দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







যজুর্বেদ ৩২|৩ ও পরমাত্মার স্বরূপ

সত্যান্বেষী
6

 

 
★न तस्य॑ प्रति॒माऽअस्ति॒ यस्य॒ नाम॑ म॒हद्यशः॑।हि॒र॒ण्य॒ग॒र्भऽइत्ये॒ष मा मा॑ हिꣳसी॒दित्ये॒षा यस्मा॒न्न जा॒तऽइत्ये॒षः॥
ন তস্য॑ প্রতি॒মাऽঅস্তি॒ য়স্য॒ নাম॑ ম॒হদ্যশঃ॑ ।
হি॒র॒ণ্য॒গ॒র্ভऽইত্যে॒ষ মা মা॑ হিꣳসী॒দিত্যে॒ষা য়স্মা॒ন্ন জা॒তऽইত্যে॒ষঃ ॥
[যজুর্বেদ ৩২|৩]
(ন) না (তস্য) তার (প্রতিমা) প্রতিমা (অস্তি) হয় (যস্য) যার (নাম) নাম (মহৎ) মহান (যশঃ) কীর্তিকর। (হিরণ্যগর্ভ) জ্যোতিষ্কমণ্ডলের আধার (ইতি) এইরূপ (এষ) এই পরমাত্মা। (মা মা হিংসীৎ) "আমাকে তোমা হতে বিমুখ করোনা", (ইত্যেষা) এইরূপে এই পরমাত্মার কাছে প্রার্থণা করতে হয়। (যস্মাত্) যার অপেক্ষা (ন জাত) অধিক প্রসিদ্ধ কিছুই নেই (ইতি) এইপ্রকার (এষ) এই পরমাত্মার স্বরূপ।
 
এইটি বেদের অত্যন্ত প্রসিদ্ধ মন্ত্রগুলোর একটি। এই মন্ত্রে স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করা হচ্ছে, সেই অনন্ত পরমেশ্বরকে কোনো প্রতিমায় ব্যক্ত করা সম্ভব না। কিছু ভাষ্যকার প্রতিমা শব্দ দ্বারা এখানে মূর্তি, ছবি এই অর্থগুলো গ্রহণ করেছেন। আবার কিছু ভাষ্যকার প্রতিমা শব্দ দ্বারা এখানে সাদৃশ্য, উপমা, তূলনা এই অর্থগুলো গ্রহণ করেছেন।
 
তবে এই ভাষ্যগুলো ছাড়াও আর্য সমাজের ভাষ্যই এখানে অত্যন্ত নিরপেক্ষ। কেননা আর্যসমাজের বিদ্বানদের করা প্রায় সকল ভাষ্যেই প্রতিমা শব্দটি দ্বারা এখানে সম্ভাব্য সকল অর্থকেই স্বীকার করা হয়েছে।
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ভাষ্য করছেন, "পরমেশ্বরের প্রতিমা অর্থাৎ পরিমাপ, সাদৃশ্য, তুলনা, প্রতিকৃতি বা আকৃতি নেই।"
 
হরিশরণ সিদ্ধালংকারও একইরকমভাবে ভাষ্য করছেন, "সেই প্রভুর মূর্তি, পরিমাপ, সাদৃশ্য, তুল্যতা নেই।"
ড. তুলসীরাম শর্মা অনুবাদ করছেন, "There is none and nothing like Him, no picture, no icon, no simile, no metaphor."
 
এভাবে আর্য সমাজের অন্যান্য সকল বেদ-উপনিষদ ভাষ্যেই অনুরূপ অনুবাদ পাওয়া যায়। এছাড়া পূর্ববর্তী পুরাণবাদী ভাষ্যকারগণও এরূপ উভয় অর্থকেই স্বীকার করেছেন। মহিধর ও উব্বট দুজনেই প্রায় একইপ্রকার অর্থ করেছেন যে, সেই পুরুষের প্রতিমা ও প্রতিমানভূত কোনো বস্তু নেই।
 
এই মন্ত্রটির অনুবাদ আবার অনেকে শঙ্করাচার্যের উপনিষদ্ ভাষ্য হতে দেখিয়ে থাকে। অথচ শঙ্করাচার্য তার সেই উপনিষদ্ ভাষ্যেই [মুন্ডকোপনিষদ্ ২|১|২] এ "অমূর্তঃ পুরুষঃ" এর ভাষ্য করেছেন, " অমূর্তঃ সর্বমূর্তিবর্জিত পুরুষ" অর্থাৎ সেই পুরুষ সর্বমূর্তিবর্জিত। অর্থাৎ পরমেশ্বরের যে কোনো মূর্তি হয়না তা শঙ্করাচার্যের উপনিষদভাষ্যেও স্পষ্টতই স্বীকার করা হয়েছে। 
 
তথাপি যজুর্বেদের উক্ত মন্ত্রে যারা প্রতিমা দ্বারা প্রতিমা বা মূর্তি অর্থকে মানেনা তাদের দাবি পরমেশ্বরের প্রতিমা বানানো অবশ্যই সম্ভব। তাই এখানে প্রতিমা দ্বারা প্রতিমা অর্থ নেওয়া যাবেনা। কিন্তু আসলেই কি বেদ, উপনিষদ্, গীতা, দর্শনাদি বৈদিক শাস্ত্রে প্রতিপাদিত সেই পরমেশ্বরের কোনো মূূর্তি বানানো যায়? নিচে এই বিষয়েই আলোচনার চেষ্টা করব।
 
১) সনাতনধর্মে পরমাত্মা অসীম (সাম ৩৩৫), অনন্ত (ঋক্ ৪|১|৭)।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহতঃ। [যজুর্বেদ ৪০|৫]
(তত্) সেই ব্রহ্ম (অস্য সর্বস্য) এই সমস্তকিছুর (অন্তঃ) ভেতরে (তত্ উ) সেই ব্রহ্মই (সর্বস্যাস্য) এই সমস্তকিছুর (বাহতঃ) বাহিরে।
 
যিনি সমস্ত চরাচর জগতে ব্যাপ্ত হয়ে তা অতিক্রম করেও অনন্তব্যাপী একটি মানবাকৃতির প্রতিমাতে কি সেই অসীম পরমেশ্বরকে ব্যক্ত করা যায়? 
 
পরমেশ্বরের সেই অনন্ত স্বরূপের বিষয়ে বেদে বলা হচ্ছে, " যতটা বিশাল আকাশ ও পৃথিবী তাদের বিস্তারে, যতদূর জলধারা প্রবাহমান, যতদূর প্রকাশ বিদ্যমান, যতদূর সমস্ত দিক-উপদিক বিস্তৃত এই সমস্ত অপেক্ষাও পরমেশ্বর অনেক বিশাল, তিনি সর্বদাই মহান।[অথর্ব ৯|২|২০,২১] " 
 
বিশাল আকাশ, পৃথিবী, সমস্ত দিক-উপদিকও যার বিশালতার কাছে অতি নগণ্য সেই পরমেশ্বরের অপার স্বরূপকে সামান্য কোনো মূর্তি-ছবিতে ব্যক্ত করার ক্ষমতা কারো আছে কি? 
 
সমস্ত জগত তারই মহিমা, তিনি এই সমস্ত জগত অপেক্ষাও অনেক বিশাল। [যজু ৩১|৩]।
ব্রহ্ম শব্দের অর্থই বিশাল। "তার অপেক্ষা বিশাল কিছুই নেই [ঋগ্বেদ ৪|৩০|১]। "
শুধুমাত্র এই জগতের বিশালতাকেই আমরা কল্পনাতেও ধারণ করতে অপারগ। আর যেই ব্রহ্মের বিশালতার কাছে এই সমস্ত জগতও তুচ্ছ কোন মূর্তি, ছবি বা আকারে সেই অনন্ত ব্রহ্মকে ব্যক্ত করা যাবে?
বেদে আরো বলা হচ্ছে,
 
যদ্দ্যাব ইন্দ্র তে শতং শতং ভূমীরুত স্যুঃ। ন ত্বা বজ্রিন্সহস্রম্ সূর্যা অনু ন জাতমষ্ট রোদসী।।
[সামবেদ ২৭৮]
(ইন্দ্র) হে সর্বৈশ্বর্যময়, (যত্) যদি (তে) আপনার (দ্যাবঃ) এই আকাশ (শতম্) শতসংখ্যক হয় (উত্) এবং (ভূমিঃ শতম্ স্যুঃ) যদি পৃথিবীও শতসংখ্যক হয় (ন ত্বা অনু) তা আপনার সমান হবে না। (বজ্রিন্) হে ওজস্বী ব্রহ্ম, (সহস্রম্ সূর্যাঃ) সহস্র সূর্যও আপনার সমান না। (জাতম্) সমস্ত সৃষ্টিতে নিজ মহিমা দ্বারা প্রকট আপনাকে (রোদসী) সমস্ত দ্যুলোক- পৃথিবী (ন অষ্ট) ব্যাপ্ত করতে পারে না।
 
শত পৃথিবী, শত আকাশও যার সমান না কোন মূর্তি সেই অনন্ত পরমাত্মার সমান হবে? একটা মানুষের মতো দেখতে মূূর্তি বানিয়ে দিলেই কি তা সেই অনন্ত পরমাত্মার মূূর্তি হয়ে যায়? 
 
২) এমন কোন আকার বা শরীর আছে যা পরমেশ্বরের সেই অসীম স্বরূপকে নিজের মধ্যে ধারণ করবে? কোনোকিছুর আকার আছে মানেই হলো তার একটা সীমানা বা বাউন্ডারি আছে। যেহেতু পরমেশ্বর অসীম তাই তার কোনো আকার বা শরীর হতে পারেনা। কেননা আপনি পরমেশ্বরকে কোনো আকার দিলেন মানে আপনি তাকে সেই আকার বা শরীরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছেন। অনন্ত অপার পরমেশ্বরকে কোনো আকার বা রূপে আবদ্ধ করা যায় না।
অতএব, যেই পরমেশ্বর নিরাকার (যজু৪০|৮), অরূপ(শ্বেতা৩|১০) তার কীভাবে কোনো প্রতিমা বানানো যেতে পারে? 
 
৩) আলোচ্য মন্ত্রাংশের অর্থ হিসেবে আপনি বলছেন, " পরমেশ্বরের সদৃশ কিছু নেই", "পরমেশ্বরের সাথে তূলনা করার মতো কিছু নেই "। এই অর্থগুলো আর্য সমাজও স্বীকার ও একইসাথে মনন করে।
পরমেশ্বরের সদৃশ কিছু হতে পারেনা যদি আপনি তা বিশ্বাস করেন তাহলে কীভাবে কোনো মূর্তি বানিয়ে সেই মূর্তির রূপ বা আকারকে পরমেশ্বরের সদৃশ বলে মানছেন?
যদি পরমেশ্বরের সাথে তূলনা করার মতো কিছুই না থাকে তাহলে কোনো জড় মূর্তির রূপ বা আকারকে আপনি কীভাবে পরমেশ্বরের সাথে তূলনা করছেন?
 
বেদাদি শাস্ত্রে অসংখ্য জায়গায় বলা হয়েছে পরমেশ্বরের সদৃশ বা তার সাথে তূল্য কিছু হতে পারে না।
দেবীসুক্তে পরমাত্মা বলছেন, "আরভামাণা ভুবনানি বিশ্বা। পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যা। [ঋক্ ১০|১২৫|৮] অর্থাৎ আমিই নিখিল জগতের নির্মাণ করি। আমি আকাশের অতীত, এই পৃথিবীর অতীত।"
"তার সদৃশ কিছু না আছে পৃথিবীতে, না আছে আকাশে। না জন্মেছে, না জন্মাবে। [ঋক্ ৭|৩২|২৩]"
"হে পরমেশ্বর! না এরূপ কিছু আছে যেরূপ আপনি। [ঋক্ ৪|৩০|১] "
এই জগতে যদি সেই অনন্ত পরমেশ্বরের সদৃশ কিছু না থাকে তাহলে কেন প্রতিমা তৈরি করে জাগতিক রূপ, আকারে তাকে ব্যক্ত করা হয়?
 
উপনিষদে ঋষিগণের বাক্যে যিনি জ্ঞাত - অজ্ঞাত সমস্তকিছুরই অতীত[কঠ ২|১|১০] সামান্য একটা মানবাকৃতির মূর্তি বানিয়ে দিলেই কি সেই সর্বেশ্বরের প্রতিমা হয়ে যায়?
যিনি পরম [ঋক্ ১|১৬৪|৩৯], যার সদৃশ কিছুই নেই [ঋক্ ১|৫২|১৩] কেন কোনো প্রতিমা বানিয়ে বলা হয় তা সেই পরমেশ্বরের সদৃশ?
৪) যেই পরমেশ্বর সমস্ত জাগতিক পরিমাপের অতীত [অথ ১০|৭|৩৯] কোন পরিমাপে তার মূর্তি নির্মিত হবে?
৫) নৈব চ তস্য লিঙ্গম্। [শ্বেতাশ্বতর ৬|৯]
(তস্য) তার (লিঙ্গম্) কোনো চিন্হবিশেষও (ন এব) নেই।
ন প্রতীকে ন হি সঃ।। [বেদান্তদর্শন ৪|১|৪]
(ন প্রতীকে ন হি সঃ) প্রতীক = মূর্তি আদি জড়ের মাঝে পরমাত্ম-বুদ্ধি করা উচিত না, কেননা তা পরমাত্মা নয়।
 
বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে কোনো চিন্হবিশেষেও সেই অনন্ত পরমেশ্বরকে ব্যক্ত করা যায় না। এই শাস্ত্রবাক্যগুলোর অর্থ নিয়ে কিন্তু কারো কোনো দ্বিমত নেই। তাহলে যেই পরমেশ্বরের কোনো চিন্হবিশেষও তৈরি করা সম্ভব না তার প্রতিমা কীভাবে তৈরি করা যাবে? 
 
৬) যারা এরূপ কোনো আকৃতি, প্রতিমা, বস্তু বা স্থানেই পরমাত্মা বিশেষভাবে বিদ্যমান বলে মনে করে তাদের বিষয়ে উপনিষদে এসেছে,
 
যদ্ এবেহ তদ্ অমুত্র যদ্ অমুত্র তদন্বিহ।
মৃত্যো স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি।।
[কঠোপনিষদ ২|১|১০]
(যৎ) যেই ব্রহ্ম (ইহ) এখানে (তৎ এব) সেই ব্রহ্মই (অমুত্র) ওখানেও, (যৎ) যেই ব্রহ্ম (অমুত্র) ওখানে (তৎ) সেই ব্রহ্ম (ইহ অনু) এখানেও একইভাবেই বিদ্যমান। (যঃ) যেই ব্যাক্তি (ইহ) এই ব্রহ্মতে (নানা ইব) নানাত্ব (পশ্যতি) দর্শন করে (সঃ) সে (মৃত্যোঃ) মৃত্যু হতে (মৃত্যুম্) মৃত্যুকে (আপ্নোতি) প্রাপ্ত হয়।
গীতাতেও বলা হচ্ছে,
সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং [গীতা ১৩|২৭]
(সর্বেষু ভূতেষু) তিনি সর্বভূতে (সমং) সমভাবে (তিষ্ঠন্তং) স্থিত।
তাই তিনি যে কোনো আকৃতি, প্রতিমা, বস্তু বা স্থানেই বিশেষভাবে বিদ্যমান আছেন এমনটা নয়। তিনি নিখিল ব্রহ্মান্ড ও তার পরেও যাকিছু সমস্ততে এক অদ্বিতীয় স্বরূপেই পূর্ণ হয়ে আছেন। যারা কোনো বিশেষ আকৃতি, প্রতিমা, বস্তু বা স্থানেই কেবল তাকে দর্শন করার চেষ্টা করে তারা সেই পরমাত্মার প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারেনা এবং সেই অজ্ঞানতাবশত মৃত্যু হতে মৃত্যুকে অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর এই সংসারচক্রে আবদ্ধ হয়ে থাকে।
 
৭) যারা মূর্তি-পূজা করে তারা পরমেশ্বরকে কোনো মানবাকৃতি বা তাদের কল্পিত কোনো বিশেষ রূপেই চিন্তন করে। অথচ পরমেশ্বর স্বয়ং রূপ,শরীর বা আকারাদির অতীত হয়েও তার রূপ বা শরীর বিশ্বময়। কেননা পরমেশ্বরই জগতের সমস্ত রূপের স্রষ্টা [অথ ১৩|১|১১], তাই জগতের সমস্ত রূপও তারই। আবার আত্মা যেরূপে শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে থাকে তেমনি পরমেশ্বর সমস্ত ভূতে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন [যজু ৪০|৫,৬], সমস্ত রূপে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন [ঋক্ ৯|২৫|৪]।
তাই উপনিষদে বলা হচ্ছে,
 
"পরমেশ্বর সমস্ত ভূতেই প্রবিষ্ট হয়ে আছেন, সমস্ত ভূতই তার শরীর [বৃহদারণ্যক ৩|৭|১৫]। " এভাবে বলা হচ্ছে, "পৃথিবী, অগ্নি, বায়ু, জল, অন্তরিক্ষ, দ্যুলোক, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, দিকসমূহ, আকাশ, অন্ধকার, তেজ সমস্তকিছুর মধ্যে তিনি বিদ্যমান। এই সমস্তকিছুই তার শরীর [বৃহ ৩|৭|৩-১৪]। "
 
তাই পরমেশ্বরকে কোনো বিশেষ আকার, শরীর বা রূপেই কল্পনা করা ভ্রান্তমত ব্যতিত কিছুই না। বরং তার দ্বারা ব্যাপ্ত জগতের প্রতিটা বস্তুই তার শরীর, এই সমস্ত জগতই তার শরীর। সমস্ত জগতময় তার রূপ।
পবিত্র বেদেও একইভাবেই সেই নিরাকার পরমাত্মার স্বরূপ বর্ণনা করা হচ্ছে,
 
যস্য ভূমিঃ প্রমান্তরিক্ষমুত্ উদরম্। দিবং যশ্চক্রে মূর্ধানং তস্মৈ জ্যষ্ঠায ব্রহ্মণে নমঃ॥
[অথর্ববেদ ১০|৭|৩২]
(ভূমিঃ) ভূমি (যস্য) যার (প্রমা) পাদমূল (উত) ও (অন্তরিক্ষম্) অন্তরিক্ষ (উদরম্) যার উদর (দিবম্) এই দ্যুলোক (মূর্ধানম্) যার মস্তক (যঃ চক্রে) যিনি একে রচনা করেছেন (তস্মৈ জ্যেষ্ঠায়) সেই সব থেকে মহান, ( ব্রহ্মণে) সব থেকে বিশাল পরমাত্মাকে (নমঃ) নমস্কার করি।
যস্য সূর্যশ্চক্ষুশ্চন্দ্রমাশ্চ পুনর্ণবঃ। অগ্নিং যশ্চক্র আস্যং তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ॥
[অথর্ববেদ ১০|৭|৩৩]
(পুনর্ণব) পুনঃপুনঃ নবীন (সূর্যঃ চ চন্দ্রমাঃ) এই সূর্য ও চন্দ্রমা (যস্য) যার (চক্ষুঃ) নয়ন। (অগ্নিম্) প্রকাশ (আস্যম্) যার বদন। (যঃ) যিনি (চক্রে) একে রচনা করেছেন। (তস্মৈ) সেই (জ্যেষ্ঠায়) সব থেকে মহান, (ব্রহ্মণে) সব থেকে বিশাল পরমাত্মাকে (নমঃ) নমস্কার করি।
 
অর্থাৎ একজন প্রকৃত ঈশ্বরভক্ত পরমেশ্বরকে কেবল কোনো বিশেষ আকার বা রূপেই চিন্তন করে না। বরং তার স্রষ্টাকে সে খুঁজে পায় সমস্ত সৃষ্টির মাঝেই। অনন্ত অপার পরমেশ্বর সমস্ত জগতে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন, এই সমস্ত জগতই যেন তার শরীর। ওই সূর্য ও চন্দ্রমা যেন তারই দুইটি চোখ, দীপ্তি যেন তার বদন, দ্যূলোক তার মস্তক, অন্তরিক্ষ তার উদর, এই ভূমি যেন তারই পাদমূল। অর্থাৎ এই নিখিল জগতই তার রূপ, এই সমস্ত সৃষ্টির মধ্য দিয়েই রূপহীন তার রূপ ব্যক্ত হয়। এভাবে প্রতিটা বস্তুতেই একজন ঈশ্বরভক্ত পরমেশ্বরের বিভূতি খুঁজে পায়। সমস্ত জগতময় তার সেই বিশ্বরূপকে উপলব্ধি না করে যারা কোনো প্রতিমা বানিয়ে পরমেশ্বরকে কেবল কোনো বিশেষ আকার বা রূপেই কল্পনা করতে চায়, তারা পরমেশ্বরের প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারেনা।

Post a Comment

6Comments
  1. নিজের ইচ্ছে মতো মন্তব্য করার জিনিস না সনাতন ধর্মের শাস্ত্রগুলো।
    আর বিশেষ করে বেদ

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার ভুল মনে হলে আর অগ্নিবীর নিজ ইচ্ছে মতো মন্তব্য করে থাকলে সঠিক টা কি বেদ কি বলে এই বিষয়?

      Delete
  2. আপনার ভুল কথা বলছেন। আমাদের ধর্মে ঠাকুরের কোন চিত্র অঙ্কন করা হয়নি তবে ঠাকুর কি রকম দেখতে ছিল সেই রকম মতামত আমাদের শাস্ত্রে দেয়া আছে সেই অনুযায়ী আমাদের ভগবানের যে মূর্তিটা তৈরি করা হয়।

    ReplyDelete
  3. "যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
    মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।"শ্রীমদভগবদগীতা ৪/১১
    অর্থাৎ
    "যারা যেভাবে আমার ভজনা করে, আমি তাদের সেভাবেই তুষ্ট করি। হে পার্থ, মনুষ্যগণ সর্বভাবে আমার পথই অনুসরণ করে।"
    শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতে সাকার উপাসনার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে দ্বাদশ অধ্যায়, "ভক্তিযোগ", এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে।
    অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেন, যাঁরা সর্বদা সাকার রূপে তাঁর ভজনা করেন এবং যাঁরা অক্ষর, অব্যক্ত ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ যোগী?
    এর উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
    শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ১২, শ্লোক ২:
    ময়্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যযুক্তা উপাসতে।
    শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ।।
    এর অর্থ:
    "যাঁরা আমাতে (সাকার ঈশ্বরে) মনকে নিবিষ্ট করে এবং পরম শ্রদ্ধা সহকারে সর্বদা আমার ভজনা করেন, আমার মতে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ যোগী।"
    সাকার উপাসনার সুবিধা:
    এই শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট করে বোঝান যে, সাকার ঈশ্বরের উপাসনা মানুষের জন্য সহজ এবং অধিক ফলপ্রসূ। এর কারণগুলো হলো:
    * মনকে একাগ্র করা সহজ: অব্যক্ত, নিরাকার ব্রহ্মের উপর মনকে স্থির করা সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু সাকার রূপে ঈশ্বরের উপাসনা করলে ভক্ত একটি নির্দিষ্ট রূপ বা গুণাবলী নিয়ে চিন্তা করতে পারে, যা মনকে একাগ্র করতে সাহায্য করে।
    * শ্রদ্ধা ও ভক্তির বিকাশ: সাকার উপাসনার মাধ্যমে ভক্তের মনে প্রেম, ভক্তি, এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে ঈশ্বরের প্রতি। এই ব্যক্তিগত ভক্তি আধ্যাত্মিক পথে দ্রুত অগ্রগতি এনে দেয়।
    * বন্ধন থেকে মুক্তি: শ্রীকৃষ্ণ আরও বলেন যে, যাঁরা সাকার রূপে তাঁর প্রতি সম্পূর্ণভাবে মন নিবিষ্ট করেন, তিনি স্বয়ং তাঁদেরকে জন্ম-মৃত্যু রূপ সংসার সাগর থেকে উদ্ধার করেন।
    তবে, এর মানে এই নয় যে নিরাকার উপাসনা খারাপ। শ্রীকৃষ্ণ দ্বাদশ অধ্যায়ের পরবর্তী শ্লোকগুলোতে নিরাকার উপাসনার কথাও বলেছেন, কিন্তু তিনি উল্লেখ করেছেন যে, নিরাকার উপাসনা সাধকদের জন্য অধিক কষ্টসাধ্য:
    শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ১২, শ্লোক ৫:
    ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্।
    অব্যক্তা হি গতিদুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে।।
    এর অর্থ:
    "অব্যক্ত (নিরাকার) ব্রহ্মে আসক্তচিত্ত ব্যক্তিগণের ক্লেশ অধিক হয়, কারণ দেহধারীগণের পক্ষে অব্যক্ত গতি (নিরাকার ব্রহ্মকে প্রাপ্তি) দুঃখকর।"
    সংক্ষেপে, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় সাকার উপাসনাকে সহজ ও শ্রেষ্ঠ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ এটি সাধারণ মানুষের জন্য অধিক বোধগম্য এবং ভক্তি বিকাশে সহায়ক।
    হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন এবং সুখী হউন।

