দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







❝ কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্ ❞ ও এর প্রামাণিকতা

সত্যান্বেষী
0

 


 

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু ১৫টি অধিকরণে বিভক্ত। এদের মধ্যে প্রথম পাঁচটি অধিকরণ তন্ত্র নামে অভিহিত এবং এগুলিতে রাজ্যের আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা বর্ণিত হয়েছে। পরের আটটি অধিকরণের বিষয় আবাপ অর্থাৎ এক রাজ্যের সাথে। তার প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সম্পর্ক নির্ণয়; এবং শেষ দুটি অধিকরণ মিশ্র চরিত্রের। সমগ্র গ্রন্থের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাজ্যের আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা, বিদেশীয় রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, পৃথিবীর শাসনকর্তৃত্ব লাভের ব্যাপারে রাজার উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্য প্রাপ্তির জন্য নানা উপায় — এইগুলিই মোটামুটি অর্থাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে। অর্থশাস্ত্র শব্দটির ব্যাখ্যাপ্রঙ্গে কৌটিল্য বলেছেন—
(ক) পৃথিব্যাঃ লাভে পালনে চ যাবত্ত্যর্থাস্ত্রাণি পূর্বাচাযৈঃ প্রসথাপিতানি প্রায়শঃ তানি সংহৃত্য একমিদম্ অর্থশাস্ত্রং কৃতম্। (১.১.১)।
(খ) মনুষ্যাণাং বৃত্তিরর্থঃ।
তস্যাঃ পৃথিব্যাঃ লাভপালনোপায়ঃ শাস্ত্রমর্থশাস্ত্রমিতি। (১৫.১.২)।
(গ) মনুষ্যব ভূমিরিত্যর্থঃ।
মনুষ্যের বৃত্তি বা জীবিকাকে অর্থ বলা হয়।
মনুষ্যযুক্ত ভূমির নামও অর্থা প্রথম অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ের শেষে অর্থশাস্ত্রকার নিজেই বলেছেন—এই শাস্ত্রে ১৫০টি অধ্যায়, ১৮০টি প্রকরণ এবং ছয় হাজার শ্লোক আছে।
“ —শাস্ত্রসমুদ্দেশঃ সপঞ্চাশদধ্যায়শতং সাশীতি প্রকরণশতং ষট্ শ্লোকসহস্রাণি ইতি। ” (১।১।১৬)
কিন্তু বর্তমানে যে অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি আমরা পাই, তাতে দেখা যায়, গ্রন্থইট প্রধানতঃ গদ্যে দেখা এবং এতে ৩৮০টি শ্লোক আছে যাদের বেশীর ভাগই অধ্যায়গুলির শেষে সংযোজিত।
তাহলে অর্থশাস্ত্রকার যে ছয় হাজার শ্লোকসমন্বিত অর্থশাস্ত্রের কথা বলেছেন, সেটি কোন গ্রন্থ? কেউ কেউ বলেন, (যেমন, T. Ganapati Sasti) আমাদের দেশের লিপিকরেরা পুঁথি গদ্যে লিখিত হলেও তার ৩২টি ক'রে অক্ষরকে একত্রে নিয়ে একটি 'শ্লোক' খুঁজে পাওয়া যায় না। অতএব শাস্ত্রকার স্বগ্রহে যে ছয় হাজার শ্লোকের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছেন, তার প্রকৃত তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাছাড়া, আরও একটি জিজ্ঞাসা হ'ল–গ্রন্থে যেখানে বেশ কিছু প্রকৃতি শ্লোক বর্তমান, সেখানে গ্রন্থকার নিজ গ্রন্থে ৩২টি অক্ষর নিয়ে একটি শ্লোকের হিসাবে সমগ্র গ্রন্থের গদ্যরচনাগুলিকে শ্লোক সংখ্যা দিয়ে গণনা করবেন এমন চিত্তা কষ্টকল্পিত। অপরপক্ষে বলা যায়, 'অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থটি আসলে গদ্যে রচিত কিছু সূত্রের সমষ্টি। এই গদ্য-সূত্র ও প্রকৃত শ্লোকগুলিকে একত্রে গণনা করলে সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৩৭০ (কাংলের সম্পাদিত সংকলনে)। J. Jolly র পাঞ্জাব সংস্করণে এই সংখ্যা-৬৮৮০। এখন অর্থশাস্ত্র ৬ হাজার শ্লোকে রচিত হয়েছিল বলে। যে সব উক্তি দেখা যায়, তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। দণ্ডীর দশকুমারচরিতেও বলা হয়েছে—অর্থশাস্ত্র ছয় হাজার শ্লোকে রচিত। —অধীস্ব তাবদ্দণ্ডনীতিম্। ইয়মিদানীমাচার্যবিষ্ণুগুপ্তেন মৌর্যার্থে ষডুভিঃ শ্লোকসহস্ৰৈঃ সংক্ষিপ্তা। (অষ্টম অধ্যায়)। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, দণ্ডী অর্থশাস্ত্রের (১.১.১৬) “শাস্ত্রসমূদ্দেশঃ..... ষট্ শ্লোকসহস্রাণীতি”—এই উক্তির সাথে পরিচিত ছিলেন। যাহোক, মূল অর্থশাস্ত্র যে ছয় হাজার শ্লোকে রচিত, তা বর্তমানে প্রাপ্ত অর্থশাস্ত্র থেকে সমর্থনের জন্য কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই।
ডি. ডি. কোশাম্বী মনে করেন, ৩২ অক্ষরসমন্বয়ে একটি শ্লোক ধৰলে বৰ্তমান গ্রন্থে ৪৮০০ টি শ্লোক পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্রে ছয় হাজার শ্লোক ছিল—একথা স্বীকার ক’রে নিলে বর্তমান সংস্করণে ২৫ শতাংশ শ্লোক কম পাওয়া যাচ্ছে। এর সম্ভাব্য কারণ হ'ল—পরবর্তীকালে অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত অনেক ব্যাপার অপ্রচলিত হয়ে যাওয়ায় সেইগুলি বাদ দেওয়া হয়েছিল। তাই প্রতিটি অধ্যায় থেকে কিছু কিছু অংশ বাদ পড়ায় শ্লোকসংখ্যা ৬০০০ থেকে কমে ৪৮০০ হয়েছে। কিন্তু এই অইভমতের বিরুদ্ধে এ কথা বলা যায় যে, আমরা যেভাবে অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটিকে এখন পাই তাতে প্রতিটি অধ্যায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, কোনও অধ্যায় থেকে কোনও অংশ বাদ পড়েছে ব’লে কখনো মনে হয় না। অপরপক্ষে বলা যায় যে, বিশেষ বিশেষ অধ্যায়ে এমন কিছু বিষয় আলোচিত হয়েছে—যেমন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয় বা দাস ও কর্মকরদের বিষয়—তা মনু-যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতির বর্ণনা থেকে অনেক বেশী বিস্তারিত।
কৌশাম্বী তাঁর নিজের যুক্তির স্বপক্ষে বলেছেন—চতুরঙ্গ সৈন্য কর্তৃক পত্তি, অশ্ব, রথ ও হস্তীর ব্যবহার সম্পর্কে কৌটিল্য যে আলোচনা করেছেন তা অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত বিষয়ের মত বিস্তৃত ও সম্পূর্ণ নয়; অতএব পরবর্তীকালে প্রয়োগের অভাবের জন্য এই সব বিষয়ের কিছু কিছু অংশ পরিহহৃত হয়েছে বলে কৌশাম্বী মনে করেন। কিন্তু এই গ্রন্থ পাঠ করলে পাঠকের কাছে মনে হবে—যুদ্ধভূমি ও পত্তি-অশ্ব রথকর্ম (১০.৪), চতুরঙ্গ-বলের উপযোগী যুদ্ধোপায় (১০.৫), কূটযুদ্ধবিকল্প (১০.৩) প্রভৃতি যেভাবে অর্থশাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে, তার বেশী কিছু আলোচনার সুযোগ থাকলেও প্রয়োজন নেই। অতএব পরবর্তী কালে ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় অর্থশাস্ত্রের অংশবিশেষ পরিত্যক্ত হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত করা উচিত নয়। তাছাড়া, অর্থশাস্ত্রে জনপদনিবেশ, দুর্গনিবেশ প্রভৃতি অনেক বিষয় আছে যার প্রয়োজনীয়তা পরবর্তীকালে দেখা যায় না; সেগুলি কেন পরিত্যক্ত হয় নি সে প্রশ্নও এসে যায়।
🚫 অর্থশাস্ত্রে পরবর্তীকালে কিছু কিছু প্রক্ষিপ্ত অংশ প্রবিষ্ট হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। এ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, অর্থশাস্ত্রের প্রাচীন পুঁথির ধারে ধারে (margin) পাঠক নিজস্ব টীকা (note) লিখে রেখেছিলেন এবং সেগুলিই পরবর্তীসময়ে মূল গ্রন্থে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে—
(১) প্রতিলোম-বর্ণের অন্তর্গত সূত ও মাগধ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থশাস্ত্র বলেছে—পুরাণবর্ণিত সৃত ও মাগধ পরস্পর থেকে ভিন্ন; এরা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় থেকে আলাদা। —পৌরাণিকল্পন্যঃ সূতো মাগধশ্চ ব্রহ্মক্ষত্ৰিয়াদ বিশেষঃ (৩.৭.৪)। কৌটিল্যের কাছ থেকে এই ধরণের তাৎক্ষণিক মন্তব্য আশা করা যায় না। এবং এই বাক্য ব্যাকরণগত সামঞ্জস্যহীন।
(২) মিশ্রবর্ণের জাতিরা নিজ নিজ বৃত্তি বা শূদ্রবৃত্তি অবলম্বন করবেন, এই উক্তির পর কৌটিল্য বলেছেন এই ভাবে কাজ করেই রাজা স্বর্গে যান, অন্যথায় তাঁর নরকপ্রাপ্তি হয়। —কেবলমেবং বর্তমানঃ স্বর্গমাপ্নোতি রাজা, নরকমন্যথা (৩.৭.৫)। হঠাৎ এধরণের উক্তির পক্ষে কোনও যুক্তি নেই, কারণ পূর্ববর্তী সূত্রে রাজার ব্যবহার সম্পর্কে কোনও কথা বলা হয় নি। অতএব এটিও পুঁথিপার্শ্বস্থ পাঠকলিখিত মন্তব্য বলেই মনে হয়।
