ओ३म्
নমস্কার
বিদ্যার
বা জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যম হলো ভাষা। নিজের থেকে ভিন্ন, অপর কোনো
ব্যক্তিকে বোঝানোর জন্য বাণী দ্বারা শব্দোচ্চারণের আবশ্যকতা হয়ে থাকে।
অর্থাৎ, যখন উপদেশ্য এবং উপদেষ্টার মধ্যবর্তী দূরত্ব বেশি হয় তখন ভাব
আদান-প্রদানের জন্য বর্ণোচ্চারণের প্রয়োজন হয়ে থাকে, পরন্তু যখন নিজে
মনে মনে কথা বলা হয়, অর্থাৎ, যখন আমরা চুপচাপ অবস্থায় কোনো বিষয়ে
চিন্তন করি, তখন সংকল্প-বিকল্প অথবা প্রশ্নোত্তরের শৃঙ্খলায়
কণ্ঠ-তালু-জিহ্বা প্রভৃতির কাজ ছাড়াই আমাদের মনে সূক্ষ্মরূপে ভাষা
ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে। মনের ভেতর বলে চলা সেই সূক্ষ্ম ভাষা আমাদের দ্বারা
উচ্চারিত স্থূল ভাষার সংস্কারগুলোর স্মৃতিরূপ হয়ে থাকে । সৃষ্টির আদিতে যখন
পরমাত্মা ঋষিগণের হৃদয়ে বেদ জ্ঞান প্রদান করেন, তখন অন্তর্যামী হওয়ার
কারণে ঋষিগণের হৃদয়ে বিদ্যমান আত্মায় বেদ এবং তাঁর ভাষার সংস্কার প্রদান
পূর্বক তিনি তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেন। তখন অর্থসমূহ জানার জন্য সেই
শব্দরাশিকে তাঁরা এমনভাবে উচ্চারণ করতে থাকেন যেমনভাবে কোনো ব্যক্তি
পূর্বে জ্ঞাত বাক্যসমূহ নিদ্রা ভেঙ্গে জাগ্রত হয়ে উচ্চারণ করতে থাকে। এই
সমস্ত প্রক্রিয়া জীবাত্মার মস্তিষ্কগত হৃদয়প্রদেশে সংঘটিত হয়। সেই
স্থানেই স্থিত পরমেশ্বর দ্বারা জীবাত্মার উক্ত প্রেরণা প্রাপ্ত হয়ে
থাকে। অতঃ শব্দের উচ্চারণের মাধ্যমে উপদেশের আবশ্যকতা হয় না।
এক
আত্মা দ্বারা অপর আত্মায় এই প্রকার ভাব প্রদানের প্রক্রিয়া কোনোরূপ
অলৌকিক নয়। Mesmerism একটি অত্যন্ত নিম্ন স্তরের সিদ্ধি। ধ্যানের
একাগ্রতা দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে প্রভাবিতকারী এই বিদ্যাকে আয়ত্ত করে
তার নিজ সংকল্পশক্তি দ্বারা অপর ব্যক্তিকে Mesmerism এর মাধ্যমে বশ
করে তার দ্বারা যা ইচ্ছা তা করাতে পারে। উক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে
Mesmerism আয়ত্তকারী তার স্বভাষাকে অপর কারো হৃদয়ে সঞ্চরণ করাতে সক্ষম
হয়। এইভাবে যে ভাষাকে প্রযোজক জানেন, তা তিনি সেই ভাষা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ
লোকের দ্বারাও কথন করাতে পারেন। কলেজের পাঠ না নেওয়া অশিক্ষিত পিয়নকেও
জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে দেখা গিয়েছে। যখন সাধারণ একজন মানুষ
অভ্যাস দ্বারা মনোবলের শক্তিতে নিজের সুপ্ত শক্তিসমূহকে জাগ্রত করে তার
বিশিষ্ট সামর্থ্য দ্বারা নিজ থেকে ভিন্ন অপর কোনো ব্যক্তির হৃদয়ে তার নিজ
ভাষা এবং ভাবের সঞ্চরণ করতে পারে এবং প্রভাবিত ব্যক্তি প্রযোজক অথবা
সংক্রাতার ইচ্ছানুসারে ব্যবহার, চলা-ফেরায় বিবশ হয়ে যায় ; তাহলে
জীবাত্মায় স্থিত সর্বান্তর্যামী তথা সর্বশক্তিমান পরমাত্মা দ্বারা এরূপ
প্রক্রিয়ায় জ্ঞান প্রদান সর্বথা সম্ভব এবং প্রধান বিষয়, সর্গের আদিতে
যে চার ঋষিগণের আত্মায় এই পরম জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে, তাঁরা বিশিষ্ট
সংস্কারী আত্মা ছিলেন। বেদের প্রকট হওয়ার জন্যই মাধ্যম রূপে তাঁদের
প্রাদুর্ভাব হয়েছে। এই প্রকারে সর্বান্তর্যামী পরমাত্মাকে তাঁর নিজ জ্ঞান
প্রদানের জন্য মুখ, জিহ্বা প্রভৃতি অবয়ব সমূহের কোনোরূপ আবশ্যকতা হয়
না।
যেমনভাবে
পরমেশ্বর পক্ষীজগতকে বিভিন্ন কারুকার্যময় নীড় বানানোর যথাবৎ জ্ঞান
দিয়েছেন, যেমনভাবে মৌমাছিকে অনেক কোষ্ঠযুক্ত চাক বানানোর এবং মধু
সংগ্রহ করার রাসায়নিক প্রক্রিয়া দিয়েছেন, যেমনভাবে মৎস্যকুলকে সাঁতার
কাটার এবং বানর জাতিকে লাফিয়ে চলার জ্ঞান দিয়েছেন, ময়ূরের নাচা এবং
নবজাত শিশুর স্তনপান করা শিখিয়েছেন, তদ্রুপ তিনি মনুষ্যজাতিকে সর্বপ্রকার
জ্ঞানের জন্য বেদরূপী জ্ঞান প্রদান করেছেন।
ইন্দ্রিয়
সমূহ, হস্ত-পদ রহিত হয়েও নিরাকার পরমেশ্বর সৃষ্টির রচনা করেন।
সাধনরূপে হাত, পা প্রভৃতি অঙ্গের আবশ্যকতা বাহ্যিক ক্রিয়া সম্পাদন করার
জন্য প্রয়োজন হয়ে থাকে। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড সেই বিরাট্ প্রভুর বিরাট্
শরীরে স্থিত এবং সেই প্রভুও সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে অবস্থান করছেন। যে
সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান প্রভু তাঁর অসীম সামর্থ্য দ্বারা হস্ত-পদ
বিনাই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রচনা করতে পারেন, তাঁর জন্য বাহ্যিক কোনো ক্রিয়া
দ্বারাই ঋষিগণের হৃদয়ে পরম সত্য জ্ঞান প্রদান অত্যন্ত সাধারণ বিষয়।
ঋগ্বেদে
চার প্রকার বাক্-এর কথা বলা হয়েছে। যা পরবর্তীতে - পরা, পশ্যন্তী,
মধ্যমা এবং বৈখরী - এই চার প্রকার বাণী রূপে ব্যাখ্যাত হয়েছে।
পরা -- আত্মার মুখ্য শক্তিরূপ, এর কোনো স্বরূপ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
পশ্যন্তী -- সেই বাক যাতে শব্দ এবং অর্থ একরূপে অবস্থান করে, উভয় বিভক্ত হয় না, এই বাক কেবল প্রকাশরূপে বর্ণন করা হয়ে থাকে।
মধ্যমা --
শব্দ এবং অর্থের বিভাগ বিদ্যমান। কিন্তু শব্দের প্রকাশ কেবল হৃদয় দ্বারা
হয়ে থাকে, কন্ঠ-তালু আদির কোনো প্রয়োজন হয় না এবং এই শব্দ কেউ শুনতে
পায় না। মনুষ্য একে মনে মনে কথা বলা এমনটা সম্বোধন করে।
বৈখরী
-- এই বাক দুইভাগে বিভক্ত । উপাংশু ভাষণ অর্থাৎ, মৃদুস্বর প্রয়োগে
বাক্যালাপ এবং দ্বিতীয়টি উচ্চৈঃ স্বর প্রয়োগ দ্বারা ভাষণ যা সমস্ত
মনুষ্য শ্রবণে সামর্থ্য ।
এই চারটি বাকের মধ্যে পরা, পশ্যন্তী এবং মধ্যমায় কণ্ঠ-তালুর ব্যাপার নেই।
ঈশ্বরের বাণী সম্মুখাভিমুখ ভাবে প্রকট হয় না ।
যে
ঋষিগণের হৃদয় রাজস্-তামস্ বৃত্তিসমূহ থেকে অসম্পৃক্ত হয়, তাঁরা যখন
তাঁদের নির্মল, স্বচ্ছ, নির্দোষ চিত্তকে পরমেশ্বরের সর্বজ্ঞতায় তৎস্থ
করেন তখন তাদের স্ফটিকমণিতুল্য চিত্তে পরমেশ্বরের জ্ঞান প্রকাশ পায়। এই
প্রকারে মধ্যমা বাক্ দ্বারা বেদ সেই ঋষিগণ প্রাপ্ত হন।
বেদ
জ্ঞান প্রকটের জন্য পরমেশ্বরের না বলার প্রয়োজন হয়েছে এবং না ঋষিগণের
শ্রবণের জন্য কর্ণের প্রয়োজনের আবশ্যক হয়েছে। ঋষিগণ বৈখরী বাণী দ্বারা
বেদ জ্ঞানকে এই মনুষ্যলোকে প্রচার এবং প্রসার করেন।
ঋগ্বেদ ১০/৭১/৩ নং মন্ত্রে বর্ণন হয়েছে -- ঋষিগণের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট বাণী মনুষ্যগণ গ্রহণ করে ।
অবিদ্যা
এবং মোহের আবরণ নাশ হওয়ার পর যখন আত্মশক্তির পূর্ণ বিকাশ হয় তখন
পরমাত্মার জ্যোতির প্রকাশে আত্মা দ্বারা আনন্দ-কোষ প্রাপ্তি হওয়ার পর
জ্ঞানময়ী পরা বাণীর শব্দানুভূতি হয়ে থাকে। তৎপশ্চাৎ পশ্যন্তী, মধ্যমা
এবং অন্তে বৈখরী বাণীর রূপ উদ্ভুত হয়। অনন্ত একরস জগদ্ব্যাপী পরমাত্মায়
পরা-বাণীরূপে বেদমন্ত্র সদা অবস্থান করে। পরমাত্মার সহিত জীবাত্মার হৃদয়ের
যোগসূত্র হওয়ার পর যোগ দ্বারা জীবাত্মার স্বাভাবিক গুণ আনন্দে লীন হয়ে
পরা-বাণীর অনুভূতি অনুভব করে।
উক্ত
বচনের সমর্থনে শঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্ত ভাষ্যে বর্ণনা করেন – "অভিষ্ট
অর্থের অনুষ্ঠানকারী মনুষ্য সেই অর্থের বাচক শব্দকে প্রথমে স্মরণ করে
পরে তার অনুষ্ঠান করে – যা আমাদের সবার প্রত্যক্ষ। প্রজাপতি স্রষ্টারও
সৃষ্টির পূর্বে বৈদিক শব্দ প্রকট হয়েছিলো। তৎপশ্চাৎ তদনুসার অর্থসমূহ
সৃষ্টি করেছেন। এমনটা প্রতীত হয়। এ কারণে তালু প্রভৃতির সহায়তা ছাড়াই
শব্দের অনুভূতি হয়েছে। এই মত সযুক্তিক এবং সপ্রমাণ।
এখানে আরও একটি শঙ্কার সমাধান আবশ্যক যে, সৃষ্টির আদিতে অগ্নি আদি চার ঋষিগণের হৃদয়েই কেন বেদ জ্ঞানের প্রকাশ হয়েছে?
সমাধান
– সৃষ্টির আদিতে পরমেশ্বর ব্রহ্মবিৎ অগ্নি আদি নামক পরম পবিত্র
আত্মাগণে ঋগ্বেদাদি বেদ জ্ঞানের প্রকাশ করেছেন। এই বিষয়ে ঋগ্বেদ ১০/৭১/১
নং মন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে –
বৃহস্পতে প্রথমং বাচো অগ্রং যৎপ্রৈরত নামধেয়ং দধানাঃ ।যদেষাং শ্রেষ্ঠং যদরিপ্রমাসীৎপ্রেণা তদেষাং নিহিতং গুহাবিঃ llসৃষ্টির আদিতে পদার্থসমূহের নামরূপকে গ্রহণ পূর্বক ঋষিগণের হৃদয়গুহায় বৃহস্পতি (বৃহৎ লোকসমূহের পতি জগদীশ্বর) তাঁর শ্রেষ্ঠ বাণী প্রেরিত করেছেন ।
হৃদয়গত প্রেরণার জন্য মুখ থেকে শ্রবণ করা বা কোনো বাহ্যিক অঙ্গের
প্রয়োজন অনাবশ্যক –" স্বয়ং তদন্তঃকরণেন গৃহ্যতে " – হৃদয়ে প্রেরণা
প্রাপ্তকারী শুদ্ধান্তঃকরণযুক্ত ব্যক্তি অনায়াসেই গ্রহণ করতে পারে ।
পরমেশ্বর অগ্নি আদি ঋষিগণ যাঁদের পরম জ্ঞান প্রদানের জন্য বরণ করেছেন,
তাঁরা মোক্ষ অবধি দীর্ঘকাল পর্যন্ত সেই পরমেশ্বরে লীন থেকে পুনরায়
আগমনকারী বিশিষ্ট জীব ছিলেন। অতএব এই মহান কার্যের জন্য এই ঋষিগণ ছিলেন
সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। ঈশ্বরে প্রণিধান ( স্থিতি ) হওয়ার দরুণ তাঁদের
অন্তঃকরণে দীপ্ত হওয়ার পর পরমেশ্বরকে যোগ দ্বারা প্রত্যক্ষ হওয়ার
ফলে পরম সত্য বেদের প্রকাশ হয়, অর্থাৎ, নির্মল বুদ্ধির জ্ঞানগ্রাহক
স্বাভাবিক গুণের কারণ বেদ পবিত্র ঋষিগণের আত্মায় সংক্রান্ত
(প্রতিভাসিত) হয়েছে ।
- - বিদুষাং বশংবদঃ
নমস্কার