১] গর্ভাধানঃ [অথর্ববেদ ৬।৮১।২] গর্ভধারণ অর্থাৎ গর্ভাশয়ে বীর্যস্থাপন-স্থিরীকরণ যে ক্রিয়া দ্বারা হয় তাহাকে গর্ভাধান বলে। যার বীজ ও ক্ষেত্র উত্তম তার যেমন উত্তম ফসল উৎপন্ন হয়, তেমনই বলবান স্ত্রী - পুরুষের সন্তানও উত্তম হয়। এজন্য পূর্ণ যৌবন অবধি ব্রহ্মচর্য পালনের পর সমাবর্তনের মাধ্যমে গৃহস্থ জীবনে প্রবেশের বিধান রয়েছে।
২] পুংসবনঃ [অথর্ববেদ ৩।২৩।৬] পত্নী গর্ভবতী হয়েছেন জানার পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় মাসে সুস্থ সন্তান কামনায় পুংসবন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যজ্ঞ করা হয়। এই অনুষ্ঠান মূলত গর্ভাবস্থায় প্রসূতির সুস্থতার জন্য এবং সন্তান ঠিকভাবে ভূমিষ্ঠ হবার জন্য করা হয়।
৩] সীমান্তোন্নয়নঃ [ঋগ্বেদ ২।৩২।৪] এই সংস্কার দ্বারা গর্ভধারিণী স্ত্রীর মন আনন্দিত হয় এবং শরীর আরোগ্য লাভ করে। গর্ভমাস হতে চতুর্থ মাসে এ সংস্কার করতে হয়।
৪] জাতকর্মঃ [ঋগ্বেদ ৫।৭৮।৯] সন্তান প্রসবের সময় মন্ত্র জপ; মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক নাভিচ্ছেদন, শিশুর যত্ন বিষয়ক কর্মসমূহকে জাতকর্ম সংস্কার বলা হয়।
৫] নামকরণঃ [যজুর্বেদ ৭।২৯] সন্তান জন্ম হওয়ার একাদশ তম দিনে আত্মীয় পরিজন ও পরিবারের ব্যক্তিদের সঙ্গে করে সন্তানের নাম রাখার সংস্কারকে নামকরণ সংস্কার বলে।
৬] নিষ্ক্রমণঃ [অথর্ববেদ ৮।২।১৪] ঘরের বাইরে শুদ্ধ বায়ুপূর্ণ স্থানে সন্তানকে ভ্রমণ করানোর সংস্কারকে নিষ্ক্রমণ বলে। যে সময় ভাল মনে হবে, সে সময়েই ভ্রমণ করানো যাবে। চতুর্থ মাসে বা এর পরে ভ্রমণ করাতে হবে।
৭] অন্নপ্রাশনঃ [অথর্ববেদ ৮।২।১৯] যখন শিশু অন্ন জাতীয় খাদ্যাদি হজম করার উপযুক্ত শক্তি লাভ করবে, তখন মুখে অন্ন দেওয়াই অন্নপ্রাশন সংস্কার।
৮] চূড়াকর্মঃ [অথর্ববেদ ৬।৬৮।৩] শিশুর মস্তক মুণ্ডন অর্থাৎ মাথার চুল ফেলে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে চূড়াকর্ম সংস্কার। ১ বছর বা ৩ বছর বয়সে এই সংস্কার পালন করতে হয়।
৯] কর্ণবেধঃ [অথর্ববেদ ৬।১৪১।২] শিশুর জন্মের তৃতীয় বা পঞ্চম বর্ষে নাক ও কান ছিদ্র করাকে কর্ণবেধ বলা হয়। এই সংস্কার এখন প্রায় বিলুপ্ত বলা যায়। আমাদের এই সংস্কার গুলোর রক্ষা করা ও পালন করা উচিৎ।
১০] উপনয়নঃ [অথর্ববেদ ১১।৫।৩] যে সংস্কার দ্বারা শিষ্যকে গুরুর সাহচর্যে শিক্ষাগ্রহণ করে বিদ্বান ব্যক্তিতে পরিণত হতে নিয়ে যাওয়া হয় তার নাম “উপনয়ন”। এই সংস্কারের মাধ্যমে গুরু তার শিষ্যকে যজ্ঞোপবীত দিয়ে দীক্ষিত করেন। উপনয়ন বর্তমানে কেবল এক বর্ণের জন্য প্রচলিত থাকলেও বৈদিক কর্মগত বর্ণব্যবস্থা অনুযায়ী এটি আবশ্যিক সংস্কার যা নারী পুরুষ, বর্ণ নির্বিশেষে বাধ্যতামূলক। উপনয়নের স্বীকৃতির মাধ্যমেই মানব দ্বিজত্ব লাভ করে ও শাস্ত্রচর্চাদি কর্মে অধিকার লাভ করে।
১১] বেদারম্ভঃ [অথর্ববেদ ১১।৫।২৪] গায়ত্রী মন্ত্র থেকে শুরু করে চারবেদ অধ্যয়নের জন্য যে নিয়ম-ধারণ করতে হয়, তাকে বেদারম্ভ সংস্কার বলে। যেদিন উপনয়ন হয় সেদিনই এই সংস্কার করতে পারে। অথবা ১ বছরের মধ্য করতে হয়।
১২] সমাবর্তনঃ [ঋগ্বেদ ৩।৮।৪] শাস্ত্র অধ্যয়ন ও শিক্ষা সমাপ্ত হলে গুরুগৃহ থেকে গৃহে ফিরে গৃহস্থাশ্রম গ্রহণের জন্য সমাবর্তন সংস্কার পালন করা হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এমন অনুষ্ঠান প্রচলিত রয়েছে।
১৩] বিবাহঃ [অথর্ববেদ ১১।৫।১৮] সমাবর্তনের পর গৃহাশ্রমের জন্য শুভ গুণ কর্ম ও স্বভাবের দিক দিয়ে সকলদিক দিয়ে তুল্য ও প্রীতিযুক্ত হয়ে স্ত্রী পুরুষের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনই বিবাহ সংস্কার। বিয়ের পর গৃহাশ্রমে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ লাভের জন্য নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পরোপকার করা, ঈশ্বর উপাসনা ও গৃহকর্ম করা, সত্যধর্মে একনিষ্ঠ হওয়া এবং ধর্মানুসারে চলা কর্তব্য।
১৪] বানপ্রস্থঃ [ঋগ্বেদ ১০।১৪৬।৫] বিবাহের পরে ধর্মানুসারে সন্তান প্রাপ্তি সহ সংসারের কাজ শেষ করে মহাত্মাগণের সহিত যোগাভ্যাস, শাস্ত্র আলোচনা ও পরমাত্মার সাক্ষাৎ লাভের প্রযত্ন করাকে বানপ্রস্থ সংস্কার বা গৃহাশ্রমসংস্কার বলে।
১৫] সন্ন্যাসঃ [ঋগ্বেদ ৯।১১৩।৪] সংসারের মায়া মোহত্যাগ ও পক্ষপাত ত্যাগ করে, বৈরাগ্যবান হয়ে পরোপকারের জন্য ও সমাজের কল্যাণের জন্য পরিভ্রমণ করা সন্ন্যাস সংস্কার।
১৬] অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াঃ [যজুর্বেদ ৪০।১৫] মৃত্যুর পর দাহকার্য সম্পাদন করা অর্থাৎ অন্তিম সংস্কারকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বলে। অন্ত্যেষ্টিই শেষ সংস্কার। এরপর শরীরের জন্য অন্য কোনো সংস্কারই অবশিষ্ট থাকে না। এর নাম নরমেধ, পুরুষমেধ, নর যাগ ও পুরুষ যাগ। শ্মশান ভূমিতে জ্বলন্ত চিতায় সমিধা, সুগন্ধি, রোগনাশক ওষধি এবং ঘৃত আহুতি দ্বারা মৃত শরীরকে ভস্মীভূত করাই অন্ত্যেষ্টি। জীব তার কৃত কর্মের ফল নিজেই ভোগ করে। বংশধরদের শ্রাদ্ধাদি কোনো কার্যই তাকে সাহায্য করতে পারে না।
বেদ নির্ধারিত এই ১৬ সংস্কারের পালন ও রক্ষণ প্রত্যেক সনাতনীর জন্য একান্ত কর্তব্য। এগুলো পালনের পদ্ধতির জন্য মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী রচিত “সংস্কার বিধি” পুস্তক দ্রষ্টব্য।
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক