জলচক্র হল প্রাকৃতিক প্রভাবে ক্রমাগত রূপান্তরের মাধ্যমে জলের চক্রাকারে তথা ক্রমাগত সঞ্চারণশীলতা। এই চক্রকে হাইড্রলজিক্যাল চক্র বা H2O চক্র বলা হয় । এই জলচক্রের জন্যেই এই পৃথিবীতে জলের সামঞ্জস্য ব্যাহত হয় না ।
জলচক্রের সাথে শক্তি বিনিময় জড়িত, যা তাপমাত্রা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। জল বাষ্পীভূত হওয়ার সাথে চারপাশ শীতল করে। একই ভাবে জলীয়বাষ্পের ঘনত্ব বাড়লে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। জলচক্র সংঘটিত করে সৌর শক্তি। পৃথিবীতে বাষ্পীভূত হওয়া জলের ৮৬ শতাংশই সমুদ্রের জল, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা শীতল রাখতে অবদান রাখে ।

জলচক্র বা বারিচক্রের বৈশিষ্ট্য
(১) জলচক্রের কোনাে শুরু বা শেষ নেই।
(২) জলচক্র হল পরিবেশের মধ্যে জলের এক বিরামহীন আবর্তন বাবস্থা যার সাহা
(৩) জলচক্রের তিনটি প্রধান অংশ আছে, যেমন- (ক) বাষ্পীভবন বা Evaporation (এর মধ্যে বাষ্পীয় প্রস্বেদন অর্থাৎ Evapotranspiration-কে ধরা হয়), (খ) ঘনীভবন (Condensation) এবং (গ) অধঃক্ষেপণ বা বর্ষণ (Precipitation)।
(৪) জলচক্রের আর একটি বিশেষত্ব হল যে, স্থলভাগে যে পরিমাণ বাষ্পীভবন হয়, বৃষ্টিপাত হয় তার চেয়ে বেশি। আবার সমুদ্র থেকে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প জোগান দেওয়া হয়, বৃষ্টিপাত হয় সেখানে তার চেয়ে অনেক কম।
(৫) জলচক্রের মাধ্যমে জীবজগৎ, জলের জোগান পায় এবং প্রস্বেদনের (Transpiration) সাহায্যে উদ্ভিদ নিজেদের মধ্যে জলের ভারসাম্য বজায় রাখে।
(৬) জলচক্রের গতিপ্রকৃতি সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হলে বন্যা বা খরা দেখা দেয়।


ঋষি: - সিন্ধুদ্বীপম্ দেবতা - অপাংনপাৎ সোম আপশ্চ দেবতাঃ ছন্দঃ - গায়ত্রীঅপো দেবীরুপ হ্বয়ে যত্র গাবঃ পিবন্তি নঃ।সিন্ধুভ্যঃ কর্ত্বং হবিঃ ॥অথর্ববেদ ১।৪।৩পদার্থঃ (যত্র) যে জল থেকে (গাবঃ) সূর্যের কিরণ [বা গোরু আদি জীব বা ভূমি প্রদেশ] (নঃ) আমাদের জন্য (হবিঃ) গ্রহণ-দানযোগ্য অন্ন বা জল (কর্ত্বম্) উৎপন্ন করার লক্ষ্যে (সিন্ধুভ্যঃ) প্রবাহমান সমুদ্র থেকে (পিবন্তি) পান করে। (দেবীঃ) সেই উত্তম গুণাবলীর [ দ্যোতিত , শুদ্ধ ] (অপঃ) জলকে (উপ) আদরের সাথে (হ্বয়ে) আমি আবাহন = স্বীকার - সদপ্রয়োগ করি ।সরলার্থঃ যে জল থেকে সূর্যের কিরণ [বা গোরু আদি জীব বা ভূমি প্রদেশ] আমাদের জন্য গ্রহণ-দানযোগ্য অন্ন বা জল উৎপন্ন করার লক্ষ্যে প্রবাহমান সমুদ্র থেকে পান করে। সেই উত্তম গুণাবলীযুক্ত [ দ্যোতিত , শুদ্ধ ] জলকে আদরের সাথে আমি আবাহন = স্বীকার - সদপ্রয়োগ করি ।[ ভাষ্যকারঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী ]
অর্থাৎ সূর্যের কিরণ সমুদ্র আদি থেকে জলকে বাষ্পায়িত করে গ্রহণ করে, সেই জল আবার বর্ষিত হয়ে আমাদের জন্য অন্ন আদি পদার্থ উৎপন্ন করতে সহায়ক হয়ে সুখ প্রদান করে । অথবা গোরু আদি সমস্ত প্রাণী জলের সাহায্যে উৎপন্ন পদার্থের মাধ্যমে সুখী হয়ে সকলকে সুখী করে, সেভাবেই আমাদের পরস্পরের সহায়ক এবং উপকারী হওয়া আবশ্যক ।
২।
ঋষি: - অথর্বা দেবতা - মরুদ্গণঃ ছন্দঃ - বিরাড্জগতীউদীরয়ত মরুতঃ সমুদ্রতস্ত্বেষো অর্কো নভ উৎপাতয়াথ।মহঋষভস্য নদতো নভস্বতো বাশ্রা আপঃ পৃথিবীং তর্পয়ন্তু ॥অথর্ববেদ ৪।১৫।৫পদার্থঃ (মরুতঃ) হে বায়ুবেগ ! (অর্কঃ= অর্কস্য) সূর্যের (ত্বেষঃ= ত্বেষেণ) প্রকাশ দ্বারা (নভঃ) জলকে (সমুদ্রতঃ) সমুদ্র থেকে (উদীরয়ত) ওঠাও এবং (উৎ পাতয়াথ) উপরে নিয়ে যাও। (মহ ঋষভস্য) অত্যন্ত গমনশীল, (নদতঃ) গর্জিত, (নভস্বতঃ) আকাশে বিস্তৃত [মেঘ] এর (বাশ্রাঃ) টিপটিপ (আপঃ) জল ধারা (পৃথিবীম্) পৃথিবী কে (তর্পয়ন্তু) তৃপ্ত করুক ।সরলার্থঃ হে বায়ুবেগ ! সূর্যের প্রকাশ দ্বারা জলকে সমুদ্র থেকে ওঠাও এবং উপরে নিয়ে যাও। অত্যন্ত গমনশীল, গর্জিত, আকাশে বিস্তৃত [মেঘ] এর টিপটিপ জল ধারা পৃথিবীকে তৃপ্ত করুক ।[ ভাষ্যকারঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী ]
অর্থাৎ , জল, পবন ও আলো দ্বারা পৃথিবী থেকে মেঘমণ্ডলে আরোহণ করে এবং আবার পৃথিবীতে বর্ষিত হয়ে অনেক পদার্থ উৎপন্ন করে, এইভাবে সজ্জন পুরুষ বিজ্ঞান দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে সংসারে বিদ্যা বিস্তার করে।

৩।ঋষিঃ গোরিবীতিঃ দেবতাঃ ইন্দ্রঃ ছন্দঃ ত্রিষ্টুপ স্বরঃ ধৈবতঃচক্রং য়দস্যাপ্স্বা নিষত্তমুতো তদস্মৈ মধ্বিচ্চচ্ছদ্যাৎ।পৃথিব্যামতিষিতং য়দূধঃ পয়ো গোষ্বদধা ওষধীষু ॥সামবেদ ৩৩১পদার্থঃ (অপ্সু) জলের মধ্যে (অস্য) এই পরমাত্মার অর্থাৎ তাঁর দ্বারা রচিত (য়ৎ) যে (চক্রম্) আরোহন অবরোহনরূপ চক্র (আ নিষত্তম্) স্থিত আছে [‘নসত্তনিষত্তানুত্ত০' অষ্টা০ ৮।২।৬১], (উত উ তৎ) তা (অস্মৈ) এই সংসারের জন্য (মধু ইৎ) মধুকেই (চচ্ছদ্যাৎ) প্রদান করে [‘বহুলং ছন্দসি' অষ্টা০ ২।৪।৭৬]। (য়ৎ) যে (ঊধঃ) অন্তরিক্ষরূপী গাভীর দুধের মতো বিদ্যমান মেঘ (পৃথিব্যাম্) ভূমিতে (অতিষিতম্) বর্ষার ধারারূপে পতিত হয়, ['স্যতিরুপসৃষ্টো বিমোচনে' নিরু০ ১।১৫] তার মাধ্যমে, হে পরমাত্মা ! তুমি (গোষু) গাভীদের মাঝে এবং (ওষধীষু) ঔষধির মাঝে (পয়ঃ) যথাক্রমে দুধ এবং রসকে (অদধাঃ) নিহিত করো ।সরলার্থঃ এই পরমাত্মার অর্থাৎ তাঁর দ্বারা রচিত জলের মধ্যে যে আরোহন অবরোহনরূপ চক্র স্থিত আছে, তা এই সংসারের জন্য মধুকেই প্রদান করে। হে পরমাত্মা ! অন্তরিক্ষরূপী যে গাভীর দুধের মতো বিদ্যমান মেঘ ভূমিতে বর্ষার ধারারূপে পতিত হয়, তার মাধ্যমে তুমি গাভীদের মাঝে এবং ঔষধির মাঝে যথাক্রমে দুধ এবং রসকে নিহিত করো ।
অর্থাৎ , পৃথিবীর নদ, নদী, সমুদ্র প্রভৃতি থেকে জল বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে গমন করে, সেখানে মেঘের আকারে পরিণত হয়ে বর্ষা দ্বারা পুনরায় ভূমণ্ডলে নেমে আসে। এই নির্মল জল গাভীর দেহে দুধ রূপে এবং বনস্পতিসমূহের মাঝে রস রূপে রূপান্তরিত হয়। পরমেশ্বর জলের এই চক্রকে সৃষ্টি করে সর্বত্র মধুময় রসের বর্ষণ করেন, তাই সবার তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ।[ ভাষ্যকারঃ ড. রামনাথ বেদালঙ্কার ]
এই জলচক্রকে অন্যত্র বেদে এইরূপে বর্ণিত করা হয়েছে—
সমানমেতদুদকমুচ্চৈত্যব চাহভিঃ।ভূমিং পর্জন্যা জিন্বন্তি দিবং জিন্বন্ত্যগ্নয়: ॥ঋগ্বেদ ১।১৬৪।৫১সরলার্থঃ এই জল সমানরূপে দিনের কখনো ওপরে গমন করে আর কখনো নিচে নেমে আসে। মেঘ বর্ষিত হয়ে ভূমিকে তৃপ্ত করে এবং অগ্নিপিণ্ড রূপ সূর্য এই জলকে বাষ্প বানিয়ে আকাশকে তৃপ্ত করে।[ ভাষ্যকারঃ পণ্ডিত জয়দেব শর্মা মীমাংসালঙ্কার ]
পরিবেশে জলচক্রের গুরুত্ব
(১) জলে প্রায় সমস্ত পদার্থই দ্রবীভূত হতে পারে।
(২) জলচক্র ছাড়া নদী, হিমবাহ, সমুদ্রস্রোত প্রভৃতি প্রাকৃতিক ক্ষয়কারী শক্তিগুলি অচল হয়ে পড়ে।
(৩) জলচক্রের সাহায্য ছাড়া জীবজগতের উদ্ভব হত না বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
(৪) জল ছাড়া জীবজগতের অস্তিত্ব ও বিবর্তন সম্ভব নয়।
(৫) জলচক্র পরিবেশের মধ্যে জলের বণ্টনগত ভারসাম্য বজায় রাখে।
(৬) জলচক্রের সাহায্যে জীব ভূ-রাসায়নিক চক্র (Bio Geo-Chemical Cycle) কাজ করতে পারে।
(৭) জলচক্র না থাকলে, মানুষের পক্ষে কোনাে ধরনের অর্থনৈতিক কাজ, অর্থাৎ কৃষিকাজ, শিল্পোৎপাদন ইত্যাদি করা সম্ভব হত না।
(৮) প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য জলচক্রের গুরুত্ব অপরিসীম। এই প্রাকৃতিক চক্রের সাহায্যে অশ্মমণ্ডল, বারিমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল ও জীবমণ্ডলের মধ্যে সংযােগ স্থাপিত হয়।
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

বাংলাদেশ অগ্নিবীর
নমস্কার🙏🙏
ReplyDelete