন গুণবত্যা প্রকৃতিনিদিশ্যতে।।
—— কুল্লূকভট্টভাষ্য, মনু. পৃ. ৪
১১. মনু. ২/৬
১২. তভোনুদঃ প্রকৃতিপ্ররেকঃ।। ( কুল্লূকভট্টভাষ্য, পৃ. ৬)
১৩. দেখিয়ে - মণিপ্রভা হিন্দী ভাষ্য, পৃ. ৩
১৪. দেখুন --- (মনু. ১/৮)
১৫. য়তকারণমব্যক্তং নিত্যং সদসদাত্মকম্। তদ্বিসৃষ্টং স পুরুষো লোকে ব্রহ্মেতি কীর্ত্যতে।। (মনু. ১/১)
[ ব্রহ্মপুরাণ (১/৩৩)। বিষ্ণুপুরাণ (১/২/১৯-২০)। কূর্মপুরাণ পূর্বার্দ্ধ ৪/৬) ]
নমস্কার