দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







বেদ মতে এক মহাবিশ্বের সময়কাল কত ?

সত্যান্বেষী
0

 


অসীম, অমিত মহাবিশ্ব সম্বন্ধে মানুষের কৌতূহল চিরন্তন। মনুষ্যেতর প্রাণিকুলের জীবন আহার, নিদ্রা, মৈথুন এই তিনটির ওপরেই আধারিত। কিন্তু অন্য প্রাণির সাথে মানুষের সবচেয়ে বড় পার্থক্য তার কৌতূহল ও উদ্ভাবনী মানসিকতা। এই মানসিকতা দিয়েই মানুষ আজ মহাকাশ থেকে মহাসমুদ্রের অতল পর্যন্ত প্রাধান্য বিস্তার করেছে। 
 
"আমি কে?" "কোথা থেকে এসেছি?" " আমার আশেপাশে যা দেখছি, এগুলো কী?" এরকম ভাবনা চিন্তা মানুষের মনে সর্বদাই জাগে। রহস্যময় রাতের আকাশ দেখে তা যে আরো বেশি ঘনীভূত হয়, তা সন্দেহাতীত। তাই মানুষ জানতে চায়, বুঝতে চায়; এই রহস্যময় মহাবিশ্বকে।
 
বৈদিক যুগের ঋষিগণ বা বিদ্বানগণ মহাকাশচর্চা বিষয়ে প্রভূত উন্নতি করেন। যে সময় আজকের ইউরোপে জংলি, বর্বর মানুষ ঘুরে বেড়াত, তখন থেকেই ভারতে জ্যোতিষ বা Astronomy চর্চার সূচনা। বেদের নাসাদীয় সূক্ত এবং হিরণ্যগর্ভ সূক্ত রয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে। এছাড়া বেশকিছু মন্ত্রেই পৃথিবীর বার্ষিক গতি, বর্ষপঞ্জি, আকার, সূর্যের আলো, সূর্যের গতি, চাঁদের গতির বর্ণনা, নানা নক্ষত্র ও জ্যোতিষ্কের কথা রয়েছে। পাশাপাশি বেদ মাল্টিভার্স নিয়েও আলোচনা করে। বেদের সৃষ্টিতত্ত্ব মূলত একটি চক্র। একবার ঈশ্বর প্রকৃতি হতে জগৎ নির্মাণ করবেন, তার ধ্বংস হবে; এক মহাকল্প পরে পুনরায় জগৎ সৃষ্টি হবে। আগের কল্পের মোক্ষপ্রাপ্ত আত্মাসমূহের পুনরাগমন ঘটবে। এভাবেই চলতে থাকবে অনাদি সৃষ্টিচক্র।
 
ষড়বেদাঙ্গের অন্যতম হল জ্যোতিষ। জ্যোতিষ বলতে আমরা এখন Astrology বা গ্রহ উপগ্রহের মাধ্যমে হাত দেখে ভাগ্য নির্ণয়ের মত কাল্পনিক বুজরুক অপবিজ্ঞান বোঝালেও বৈদিক জ্যোতিষ মহাবিশ্বের তত্ত্ব, নানা নক্ষত্র এবং তাদের‌ দ্বারা সময় গণনা নিয়ে আলোচনা করে। পরবর্তীতে বরাহমিহির ও আর্যভট্ট এই শাখায় বিস্তর চর্চা করেন। 
 
প্রথমেই আমরা প্রচলিত সনাতনী মত অনুযায়ী মহাবিশ্বের বয়স দেখব। 
 
মনুস্মৃতি ১ম অধ্যায় শ্লোক ৭১, ৭২ এর অনুসারে বারো সহস্র চতুর্যুগীর এক দৈব যুগ এবং এক সহস্র দৈব যুগের ব্রহ্মের এক দিন এবং সমান সময় রাত্রি। অর্থাৎ ১২,০০০ দৈব বর্ষ*১০০০ যুগ*৩৬০ মানুষ বর্ষ= ৪,৩২,০০,০০,০০ মনুষ্য বর্ষে ব্রহ্মের এক দিন এবং ব্রহ্মের রাত্রি। মনু ১।৬৭ হতে ড. সুরেন্দ্র কুমারকৃত বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি অনুবাদ নিম্নরূপঃ 
 
