আমাদের সমাজও এই মরণব্যধি থেকে মুক্ত নয়। বিশেষ করে দেখা যায় পূজার সময় এলেই আনন্দ করার নামে প্রচুর সনাতনী যুবক মদ্যপানে রত হয়ে পড়ে,অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হয়। এমন ই অবস্থা কিছু কিছু অঞ্চলে যে বিধর্মীরা এই নিয়ে হাসাহাসি করার সুযোগ পায়। করোনা লকডাউনের সময় কলকাতার মানুষদের মদের দোকানে দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাড়িয়ে থাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ব্যঙ্গবিদ্রূপের জন্ম দেয়। অনেকেই সে সময় হিন্দুদের নিয়ে কটূক্তি করার সুযোগ পায়।
অনেকেই গর্ব করে বলে বেড়ায় মদ খেলে কী সমস্যা, মদ খাওয়াতে নাকি সনাতন ধর্মে কোন বিধিনিষেধ ই নেই!
অনেকেই আবার আরও এককাঠি সরস। তারা নিজের লোলুপতাকে বৈধ করার জন্য পুরাণের কল্পকাহিনীর কিছু শ্লোক উদ্ধৃত করেন যার কোন প্রাসঙ্গিকতাই সনাতন আইনে নেই। কেননা সনাতন আইনের সর্বোচ্চ অথোরিটি হলো পবিত্র বেদ। এছাড়া জীবনবিধি ও রাষ্ট্রীয় আইনের জন্য আছে স্মৃতিশাস্ত্র সমূহ। তাই মিথোলজির কোন বইয়ের শ্লোক এক্ষেত্রে গ্রহণীয় নয়।
যেমন বিষ্ণুপুরাণের একটি শ্লোক দেখানো হয়-
সুরামাংসপোহারৈশ্চ ভক্ষ্যভোজৈশ্চ পূজিতা(বিষ্ণুপুরাণ ৫.১.৮৪)অর্থাৎ সুরা(মদ) ও মাংস,ভক্ষ্য ও ভোজ্য দ্বারা দেবীকে পূজা করার কথা বলা হয়েছে বিষ্ণু পুরাণে।
বিষ্ণুপুরাণে আমাদের পরম সম্মানীয় শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রী বলরামের মদপান করার কাল্পনিক গল্প বলা আছে। স্কন্দ পুরাণেও আমরা দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রী বলরাম এবং তাদের স্ত্রীদের মদ পান ই নয় বরং মদপান করে মাতাল হয়ে যাবার উদ্ভট কাল্পনিক ও অশ্লীল পৌরাণিক গল্প পাওয়া যায়। প্রায় সব পুরাণেই এরকম অবাস্তব সব গল্প পাওয়া যায়। এইসব মিথোলজির গল্পের সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক এবং বাস্তব আইনের উপর এদের তেমন কোন প্রভাব নেই।
একইভাবে তন্ত্রশাস্ত্রে প্রচুর পরিমাণে মদের ব্যবহার পাওয়া যায়। স্বাভাবিকভাবেই তন্ত্রশাস্ত্র বৈদিক পরম্পরার সাথে মিলবেনা।এজন্যই এটি তন্ত্র।
যেমন কুলার্ণবতন্ত্রে দেখা যায় ৫ম উল্লাসের ৩২,৩৩,৩৪ নং শ্লোকগুলোতে ৩ ধরনের মদ তৈরীর প্রক্রিয়া সহ বর্ণিত আছে-
পৈষ্টী, গৌড়ী ও মাধ্বী সুরা।এছাড়াও আছে তালজা সুরা,মৈরেয়ী সুরা ইত্যাদির বর্ণনাও। এই মদগুলো কী কী উপাদান দিয়ে প্রস্তুত করা হবে তারও বর্ণনা করা আছে।
এগুলো দিয়ে পূজা করার কথা রয়েছে সেখানে।
আবার কুলার্ণব তন্ত্রের পঞ্চম উল্লাসের ৪২ নং শ্লোকে মদ,মাংস ও ভাং অষ্টগন্ধের সাথে মিশিয়ে বটিকা(ট্যাবলেট) তৈরী করে তা সংরক্ষণ করার কথাও বলা হয়েছে। কোন কারণে মদ শেষ হয়ে গেলে বা না থাকলে এগুলো দিয়ে পূজা করতে বলা হয়েছে তন্ত্রে।
তন্ত্রশাস্ত্রে এরকম মহিষরক্ত, মেষ রক্ত, ছাগরক্ত,মদ প্রভৃতি দ্বারা পূজার কথা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় নরবলি, গোবধ, গোরক্ত দিয়ে পূজা করা সহ নানা উপাচার। স্বাভাবিক ভাবেই বৈদিক জীবনপ্রণালীতে এগুলো প্রযোজ্য হবেনা।
মুণ্ডমালা তন্ত্রের ৫ম পটলের ৫১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে-
মদ্যপান ন কর্তব্যং ন কর্তব্যং কলৌ যুগে।শাক্তানাং চৈব শৈবানাং কর্তব্যং সর্ব সিদ্ধিদম্।।অর্থাৎ কলিযুগে সাধারাণ মানুষের জন্য মদ্যপান উচিত না হলেও শৈব ও শাক্তদের মদ্যপান অবশ্য কর্তব্য ও মদ্যপান তাদের জন্য সর্বসিদ্ধিদায়ক!
আর এভাবেই বিভিন্ন সময়ে সমাজে এই অপপ্রথাগুলো প্রবেশ করেছে ধীরে ধীরে যার ফলাফল এখন আমরা আমাদের সমাজে দেখতে পাচ্ছি বিশেষত বিভিন্ন পূজার মৌসুম আসলেই।
আমাদের জীবনাচরণের ও হিন্দু আইনের মূল আধার বেদ। জগতে সৃষ্ট জীবের বিধি বিধান তথা জীবনাচরণ নিশ্চিত করা ঈশ্বরেরই কর্তব্য। সৃষ্ট জীবের মধ্যে মনুষ্যের জ্ঞান প্রজ্ঞা অনান্য জীবের অপেক্ষা অধিক উৎকৃষ্ট। সেহেতু ঈশ্বর মনুষ্যের কর্তব্য কর্ম, তথা বিধি নিষেধাদিরূপ জ্ঞানের সমষ্টি বেদ এই মনুষ্যকূলের জন্য প্রকট করেছেন।
মানুষ এই জ্ঞানের ব্যবহার দ্বারা তাদের জীবনাচরণ আরো সুসঙ্খলরূপে সাজিয়েছে, ফলে সৃষ্টি হয়েছে অনেক শাস্ত্রের। এভাবে জগতের সমস্ত শাস্ত্র তথা মহান পুরুষ মুনি ঋষি আদি বেদেরই জয়গান গেয়েছেন। এর কারণ এই যে বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান হেতু এতে ভূল সিদ্ধান্ত থাকতে পারে না, যা মনুষ্যের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সেই হেতু সকল শাস্ত্রের মূল শিরোমণি বেদ কে সবাই এক বাক্য স্বীকার করেছেন।
বেদে মানব জীবনের সপ্ত মর্যাদা অর্থাৎ সাতটি বিশেষ সীমার কথা বলেছেন, যার একটিও যদি কেউ প্রাপ্ত হয় তবে সে নিশ্চিতরূপে পাপী। যথাঃ
সপ্ত মর্য্যাদা কবয়স্ততক্ষুস্তাসামমেকামিদভ্যংহুরো গাত্।(ঋগ্বেদ ১০।৫।৬)অর্থাৎ মেধাবী আপ্ত ঋষিগণ সপ্ত মর্যাদাকে নিজেদের জীবনের সীমা তৈরী করেছেন, তাহার যেন লঙ্ঘন না করা হয় অর্থাৎ তাহাতে যেন কেউ না পৌছে।
নিরুক্তে ৬।২৭ অনুসারে এ সীমার প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে -
চুরি, গুরুপত্নির সাথে সম্ভোগ, ব্রহ্মহত্যা, গর্ভপাত, সুরাপান, পাপকর্মের পুনরাবৃত্তি এবং পাপ করেও মিথ্যা বলা - পাপ কে লুকানো। এর মধ্যে একটিতেও যে গমণ করে - নিজের মধ্যে আরোপিত করে, সে পাপী হয়।
অর্থাৎ বেদ মতে সাতটি পাপ কার্যের মধ্যে একটি হচ্ছে সুরা (মদ্য) পান। অর্থাৎ বেদ কখনো মদ্য পানের বিধান দেয় নি। প্রচলিত মনুসংহিতাই সুরা(মদ্য) কে আরো ঘৃণার সাথে দেখা হয়েছে।
নকী রেবন্তং সখ্যায় বিন্দসে পীয়ন্তি তে সুরাশ্ব।(ঋগ্বেদ ৮:২১:১৪)
সুরা বৈ মলমন্নানাং পাপ্মা চ মলমুচ্যতে।তস্মাদ্বাহ্মণরাজন্যৌ বৈশ্যশ্চ ন সুরাং পিবেৎ ॥(মনু ১১।৯৪)-নিশ্চয়ই সুরা বা মদ অন্নের মল আর মলকে পাপ বলা হয়, এই জন্য দ্বিজরা কদাপি মদ্য পান করবে না।যক্ষরক্ষঃপিশাচান্নং মদ্যং মাংসং সুরাসবম্ ।তদ্ ব্রাহ্মণেন নাত্তব্যং দেবানামশ্নতা হবিঃ ।।(মনু ১১।৯৬)- মাদক দ্রব্য , মাংস, মদিরা তথা দ্রাক্ষা রস যক্ষ, রাক্ষস এবং পিশাচের ভক্ষ্য | দেবতার হবি ভক্ষণকারী ব্রাহ্মণের এসব কদাপি সেবনযোগ্য নয়।অমেধ্যে বা পতেন্মত্তো বৈদিকং বাপ্যুদাহরেৎ ।অকার্যমন্যৎ কুর্যাদ্বা ব্রাহ্মণো মদমোহিতঃ ।।(মনু ১১।৯৭)-মদ্য পান করে উৎপন্ন হওয়া ব্রাহ্মণ অপবিত্র স্থানে পতিত হয় অথবা বেদবাক্য অশুদ্ধ বলবে অথবা অন্য কোন নিষিদ্ধ কর্ম করবে। এই কারণে মদ্য পান করা উচিত নয়।
শুধু তাই নয়, সূরা পানকারীকে মনুসংহিতাই শাস্তির বিধান পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। যথাঃ
সুরাং পীত্বা দ্বিজো মোহাদগ্নিবর্ণাং সুরাং পিবেৎ ।তয়া স্বকায়ে নির্দগ্ধে মুচ্যতে কিল্বিষাত্ততঃ ।।(মনু ১১।৯১)-দ্বিজ অজ্ঞান দ্বারা সুরা (মদ্য) পান করলে , অগ্নির সমান তপ্ত মদ্য (সুরা) পান করবে তাহাতে তাহার দেহ দগ্ধ হবার পর সেই মদ্যপানের পাপ নষ্ট হয় অর্থাৎ দ্বিজ অজ্ঞান দ্বারা মদ্য পান করলে তার প্রায়শ্চিত্তের জন্য অগ্নির সমান গরম মদ্য পান করবে, তখন তিনি সেই মদ্যপানরূপ পাপ থেকে মুক্ত হন।
কণান্ বা ভক্ষয়েদব্দং পিণ্যাকং বা সকৃন্নিশি ।সুরাপানাপনুত্ত্যর্থং বালবাসা জটী ধ্বজী ।।(মনু ১১।৯৩)- অথবা চালকণা বা তিল রাত্রের একবার করে এক বর্ষ করে ভক্ষণ করবে, সুরাপানের পাপ দূর করার জন্য কম্বলের বস্ত্র পড়বে এবং জটাধারী থাকবে এবং সুরাপান পাত্র ধারণ করে থাকবে।।
অর্থাৎ পবিত্র বেদ, মনুসংহিতায় সুরাকে পাপের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং পাপের প্রায়শ্চিত্তরূপ বিভিন্ন শাস্তি প্রদানের বিধিও রয়েছে।
তাই কেউ যদি প্রশ্ন করে সনাতন ধর্মে সুরা বা মদ্যপান নিয়ে কী মত তাহলে অবশ্যই সরাসরি উত্তর হবে মদ্যপান সনাতন ধর্মে নিষিদ্ধ।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
Thanks 😊
ReplyDelete