    ReplyDelete
  4. বেজেই আছে পৃথিবী গোটা সৃষ্টি তার প্রকাশ তাহলে যে মাটি বা পাথরের মূর্তিতে তাকে ডাকছি সেই মূর্তি তার প্রকাশ কেন হবে না?নিরাকার অসীম সাকার হতে পারেনা?যদি না পারে তাহলে সে সর্বশক্তিমান নয়।তাই বেদ এটাও বলে একম্ সৎ বিপ্রাবহুদাবদন্তি।এক সত্য বিভিন্ন‌ভাবে প্রকাশিত।তার রূপগুলো দিয়ে সেই অসীমকে জানার চেষ্টা হয়।নীল বা কালো‌রং হয় আকাশের মতো অসীমকে জানার জন্য।অস্ত্র থাকে অধর্মকে ধ্বংসকারী চিহ্ন হিসাবে।আশির্বাদের হাত হলো সৃষ্টিকে রক্ষার চিহ্ন।এগুলো বুঝুন।

    ReplyDelete
  5. বেদকে কোরাণের সাথে তুলনা করছেন কেন?আপনি সেই অসীমকে উপলব্ধি করবেন কী করে?সবাই যে নিরাকার কে উপলব্ধি করতে পারবে তার নয়।আপনারা যে দয়ানন্দ স্বামীর ছবি কে পুজো করেন তার মধ্যে তো উনি নেই।তাও করেন কারণ ওটার মাধ্যমে ওনাকে সম্মান দেন।তেমনি নিরাকার ঈশ্বরকে আপনি সম্মান দিতে গেলে হয় তার এক যৌক্তিক রুপ বা চিহ্ন লাগবে এটা সবার আছে।আমাদের ওম্।আর সব চেয়ে বড়ো কথা হলো বেদ কোথাও বলেনি সেই সর্ব ক্ষমতাশালীর ক্ষমতা নেই নিরাকার থেকে সাকার হওয়ার।গোটা জগৎ তার প্রকাশ হলে মাটির বা ধাতুর বা পাথরের ভব্য মূর্তিটা নয় কেন?আমাদের তো বলা আছে অখন্ড মন্ডলাকারম্ ব্যাপ্তম্ জীব চরাচরম্।

    ReplyDelete
Post a Comment