  • দৈবী দিন-রাত উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়ন—
 
দৈবে রাত্র্য়হনী বর্ষং প্রবিভাগস্তয়োঃ পুনঃ।
অহস্তত্রোদগয়নং রাত্রিঃ স্য়াদ্দক্ষিণায়নম্॥ ৬৭॥
 
(বর্ষম্) মনুষ্যের এক বর্ষ (দৈবে রাত্রি-অহনী) এক দৈবী ‘দিন-রাত’ মিলে হয়। (তয়োঃ পুনঃ প্রবিভাগঃ) ঐ দৈবী ‘দিনরাতের ও পুনরায় বিভাগ রয়েছে—(তত্রউদগয়নম্ অহঃ) সূর্যের বিষুব রেখার উত্তর দিকে স্থিতি অর্থাৎ ‘উত্তরায়ণ’ ‘দৈবী-দিন’, এবং ‘দক্ষিণায়ন’ ‘দৈবী-রাত’॥ ৬৭॥
 
*অর্থাৎ দৈবী ১ দিন =‌ মনুষ্যের ১ বছর = ৩৬০ দিন।
অতএব, দৈবী ১ বছর =‌ মনুষ্যের ৩৬০ বছর।
 
ব্রাহ্মস্য তু ক্ষপাহস্য যৎপ্রমাণং সমাসতঃ ।
একৈকশো যুগানাং তু ক্রমশস্তন্নিবোধত । ।
 
[ মহর্ষিগণকে বললেন ] (ব্রাহ্মস্য তু ক্ষপা+অহস্য) ব্রাহ্ম= ব্রহ্মের রাত-দিনের (তু) তথা (একৈকশঃ যুগানাম্) এক-এক যুগের ( যৎ প্রমাণম্) যে কালপরিমাণ রয়েছে (তৎ) তা (ক্রমশঃ) ক্রমানুসারে ও (সমাসতঃ ) সংক্ষেপে (নিবোধত) শ্রবণ করো ॥ ৬৮ ॥
 
অনুশীলন - ব্রাহ্মদিন ও ব্রাহ্মরাত্রির বিশেষ পরিমাণ (১.৭২)তে দ্রষ্টব্য ।
 
  • সত্যযুগের পরিমাণ - 
 
চত্বার্যাহুঃ সহস্রাণি বর্ষাণাং তৎকৃতং যুগম্ ।
তস্য যাবচ্ছতী সন্ধ্যা সন্ধ্যাংশশ্চ তথাবিধঃ ॥৬৯ ॥ 
 
(তৎ চত্বারি সহস্রাণি বর্ষাণাং কৃতং যুগম্ আহুঃ) সেই দৈবী [৬৭ শ্লোকে যার দিন-রাতের বর্ণনা বিদ্যমান] চার হাজার দিব্য বর্ষকে এক 'সত্যযুগ' বলেছে । (তস্য) সেই সত্যযুগের ( যাবৎ+শতী সন্ধ্যা) যত দিব্য শত বর্ষের অর্থাৎ ৪০০ বর্ষের 'সন্ধ্যা' হয় এবং (তথাবিধঃ) তত বর্ষেরই অর্থাৎ ৪০০ বর্ষের ( সন্ধ্যাংশঃ) 'সন্ধ্যাংশ' সময় হয় ॥ ৬৯ ॥
 
অনুশীলন- চার যুগের পরিমাণ - যে কোনো যুগের পূর্বসন্ধিকালকে 'সন্ধ্যা' ও উত্তরসন্ধি কালকে 'সন্ধ্যাংশ' বলা হয় । 
 
শ্লোক অনুসারে সত্যযুগের কালপরিমাণ– ৪০০০+৪০০ (সন্ধ্যাবর্ষ ) + ৪০০ (সন্ধ্যাংশবর্ষ) = ৪৮০০ দিব্যবর্ষ হচ্ছে। একে মানববর্ষে রূপান্তরের নিমিত্তে ৩৬০ গুণ করতে হবে । এভাবে প্রকার ৪৮০০×৩৬০=১২৭২৮০০০ মানুষ বর্ষে এক সত্যযুগ হয় । 
 
  • ত্রেতা, দ্বাপর তথা কলিযুগের পরিমাণ -
 
ইতরেষু সসন্ধ্যেষু সসন্ধ্যাংশেষু চ ত্রিষু ।
একাপায়েন বর্ত্তন্তে সহস্রাণি শতানি চ ॥ ৭০ ॥
 
(চ) এবং (ইতরেষু ত্রিষু) অবশিষ্ট অন্য ৩ — ত্রেতা, দ্বাপর, কলিযুগে (সসন্ধ্যেষু সসন্ধ্যাংশেষু) 'সন্ধ্যা' নামক কালে তথা 'সন্ধ্যাংশ' নামক কালে (সহস্ত্রাণি চ শতানি এক-অপায়েন) ক্রমশঃ এক এক হাজার ও এক- এক শত কমিয়ে দেওয়ার ফলে ( বর্তন্তে) তাদের স্বীয় স্বীয় কালপরিমাণ নির্ণীত হয় , অর্থাৎ ৪৮০০ দিব্যবর্ষ সত্যযুগ , তার সংখ্যা থেকে এক সহস্র বর্ষ ও তার সন্ধ্যা বর্ষ ৪০০ সন্ধ্যাংশ বর্ষ ৪০০ থেকে এক - এক শত কমালে ৩০০০ দিব্যবর্ষ + ৩০০ সন্ধ্যাবর্ষ + ৩০০ সন্ধ্যাংশ বর্ষ = ৩৬০০ দিব্যবর্ষ ত্রেতা যুগ পাওয়া যায় । এভাবে ত্রেতার কালমান থেকে দ্বাপরের কালমানে ১০০০+১০০+১০০ কমানো হলে এক হজার ও এক শত বর্ষ দিব্যবর্ষ দ্বাপর ও ১০০০+১০০+ ১০০ = ১২০০ দিব্যবর্ষের কলিযুগ হয় ॥ ৭০ ॥
 
  • দেবযুগ পরিমাণ– 
যদেতৎপরিসঙ্খ্যাতমাদাবেব চতুর্যুগম্ ।
এতদ্ দ্বাদশসাহস্রং দেবানাং যুগমুচ্যতে ॥ ৭১ ॥ 
 
(যদ্+এতৎ ) যে এই (আদৌ ) আদি [ ৬৯ -৭০তে] (চতুর্যুগম্) চারযুগের (পরিসঙ্খ্যাতম্) কালপরিমাণ গণনা ( এতদ্ ) এটি ( দ্বাদশ সাহস্ত্রম্) বারো হাজার দিব্য বর্ষের কাল [ =মনুষ্যগণের এক চতুর্যুগীর কাল ] (দেবানাম্) দেবগণের (যুগম্) এক 'যুগ' (উচ্যতে) বলা হয় ॥ ৭১ ॥ 
 
অনুশীলন - চার যুগের পরিমাণের তুলনা তালিকা—১২০০০ দিব্যবর্ষে এক চতুর্যুগী হয় । তাকে মানববর্ষে রূপান্তরের জন্য ৩৬০ গুণ করলে ১২০০০x৩৬০ = ৪৩,২০,০০০ মানুষ বর্ষে এক চতুর্যুগী হয় । 
 
  • ব্রহ্ম দিন-রাত পরিমাণ - 
 
দৈবিকানাং যুগানাং তু সহস্ত্রং পরিসঙ্খ্যযা । 
ব্রাহ্মমেকমহর্জ্ঞেয়ং তাবতীং রাত্রিমেব চ ॥ ৭২ ॥
 
(দৈবিকানাং যুগানাম্ তু) দেবযুগকে (সহস্ত্রং পরিসঙ্খ্যযা) ১,০০০ গুণ করলে যে কাল পরিমাণ বের হয় , যেমন - চার মানবযুগের দিব্য বর্ষ ১২,০০০ হয় , তাকে ১০০০ গুণ করলে ১,২০,০০,০০০ দিব্যবর্ষকে (ব্রাহ্মম্) পরমাত্মার (একং অহঃ) এক 'দিন' (চ) ও (তাবতীং রাত্রিম্) ততটুকু দিব্যবর্ষকেই তার এক 'রাত' (জ্ঞেয়ম্) জ্ঞাত হওয়া উচিৎ ॥ ৭২ ॥
 
অনুশীলন চার মনুষ্য যুগ দিব্যবর্ষ - ১২০০০×১০০০ = ১,২০,০০,০০০ দিব্যবর্ষে ব্রহ্ম এক দিন অথবা রাত্রি হয়। এই ১,২০,০০,০০০ x ৩৬০=৪,৩২,০০,০০,০০০ মনুষ্যবর্ষ । চার আরব বত্রিশ কোটি মানববর্ষ সৃষ্ট্যুৎপত্তি কাল , যা পরমাত্মার জাগ্রত অবস্থার (সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত থাকার) সময়কাল। সমপরিমাণ কালই রাত্রি বা সুষুপ্তি অবস্থা ।
 
যদিও বর্তমান মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর (Lambda-CDM model অনুযায়ী); তবুও যদি আমরা সমকালীন অন্য সভ্যতা সংস্কৃতিগুলোর সাথে বিচার করি, ৪.৩২ বিলিয়ন বছর যথেষ্টই নিকটবর্তী। অন্য সভ্যতাগুলোতে মহাবিশ্বের বয়স নিয়ে ধারণা ছিল, তা হয়তো সর্বোচ্চ কয়েক হাজার বছরের পুরনো।
 
জনপ্রিয় মহাকাশবিজ্ঞানী ও Cosmos অনুষ্ঠানের উপস্থাপক Carl Sagan যথার্থই বলেছিলেন,
 
"The Hindu religion is the only one of the world's great faiths dedicated to the idea that the Cosmos itself undergoes an immense, indeed an infinite, number of deaths and rebirths. It is the only religion in which the time scales correspond, to those of modern scientific cosmology. Its cycles run from our ordinary day and night to a day and night of Brahma, 8.64 billion years long. Longer than the age of the Earth or the Sun and about half the time since the Big Bang. And there are much longer time scales still."
 
কার্ল সেগান অবশ্য ৪.৩২ বিলিয়ন বছরকে দিন ও রাত উভয়ভাবে গণনা করেছিলেন; ফলে মনু ও সূর্য সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাবিশ্বের বয়স তাঁর মতে ৮.৬৪ বিলিয়ন বছর। এই গণনার মূল‌ ভিত্তি অবশ্য গীতা ৮।১৭ 

সহস্রযুগপর্যন্তমহর্যদ্ব্রহ্মণো বিদুঃ৷
রাত্রিং যুগসহস্রান্তাং তেহোরাত্রবিদো জনাঃ।
অর্থঃ সহস্র চতুর্যুগ এক ব্রাহ্ম দিন এবং সহস্র চতুর্যুগ এক ব্রাহ্ম রাত্রি। 
 
মূল কথা হল পূর্বের গণনায় যেহেতু এক দিনের সময়কাল গণনা করা হয়েছে, তাহলে দিন ও রাত্রি পৃথক ধরলে ২ দিয়ে গুণ করে ৮.৬৪ বিলিয়ন বছর আসে।
 
কিন্তু পরের শ্লোকেই আছে,
 
রাত্র্যাগমে প্রলীয়ন্তে তত্রৈবাব্যক্তসংজ্ঞকে।
অর্থাৎ, ব্রহ্মের রাত্রির আগমনে সমস্ত জীব পুনরায় লয়প্রাপ্ত হয়। 
 
কাজেই ব্রহ্মের রাত্রি মূলত অব্যক্ত অবস্থা বা জগতের প্রলয়ের পর প্রকৃতির কারণ অবস্থা ও জীবাত্মার সুষুপ্ত অবস্থা নির্দেশ করে। প্রলয়ে জগতের বিদ্যমানতা সম্পর্কে মহর্ষি মনু বলেছেন - 
 
 "আসীদিদং তমোভূতমপ্রজ্ঞাতমলক্ষণম্। 
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং প্রসুপ্তমিব সর্বতঃ॥ (মনু০ ১।৫)" 
অর্থাৎ এই সমগ্র জগৎ সৃষ্টির পূর্বে প্রলয়কালে অন্ধকারে আবৃত্ত- আচ্ছাদিত, রাত্রিরূপ অবিজ্ঞেয় ছিল। সেই সময় কারো জানার যোগ্য, তর্ক করার যোগ্য বা প্রসিদ্ধ কিছুই ছিল না। 
 
বিশিষ্ট টীকাকার কুল্লুকভট্ট ও এখানে তমঃ শব্দের অর্থা প্রকৃতি করেছেন।
 
[ ইন্দংজগৎ তমোভূতং তমসি স্থিতং লীনমাসীৎ। তমঃ
শব্দেন গুণবত্যা প্রকৃতিনিদিশ্যতে।।
—— কুল্লুকভট্টভাষ্য‌, মনু. পৃ. ৪]
 
বেদমন্ত্রেও স্পষ্টভাবে এই কথাই বলা হয়েছে -
 
তম আসীৎ তমসা গূঢমগ্রেঽপ্রকেতং সলিলং সর্বমা ইদম্। তুচ্ছ্যেনাভ্বপিহিতং য়দাসীত্তপসস্তন্মহিনা জায়তৈকম্" (ঋ০ ১০।১২৯।৩) 
অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে প্রলয়কালে এই জগৎ অন্ধকার দ্বারা আবৃত ছিল। এই সবকিছু কারণরূপ প্রকৃতিতে লীন ছিল। অদ্বিতীয় পরমেশ্বর নিজের তপের প্রভাবে কার্যরূপে প্রকট করেছেন। অর্থাৎ প্রলয়েও জীব তথা জগতের অস্তিত্ব ছিল।
 
অর্থাৎ এভাবে প্রমাণিত হলো যে, ব্রহ্মের রাত্রি প্রকৃতপক্ষে জগতের প্রলয় পরবর্তী সুষুপ্তিকাল। কাজেই এখানে কার্ল সেগানের কৃত গণনা ত্রুটিপূর্ণ, ড. সুরেন্দ্র কুমার কৃত গণনাই শাস্ত্রীয় আলোকে নির্ভুল।
মনুস্মৃতি বা সূর্য সিদ্ধান্ত থেকে আমরা এতক্ষণ জগতের কাল গণনা দেখলাম যা বৈজ্ঞানিকভাবে জগতের বয়সের কাছাকাছি হলেও একদম নিখুঁত গণনা নয়। নিঃসন্দেহেই বলা যায় এই গণনা ভ্রান্ত। পৌরুষেয় গ্রন্থে ভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক, বরং আমরা বা জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ এতেই আশ্চর্য যে প্রাচীন ভারতীয় বিদ্যায় জগতের বয়স প্রচলিত অন্যান্য মতবাদের চেয়ে অনেক পুরাতন এবং বাস্তবের নিকটতম।
 
  • কিন্তু অপৌরুষেয় বেদ তো অভ্রান্ত, বেদ কী বলে জগতের বয়স নিয়ে? 
 
অথর্ববেদ ৮।২।২১ মন্ত্রটিকে পণ্ডিত ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী অত্যন্ত নিপুণভাবে আধিদৈবিক পক্ষে ব্যাখ্যা করেছেন, মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয় করতে। এখানে হরিশরণ সিদ্ধান্তালংকার, দামোদর সাতবালেকর, ড. তুলসী রাম আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করেছেন। আবার, বিশ্বনাথ বেদালঙ্কার, পণ্ডিত দেবীচাঁদ, বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী সহ বাকি আর্ষ আধিদৈবিক পক্ষে করলেও প্রচলিত সূর্যসিদ্ধান্ত অনুযায়ী গণনা করেছেন। ক্ষেমকরণ জীই একমাত্র ব্যতিক্রম, যিনি মন্ত্রের গূঢ় তাৎপর্য বুঝে মন্ত্রের অর্থ অনুযায়ী মহাবিশ্বের কাল গণনার প্রয়াস নিয়েছেন। 
 
পদার্থঃ [হে মনুষ্য !] (তে) তোমার জন্য (শতম্) শত এবং (অয়ুতম্) দশ সহস্র (হায়নান্) বর্ষকে [ক্রমে] (দ্বে যুগে) দুই যুগ, (ত্রীণি) তিন [যুগ] এবং (চত্বারি) চার [যুগ] (কৃণ্মঃ) আমরা করি। (ইন্দ্রাগ্নী) বায়ু এবং অগ্নি এবং (তে) সেই [প্রসিদ্ধ] (বিশ্বে দেবাঃ) সব দিব্য পদার্থ [সূর্য, পৃথিবী আদি] (অহৃণীয়মানাঃ) সংকোচ না করে (অনু মন্যন্তাম্) অনুকূল থাকুক ॥২১॥
 
ভাবার্থঃ পরমেশ্বর এই সৃষ্টি এবং কাল চক্র মনুষ্যের উপকারের জন্য নির্মাণ করেছেন। বিজ্ঞানী পুরুষ পরমেশ্বরের অপার মহিমায় নিজের পরাক্রম বৃদ্ধি করে নতুন-নতুন আবিষ্কার করে অমর নাম করে ॥২১॥
 
মন্ত্রের পূর্বার্ধে সৃষ্টির সময়ক্রম কলিযুগ, দ্বাপর, ত্রেতা এবং সত্যযুগ এবং বর্ষের অর্থ দৈববর্ষ জানা যায়, সুতরাং এভাবে− 
 
সন্ধিকালঃ (শত বছরের গুণিতক; শতম্ পদ হতে আসা)
কলি ১০০*১=১০০
দ্বাপর ১০০*২=২০০
ত্রেতা ১০০*৩=৩০০
কৃতযুগ ১০০*৪=৪০০
মোট সন্ধিবর্ষের যোগফল ১,০০০ বর্ষ
 
যুগকালঃ (অযুত বা ১০০০০ বছরের গুণিতক; অয়ুতম্ পদ হতে আসা)
কলি ১০,০০০*১=১০,০০০
দ্বাপর ১০,০০০*২=২০,০০০
ত্রেতা ১০,০০০*৩=৩০,০০০
কৃতযুগ ১০,০০০*৪=৪০,০০০
মোট যুগবর্ষের যোগফল ১,০০,০০০
সন্ধি এবং যুগবর্ষের যোগফল ১,০১,০০০। ১,০১,০০০‌ দৈববর্ষ = ১,০১,০০০*৩৬০ = ৩৬,৩৬,০০০ মনুষ্য বর্ষ। 
 
এমন ১ হাজার চতুর্যুগ হল মহাবিশ্বের সময়কাল; অর্থাৎ ৩,৬৩,৬০,০০০*১০০০=৩৬৩৬,০০,০০,০০০
অর্থাৎ ইংরেজি গণনা পদ্ধতিতে তা ৩৬.৩৬ বিলিয়ন বছর।
 
*এখানেও গণনার ক্ষেত্রে ড. সুরেন্দ্র জীর মত আমরা ব্রাহ্মী রাতের আলাদা হিসাব করি নি । তার কারণ পূর্বেই পরিষ্কার করা হয়েছে।
 

 
 

 
গ্রন্থপঞ্জি:
১. বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি, ড. সুরেন্দ্র কুমার; বঙ্গানুবাদ: ড. প্রতাপ চন্দ্র রায় (এই বছরের শেষে প্রকাশিতব্য)
২. অথর্ববেদ ভাষ্য, পণ্ডিত ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী
৩. সত্যার্থ প্রকাশ, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)