প্রশ্ন: ঈশ্বর নিরাকার হলে বেদ ঈশ্বরের বাণী হয় কীভাবে ? বাণী হতে হলে ঈশ্বরের মুখ, ঠোঁট, জিহ্বা, দাঁত থাকা দরকার ।
উত্তর: বেদোৎপত্তির বিষয়ে কেউ কেউ এইরকম প্রশ্ন করেন, পরমেশ্বর নিরাকার হওয়ায় কীভাবে শব্দরূপ বেদ তাঁর থেকে উৎপন্ন হতে পারে ? এর উত্তর হলো, পরমেশ্বর সর্বশক্তিমান এজন্য তার প্রতি এরকম সন্দেহ করা যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা মুখ প্রাণ ইত্যাদি উপায় ছাড়াও এই ইন্দ্রিয় বা অঙ্গের কাজ করার জন্য পরমেশ্বরের অনন্ত শক্তি আছে। অর্থাৎ পরমাত্মা নিজের অনন্ত সামর্থ্য বলে মুখ ও প্রাণ আদি ইন্দ্রিয় ছাড়াই মুখ প্রাণ ইত্যাদির যে যে কাজ তা যথাযথভাবে করতে পারেন ।
অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ।
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্॥
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ ৩।১৯
সরলার্থঃ সেই পরমাত্মার হাত নেই, তবুও নিজের অনন্ত শক্তি দ্বারা তিনি সবকিছু গ্রহণ অর্থাৎ ধারণ করেন। তাঁর পা নেই, তবুও তিনি সর্বব্যাপক হওয়ার কারণে সর্বাধিক বেগবান। তাঁর চক্ষু নেই, তবুও তিনি সবকিছু দর্শন করেন। তাঁর কর্ণ নেই, তবুও তিনি সবই শ্রবণ করেন। তিনি সমস্ত জ্ঞাতব্য বিষয় জানেন, অথচ তাঁকে কেউ সম্পূর্ণরূপে জানে না। এজন্য জ্ঞানিগণ তাঁকে সর্বাগ্রণী, সর্বাপেক্ষা মহান পুরুষ বলেন।
এই শ্রুতিবাক্যে স্পষ্টভাবে পরমাত্মার ইন্দ্রিয়ের প্রতিষেধ করা হয়েছে। পরমেশ্বর চক্ষু-কর্ণাদি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও হস্ত-পদাদি কর্মেন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়াই গ্রহণ, দর্শন, শ্রবণাদি কার্য সিদ্ধ করতে পারেন, আর এটিই তাঁর সর্বশক্তিমত্তা। সংসার সাগরে নিমজ্জিত অল্পজ্ঞ মানব সেই সর্বজ্ঞ ব্রহ্মকে জানতে পারে না। কিন্তু বৈরাগ্য-প্রাপ্ত, শ্রদ্ধাবান, ধার্মিক মনুষ্যগণ ব্রহ্মবিদ্যার চর্চা ও ধ্যানাদি যোগাভ্যাস দ্বারা তাঁকে জানতে সমর্থ হন। কিন্তু সেই বাক্যমনাতীত ব্রহ্মকে কেউ পূর্ণরূপে জানতে পারে না (কেন০ ২।৩ দ্রষ্টব্য)। তাই বর্তমান শ্রুতিতে বলা হয়েছে, তাঁর জ্ঞাতা কেউই নেই। এজন্য জ্ঞানিগণ সেই জগদীশ্বরকে সর্বাগ্রণী, সর্বাপেক্ষা মহান পুরুষ বলেন।
এই শ্রুতির ব্যাখ্যায় মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী লিখেছেন—
“পরমেশ্বরের হস্ত নেই, কিন্তু তিনি নিজের শক্তিরূপ হস্ত দ্বারা সমস্ত রচনা এবং গ্রহণ করেন। তাঁর চরণ নেই, কিন্তু তিনি ব্যাপক হওয়ার কারণে সর্বাপেক্ষা অধিক বেগবান। তাঁর চক্ষুগোলক নেই, কিন্তু তিনি সমস্ত যথাবৎ দর্শন করেন। তাঁর শ্রোত্র নেই, তবুও তিনি সকলের কথা শ্রবণ করেন। তাঁর অন্তঃকরণ নেই, কিন্তু তিনি সমস্ত জগৎকে জানেন। তাঁকে সম্পূর্ণরূপে জানতে পারে, এমন কেউ নেই। সনাতন, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বত্র পূর্ণ হওয়ার কারণে তাঁকে ‘পুরুষ’ বলা হয়। তিনি ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ ব্যতীত সব কর্ম নিজের অনন্ত সামর্থ্য দ্বারা করেন। (সত্যার্থ প্রকাশ, ৭ম সমুল্লাস)”।
সর্বশক্তিমান সম্ভব-অসম্ভব সব কিছুই করতে পারে, এ মনে করা মস্ত বড় ভুল ছাড়া আর কিছুই না । যাঁর মধ্যে সর্বপ্রকার শক্তি আছে তিনি সর্বশক্তিমান, এই হলো সর্বশক্তিমানের বাস্তবিক অর্থ। যিনি সর্বশক্তিমান হবেন তিনি জগতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পদার্থকে অপরের সাহায্য ব্যতীত যেমন যুক্ত করতে পারবেন, তেমনি তাদের বিযুক্তও করতে পারবেন । তিনি সমস্ত জীবকে তাদের কর্মানুয়াযী ফল দিতে এবং সৃষ্টি, স্থিতিও প্রলয় করতে পারবেন । তাৎপর্য এই যে, ঈশ্বর তাঁর নিজের কর্ম সম্পাদনে অপর কোনো কিছুর সাহায্য গ্রহণ করবেন না । এই হল ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্ত্বা । সর্বশক্তিমানের অর্থ এ নয় যে, তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবেন ।
মুখ প্রাণ আদি অর্থাৎ ইন্দ্রিয় ব্যতীত যেসব কাজ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে করতে হয় তা না করতে পারার দোষ কেবল অল্প সামর্থ্যযুক্ত জীবেরই হয়, পরমাত্মার এই দোষ নেই। আবার আমরা যেমন মনে মনে কোন চিন্তা করার সময় বাক্য রচনা ছাড়াও মনে মনে প্রশ্নোত্তরের শব্দ উচ্চারণ করতে পারি, সেভাবেই পরমেশ্বরের বিষয়ে জানা কর্তব্য । যিনি সর্বসামর্থ্যযুক্ত, তিনি কখনো কোনো কাজ করবার সময় কারো বা কিছুর সাহায্য গ্রহণ করেন না। কারণ তিনি নিজ সামর্থ্যবলেই সকল ধরনের কাজ করতে সমর্থ হন। যেভাবে অন্যের সাহায্য ব্যতীত আমরা কোন কাজ করতে সক্ষম নই, ঈশ্বর তেমন নয়।
শরীরের অধীনে থেকেন ঈশ্বরকে যদি অপরের ভরসায় কাজ করতে হয়, তাহলে তিনি ‘সর্বশক্তিমান’ হবেন কেমন করে? অল্পজ্ঞ জীব যেমন শরীরের ভরসায় কাজ করে, তেমনি ঈশ্বরকেও শরীরের ভরসায় কাজ করতে হবে । তাহলে তুমিই বল, জীব আর ঈশ্বরে পার্থক্য কী রইল? মানুষকে যেমন শীত, গ্রীষ্ম, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ব্যাকুল করে তোলে, মানুষের যেমন রাগ-দ্বেষ, জ্বর-জ্বালা হয়, তেমনি শরীরধারী ঈশ্বরেরও হবে ।
ঈশ্বর সাকার স্বীকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে পরাধীন হতে হবে তত্ত্বতঃ তিনি স্বাধীন থাকতে পারবেন না । কখনও তাঁর খাওয়ার প্রয়োজন বা কখনও জলের, কখনও বা বস্ত্রাদির আবার কখনও নিবাস স্থানের অর্থাৎ মাথা গোঁজার মত ঠাঁইও প্রয়োজন হবে । যিনি জগতের যাবতীয় কর্ম আপন শক্তিবলে করেন, তাঁকে শরীরের সাহায্যে করতে হবে। এ অবস্থায় তাঁকে সর্বশক্তিমান কোন্ বিচারে বলবো বলো? যদি কোনো ব্যক্তি অন্যকে আপন দৃষ্টি শক্তি প্রভাবে আকৃষ্ট করে জ্ঞানহারা করতে সক্ষম হয়, আর এক ব্যক্তি কাহাকেও ঔষধ প্রয়োগে জ্ঞানহারা করে বলতো, এ দুজনের মধ্যে কোন জন অধিক শক্তিশালী । এস্থলে সেই শক্তিশালী ব্যক্তি, যেজন দৃষ্টিশক্তিবলে অন্যকে জ্ঞানহারা করতে সক্ষম। যদি বলো কেনো ? কারণ এই যে, সে অপরকে সংজ্ঞাহীন করতে ঔষধের সাহায্য নেয়নি এবার তুমি বেশ ভাল করে বুঝেছ যে, ঈশ্বর সেই অবস্থায় সর্বশক্তিমান হতে পারবেন, যখন তিনি সাকার নন।
সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি॥১
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ ৩।১৬ ও গীতা ১৩।১৪
সরলার্থঃ সেই পরমাত্মা সর্বত্র হস্ত ও চরণ বিশিষ্ট অর্থাৎ অনন্ত বলবান এবং সর্বগত; সর্বত্র চক্ষু, মস্তক ও মুখ বিশিষ্ট অর্থাৎ সর্বদ্রষ্টা (সবার কর্মের সাক্ষী), সর্বজ্ঞ (অনন্ত জ্ঞানবান), সর্ববক্তা (অন্তর্যামীরূপে সবার উপদেষ্টা) এবং সর্বত্র শ্রুতিযুক্ত (সর্বদিকে শ্রবণশক্তি সম্পন্ন)। তিনি জগতে সবকিছু আবৃত করে অর্থাৎ সবার মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে অবস্থিত রয়েছেন।
পরমাত্মার মহিমা জগতের সর্বত্র বিস্তৃত। তাঁর হস্ত সর্বত্র বিদ্যমান, ‘হস্ত’ বলের প্রতীক অর্থাৎ তিনি অনন্ত বলবান ও সকল পদার্থের ধারণকারী। তিনি সর্বত্র চরণযুক্ত, ‘চরণ’ গমন বা গতিশক্তির প্রতীক অর্থাৎ তিনি সর্বগত, আমরা যে স্থানেই চিন্তা করি না কেন পরমাত্মা সেখানে পূর্ব থেকেই উপস্থিত আছেন। তাঁর চক্ষু সর্বত্র, ‘চক্ষু’ দর্শনের প্রতীক অর্থাৎ তিনি সর্বদ্রষ্টা, সকলের শুভ-অশুভ কর্মের সাক্ষী, এমন কোনো পদার্থ বা স্থান নেই যা তাঁর দৃষ্টিশক্তির অগোচরে। সেই পরমাত্মার মস্তক সর্বত্র, ‘মস্তক’ জ্ঞানের প্রতীক অর্থাৎ তিনি সর্বজ্ঞ, অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী। তিনি সর্বত্র মুখবিশিষ্ট, ‘মুখ’ জ্ঞানোপদেশের প্রতীক অর্থাৎ তিনি সর্ববক্তা, যে উপাসক হৃদয়দেশে তাঁর ধ্যান করেন, তার হৃদয়ে অন্তর্যামীরূপে জ্ঞানের উপদেশ (কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ণয় করার বিবেক-বুদ্ধি) প্রদান করেন। তিনি সর্বত্র শ্রুতিযুক্ত বা কর্ণযুক্ত, ‘কর্ণ’ শ্রবণের প্রতীক অর্থাৎ সকল ভক্তের স্তুতি ও প্রার্থনা তিনি শ্রবণ করেন। হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ প্রাকৃত অথবা অপ্রাকৃত কোনোটিই পরমাত্মার নয়, এসব হচ্ছে তাঁর বিবিধ কার্য সম্পাদনের ও আশ্চর্য সামর্থ্যের আলংকারিক বর্ণনা মাত্র। পরবর্তী শ্রুতিসমূহে এই ভাব স্পষ্ট হয়েছে।
এখন পরমাত্মাকে ইন্দ্রিয়-রহিত বলছেন—
সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
সর্বস্য প্রভুমীশানং সর্বস্য শরণং বৃহৎ॥
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ ৩।১৭
সরলার্থঃ সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহের প্রকাশক হয়েও স্বয়ং সকল ইন্দ্রিয়-বর্জিত। তিনি সবার প্রভু, নিয়ন্তা এবং সবার মহান আশ্রয়।
মানুষ যেমন চক্ষু-কর্ণাদি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও হস্ত-পদাদি কর্মেন্দ্রিয়ের সংযোগে কর্ম করে থাকে, তেমনই পরমাত্মার কর্ম করার জন্য কোনো ইন্দ্রিয় বা করণের প্রয়োজন হয় না। তিনি প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ইন্দ্রিয়-বর্জিত, কিন্তু সকল ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক অর্থাৎ জীবগণের ইন্দ্রিয়সমূহে যে দর্শন, শ্রবণ, আঘ্রাণ, স্পর্শন, চিন্তন, মনন ও বিবেচন করার ভিন্ন-ভিন্ন শক্তি আছে, সেগুলো পরমাত্মার অনন্ত শক্তি থেকেই প্রাপ্ত। তিনিই সমস্ত জড়-চেতন জগতের স্বামী ও নিয়ামক। একমাত্র তিনিই সবার পরম আশ্রয়স্থল, কেননা জীবজগৎ তাঁর আশ্রয়েই বর্ধিত হচ্ছে।
যেমন দেখো, জগত যখন উৎপন্ন ছিলো না, সেই সময় নিরাকার ঈশ্বর সম্পূর্ণ জগৎ নির্মাণ করেন। তখন বেদ রচনায় সন্দেহ থাকতে পারে কি? যেমন বেদে অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিদ্যা রচনা করেছেন, তেমনি জগতে ও প্রয়োজনীয় পদার্থ গুলি অত্যন্ত আশ্চর্য রূপে রচনা করেছেন। তাহলে বেদের রচনা নিরাকার ঈশ্বর কেন করতে পারবেন না? প্রকৃতপক্ষে তাকে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আনা বা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই তিনি কোন কাজ করতে পারেন বলা যেমন শাস্ত্রবিরুদ্ধ তেমন তার সর্বশক্তিমান হওয়াকে উপহাস করা । আমাদের উচিত অশাস্ত্রীয়ভাবে ঈশ্বরের দিব্য বৈশিষ্ট্যের প্রতি কুতর্ক না করে বৈদিক শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত মেনে চলা।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর