
পরমাত্মা,চিরন্তন,শাশ্বত,নিত্য,শুদ্ধ,চৈতন্য,স্বয়ম্ভু,নিরাকার,সর্বব্যাপি,জগতের,অধিপতি,জন্মরহিত,মৃত্যুরহিত,হিংসারহিত,দুঃখরহিত,কামনা-বাসনা শুণ্য, আনন্দস্বরুপ, যিনি সৃষ্টিকর্তা,ধংসকর্তা এবং কর্মফল প্রদাতা,সর্বজ্ঞানী, এবং সর্বশক্তিমান।
এই মহাবিশ্বে এমন কোন স্থান শূন্য নেই যেখানে তিনি নেই। সমগ্র জগৎকে যিনি ধারণ করেন এবং বারংবার রচনা করেন। তার সৃষ্টির এই সমগ্র জগৎ এ তার প্রকাশ বিদ্যমান।

পরমাত্মার ন্যায় জীবাত্মাও অনাদি, চিরন্তন। পরমাত্মা,এবং জীবাত্মার, উভয়ের কোনো আদি এবং অন্ত নেই, সৃষ্টি এবং ধংস নেই। পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার তুলনা করলে দেখা যায়, জীবাত্মা অসংখ্য কিন্তু পরমাত্মা এক এবং অদ্বিতীয়,, পরমাত্মা সর্বজ্ঞানী কিন্তু জীবাত্মা নির্দিষ্ট জ্ঞানে সীমাবদ্ধ,, পরমাত্মা সর্বত্রই বিরাজিত আর জীবাত্মা শুধুমাত্র চেতন দেহে বিরাজিত,, পরমাত্মা সর্বশক্তিমান আর জীবাত্মার শক্তি সীমিত।
ঋগবেদের একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে যে একটি বৃক্ষে দুইটি পক্ষী অবস্থান করেছে। বৃক্ষটি জগৎ এবং দুইটি পক্ষীর একটি জীব(জীবাত্মা), অন্যটি ব্রহ্ম(পরমাত্মা)। প্রকৃতি, জীব ও ব্রহ্ম এরা অনাদি।
জীবাত্মা সংসারে পাপ পূণ্যের ফলভোগ করেন এবং পরমাত্মা ফল ভোগ না করিয়া সাক্ষী রূপে বর্ত্তমান থাকেন।
আমাদের দেহের চেতন গুণকেই জীবাত্মা বলা হয়। এই জীবাত্মার দ্বারাই আমারা সুখ, দুঃখ এবং আনন্দ ভোগ করি। যতক্ষন এই দেহের মধ্যে জীবাত্মা বিদ্যমান ততক্ষন আমরা জীবিত থাকি। শরীর এবং জীবাত্মার বিয়োগ হলে শরীর অচল(মৃত,জড়) হয়ে যায়। কর্ম অনুযায়ী এই জীবাত্মা এক শরীর থেকে অন্য শরীরে বিচরণ করে কর্মের ফল ভোগ করে।জীবাত্মার কোনো লিঙ্গ বিশেষ নেই তিনি যখন যেরুপ দেহে আরোহণ করেন সেই রুপেই আবদ্ধ হয়ে যান।

কোনো কিছু অর্জন করার ইচ্ছা , কোনো কিছু থেকে অপছন্দ ( দ্বেষ ) , চেষ্টা করার ইচ্ছা ( প্রযত্ন ) , সুখ অনুভব করা ,দুঃখ অনুভব করা , জ্ঞান আছে ।
বৈশেষিক ৩/২/৪ সূত্র অনুসারে যখন আত্মা মরণশীল শরীরে থাকে তখন আত্মার বিস্তারিত বৈশিষ্ট গুলি হল -





ঈশ্বরের ন্যায় প্রকৃতিও অনাদি, চিরন্তন। প্রকৃতির সৃষ্টি হয়না এবং ধংস ও হয়না। ঈশ্বর এবং জীবাত্মা ছাড়া এই মহাবিশ্বে যা কিছু বিদ্যমান তা সব মিলিয়েই প্রকৃতি। ঈশ্বর এই প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করেন। তিনি এই জগৎকে এবং জগৎ এর নিয়ম কে প্রকৃতির দ্বারাই গঠন করেছেন। তাই এই প্রকৃতি জগৎ এর উপাদান কারন এবং ঈশ্বর নিমিত্ত কারন। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সেই অব্যাক্ত প্রকৃতি হতে জগৎ কে বার বার রচনা করেন। যখন জগৎ ধ্বংস হয়ে যায় তখন প্রকৃতি পুনরায় এমন এক অবস্থায় চলে যায় যখন সেখানে অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকেনা। সেই প্রকৃতি হতেই ঈশ্বর নিজ সামর্থ্য দ্বারা জগৎকে পুনরায় রচনা করে থাকেন।
স্বত্তঃ, রজঃ এবং তমঃ গুণের সমন্নয় দ্বারা সমস্তকিছুই আচ্ছাদিত হয়ে থাকে আর এই মেলবন্ধন কে প্রকৃতির নিয়ম বলা হয়ে থাকে।
প্রকৃতি নিজে থেকেই কিছু করতে পারার সামর্থ্য রাখে না, ঈশ্বরের অনুপ্রেরণায় প্রকৃতি হতে সমস্তকিছু প্রকটিত হয় এবং পরবর্তীতে প্রকৃতির নিয়মেই এই জগৎ চালিত হয়, প্রকৃতির নিয়মেই এই জগৎ সৃষ্টি এবং ধংস হয়। মহাবিশ্বে এই অবিচ্ছিন্ন পরিবর্তন প্রকৃতির চিরন্তন আইন।

মহী দেব্যু ষসো বিভাতী সৈকেনৈকেন মিষতা বিচষ্টে।।


এই নিত্যাপ্রকৃতি সর্বদায় পরিণাম যুক্তা,পুরাতন, নব নব রূপ ধারিণী এবং সর্বকার্য্যে কারণরূপে বিরাজমানা। প্রত্যেক গতিশীল জীবের সঙ্গেই এই প্রকৃতি নিজের স্বরূপ ও সত্ত্বা প্রকাশ করিতেছে।


ঈশ্বর ও জীবাত্মা অনাদি । কর্মফল ও পূর্বকল্প অনুযায়ীই জীব দেহধারণ করেন ।
ঈশ্বর সর্বশক্তিমান । তিনি নিজে আনন্দ ও রসস্বরূপ । তাঁর নিজস্ব কোন কামনা বা ইচ্ছা নেই । তিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ । এজন্য বলা হয়েছে তিনি 'অকামো ধীরো অমৃতঃ স্বয়ম্ভু রসেন তৃপ্তো ন কুতশ্চনোনঃ - অথর্ববেদ ১০.৮.৪৪ ' ।
তথাপি জীবাত্মা যেহেতু তাঁর সাথেই অনাদি ও তিনি তাদের পালক রক্ষক ও কর্মফল বিধাতা তাই তিনি জীবাত্মাদের সখাত্ব ও তাদের মোক্ষপথে ধাবিত ইচ্ছা করেন । এটা পরমেশ্বরের কোন দুর্বলতা নয় । বরং আমাদের উন্নতি ও মঙ্গল কল্পেই তিনি তা করেন ।
জ্ঞাজ্ঞৌ দ্বাবজাবীশানীশাবজা হ্যেকা ভোক্তৃভোগ্যার্থযুক্তা ।
অনন্তশ্চাত্মা বিশ্বরূপো হ্যকর্তা ত্রয়ং য়দা বিন্দতে ব্রহ্মমেতৎ ।। ৯ ।।
সরলার্থঃ সর্বজ্ঞ ব্রহ্ম এবং অজ্ঞ জীব— এই উভয়েই অনাদি। এদের মধ্যে সর্বস্বামী ব্রহ্ম অনন্ত সামর্থ্যবান, কিন্তু জীব অসমর্থ। তৃতীয় নিশ্চিতরূপে এক অজন্মা প্রকৃতি, ভোক্তা জীবের ভোগের সামগ্রীযুক্ত। সেই অনন্ত পরমাত্মা, বিশ্বরূপ অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বই সর্বব্যাপক পরমেশ্বরের অবয়ব স্বরূপ এবং নিশ্চিতরূপে তিনি কর্ম ও কর্মফলের বন্ধনে লিপ্ত হন না। যখন মানুষ, উক্ত (ব্রহ্ম, জীব এবং প্রকৃতি) তিন সত্তাকে যথার্থভাবে জানেন, তখন তিনি ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়ে মোক্ষসুখ ভোগ করেন ।। ৯ ।।(শেতাশ্বতর উপনিষদ)

এতজ্ জ্ঞেয়ং নিত্যমেবাত্মসংস্থম্ নাতঃ পরং বেদিতব্যং হি কিঞ্চিৎ ।
ভোক্তা ভোগ্যং প্রেরিতারং চ মত্বা সর্বং প্রোক্তং ত্রিবিধং ব্রহ্মমেতৎ ।। ১২।।
সরলার্থঃ এই ব্রহ্মকে সর্বদাই আত্মায় স্থিত বলে জানা উচিত, নিশ্চিতরূপে এর থেকে শ্রেষ্ঠ কোন কিছুই জানার যোগ্য নেই। সুখ-দুঃখ ভোগকারী জীবাত্মা, ভোগ্য প্রকৃতি এবং প্রেরক পরমাত্মা—জ্ঞানীগণের দ্বারা কথিত এই ত্রিবিধ অনাদি তত্ত্বকে (ব্রহ্ম, জীব এবং প্রকৃতিকে) সর্বপ্রকারে জেনে, জীব এই ব্রহ্মকে লাভ করেন ।। ১২ ।।(শেতাশ্বতর উপনিষদ)


তাহলে কি ঈশ্বর সাকার রুপ ধারণ করতে পাড়েন? 




ঈশানো ভূতভব্যস্য স এবাদ্য স উ শ্বঃ ৷ এতদ্বৈ তৎ ৷৷১৩।।(কঠোপনিষদ ২.১.১৩)
পদার্থঃ (অংগুষ্ঠমাত্রঃ) অঙ্গুষ্ঠমাত্র স্থানীয় (পুরুষঃ) পুরুষ (অধূমকঃ) ধূমরহিত (জ্যোতিঃ,ইব) জ্যোতির ন্যায় নির্ভ্রান্ত জ্ঞান-প্রকাশস্বরূপ (ভূতভবস্য) ভূত এবং ভবিষ্যতের (ঈশানঃ) স্বামী (সঃ এব) তিনিই (অদ্য) আজ যেমন রয়েছেন (শ্বঃ) আগামীকালও তেমনি থাকবেন ( এতৎ, বৈ, তৎ) ইনিই সেই ব্রহ্ম।।১৩।।
সরলার্থঃ অঙ্গুষ্ঠমাত্র স্থানীয় পুরুষ ধূমরহিত, জ্যোতির ন্যায় নির্ভ্রান্ত জ্ঞান-প্রকাশস্বরূপ, ভূত এবং ভবিষ্যতের স্বামী। তিনিই আজ যেমন রয়েছেন আগামীকালও তেমনি থাকবেন, ইনিই সেই ব্রহ্ম।।১৩।।
অর্থাৎ ঈশ্বররের কোনো পরিবর্তন হয় না।
ঈশ্বকে সচ্চিদানন্দ বলা হয় -
(টুনদি সমৃদ্ধৌ) আঙ্ পূর্বক এই ধাতু দ্বারা 'আনন্দ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। 'আনন্দন্তি সর্বে মুক্তা যস্মিন্, যদ্বা যঃ সর্বাঞ্জীবনানন্দযতি স আনন্দঃ' যিনি আনন্দ স্বরূপ, যাঁহাতে সকল মুক্ত জীব আনন্দ লাভ করে এবং যিনি সকল ধর্মাত্মা জীবকে আনন্দিত করেন, সেই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম ‘আনন্দ'।
(অস ভুবি) এই ধাতু হইতে ‘সৎ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। 'যদস্তি ত্ৰিযু কালেষু ন ৰাধ্যতে তৎসদ্ ব্ৰহ্ম’ যিনি সর্বদা বর্তমান, অর্থাৎ ভূত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান কালে যাহার নাস্তিত্ব নাই, সেই কারণে সেই পরমেশ্বকে ‘সৎ’ বলা হয়।
(চিতী সংজ্ঞানে) এই ধাতু হইতে ‘চিৎ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। 'যশ্চেততি চেতষতি-সংজ্ঞাপযতি সর্বান্ সজ্জনান্ যােগিনস্তচ্চিৎ পরং ব্রহ্ম’ যিনি চেতনা স্বরূপ, সকল জীবকে চেতনা যুক্ত করেন। এবং যিনি সত্যাসত্যের জ্ঞাপয়িতা, সেই পরমেশ্বরের নাম “চিৎ”।



শীত,গ্রীষ্ম, খুধা, তৃষ্ণা, ভয়, রোগ, শোক, বৃদ্ধত্ব মৃত্যু প্রভৃতি প্রত্যেক সাকার বা দেহধারীকে গ্রাস করে দুঃখ দেয়। ঈশ্বর সর্বদা এই সমস্ত হতে পৃথক। অতএব ঈশ্বরকে সাকার স্বীকার করলে তাকে দোষ স্পর্শ করবে, সে অবস্থায় ঈশ্বর সচ্চিদানন্দ এবং নির্বিকার হতে পারবেন না। কেননা প্রত্যেক সাকার পদার্থে জন্ম, বৃদ্ধি, জরা, মৃত্যু প্রভৃতি বিকার দোষ থাকে।
ঈশ্বরকে সাকার স্বীকার করলে তিনি সর্বব্যাপক হতে পারবেন না। কেননা প্রত্যেক সাকার পদার্থ একদেশী অর্থাৎ এক স্থানে স্থিতিশীল।
ঈশ্বর অনাদি অনন্ত হতে পারবেন না। কেননা প্রত্যেক সাকার বা অবয়বী বা দেহধারী উৎপন্ন হয়ে থাকে। যে বস্তুর আরম্ভ আছে অর্থাৎ সে সাদি। এই অবস্থায় ঈশ্বরের অনাদিত্ব গুণের অভাব হবে। ঈশ্বর অনাদি হতে পারবেন না, অনন্তও হতে পারবেন না। যার আদি আছে তার অন্তও অবশ্যই আছে। যার উৎপত্তি আছে তার বিনাশও আছে। যে নদীর এক পাড় থাকে তার অপর পাড়ও থাকে।
ঈশ্বরের সর্বজ্ঞত্ব গুণের অভাব হবে। কেননা যদি ঈশ্বরকে সর্বজ্ঞ স্বীকার করা যায়, তাহলে ঈশ্বর সাকার হওয়ায়, একদেশে অবস্থিতির কারণে, সর্বত্র বিদ্যমান থাকা সম্ভব হবে না। যদি ঈশ্বর সর্বত্র না থাকেন তাহলে তার মধ্যে সব স্থানের জ্ঞান থাকাও সম্ভব হবে না, তার জ্ঞান এক স্থানেরই হবে। ঈশ্বর যে দেশে বা যে স্থানে থাকবেন তার সেই দেশের বা সেই স্থানের জ্ঞানই হবে। পরিণাম- ঈশ্বর অন্তর্যামী ও হতে পারবেন না। কেননা তিনি প্রত্যেকের মনের কথা জানতে পারবেন না।
ঈশ্বরের নিত্যত্ব গুণের অভাব হবে। ঈশ্বর অনিত্য হয়ে যাবেন। সেই নিত্য যার অস্তিত্ব থাকবে অথচ কোনও কারণ থাকবে না। সে কোন পদার্থের সংযোগ দ্বারা উৎপন্নও হবে না। কেননা যে সাকার, সে বস্তু তত্ত্বের মিশ্রণে বা যোগে উৎপন্ন হয়ে থাকে।
পরমাত্মা সর্বাধার গুন রহিত হবেন। তিনি সর্বাধার না হয়ে অপরাধার হয়ে যাবেন। পরমাত্মা সর্বাধার কেন জানো? কেননা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার আশ্রয়ে থেকে গতিশীল। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে তিনি ধারণ করে আছেন। যদি পরমাত্মাকে সাকার স্বীকার করা যায়, তাহলে তিনি কারও আশ্রয়ে থাকবেন। এই কারণেই তো মত মতান্তরবাদীর দল ঈশ্বরকে সাকার করে। তার আশ্রয়স্থল তৈরি করে রেখেছে। কেহ সপ্তলোক, কেহ চতুর্থলোক, কেহ বা গোলক, আবার কেহ বা বৈকুন্ঠ প্রভৃতি স্থান স্থির করে রেখেছে। যদি পরমেশ্বর নিজেই অপরের আশ্রিত হয়ে থাকেন তাহলে বলতো জগৎটা থাকবে কার আশ্রয়ে? জগৎ তখন যে নিরাশ্রয় হয়ে যাবে। ঈশ্বরকে সাকার স্বীকার করলে এমনি আরও অনেক দোষ ঈশ্বরে যুক্ত হবে।



