মানুষের শরীর, মন ও আত্মার ক্ষুধা নানাবিধ – জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষুধা, ধনরত্নের ক্ষুধা মানসম্মানের ক্ষুধা বা প্রভাবপ্রতিপত্তির ক্ষুধা। এইসব ক্ষুধার নিবৃত্তি নর বা নারী একা একাও করতে পারে। এমন কতকগুলো ক্ষুধা আছে, যার নিবৃত্তি পুরুষ বা নারী একা একা করতে পারে না। তাতে নর ও নারীর মিলিত শক্তির প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজনেই নর ও নারী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় ও দাম্পত্য জীবন যাপন করে। দাম্পত্য জীবন ব্যতিরেকে এইসব ক্ষুধা নিবৃত্তির অন্য উপায় নেই । এইসব ক্ষুধা নরনারীর মধ্যে অন্তর্নিহিত। এই ক্ষুধাগুলিকে পাঁচ শ্রেণীতে বিভাগ করা যাইতে পারে- প্রথম যৌন ক্ষুধা, দ্বিতীয় সংসার রচনার ক্ষুধা, তৃতীয় সন্তান লাভের ক্ষুধা, চতুর্থ সামাজিকতার ক্ষুধা ও পঞ্চম আধ্যাত্মিক ক্ষুধা। বিবাহের উদ্দেশ্য এই পঞ্চবিধ ক্ষুধার নিবৃত্তি। পতি ও পত্নী যদি বিবাহের মূল উদ্দেশ্য এই পঞ্চবিধ ক্ষুধাকে না জানে, তবে তাহাদের দাম্পত্য জীবন ব্যর্থ হয় । এই পঞ্চবিধ ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য নর নারীর প্রতি এবং নারী নরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। নর ও নারীর মধ্যে পরস্পরের এই স্বাভাবিক আকর্ষণকে নিয়ন্ত্রিত, বৈধ, সীমাবদ্ধ ও উপযোগী করার জন্যই পরমেশ্বর বিবাহ বিধান প্রণয়ন করেছেন । জগতের অতি অল্প লোকই যৌন ক্ষুধাকে জয় করতে পেরেছে ।
যৌবনে এই ক্ষুধা নর ও নারীর প্রবল থাকে। এমন কি অনেকের পক্ষে তা সীমাকেও অতিক্রম করে। প্রাপ্তবয়স্ক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলের মধ্যেই যৌন ক্ষুধার অস্তিত্ব আছে। বিবাহিত জীবনে পতি ও পত্নীর শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক মিলনেই এই যৌন ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়। পতি বা পত্নীকে অতিক্রম করে নারী বা নরের যে অন্যত্র শারীরিক মিলন, তা অবৈধ। তাতে মানসিক ও আত্মিক মিলন অসম্ভব। অবৈধ শারীরিক মিলনে বা অবৈধ সন্তান সৃষ্টিতে সমাজ ও পরিবার ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। বৈধভাবে মানবাত্মার ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যই বিবাহ বিধানের প্রয়োজন ।

ব্রাহ্মো দৈবস্তথৈবার্ষঃ প্রাজাপত্যস্তথাসুরঃ ।
গান্ধর্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচশ্চাষ্টমোঽধমঃ ।। ৩.২১ ।।
অর্থাৎ, বিবাহ আট প্রকার, যথা- ব্রাহ্ম, , দৈব, আৰ্ষ, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ ।

আচ্ছাদ্য চার্চয়িত্বা চ শ্রুতশীলবতে স্বয়ম্ ।
আহূয় দানং কন্যায়া ব্রাহ্মো ধর্মঃ প্রকীর্তিতঃ ।। ৩.২৭ ।।
যজ্ঞে তু বিততে সম্যগৃত্বিজে কর্ম কুর্বতে ।
অলঙ্কৃত্য সুতাদানং দৈবং ধর্মং প্রচক্ষতে ।। ৩.২৮ ।।
একং গোমিথুনং দ্বে বা বরাদাদায় ধর্মতঃ ।
কন্যাপ্রদানং বিধিবদার্ষো ধর্মঃ স উচ্যতে ।। ৩.২৯ ।।
সহোভৌ চরতাং ধর্মং ইতি বাচানুভাষ্য চ ।
কন্যাপ্রদানং অভ্যর্চ্য প্রাজাপত্যো বিধিঃ স্মৃতঃ ।। ৩.৩০ ।।
অর্থাৎ,
- (১) কন্যাকে বস্ত্রাদিদ্বারা অলঙ্কৃত করে এবং কন্যাও যাকে পছন্দ করেছে সেই উত্তম, সুশীল, বিদ্বান ও কন্যার যোগ্য পুরুষকে আহ্বান করে আদর অভ্যর্থনা সহকারে কন্যাদান করাকে ব্রাহ্মবিবাহ বলে।
- (২) বিরাট যজ্ঞে বড় বড় বিদ্বানকে বরণ করে তাতে ঋত্বিক কর্মে নিযুক্ত কোন বিদ্বানকে বস্ত্রালঙ্কারাদিদ্বারা সুশোভিতা কন্যা দান করলে তা হয় দৈববিবাহ ।
- (৩) বরের নিকট হইতে ১ (এক) জোড়া বা ২ (দুই) জোড়া গাভী ও বলদ নিয়ে তাকে ধর্মপূর্বক কন্যাদান করার নাম আর্ষবিবাহ । [ একথা মিথ্যা, কেননা পরে মনুস্মৃতিতে (৫।৪৫-৪৮) নিষেধ করা হয়েছে এবং তা যুক্তিবিরুদ্ধও বটে। অতএব, কিছু আদান-প্রদান না করে উভয়ের প্রসন্নতা সহকারে পাণিগ্রহণ করাই আর্ষ বিবাহ ]
- (৪) যজ্ঞশালায় যথাবিধি যজ্ঞ করে সকলের সম্মুখে-“তোমরা উভয়ে মিলে যথাবিধি গৃহাশ্রম কর্ম করতে থাক” এইরূপ বলার পর উভয়ের সানন্দে পাণিগ্রহণ হওয়াকে প্রাজাপত্যবিবাহ বলে।

জ্ঞাতিভ্যো দ্রবিণং দত্ত্বা কন্যায়ৈ চৈব শক্তিতঃ ।
কন্যাপ্রদানং স্বাচ্ছন্দ্যাদাসুরো ধর্ম উচ্যতে ।। ৩.৩১ ।।
ইচ্ছয়ান্যোন্যসংয়োগঃ কন্যায়াশ্চ বরস্য চ ।
গান্ধর্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুন্যঃ কামসম্ভবঃ ।। ৩.৩২ ।।
হত্বা ছিত্ত্বা চ ভিত্ত্বা চ ক্রোশন্তীং রুদন্তীং গৃহাৎ ।
প্রসহ্য কন্যাহরণং রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে ।। ৩.৩৩ ।।
সুপ্তাং মত্তাং প্রমত্তাং বা রহো যত্রোপগচ্ছতি ।
স পাপিষ্ঠো বিবাহানাং পৈশাচশ্চাষ্টমোঽধমঃ ।। ৩.৩৪ ।।
অর্থাৎ,
- (৫) বরের জ্ঞাতিবর্গকে ও কন্যাকে যথাশক্তি ধন দিয়ে হোমাদি বিধিদ্বারা কন্যাদান করাকে আসুরবিবাহ বলে ।
- (৬) বর ও কন্যার ইচ্ছানুসারে উভয়ের যে সংযোগ হয় এবং কামাসক্ত হয়ে উভয়ে মনে মনে স্বীকার করে নেয় যে, তারা উভয়ে স্ত্রী- পুরুষ—এরূপ বিবাহকে গান্ধর্ববিবাহ বলে।
- (৭) হনন ও ছেদন অর্থাৎ কন্যাপক্ষীয় বাধাদানকারীদিগকে বিদীর্ণ করে বিলাপকারিণী, রোরুদ্যমানা, কম্পিতকলেবরা ও ভীতিপরায়ণা কন্যাকে বলাৎকারে হরণ করে বিবাহ করাকে রাক্ষস বিবাহ বলে।
- (৮) নিদ্রিতা, উন্মাদগ্রস্তা বা মদ্যপানে উন্মত্তা কন্যাকে একান্তে পেয়ে তাকে দূষিত করা—তা সব বিবাহের মধ্যে নীচ হইতেও নীচ, মহানীচ, দুষ্ট, অতিদুষ্ট পৈশাচবিবাহ ।

ব্রাহ্মাদিষু বিবাহেষু চতুর্ষ্বেবানুপূর্বশঃ ।
ব্রহ্মবর্চস্বিনঃ পুত্রা জায়ন্তে শিষ্টসম্মতাঃ॥
মনুস্মৃতি ৩।৩৯
অর্থাৎ, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য ও প্রাজাপত্য- এই ৪ (চার) প্রকারের বিবাহে পরস্পর পাণিগ্রহণে আবদ্ধ স্ত্রী-পুরুষ থেকে যে সব সন্তান উৎপন্ন হয়, তাহারা বেদাদি বিদ্যায় তেজস্বী, আপ্ত পুরুষের মতানুকূল ও অত্যুত্তম হয় ।
রূপসত্ত্বগুণোপেতা ধনবন্তো যশস্বিনঃ ।
পর্যাপ্তভোগা ধর্মিষ্ঠা জীবন্তি চ শতং সমাঃ ॥
মনুস্মৃতি ৩।৪০
অর্থাৎ, সেই সব পুত্র বা কন্যা সুন্দর রূপ, বল ও পরাক্রমযুক্ত, শুদ্ধবুদ্ধি, উত্তম গুণ ও বহুধনযুক্ত; পুণ্য কীৰ্ত্তিমান, পূর্ণভোগের ভোক্তা ও অতিশয় ধর্মাত্মা হয়ে ১০০ (শত) বৰ্ষ পৰ্য্যন্ত জীবিত থাকে ।

ইতরেষু তু শিষ্টেষু নৃশংসানৃতবাদিনঃ ।
জায়ন্তে দুর্বিবাহেষু ব্রহ্মধর্মদ্বিষঃ সুতাঃ ॥
অনিন্দিতৈঃ স্ত্রীবিবাহৈরনিন্দ্যা ভবতি প্রজা ।
নিন্দিতৈর্নিন্দিতা নৄণাং তস্মান্নিন্দ্যান্বিবর্জয়েৎ ॥
মনুস্মৃতি ৩।৪১-৪২
অর্থাৎ, এই চার প্রকার বিবাহ বাদে অবশিষ্ট— আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ এই ৪ (চারি) প্রকারের দুষ্ট বিবাহে উৎপন্ন সন্তান নিন্দিত কর্মের কর্তা মিথ্যাবাদী, বৈদিক ধর্মের বিদ্বেষী ও নীচ স্বভাবযুক্ত হয় । এজন্য যে সব নিন্দিত বিবাহে সন্তান নীচ হয়, তা ত্যাগ করে যে সব উত্তম বিবাহে সন্তান উত্তম হয়, তা-ই করা অত্যুত্তম কাৰ্য ।
অতঃ সনাতন ধর্মালম্বী মাত্রেই আর্যশাস্ত্রীয় বিধিবিধান অনুযায়ী উৎকৃষ্ট বিবাহ করা উচিত ।
আরো পড়ুন " কন্যার বর নির্বাচন অধিকার " ~ https://www.agniveerbangla.org/2023/02/blog-post_22.html?m=1
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর