দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







পঞ্চমহাযজ্ঞ কী ও কিভাবে করা হয় ?

সত্যান্বেষী
0


আমরা ৫টি জায়গায় প্রতিদিন অজ্ঞাতসারে পাপ বা হিংসা করি -

পঞ্চ সূনা গৃহস্থস্য চুল্লী পেষণ্যুপস্করঃ ।
কণ্ডনী চোদকুম্ভশ্চ বধ্যতে যাস্তু বাহয়ন্ । ।
তাসাং ক্রমেণ সর্বাসাং নিষ্কৃত্যর্থং মহর্ষিভিঃ ।
পঞ্চ ক্ল্প্তা মহাযজ্ঞাঃ প্রত্যহং গৃহমেধিনাম্ । ।
অধ্যাপনং ব্রহ্ময়ম্যজ্ঞঃ পিতৃযজ্ঞস্তু তর্পণম্ ।
হোমো দৈবো বলির্ভৌতো নৃযজ্ঞোঽতিথিপূজনম্ । ।
মনুস্মৃতি ৩।৬৮-৭০
অনুবাদঃ চুল্লী, জাঁতা বা শিল নোড়া, উপস্কার বা হাড়িকড়া, কন্ডনী বা ঢেকি ও কলসী এই পাঁচটির নাম সূনা বা পশুবধস্থান। এগুলো নিয়ে কাজ করতে গেলে অজ্ঞাতসারে যে প্রাণিহিংসা ঘটে, তার জন্য গৃহস্থকে পাপে লিপ্ত হতে হয় ।
উপরোক্ত পাঁচটি থেকে উৎপন্ন পাপের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহর্ষিগণ গৃহস্থদের পক্ষে যথাক্রমে পাঁচটি মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠানের বিধান দিয়েছেন।
বেদাদি অধ্যায়ন ও অধ্যাপনার নাম ব্রহ্মযজ্ঞ, অন্ন উদকাদির দ্বারা জীবিত পিতৃপুরুষদের শ্রদ্ধা সহকারে তপর্ণের নাম পিতৃযজ্ঞ, অগ্নিতে প্রক্ষেপরূপ হোমের নাম দেবযজ্ঞ, পশুপাখি,কৃমি, কুকুর, বেড়াল, অধম, পাপীকে খাওয়ানোর নাম ভূতযজ্ঞ এবং অতিথি সেবার নাম নৃযজ্ঞ বা মনুষ্যযজ্ঞ ।
মহর্ষি যাস্কাচার্য লিখিত বৈদিক শব্দকোষ নিরুক্তে [৭।১] বলা হয়েছে-
“য়ৎকাম ঋষির্য়েস্যাং দেবতায়ামার্থপত্যমিচ্ছন্স্তুতিং প্রযুংক্তে তদ্দৈবতঃ স মন্ত্রো ভবতি॥”অর্থাৎ যখন ঈশ্বর কোন একটি বিষয়ের সম্বন্ধে আমাদের মন্ত্রের মাধ্যমে শিক্ষা দেন তখন মন্ত্রের সেই বিষয়টিকে দেবতা বলা হয়।
উদাহরণস্বরূপ ঋগ্বেদ ১০।১৫১ এর দেবতা হলো ‘শ্রদ্ধা’ এবং এই সূক্তের আলোচ্য বিষয় হলো ঈশ্বর ও গুরুজনে শ্রদ্ধা বা সম্মান। ঋগ্বেদ ১০।১১৭ এর দেবতা হলো ‘ধনদানপ্রশাংসা’ এবাং এই সুক্তের মন্ত্রসমূহের আলোচ্য বিষয় হলো গরীবদুঃখীদের দানে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। ঋগ্বেদ ১০।১৪৬ এর দেবতা হলো ‘দ্যুতনিন্দা’ এবং তাই এর আলোচ্য বিষয়বস্তু হলো জুয়াখেলার অপকারিতা ও নিষিদ্ধতা। ঋগ্বেদ এর প্রথম মণ্ডলের প্রথম সূক্তের দেবতা হলো ‘অগ্নি’। আজ ম্যাক্সমুলার সহ বিদেশী মিশনারীদের অপপ্রচারের কারণে একে সবাই নির্দিষ্ট আকৃতিযুক্ত আলাদা একটি দেবতা মনে করে, যদিও তা সম্পূর্ণ ভুল।
•  উপযোগের দেব - এই তেত্রিশ প্রকার দেব এর মধ্যে কেবল জীবাত্মা চেতন। ইহা অন্যের উপযোগ করে অথবা স্বয়ং অন্য জীবাত্মার উপযোগে আসে। যেমন গাভী দুধ দিয়ে, ভেড়া ঊণ [লোম] দিয়ে, ষাঁড় হাল চাষের উপযোগে আসে। তেমনি সৈনিক, বৈদ্য আদিও উপযোগে আসে। জীবাত্মার অতিরিক্ত শেষ বত্রিশ দেব জড় এবং উপযোগের দেব বলা হয়।
•  ব্যবহারের দেব - মাতা, পিতা,আচার্য, অতিথি এবং পতি-পত্নী দ্বারা সংসারের ব্যবহার সিদ্ধ হয়। এ জন্য এই পাঁচ কে ব্যবহারের দেব বলা হয়।
এই পাঁচজন বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষ দেব-দেবী। তৈত্তিরীয় উপনিষদেও আমরা এইরূপ দেবতাদেরই দেখতে পাই এবং তাদের পূজনের কথা পাই। “মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব, আচার্য়দেবো ভব, অতিথিদেবো ভব।” তৈত্তিরীয় উপনিষদ ১।১১।২। তবে দেব হবেন তিনিই, যাঁর মধ্যে উত্তম গুণাবলী তথা বিভিন্ন দৈবী সম্পদ [গীতা ১৬।১-৩] রয়েছে। পিতামাতা, আচার্য, পতি-পত্নী প্রত্যেকে আদর্শ আচরণ না করলে তারা দেব হিসেবে আখ্যার যোগ্য হবেন না।
গীতায় বলা আছে যে যজ্ঞ সম্পন্ন হলে দেব বা বিদ্বান ইষ্টকে অর্থাৎ যজ্ঞ সম্পন্নকারীকে ফল দান করবেন। অর্থাৎ গীতা ও মনুস্মৃতিতে যে দেবযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে তা নিরুক্ত অনুসারে মূলত বিদ্বান মানবদের ও পরিবেশের শুদ্ধিকারী দেবযজ্ঞের কথা ।
আর এই ধরণের যজ্ঞ কেন করবেন ও করলে কি হয় তাও একবার দেখুন-
অন্নাদ্ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ। যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ ॥ ৩/১৪ অর্থ: সকল প্রাণী অন্ন থেকে উৎপন্ন হয়, অন্নের উৎপত্তি হয় বৃষ্টি থেকে , বৃষ্টি হয় যজ্ঞ দ্বারা এবং যজ্ঞ কর্ম দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে। কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্। তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ ॥ ৩/১৫ অর্থ:  কর্ম বেদ থেকে উৎপন্ন বলে জানবে। বেদ অবিনাশী অক্ষর  থেকে উৎপন্ন। সেজন্য সর্বব্যাপী ব্রহ্ম  নিত্য (সবসময়) যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত।
অক্ষর শব্দে ক্ষয় রহিত পরমাত্মাকে বুঝানো হয়েছে (মুণ্ডক উপনিষদ : ১/১/৭)। প্রাচীন টীকাকারেরা বলেছেন - ব্রহ্ম শব্দে এখানে বেদ বুঝতে হবে এবং অক্ষর শব্দে পরমাত্মা। তবে কেউ কেউ প্রথম চরণে ব্রহ্ম শব্দে বেদ বুঝেছেন, দ্বিতীয় চরণে ব্রহ্ম শব্দে পরমব্রহ্ম বুঝেছেন। তা না হলে অর্থের অসঙ্গতি হয়। কিন্তু শঙ্করাচার্য দ্বিতীয় চরণেও ব্রহ্ম শব্দে বেদ বুঝেছেন। অর্থাৎ ‘বেদ সর্বার্থ প্রকাশক হেতু নিত্য যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত।’ তবে এজন্য মূল তাৎপর্যের কোনো সমস্যা হয় না। পাঠক যেকোনো একটি অনুবাদ গ্রহণ করতে পারে। আমরা এই স্থানে  শ্রীধর স্বামী, কেদারনাথদত্ত, বিশ্বনাথ ইত্যাদি বহু প্রচলিত টীকাকারের অর্থ গ্রহণ করেছি ।
এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ যঃ। অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি ॥ ৩/১৬ অর্থ: হে পার্থ (অর্জুন)! যে এই পৃথিবীতে এই প্রকার প্রবর্তিত চক্র অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগী পাপময় ব্যর্থ জীবন ধারণ করে।
‘প্রবর্তিত’ শব্দে উপরে উল্লেখিত কর্মকে বুঝানো হয়েছে। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন যে, গীতা ও বৈদিক গ্রন্থসমূহে যজ্ঞের মাধ্যমে দেবতা পূজা বলতে কি বুঝানো হয়েছে ।
যজ্ঞাশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ।ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ ॥ ৩/১৩অর্থ:- যজ্ঞে অবশিষ্ট অন্নের ভোগকারী শ্রেষ্ঠ মানুষেরা সকল পাপ থেকে মুক্ত হন। আর যে পাপী (শুধুমাত্র) নিজের শরীর পালনের জন্য পচন [ রান্না ] করে তারা তো পাপকেই ভোজন করে।
এখানে ‘যজ্ঞ’ শব্দে পঞ্চমহাযজ্ঞ বুঝানো হয়েছে।
  • ১। ব্রহ্মযজ্ঞ (শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং সন্ধ্যোপাসনা),
  • ২। দেবযজ্ঞ (হবন অর্থাৎ অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে যে যজ্ঞ করা হয়),
  • ৩। পিতৃযজ্ঞ (পিতা-মাতা সহ গুরুজনদের শ্রদ্ধার সাথে সেবা করা),
  • ৪। অতিথিযজ্ঞ (ধর্মাত্মা অতিথিদের সেবা করা),
  • ৫। ভূতযজ্ঞ (প্রাণীদের সেবা করা) ⎯এই পাঁচ প্রকার যজ্ঞ সম্পন্ন করার পর অবশিষ্ট অন্ন ভোগকারী পাপমুক্ত হয় ।
ঋগ্বেদ ১০.১১৭.৬ এবলা হয়েছে -
মোঘমন্নং বিন্দতে অপ্রচেতাঃ সত্যং ব্রবীমি বথ ইতস তস্য৷নার্যমণং পুষ্যতি নো সখায়ং কেবলাঘো ভবতি কেবলাদী।।- উদার চিত্তরহিত, অদূরদর্শী, ক্ষুদ্রজ্ঞানী ব্যক্তির ধন উপার্জন ও অন্নাদি ভোজন সবই ব্যর্থ হয়। আমি সত্য বলছি যে,  ঐসব ধন বৈভব তার জন্য মৃত্যুস্বরূপ। যে ব্যক্তি অন্নাদি দ্বারা বিদ্বান ব্যক্তি অথবা তার আত্মীয় স্বজনকে পালন পোষণ করে না, প্রকৃতপক্ষে সেই একলা ভোজনকারী ব্যক্তি শুধু পাপই ভোজন করে অর্থাৎ সে পাপী হয়৷।
উক্ত শ্লোকের ভাব মনুস্মৃতিতেও সরাসরি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে -
পঞ্চৈতান্যো মহাঅয়জ্ঞান্ন হাপয়তি শক্তিতঃ ।
স গৃহেঽপি বসন্নিত্যং সূনাদোষৈর্ন লিপ্যতে ।
মনুস্মৃতি ৩।৭১
অনুবাদঃ যে গৃহস্থ প্রতিদিন পূর্বোক্ত পাঁচটি মহাযজ্ঞ যথাসম্ভব পরিত্যাগ না করেন, তিনি গৃহস্থাশ্রমে বাস করেও সূনা বা পশুবধস্থান জনিত দোষে লিপ্ত হন না ।

  • পঞ্চমহাযজ্ঞের বৈদিক প্রমাণ ও পালন পদ্ধতি

প্রথম ব্রহ্মযজ্ঞ, [ঋগ্বেদ ১।৬।১] ব্রহ্মযজ্ঞ হলো ব্রহ্মকে জানার প্রচেষ্টা। পশুজন্মের সাথে মানবজন্মের পার্থক্য কী? একটি পশু আহার করে, ঘুমায়, মৈথুন করে। একজন মানুষের জীবনও‌ যদি আহার, নিদ্রা, মৈথুনেই কেটে যায়, তাহলে পশুর সাথে তার পার্থক্য কী! ঈশ্বর আমাদের‌ শ্রেষ্ঠ মনুষ্যযোনী দিয়েছেন, বর্তমান মনুষ্য জন্মকে সার্থক তখনই করতে পারি, যদি আমরা এই দুর্লভ জন্মকে ব্রহ্ম সাধনার কাজে লাগাই।‌ তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়। [যজুর্বেদ ৩১।১৮]। এই ব্রহ্মকে জানলেই মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায়, মুক্তিলাভের আর কোনো উপায় নেই। এভাবেই আমরা‌ ক্রমান্বয়ে জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিরূপ মোক্ষের দিকে ধাবমান হতে পারব। ব্রহ্মকে জানার যেকোনো প্রচেষ্টাই ব্রহ্মযজ্ঞ। সাধারণত যোগ, প্রাণায়াম, স্বাধ্যায় [শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন], অধ্যাপনা, ঈশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা, উপাসনা এসকলই ব্রহ্মযজ্ঞের অন্তর্ভুক্ত।
 
দ্বিতীয় দেবযজ্ঞ,[ঋগ্বেদ ৮।৪৪।১, যজুর্বেদ ৩।১, যজুর্বেদ ১২।৩০] নিত্য অগ্নিহোত্রসহ সকল যজ্ঞ, প্রাকৃতিক দেবের পরিশুদ্ধির উদ্দেশ্যে হবি অর্পণ, বিদ্বানগণের সংসর্গ লাভ ও সেবা করাই দেবযজ্ঞ। গীতায় আছে, তাই প্রতিদিন কিংবা বিশেষ তিথিতে কাষ্ঠ, নানা আহার্য শস্যদ্রব্য, ঘৃত, সুগন্ধি মশলা, কেসর, জাফরান, পুষ্প প্রভৃতি দিয়ে যজ্ঞ করতে হবে। নানা সুগন্ধি দ্রব্য হবি দেয়ার ফলে বায়ু বিশুদ্ধ ও নিরোগ থাকে।
 
তৃতীয় পিতৃযজ্ঞ, [যজুর্বেদ ২।৩৪] আমাদের প্রপিতামহ-প্রপিতামহী, পিতামহ-পিতামহী, মাতা-পিতা, স্বগোত্রীয় কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ, গুরু বা আচার্য তথা অন্য যেকোনো বিদ্বান্ বা শিক্ষিত ব্যক্তি যাঁরা অনুভবপ্রবীণ, জ্ঞানপ্রবীণ ও মান-সম্মান পাওয়ার যোগ্য তাদেরকে ‘পিতর’ বলা হয়। তাদের যথাযথভাবে সন্মান প্রদর্শন, তাঁদের সাথে ভালো আচরণ ও তাঁদের শ্রদ্ধা করাই পিতৃযজ্ঞ। ‘য়ে সমানাঃ সমনসঃ পিতরো য়মরাজ্যে’, [যজুর্বেদ ১৯।৪৫] ‘পিতৃভ্যঃ স্বধায়িভ্যঃ স্বধা নমঃ’, [যজুর্বেদ ১৯।৩৬] পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহাদির তথা ‘নমো বঃ পিতরো রসায়’ ইত্যাদি মন্ত্র [যজুর্বেদ ২।৩২] পিতরদের সেবা ও সৎকার করার পক্ষে প্রমাণস্বরূপ। ‘অহতৌ পিতরৌ ময়া’ [যজুর্বেদ ১৯।১১] = আমার মাধ্যমে যেন আমার মা-বাবা কষ্ট না পায়।
 
এ বিষয়ে মহর্ষি মনু বলেছেন— “কুর্য়াদহরহঃ শ্রাদ্ধমন্নাদ্যেনোদকেন বা। পয়োমূলফলৈর্বাঽপি পিতৃভ্যঃ প্ৰীতিমাবহন্॥ [মনুস্মৃতি ৩।৮২]” অর্থাৎ গৃহস্থ ব্যক্তি অন্নাদি ভোজ্য পদার্থ এবং জল, দুধ, কন্দমূল, ফল ইত্যাদি দ্বারা পিতরদের প্রসন্নতার জন্য প্রতিদিন শ্রাদ্ধ করবে অর্থাৎ শ্রদ্ধা সহকারে পিতামাতার সেবা-সৎকার করবে। এখানে ভগবান্ মনু স্পষ্টভাবে জীবিত পিতরদের সেবা করার জন্য বিধান দিয়েছেন এবং সেটি প্রতিদিন করতে বলেছেন।
 
প্রসঙ্গত অন্ত্যেষ্টি কর্ম ব্যতীত পৃথক কোনো কর্ম মৃতের জন্য দ্বিতীয়বার কর্তব্য নয়। মূলত ‘শ্রাদ্ধ’ শব্দের মূল অর্থ শ্রদ্ধা, “শ্রৎ সত্যং দধাতি য়য়া ক্রিয়য়া সা শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধয়া য়ৎ ক্রিয়তে তচ্ছ্রাদ্ধম্।” অর্থাৎ যে ক্রিয়া দ্বারা সত্যকে গ্রহণ করা যায় তার নাম শ্রদ্ধা এবং যা শ্রদ্ধা সহকারে করা যায়, তার নাম শ্রাদ্ধ। মৃত্যুর পরে তো জীব কর্মানুসারে বিভিন্ন যোনিতে গমন করে, অতএব মৃত্যুর ১৫ দিন বা ১ মাস পরে কোনো অনুষ্ঠান করে তাদের তৃপ্তি বা সেবা কখনো সম্ভব নয়৷ আর মাতা, পিতা, পুত্রাদি সম্বন্ধ শারীরিক। শরীর নষ্ট হওয়ার পর কে কার পিতা আর কে কার পুত্র? অতএব জীবিতকালে শ্রাদ্ধ করাই বৈদিক নিত্যকর্ম।
 
চতুর্থ ভূতযজ্ঞ হলো জগতের সকল মানুষ ও পশুপাখির কল্যাণ কামনা ও তাদের সর্বদাই যথাসাধ্য সাহায্য করা [ঋগ্বেদ ২।১৩।৪]। “দ্বিপাদব চতুষ্পাৎ পাহি” [যজুর্বেদ ১৪।৮] দ্বিপাদ ও চতুষ্পাদ প্রাণীদের সংরক্ষণ করো। “ঊর্জম্ নো ধেহি দ্বিপদে চতুষ্পদে” [যজুর্বেদ ১১।৮৩] সকল দ্বিপদী ও চতুষ্পদী বৃদ্ধি ও পুষ্টিপ্রাপ্ত হোক- এভাবেই পবিত্র বেদে সকল প্রাণীর সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। মানব ও পশুর প্রতি আমাদের সর্বদাই উত্তম আচরণ করা উচিত। আমরা অসুস্থ মানবের সেবা করতে পারি, দুঃস্থদের সাহায্য করতে পারি, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দিতে পারি, অবলা প্রাণীর জন্যও আহার, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারি। এসবই ভূতযজ্ঞ। শুনাং চ পতিতানাং চ শ্বপচাং পাপরোগিণাম্। বয়সানাং কৃমীণাং চ শনকৈর্নির্বপেদ্ ভুবি॥ [মনু ৩।৯২] কুকুরাদি পশু, পতিত ব্যক্তি, অত্যন্ত দরিদ্র ব্যক্তি, কুষ্ঠাদি ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী, কাক আদি পক্ষী ও পিঁপড়া আদি কীটের জন্যে খাদ্যদ্রব্যের ছয় ভাগ আলাদাভাবে ভাগ করে দেওয়া ও তাদেরকে সদা প্রসন্ন রাখা উচিত।
 
পঞ্চম ‘অতিথিযজ্ঞ’ অতিথিদের যথাযথ সেবা। যিনি পূর্ণ বিদ্বান, পরোপকারী, জিতেন্দ্রিয়, ধার্মিক, সত্যবাদী, ছল-কপট-রহিত, নিত্য ভ্রমণকারী মানুষ, তিনিই ‘অতিথি’। [অথর্ববেদ ৯।৬।[৩]১-৮] কারো ঘরে যখন‌ এসব গুণযুক্ত, সেবা করার যোগ্য অতিথি আসেন; তখন তাঁকে গৃহস্থ দাঁড়িয়ে নমস্কার করে, উত্তম আসনে বসাবেন। পরে গৃহস্থ তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন, “আপনার জল, খাদ্য বা অন্য কোনো বস্তুর ইচ্ছা হয় সেটা বলুন। হে অতিথি! যেভাবে আপনার কামনা পূর্ণ হয়, আমরা সেভাবেই আপনার সেবা করবো।” এভাবেই আমরা পরস্পর সেবা ও সৎসঙ্গপূর্বক বিদ্যাবৃদ্ধি দ্বারা সর্বদা আনন্দে থাকতে পারি।‌

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বিরচিত পঞ্চমহাযজ্ঞবিধি বইটি পড়ুন



বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)