বেনস্তৎপশ্যন্নিহিতং গুহা সদ্যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীডম্।
তস্মিন্নিদং সং চ বিচৈতি সর্বং স ওতঃ প্রোতশ্ব বিভূঃ প্রজাসু।।
(যজুর্বেদ, ৩২/৮)
বঙ্গানুবাদঃ- যাহাতে সর্বজগৎ আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে সেই বুদ্ধিগম্য চেতন ব্রহ্মকে মেধাবী পুরুষ জ্ঞান দৃষ্টিতে দর্শন করেন। সর্ব্ব জগৎ প্রলয়কালে তাঁহাতে সূক্ষ্মরূপে মিলিত হয় এবং উৎপত্তিকালে পৃথক স্থুলরুপে পরিণত হয়। সেই সত্যস্বরুপ পরমাত্মা জীব ও প্রকৃতিতে ওতঃপ্রোতঃ ভাবে ব্যপক রহিয়াছেন।

নিকাব্যা বেধসঃ শশ্বতস্কর্হস্তে দধানো নর্য্যা পুরূনি।
অগ্নির্ভূবদ্রয়ি পতী রয়ীনাং সত্রা চক্রাণো অমৃতানি বিশ্বা।।
(ঋগ্বেদ, ১/৭২/১)
অনুবাদঃ— যে বিদ্বান, পুরুষ, সর্ববিদ্যার ধারণকর্তা অনাদি স্বরুপ পরমেশ্বর কৃর্তৃক প্রকাশিত, নানাবিধ সত্যার্থের প্রকাশক, মোক্ষদাতা ও মনুষ্যের সুখের মূল জ্ঞানরাশিকে প্রত্যক্ষ পদার্থের ন্যায় হস্তে ধারণ করিয়া কৃত ধর্মাচরণকে নিশ্চিতরূপে সিদ্ধ করেন তিনি অনন্ত বিদ্যাধনৈশ্বর্য্যকে রক্ষা করেন এবং অনন্ত শোভা সৌন্দর্য্যকে ধারণ করেন।

আনন্দা মোদা প্রমুদোহভীমোদ মুদশ্চ যে।
উচ্ছিষ্টাজ্জঞ্জিরে সর্বে দিবিদেবা দিবিশ্রিত।।
(অথর্ববেদ, ১১/৭/২৬)
অনুবাদঃ— জীবাত্মার মোক্ষ-সুখ, বিষয়-সুখ, পরমানন্দ এবং জ্ঞানাশ্রিত আনন্দ—এ সকল পরমাত্মা হইতেই নিঃসৃত হয়।
আনন্দ- কস্ত্বা সত্যো মদানাং ম হিষ্টো মৎসদন্ধসঃ।
দৃঢ়া চিদারুজে বসু।।
(যজুর্বেদ, ৩৬/৫)
অনুবাদঃ— হে মনুষ্য! আনন্দসমূহের মধ্যে যিনি সর্বমশ্রেষ্ঠ ও সুখ স্বরুপ, যিনি অবিনশ্বর, তিনি তোমাকে অন্নাদি পদার্থ দ্বারা আনন্দ দান করেন এবং দ্রোহশূন্য জীবকে শাশ্বত ধন প্রদান করেন।
সচ্চিদানন্দ (নিত্য + জ্ঞান + সুখপূর্ণ) (সৎ-চিৎ-আনন্দ)
পরমপুরুষ সৎ-চিৎ-আনন্দ স্বরূপ জীবাত্মা সৎ-চিৎ-স্বরূপ প্রকৃতি সৎ স্বরূপ। আত্মাতে দুইগুণ সৎ-নাশ রহিত আর চিৎ-জ্ঞান সহিত। প্রকৃতিতে জ্ঞান এবং চেতনার অভাব
পরমাত্মা সর্বব্যাপী, স্থির, সদামুক্ত, আনন্দস্বরূপ, সগুণ ও নির্গুণ এবং কেবল এক। পরমাত্মার সগুণ ভাবের প্রেরণা প্রকৃতির প্রকাশের কারণ এবং প্রকৃতি জীবের কর্মফলের যথাযথ বিধান করতে বাধ্য করে।
একদেশীয়, দেহান্তরের ফলে গতিশীল, কখনো বদ্ধ-কখনো মুক্ত, আত্মার সংখ্যা অগণিত, আত্মা সমগ্র প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রে অক্ষম কেবল দেহের চেতন ও জড় প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে চরমতর সাধনা-জ্ঞানের দ্বারা।
পরমাত্মাতে সমগ্র জগত অবস্থিত, তিনি নিত্য আনন্দময়, ইন্দ্রিয় আকর্ষের উর্ধ্বে।
জীবাত্মা তে কেবল দেহ অবস্থিত, তিনি নিত্য আনন্দময় নন তাই আনন্দের জন্য মোক্ষতা চায়। জীবাত্মার সংস্পর্শে জাগ্রত ও স্বপ্ন,সুষুপ্তি অবস্থা রয়েছে তাই তিনি পরমাত্মার ন্যায় সদানন্দময় নন।
পরমাত্মা উপাস্য
জীবাত্মা উপাসক।
তাঁরা(পরমাত্মা-জীবাত্মা) অবিনাশী কারণ তাদের জন্ম মৃত্যু নেই তথা তথা বিকার নেই। তাই লীন মানে অস্তিত্বের বিনাশ নয়৷ তবে লীন অর্থ যদি অস্তিত্বের বিনাশহীন পরমাত্মায় যুক্ত অবস্থা হয় তবে তা সম্ভব।
"সনাতনমেনমাহুরুতাদ্য স্যাপ্তুনর্ণবঃ।
অহোরাত্রো প্রজায়েতে অন্যো অন্যস্য রূপয়ো।।" অথর্ববেদ ( ১০/৮/২৩)
পদার্থঃ ( এনম) এই পরমাত্মাকে ( সনাতনং আহুঃ) সনাতন বলা হয়, পরন্ত ( উত অদ্য) ও তো আজই ( পুনর্ণবঃ) ফিরে নতুনের নতুন হয়। যে ভাবে ( অহোরাত্রো) দিন ও রাত ( অন্যঃ অন্যস্য রূপয়োঃ) এক রূপ হতে অন্য রূপে রূপান্তরিত ( প্রজায়েতে) উৎপন্ন হয়। দিন পর রাত এবং রাতের পর দিন হয় এ জন্য রাত দিন নতুন নতুন লাগে। এই প্রকার সনাতন হয়ে ও পরমাত্মা নবীন হতে নবীন। পরমাত্মা কখনও জীর্ন হয় না।

অর্থাৎ ক্লেশ, কর্ম, বিপাক ও আশয় এই চারের সঙ্গে যার কোন সম্বন্ধ নেই যিনি সমস্ত পুরুষের মধ্যে উত্তম, তিনিই ঈশ্বর।
এখানে,
ক্লেশঃ অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ, অভিনিবেশ।
কর্মঃ পূণ্য, পাপ, পূণ্যও পাপমিশ্রিত এবং পাপপূণ্যরহিত।
বিপাকঃ কর্মফলের নাম বিপাক।
আশয়ঃ যাবতীয় কর্ম সংস্কারের নাম আশয়।
এই চারের সাথে সমন্ধহীন উত্তম পুরুষই ঈশ্বর পদবাচ্য। এজন্যই ঈশ্বরকে "আনন্দময়" বলা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি কখনো দুঃখ, ক্লেশ, কর্মফল ভোগ করেন না। তিনি সর্বদা আনন্দময় স্বরূপে স্থিত। যদি এরূপ বলা হয় যে, ঈশ্বর পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করেন তবে বলতে হবে তিনি তার আনন্দময় স্বরূপ থেকে বিচ্যুত হলেন। কারন জন্মগ্রহনকারীর গর্ভস্থ যন্ত্রনা, কর্মফল এবং ত্রিতাপ জ্বালা ভোগ করার প্রয়োজন পড়ে। যদি ঈশ্বর এক মুহুর্তের জন্যও তার আনন্দময় স্বরূপ থেকে বিচ্যুত হন। তবে তিনি ঈশ্বরের সংজ্ঞা কদাপি প্রাপ্ত হতে পারবেন না।
ও৩ম্ শান্তি শান্তি শান্তি