(৩) দৈহিক পীড়নাদি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে কৌটিল্য বললেন শূদ্রো যেনাঙ্গেন ব্রাহ্মণমভিহন্যাৎ তদস্য ছেদয়েৎ। অবপূর্ণে নিষ্ক্রয়ঃ, স্পর্শেহর্ষদণ্ডঃ। তেন চণ্ডালাশুচয়ো ব্যাখ্যাতাঃ (৩.১৯.২)।—“শূদ্র ব্রাহ্মণের যে অঙ্গে অভিঘাত করবে, শূদ্রের সেই অঙ্গ ছেদন করতে হবে। শূদ্র ব্রাহ্মণের উপর হস্তাদি উত্তোলন করলে, তাকে একাঙ্গবধ-নিষ্ক্রয়-প্রকরণে উক্ত দণ্ড দিতে হবে। শূদ্র ব্রাহ্মণের অঙ্গ স্পর্শ করলে, শূদ্রের উপর অর্দ্ধনিষ্ক্রয় দণ্ড বিহিত হবে। এর দ্বারা চণ্ডাল ও অন্যান্য নীচজাতিদেরও বিধি বুঝে নিতে হবে।” সমালোচকদের মতে, এই সূত্রগুলি অপ্রাসঙ্গিক, তাছাড়া এখানে ক্রমটি হওয়া উচিত ছিল—প্রথমে স্পর্শন, তারপর অবপূর্ণ এবং শেষে অভিঘাত। পরবর্তীসূত্রে হস্তেনাবপূর্ণে...... ইত্যাদি অনেকটা এই ক্রমই অনুসৃত হয়েছে। তাছাড়া আলোচ্য সূত্রে পীড়ন-প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণ ও শূদ্র - কেবলমাত্র এই দুই বর্ণের উল্লেখ অদ্ভুত ব'লে মনে হয়। পূর্ববর্তী একটি সূত্রে (৩.১৮.৩) ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং অন্ত্যবাসায়িদের প্রসঙ্গ যে ভাবে উত্থাপিত হয়েছে, শরীর-পীড়নাদির শাস্তি-বিধানের প্রসঙ্গে এখানেও এইসব উল্লেখ করা উচিত ছিল। তাছাড়া শূদ্রদের অপরাধের জন্য যে শাস্তির কথা অর্থশাস্ত্রের এই অংশে উল্লিখিত হয়েছে, অর্থশাস্ত্রের অন্যত্র শূদ্রদের প্রতি কৌটিল্যের এইরকম কঠোর মনোভাব দেখা যায় না। সম্ভবতঃ যাজ্ঞবল্ক্য (২.২১৫) ও মনু (৮.২৭৯-২৮৪) শূদ্রদের প্রতি এই রকম শাস্তি-আচরণের বিধান দিয়েছিলেন ব'লে, পরবর্তী কালের কোনও পুঁথিলেখক তাঁদের অভিমত অর্থশাস্ত্রে অনুপ্রবিষ্ট করিয়েছিলেন।
(৪) অপরাধী সন্দেহে কোনও ব্যক্তির অপরাধ স্বীকার করাবার জন্য কৌটিল্যের নির্দেশ হল—“যে কোনও প্রকার অপরাধের জন্য ব্রাহ্মণের উপর পীড়ন করা চলবে না। সে যে অপরাধী, তার সূচনার্থ তার ললাটদেশে অপরাধ-সূচক চিহ্ন লাগিয়ে দিতে হবে—যার ফলে সে তার কোন্ জাতীয় ব্যবহার থেকে বিচ্যুত হয়েছে তা যেন সকলেই জানতে পারে। অপরাধ অনুসারে অভিশস্ত চিহ্নগুলি হ'ল—চুরি করলে কুকুরের চিহ্ন, মানুষ বধ করলে কবন্ধের চিহ্ন, গুরুভার্যা গমন করলে স্ত্রীযোনির চিহ্ন ও মদ্য পান করলে মদ্যপতাকার চিহ্ন।”—সর্বাপরাধেদ্বপীড়নীয়ো ব্রাহ্মণঃ। তস্যাভিশস্তাঙ্কো ললাটে স্যাদ্ ব্যবহারপতনায়, স্তেয়ে শ্বা, মনুষ্যবধে কবন্ধঃ, গুরুতল্পে ভগম্, সুরাপানে মদ্যধজঃ (৪.৮.৯)। এই অধ্যায়ে এইরকম উক্তি অপ্রাসঙ্গিক ব'লে মনে হয়, কারণ এই অধ্যায়ের প্রায় সর্বত্রই প্রকৃত দণ্ডবিধানের নির্দেশ আছে, কিন্তু উপরি উক্ত সূত্রগুলিতেই কেবল অভিশস্ত চিহ্ন প্রয়োগের বিধান দেওয়া হয়েছে। এই চিহ্নপ্রয়োগের বিষয় সম্ভবতঃ মনুসংহিতার (৯.২৩৭) একটি শ্লোকের ভাব নিয়ে পরবর্তীকালে কারোর দ্বারা সংযোজিত হয়েছিল। শ্লোকটি হ'ল
গুরুতল্পে ভগঃ কার্যঃ সুরাপানে সুরাধ্বজঃ। স্তেয়ে চ শ্বপদং কার্যং ব্রহ্মহন্যশিরাঃ পুমান্।।
তবে অর্থশাস্ত্রে লক্ষণীয় যে, এই বিধান শুধুমাত্র অপরাধী ব্রাহ্মণের পক্ষে নয়, সকল প্রকার অপরাধীর পক্ষে প্রযোজ্য।
(৫) সেনাকে প্রোৎসাহিত করার জন্য সংঘবদ্ধ বা সংহত সেনাকে বিজিগীষু রাজা এইরকম বলবেন—“আমিও আপনাদের সাথে তুল্যবেতনভোগী। যুদ্ধবিজিত রাজ্য আমি আপনাদের সাথে একত্র ভোগ করব। আমি যে শত্রুদের নির্দেশ করে দেব, আপনারা তাদের অভিহত করবেন।”
'সংহত্য দণ্ডং ব্রয়াৎ—“তুল্যবেতনোংশ্মি, ভবদ্ভিঃ সহ ভোগ্যমিদং রাজ্যম্, ময়াভিহিতৈঃ পরোংভিহন্তব্যঃ।” ইতি। আমরা জানি সাধারণতঃ "ইতি" শব্দের দ্বারা বক্তব্য শেষ হয়। কিন্তু ইতি' দিয়ে বক্তব্য শেষ করার পরও আরও অনেক কথা রাজা বলেছেন এবং তার মধ্যে আবার দুটি শ্লোক বলেছেন যার আরম্ভে বলেছেন “অপীহ শ্লোকৌ ভবতঃ”। সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়ার সময় রাজা যে শ্লোক উদ্ধৃতি দিচ্ছেন, তা অর্থশাস্ত্রের মত গ্রন্থের পক্ষে বেমানান। এই রকম উক্তি পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছে ব'লে মনে হয়।
(৬) আবার দেখা যায়, কোনও বক্তব্য রাখার সময় "তত্র এতদ্ ভবতি" ব'লে শ্লোক উদ্ধৃতি দেওয়া (৭.৬.৮)। এইভাবে শ্লোক সংযোজন অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। এই প্রসঙ্গে দেখা যায়, মিত্রসন্ধিব্যাপার আলোচনা করার সময় ১২টি শ্লোকে মিত্রনিরূপণ করা হয়েছে এবং শ্লোকগুলি আরম্ভ হওয়ার আগে—‘তত্রৈতদ্ ভবতি' উক্ত হয়েছে। এখানে বর্ণিত অনেক মিত্রের কথা গ্রন্থের অন্যত্র বলা হয়েছে, তাই এখানে তাদের পুনবর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। এগুলিও পরবর্তীকালে সংযোজিত হওয়া অসম্ভব নয়।
➡️ অর্থশাস্ত্র যে পদ্য থেকে গদ্যে রূপান্তরিত গ্রন্থ নয়, তার একটি বড় প্রমাণ—বর্তমান গ্রন্থে এখনো ৩৮০টি শ্লোক অন্তর্ভুক্ত। এগুলি কেন গদ্যে রূপ গ্রহণ করে নি, তার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই সমস্ত শ্লোক কৌটিল্য সম্ভবতঃ তাঁর বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য দেখাবার জন্য কোনও পূর্ববর্তী শাস্ত্র থেকে আহরণ করেছিলেন। আবার বর্তমান গ্রন্থের কিছু শ্লোক যে কৌটিল্যের স্বরচিত, তারও প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, উপধার দ্বারা অমাত্যদের সুদ্ধীকরণ বিষয়ে পূর্ব আচার্যদের মত খণ্ডন করতে গিয়ে কৌটিল্য তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন—রাজা অমাত্যগণের শৌচপরীক্ষার সময় যেন কখনই নিজেকে বা প্রধানা রাজমহিষীকে লক্ষ্য না করেন (টেনে আনবেন না)।
ন ত্বেবং কুর্যাদাত্মানং দেবীং বা লক্ষ্মীশ্বরঃ।
শৌচহেতোরমাত্যানাম্ এতৎ কৌটিল্যদর্শনম্।। (১.১০.৬) আবার শাসনাধিকার (২.১০) অধ্যায়ে যে সব শ্লোক আছে সেগুলির সবকটিই যে কৌটিল্যের নিজস্ব রচনা, তা বোঝা যায় শেষের একটি শ্লোক থাকে—
সর্বশাস্ত্রাণ্যনুক্রম্য প্রয়োগমুপলভ্য চ। কৌটিল্যেন নরেন্দ্রার্থে শাসনস্য বিধিঃ কৃতঃ।।
🔆 অর্থশাস্ত্র যে একখানি প্রাচীন গ্রন্থ, এর ভাষাপ্রয়োগই তার প্রমাণ। যেমন, উপসর্গযুক্ত ক্রিয়ার সাথে 'ত্বা' প্রত্যয় প্রয়োগ। প্রায় চৌদ্দটি এইরকম উদাহরণ অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায়। — যথা—অপকারয়িত্বা (১৩.৩.৩; ১৩.৩.৩), অভিমন্ত্রয়িত্বা (১৪.৩.৬), অবঘোষয়িত্বা (১২.৪.৩), আদীপয়িত্বা অর্থাৎ আগুন জ্বালিয়ে (৫.১.১২), আবাহয়িত্বা (৫.৬.৪), উৎসাহয়িত্বা (১৩.৩.৪), উন্মাদয়িত্বা (৫.২.৯), উপখানয়িত্বা (৭.১৭.৭), নিস্তারয়িত্বা (৪.১২.১০), প্রলোভয়িত্বা (৫.২.১১), সংপূরয়িত্বা (১৩.৪.৩), প্রবাসয়িত্বা (১২.৪.২), প্রসঞ্জয়িত্বা (১.১৮.৫), প্রস্বাপয়িত্বা (৪.৫.২) প্রভৃতি। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি কূট কৌশল প্রয়োগ ক'রে হতবুদ্ধি করা বা অলৌকিক ক্রিয়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই প্রয়োগগুলির অধিকাংশেরই ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এই ভাষার প্রাচীনত্বকে সূচিত করে। এই ধরণের প্রয়োগ প্রাচীন পালি সাহিত্যেও দেখা যায়। যেমন উপসংকয়িত্বা, পরিবত্তেত্বা, ওতারেত্না প্রভৃতি। অর্থশাস্ত্রে মর্মজ্ঞভয় (১.৮.১) এবং সর্বজ্ঞখ্যাপন (৪.৫.৭)—প্রয়োগ দুটি মর্মজ্ঞত্ব ও সর্বজ্ঞত্ব শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। এই রকম ব্যবহারও প্রাচীনত্বের নিদর্শন। এইরকম প্রাচীন প্রয়োগ পাই— রজ্জ্বার পরিবর্তে 'রজ্জুনা' (৪.৭.৮), বর্ষারাত্রিম্ এর পরিবর্তে বর্ষারাত্রম্ (৪.৩.২), অন্যতমম্ এর পরিবর্তে অন্যতমদ্ (৪.৭.৫) প্রভৃতি ব্যবহারের মধ্যে।
🍃 উপরি উক্ত সম্ভাব্য প্রক্ষিপ্ত অংশগুলি সম্বন্ধে বলা যায় যে, অর্থশাস্ত্রের মত একখানি বিশাল গ্রন্থে কিছু কিছু প্রক্ষিপ্ত অংশের অনুপ্রবেশ অস্বাভাবিক নয় এবং এর ফলে গ্রন্থের গুরুত্ব কোনও ভাবেই হ্রাস পায় না।
সন্দর্ভঃ
১। কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্ - ড. মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
২। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র - ড. রাধাগোবিন্দ বসাক
৩। কৌটিলীয়ার্থশাস্ত্র - বেঙ্কট্নাথাচার্য, মৈসুর বিশ্ববিদ্যালয়
৪। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র - শ্যামাপ্রসাদ শাস্ত্রী
৫। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র - পি. কাংলে
৬। মহামহোপাধ্যায় গণপতি শাস্ত্রীর " শ্রীমূলা" , ভিক্ষুপ্রভমতি রচিত "চাণক্যটীকা " ও ভট্টস্বামীর " প্রতিপদপঞ্চিকা" টীকা ।
🖋️

বাংলাদেশ অগ্নিবীর

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)