আমাদের সমাজে বংশমর্যাদা একটি অতি পরিচিত ধারণা। কারণ সমাজে বংশ পরিচয় ও বংশমর্যাদাকে একজন মানুষের পরিচয় এবং চরিত্র বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এবং বলা বাহুল্য যে, আমাদের জড়বাদী এই সমাজের বংশমর্যাদা নির্ধারিত হয় মুখ্যত ব্যক্তির পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা, পিতা-পিতামহের অর্জিত সুনাম/দুর্নাম, ধন-সম্পদের পরিমাণ, রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি, পেশাগত মান এবং তথাকথিত উচ্চ জাতিবাদী ধারণা ইত্যাদির ভিত্তিতে।
কিন্তু আপনি কি জানেন, মহাভারতকালীন বৈদিক সমাজে বংশমর্যাদা কিভাবে নির্ধারিত হতো? এবং সেই সমাজে কেমন কুলকে শ্রেষ্ঠ বলা হতো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা আধুনিক যুগের এই পরিচিত জড়বাদী ধারণার চেয়ে ভিন্ন ; একটি উন্নত এবং ব্যাতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হবো, যেখানে একটি কুল বা বংশের মর্যাদা নির্ভর করত সম্পূর্ণ এর সদস্যদের গুণাবলীর উপর; যেখানে ধর্ম, সদাচার, উত্তম কর্ম, এবং নৈতিকতা ছিল একটি বংশের মর্যাদার মুখ্য মাপকাঠি।
আসুন, জেনে নিই কীভাবে মহাভারতকালীন সমাজে বংশমর্যাদা নির্ধারিত হত এবং বৈদিক সমাজব্যবস্থায় কেমন কুলকে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়?

ধৃতরাষ্ট্র উবাচ
মহাকুলেভ্যঃ স্পৃহয়ন্তি দেবা ধর্মার্থনিত্যাশ্চ বহুশ্রুতাশ্চ ।
পৃচ্ছামি ত্বাং বিদুর প্রশ্নমেতং ভবন্তি বৈ কানি মহাকুলানি ॥৪/২২॥


বিদুর উবাচ
তপো দমো ব্রহ্মবিত্তং বিতানাঃ
পুণ্যা বিবাহাঃ সততান্নদানম্ ।
যেষ্বেবৈতে সপ্ত গুণা বসন্তি
সম্যগ্বৃত্তাস্তানি মহাকুলানি ॥২৩॥

যেষাং হি বৃত্তং ব্যথতে ন যোনিশ্
চিত্তপ্রসাদেন চরন্তি ধর্মম্ ।
যে কীর্তিমিচ্ছন্তি কুলে বিশিষ্টাং
ত্যক্তানৃতাস্তানি মহাকুলানি ॥২৪॥

অনিজ্যযা কুবিবাহৈর্বেদস্যোৎসাদনেন চ ।
কুলান্যকুলতাং যান্তি ধর্মস্যাতিক্রমেণ চ ॥২৫॥

দেবদ্রব্যবিনাশেন ব্রহ্মস্বহরণেন চ ।
কুলান্যকুলতাং যান্তি ব্রাহ্মণাতিক্রমেণ চ ॥২৬॥

ব্রাহ্মণানাং পরিভবাৎপরিবাদাচ্চ ভারত ।
কুলান্যকুলতাং যান্তি ন্যাসাপহরণেন চ ॥২৭॥

কুলানি সমুপেতানি গোভিঃ পুরুষতোঽর্থতঃ ।
কুলসঙ্খ্যাং ন গচ্ছন্তি যানি হীনানি বৃত্ততঃ ॥২৮॥
বৃত্ততস্ত্ববিহীনানি কুলান্যল্পধনান্যপি ।
কুলসঙ্খ্যাং চ গচ্ছন্তি কর্ষন্তি চ মহদ্যশঃ ॥২৯॥

বৃত্তং যত্নেন সংরক্ষেদ্বিত্তমেতি চ যাতি চ ।
অক্ষীণো বিত্ততঃ ক্ষীণো বৃত্ততস্তু হতো হতঃ ॥৩০॥
গোভিঃ পশুভিরশ্বৈশ্চ কৃষ্যা চ সুসমৃদ্ধয়া ।
কুলানি ন প্ররোহন্তি যানি হীনানি বৃত্ততঃ ॥৩১॥
মা নঃ কুলে বৈরকৃৎ কশ্চিদস্তু
রাজাঽমাত্যো মা পরস্বাপহারী ।
মিত্রদ্রোহী নৈষ্কৃতিকোঽনৃতী বা
পূর্বাশী বা পিতৃদেবাতিথিভ্যঃ ॥৩২॥

তৃণানি ভূমিরুদকং বাক্ চতুর্থী চ সূনৃতা ।
সতামেতানি গেহেষু নোচ্ছিদ্যন্তে কদাচন ॥৩৪॥
শ্রদ্ধয়া পরয়া রাজন্নুপনীতানি সৎকৃতিম্ ।
প্রবৃত্তানি মহাপ্রাজ্ঞ ধর্মিণাং পুণ্যকর্মিণাম্ ॥৩৫॥

________________________________


মহাত্মা বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের উত্তরে যেভাবে শ্রেষ্ঠ বংশের পরিচয় দিয়েছেন; তদনুসারে বংশের শ্রেষ্ঠত্ব কেবল জন্ম , অর্থনৈতিক প্রাচুর্য ও কতগুলি জড়বাদী শর্তের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং কিছু বিশেষ গুণ ও আচরণই বংশ বা কুলের শ্রেষ্ঠত্বের নির্ণায়ক।

১. তপস্যা: আধ্যাত্মিক সাধনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ।
২. আত্মসংযম: কামনা-বাসনা ও ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ।
৩. বেদাধ্যয়ন: বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন অধ্যাপন যথাযথরূপে করা।
৪. যজ্ঞানুষ্ঠান পালন: পঞ্চমহাযজ্ঞ এবং শাস্ত্রবিহিত যজ্ঞসমূহের অনুষ্ঠান করা।
৫. গুণ-কর্ম-স্বভাব অনুযায়ী পবিত্র বিবাহ: সঠিক বয়সে গুণবান পাত্র/পাত্রীর সাথে শাস্ত্রসম্মত ও সামাজিকভাবে বিবাহ করা।
৬. নিরন্তর অন্নদান: সমাজের দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করতে কার্পণ্য না করা।
৭. সদাচার: সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করা।
যে পরিবারে এই সাতটি গুণ বিদ্যমান, সেই পরিবারই প্রকৃত অর্থে মহাকুল বা শ্রেষ্ঠ বংশ।

৮. সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা ও মিথ্যাচার পরিহার করা।
৯. পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা ও তাঁদের সেবা করা।
১০. ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।
১১. নিজেদের পূর্বপুরুষদের সম্মান বজায় রাখা।
১২. মিথ্যা কথা ও অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকা।
১৩. অতিথিপরায়ণতা বা অতিথির সেবা করা।









মহাত্মা বিদুরের বচনসমূহ পর্যালোচনার পর আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, প্রকৃত উচ্চবংশীয় ও অভিজাত তারাই, যারা বৈদিক ধর্মের অনুসারী এবং বেদ অনুযায়ী জীবনযাপন করেন। অর্থাৎ, সদাচার, স্বাধ্যায়, যজ্ঞপরায়ণতা, পিতামাতার সেবা, দুর্নীতিমুক্ত জীবন, দানশীলতা ও অতিথিপরায়ণতার মতো মহৎ গুণাবলি যাঁদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁরা যদি দরিদ্র হন তথাপি আর্যসভ্যতা তাঁদের উচ্চ সম্মান ও সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখে। এবং বিপরীত দুর্গুণসমূহ ধারণকারী কুলসমূহকে নীচ কুল বলা হয় এবং প্রভূত ধনসম্পদশালী হলেও আর্যগণ এসমস্ত বংশকে সম্মান প্রদান করেন না।
সন্দর্ভ-
বিদুরনীতি [স্বামী জগদীশ্বরানন্দ সরস্বতী]
বিদুরনীতি [স্বামী বেদানন্দ তীর্থ]
মহাভারত [শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত]