

বেদ ঈশ্বরীয় শাশ্বত কল্যাণকারিণী বাণী । পরম পিতা পরমাত্মা অনাদি কাল হতে বারংবার - সগৌরবে জীব মাত্রের কল্যাণের নিমিত্তেই ঋষিদের শুদ্ধন্তঃকরণে বেদজ্ঞান প্রকাশিত করেন । সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বেদ - বেদোঽখিলো ধর্মমূলম্ [মনুস্মৃতি ২।৬] । শাস্ত্রে বারংবার বলা হয়েছে বেদানুকূল সিদ্ধান্তই ধর্ম ও তদ্বিরীত অধর্ম - “ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ”[মনুস্মৃতি ২।১৩] অর্থাৎ , যে ধর্মের বিষয়ে জ্ঞান প্রাপ্ত করতে চায় তার জন্য বেদই মূখ্য প্রমাণ । এখন প্রশ্ন হচ্ছে কলি যুগে বেদের আবশ্যকতা কী ? বা কলি যুগে বেদ অনুযায়ী আমরা চলতে পারবো কিনা । যেখানে সনাতন ধর্মের আদি মূল প্রধান গ্রন্থই বেদ তাহলে এই প্রশ্নই অবান্তর যে বেদ অনুযায়ী চলা যাবে কিনা । যেরূপ পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাব অনাদি , তাই তার প্রদান কৃত জ্ঞান ও অনাদি । সনাতন অর্থ যা অনাদি , অনন্ত - তাই যে জ্ঞান অনন্ত কাল ধরেই বিদ্যমান তাই সনাতন । গীতায় স্পষ্ট উল্লখ আছে -
বেদই ব্রহ্ম থেকে এসেছে ও কর্মও বেদ থেকেই প্রদত্ত -

কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ ॥
[ গীতা ৩।১৫ ]
অর্থ:- কর্ম বেদ থেকে উৎপন্ন বলে জানবে । বেদ অবিনাশী অক্ষর [ক্ষয় রহিত পরমাত্মা] থেকে উৎপন্ন । সেজন্য সর্বব্যাপী ব্রহ্ম নিত্য (সবসময়) যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত ।
অতঃ এই শ্লোকদ্বয় থেকে স্পষ্ট যে , বেদ অনাদি জ্ঞান যার কোনো আদি এবং অন্ত নেই , তাই এই জ্ঞানই সনাতন ।
বেদ দ্বারাই পরমেশ্বরকে জানতে হবে

সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনং চ ।বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্ ॥
[ গীতা ১৫।১৫ ]
অর্থ:- আমি সকল প্রাণীর হৃদয়ে স্থিত আছি । আমার থেকেই স্মৃতি, জ্ঞান ও অপোহন (হয় এবং সকল বেদ দ্বারা আমিই জানার যোগ্য । আমিই বেদান্তের কর্তা এবং বেদের জ্ঞাতা ।
এবার বেদ সম্পর্কে মহাভারত কি বলছে দেখি -

“অনাদিনিধনা নিত্যা বাগূত্সৃষ্টা স্বয়ম্ভূবা ।
আদৌ বেদময়ী দিব্যা য়তঃ সর্বাঃ প্রবৃত্তয়ঃ॥
[ মহাভারত শান্তি পর্ব- ১২।২৩২।২৪ ]
অনুবাদ- সৃষ্টির আদিতে স্বয়ম্ভূ পরমাত্মা এই বেদ বাণী প্রকাশিত হয়েছিল যার না আদি আছে , না অন্ত , যা নিত্যনাশরহিত এবং দিব্য । যা থেকে জগতের সমস্ত প্রবৃত্তির প্রকাশ পেয়েছে ।
এখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে এই বেদ বাণীর আদি নেই অন্ত নেই । সুতরাং এটা প্রমাণ করে যে , এই বেদ জ্ঞানই সনাতন । আর তা যুগের সাথে কখনো ছিন্ন হয়না ।
এবারে সরাসরি বেদ হতে দেখি -

অংতি সন্তং ন জহাত্যন্তি সন্তং ন পশ্যতি।
দেবস্য পশ্য কাব্যং ন মমার ন জীর্যতি।
[ অথর্ববেদ ১০।৮।৩২ ]
.
সরলার্থঃ মনুষ্য সমীপবর্ত্তী পরমাত্মাাকে দেখেও না , তাকে ছাড়তেও পারে না । পরমাত্মার কাব্যকের দেখ , তা মরেও না , জীর্ণও হয় না ।
অর্থাৎ বেদ সকল যুগ ও কালের জন্য প্রযোজ্য ।এর বাণী কখনো অপ্রাসঙ্গিক হয়না ,অচল হয়না । বেদ মন্ত্র কলিযুগে নিষ্ক্রিয়-এ ধরনের প্রলাপ তাই অনর্থক।সর্বযুগেই সমানভাবে প্রযোজ্য ও তা সর্বদা আধুনিক।
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন -

য়ঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ।
ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্॥
[গীতা ১৬।২৩]
= যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করে স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি প্রাপ্ত হয় না, সুখ প্রাপ্ত হয় না ও পরম গতি প্রাপ্ত হয় না।
তাহলে প্রতিনিয়ত গীতার কথা শ্রবণ করেও যারা এই বাক্যে মনোনিবেশ করে না তাদেরকে জন্য ভগবান আরো স্পষ্ট করেই বলেছেন ,
তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ ।
জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি ॥
[গীতা ১৬।২৪]
= শাস্ত্রই প্রমাণ কর্তব্য ও অকর্তব্য কী হবে সেই বিষয়ে । অর্থাৎ আমার কী করা উচিত বা অনুমোদিত কিংবা কী করা অনুচিত বা নিষিদ্ধ তা আমাকে বলবে শাস্ত্র । এবং সেই শাস্ত্রবিধান জেনেই কর্ম করতে হবে ।
নব্য শাস্ত্রানভিজ্ঞদের কাছে বিনীতভাবে প্রশ্ন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে এতো মানেন তাহলে তার এই বাক্যদ্বয় কি কখনো আপনারা দেখেননি বা পড়েননি ? যদি না পড়ে থাকেন তবে শাস্ত্রীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার দুঃসাহস কীভাবে করেন ? আর যদি পড়েই থাকেন তবে তা অনুসরণ না করা কি ভগবদ্বাক্যে বিদ্রোহ করা নয় কি ? আর এভাবেই আপনি জ্ঞানচর্চায় সিদ্ধান্তভূষণ (!) সনাতনী ?
ভগবান তো বলতেই পারতেন ' যাও হে তোমরা মনে চায় তাই করো ', কিন্তু তিনি তা বলেননি । কেননা এটা বুদ্ধিমান মাত্রেই বুঝতে মানুষ স্বভাবতই অল্পজ্ঞ ও প্রভাবিত হয় স্বার্থ দ্বারা । এজন্যই ভগবান মনু তার স্মৃতিতে [২।১২] বেদ , স্মৃতি, সদাচার ও প্রিয়কর্ম এই ৪টি বিশেষ লক্ষণ দিয়েছেন । যা বেদে সূক্ষ্মরূপে রয়েছে তার পালনীয় বিধি স্মৃতিতে বিদ্যমান, স্মৃতিতে যা বিদ্যমান বা অনুল্লেখিত তা সাধুদের আচারে প্রমাণ, আর তাও না পেলে বিবেক বাণী । অর্থাৎ আপনি যদি বেদে না পান তবেই সূক্ষ্ম সেই বিষয়ে ক্রমান্বয়ে পরের পথগুলো অনুসরণ করবেন । কিন্তু স্বার্থপরদের তার সময় কোথায় ?
সনাতন আইনশাস্ত্র তথা মানবজাতির প্রধান ধর্ম গ্রন্থ বেদ । কয়েকশতক আগেও বেদ শব্দটি ছিল প্রতিটি সনাতনিদের প্রাত্যাহিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত । কিন্তু সময়ের বিবর্তনে , অজ্ঞানতা ও তার কালগ্রাসে ঔপনিবেশিকদের চক্রান্তে , তথাকথিত বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত ধর্মপ্রচারক তথা স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ীদের অপপ্রচারের কারণে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা আজ মহান বেদের পথ থেকে দূরে সরে গিয়েছি । ফলস্বরূপ আমরা আজ জাতি হিসেবে এক ক্রান্তিলগ্নে দাড়িয়ে । জ্ঞানের অভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে অপমানের স্বীকার তো হতেহচ্ছে বটেই , এবং নিজেদের প্রতিদিনকার জীবনযাপনেও অজ্ঞতার গ্লানিবয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে নিরন্তর ।
পার্থিব বস্তু প্রত্যক্ষ বা অনুমান প্রভৃতির দ্বারা জানা যায় , কিন্তু যা অপার্থিব , অচিন্তনীয় , অনুমানের অতিত তা জানতে হলে বেদই একমাত্র অবলম্বন । বেদ কোন মনুষ্য দ্বারা রচিত নহে , তাহা অপৌরষেয় এবং নিত্য । অপৌরুষেয় বলেই বেদ নিত্য ।
"তস্মৈ নূনমভিদ্যবে বাচা বিরূপ নিত্যয়া"
ঋগবেদ ৮.৭৫.৬
"সদকারণবন্নিত্যম্" (বৈ০ দ০ ৪।১।১)
কারণ রহিত ভাবরূপ পদার্থ হলো নিত্য ৷
যে বস্তু সদা বিদ্যমান ও কখনো নিজের সত্তার জন্য অপর বস্তুর উপর নির্ভরশীল নয় তাকেই নিত্য বলে ৷ নিত্য বস্তু উৎপত্তি রহিত , নিরবয়ব ও ত্রিকালবর্তী হয় ।
বেদান্ত দর্শন-
অতএব চ নিত্যত্বম্ ॥
ব্রহ্মসূত্র ১।৩।২৯
পদার্থঃ
এই (বেদ) থেকে শুধুমাত্র নিত্যতা হয় ।
সৃষ্টির আদি থেকে বেদ যা ছিল , তাই আছে । তাই সত্যযুগ আসুক , কি ত্রেতা , দ্বাপর , কলিযুগ আসুক । বেদ তো বেদই , কোন কল্পে বা মতান্তরে তার পরিবর্তন হয় না এবং সদা সর্বদা বর্তমান । বেদ ঈশ্বরের নিত্য বিদ্যা , তার উৎপত্তি বা অনুৎপত্তি হতেই পারে না । অতঃ তার বৃদ্ধি , ক্ষয় অথবা তাতে কোন পরিবর্তন ঘটতে পারে না । এইসব কারণে বেদ প্রতিপাদিত বৈদিক ধর্ম শ্বাশত , সত্য ও সনাতন । যেখানে বেদ বলছে এটা সব যুগের জন্য প্রযোজ্য সেখানে কতিপয় বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত অজ্ঞানীদের এহেন আচরন হাস্যজনক ।
তাছাড়া এসব অবান্তর যুক্তি যারা পেশ করেন তারা নিজেরা কি আদৌও কখনো বেদ পড়েছেন তাদের কথার সত্যতা যাচাই এর জন্য ? তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ,পারলে বেদের এমন কোন নিয়ম দেখান যা বর্তমান যুগের জন্য প্রযোজ্য নয় ? বরং এটা কলি যুগে আরও বেশি প্রয়োজন কারণ বেদের কর্মকাণ্ড প্রতিদিনের নিত্যকর্মাদি , বিজ্ঞান , আইন , অর্থনীতি , রাজনীতি জ্ঞান কর্ম উপাসনা অর্থাৎ ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ সহ মানব জাতির প্রয়োজনীয় সকল কিছু আছে যা সত্য যুগের তুলনায় কলি যুগেই বেশী দরকার ।
সৃষ্টির প্রথম হতে আরম্ভ করে আজও সেই বেদ জগতে প্রচারিত । বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান , তাই ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান তিন কালেই সমানভাবেই একই অবস্থায় সুপ্রতিষ্ঠিত। এ জ্ঞানের নাশ নাই কারণ ঈশ্বর অবিনাশী । এ জ্ঞান কল্যাণকারী কারণ ঈশ্বর কল্যাণময় । বেদ নিত্য , সনাতন কারণ ঈশ্বর নিত্য ও সনাতন ।
তারা আরেকটি প্রশ্ন করেন বেদের বৃহৎ কলেবর নিয়ে যেটা সম্পূর্ন ভিত্তিহীন । কারণ বৈদিক যুগেও এমন খুব কম লোকই ছিলেন যারা কিনা সব কটা বেদ জানতেন । কেউ বা একটা , কেউ বা দুটা ,কেউ তিনটা , কেউবা চারটাই জানতেন যাদের যথাক্রমে একবেদী , দ্বিবেদী , ত্রিবেদী ও চতুর্বেদী বলা হত । তবে ত্রিবেদী ও চতুর্বেদী ছিল হাতে গোনা । একবেদীরাই ছিল সর্ব্বোচ্চ । আর তাছাড়া কেউই আমাদের বেদ মুখস্ত করতে বলছেনা । আর এ ধরনের প্রচারকারীদের মধ্যে অনেকেই বলেন পুরাণ পড়ার কথা ! এখন আপনারা ই বলুন , যেখানে চার বেদের মন্ত্রসংখ্যা ২০৩৭৯ সেখানে এর বদলে এর কয়েকগুন বড় একটা পুরাণ পড়তে বলাটা কতটুকু যৌক্তিক ?
এখন আসি পবিত্রতার বিষয়ে । অনেকেই বলেন বেদপাঠ করার মত পবিত্রতা কলিযুগের মানুষের নেই এবং নারী তথা শূদ্রদের বেদাধিকার নেই । তাহলে একটা বিষয় চিন্তা করুন-বেদের মতো পবিত্র গ্রন্থ যদি পাঠ করার মতো পবিত্রতা না থাকে তাহলে তাদের হরিনাম যা সবচেয়ে পবিত্র তা জপ করার পবিত্রতা সবার থাকবে কি করে ? সবচেয়ে খারাপ , অপবিত্র লোকটিও নিজেকে বেদপাঠের মাধ্যমে নিজেকে জ্ঞান দ্বারা শুদ্ধ করতে পারেন । আর বেদ পাঠে অধিকার সবার সমান্য । বেদ পাঠে কোন মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ করা হয় নি ।
তাই তো পবিত্র বেদ ঘোষনা করছে -

যথেমাং বাচং কল্যানীমাবদানিজনেভ্যঃ। ব্রহ্ম রাজান্যাভ্যাং শূদ্রায়চার্যায় চ স্বায় চারণায়।প্রিয়ো দেবানংদক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভুয়াসময়ং মে কামংসমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু।। (যজুর্বেদ ২৬।২)
সরলার্থঃ পরমেশ্বর সকল মনুেষ্যর প্রতি উপদেশ দিচ্ছেন - ব্রহ্মণ , ক্ষত্রিয়, শূদ্র ,বৈশ্য , স্বীয় স্ত্রীর ও সেবকাদি এবং অন্যান্য সকল মনুষ্যকেই যেমন আমি এই মঙ্গলদায়িনী বেদবাণীর উপদেশ দান করেছি , তোমরাও সেরূপ করো ।
বেদের এই মন্ত্র থেকে স্পষ্ট যে বেদপাঠে সবার অধিকার সমান । গত কয়েকশবছরে , যখন বেদজ্ঞান এর অভাবকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ী ও তথাকথিত ব্রাহ্মণ পরিচয় ধারী যারা তৈরী করেছিল অস্পৃশ্যতা নামক জঘন্য প্রথা । একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া তো দুরের কথা,অনেকেই একে অপরকে নিজেদের বানানো ছোট জাত বিবেচনা করে ছুঁতও না ।
অথচ পবিত্র বেদ বলেছে-

সমানী প্রপা সহ বোরন্নভাগঃ সমানে যোক্তো সহ বো যুনজমি।
সমঞ্চোহগ্নিং যপর্যতারা নাভি মিবাভিতঃ।।
[ অথর্ববেদ ৩।৩০।৬ ]
সরলার্থঃ তোমাদের পান একসঙ্গে হোক , ভোজনও একসঙ্গে হোক । তোমাদিগকে এক সঙ্গে একই প্রেমবন্ধনে যুক্ত করিয়াছি । সকলে মিলিয়া পরমাত্মাকে পূজা করো । রথচক্রের কেন্দ্রের চারিদিকে যেমন অর থাকে তোমরা সেইভাবে থাকো ।
ঋগ্বেদের শেষ মন্ত্রে মানব জাতির প্রতি ঈশ্বরের আদেশ -

সমানী বঃ আকুতি সমানা হৃদয়ানি বঃ।
সমানমস্তু বো মনো য়থা বঃ সুসহাসতি।।
[ ঋগ্বেদ ১০।১৯১।৪ ]
সরলার্থঃ হে মানুষ্য্ ! তোমাদের সকলের লক্ষ্য এক হোক, তোমাদের অভিপ্রায় এক হোক, তোমাদের মন এক হোক । এই ভাবে ভাবিত হয়ে তোমাদের সকলের শক্তি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হোক ।
অনেকেই বলে বেদ নাকি শুধু যজ্ঞের জন্য । বেদে শুধু
অপরা বিদ্যা আছে । বেদ পড়লে শুধু স্বর্গ প্রাপ্তি হয় মোক্ষলাভ নয় যদিও স্বর্গ-নরক বলতে আলাদা কোন কাল্পনিক জায়গার অস্তিত্ব নেই বৈদিকশাস্ত্র সমূহে , অবশ্য স্বাধ্যায় বিহীন অসংস্কৃতজ বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত ব্যাক্তিগণ কিভাবে জানবে ? তারাতো তথাকথিত পরম্পরার নামে ভণ্ডামি করতেই সময় পার করে দেয় । তাদের অনর্থক দাবির সত্যতা পর্যালোচনা করা যাক ।
বেদ দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায় না । এখন কেউ যদি কুতর্ক করে একগুঁয়ে স্বভাব ধরে বলে না , শুধু উপনিষদই পরাবিদ্যার গ্রন্থ তাহলে বলতে হয় উপনিষদের তালিকায় প্রথম যে , ঈশোপনিষদ্ তা তো পুরোটাই যজুর্বেদের ৪০ তম অধ্যায় । এখানে আপনি যদি এই উপনিষদকে পরাবিদ্যার গ্রন্থ মান্য করেন তবে তো পরোক্ষভাবে বেদেই পরাবিদ্যা মান্য করলেন । শুধু ঈশোপনিষদ্ নয় , যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় তো অধিকাংশ উপনিষদেরই বিভিন্ন জায়গাতে বেদের মন্ত্র সরাসরি এসেছে । যথাঃ
.

(i) অধ্যায় ২।১।১৮ (ঋগবেদ ৩।২৯।২)
(ii) অধ্যায় ২।১।৯ (অথর্ববেদ ১০।৮।১৯)
(iii) অধ্যায় ২।২।২ (যজুর্বেদ ১০।২৪)
.

(i) অধ্যায় ২। ১-৫ (যজুর্বেদ ১১।১-৫)
(ii) অধ্যায় ৩।১৪-১৫ ( যজুর্বেদ ৩১।১-২)
(iii) অধ্যায় ৩। ৫-৬ (যজুর্বেদ ১৬।২-৩)
.
★ প্রশ্নোপনিষৎ
(i) প্রথম প্রশ্ন ১১ ( ঋগবেদ ১।৬৪।১২)
.
★ ঐতেরীয়পনিষৎ
(i) শিক্ষাবল্লী প্রথম অনুবাক (ঋগবেদ ১।৯০।৯)
(ii) শিক্ষাবল্লী দ্বাদশ অনুবাক (যজুর্বেদ ৩৬।৯)
.
★ বৃহদারণ্যকোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২।৫।১৬ (ঋগবেদ ১।১১৬।১২
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৭ (ঋগবেদ ১।১১৭।২২)
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৯ ( ঋগবেদ ৬।৪৭।১৮)
.
যে মুণ্ডকোপনিষদে পরা অপরার ভেদ দেখানো হয়েছে সে উপনিষদেও বেদের মন্ত্র এসেছে । যথা ,
(i) মুণ্ডক ২।২।১ (অথর্ববেদ ১০।৮।৬)
(ii) মুণ্ডক ৩।১।১ (ঋগবেদ ১।১৬৪।২০)
.
অতঃ বেদ যদি অপরা বিদ্যার গ্রন্থই হয়ে থাকে তবে পরা বিদ্যার গ্রন্থ উপনিষদে বেদের মন্ত্র কেন গ্রহণ করা হলো ? নিশ্চয়ই বৈকুণ্ড ধাম থেকে নয়। এ থেকে স্পষ্টতঃ যে বেদে শুধু অপরা বিদ্যাই নেই বরং পরা বিদ্যাও রয়েছে । অর্থাৎ "স পর্য্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণম্" যজু০ ৪০।৮ ইত্যাদি মন্ত্রে যেখানে পরমব্রহ্মের প্রতিপাদন করা হয়েছে তাহা "পরা" বিদ্যা , আর যেখানে অগ্ন্যাদি ভৌতিক পদার্থের যজ্ঞপোযোগী হওয়ার বর্ণনা অথবা বিবাহ , উপনয়নাদি সংস্কারের বর্ণনা রয়েছে তাহা "অপরা" বিদ্যা । এখানে অপরা কোন নিন্দাসূচক শব্দ নয় , বিষয়ের প্রকারের দৃষ্টি দ্বারা বিদ্যার পরা অপরা দুটি ভেদ দেখানো হয়েছে । এখন যদি কেউ বেদ পাঠ করে অর্থ না বুঝে বলে যে , বেদে পরা বিদ্যা নেই সেটা তার মূর্খতা ।
যাস্কাচার্য পরিষ্কারভাবে বলেছেন -

.
স্থাণুরয়ং ভারহারঃ কিলাভূদধীত্য বেদং ন বিজানাতিয়োহর্থম্ ।
য়োহর্থজ্ঞইত্যকলং ভদ্রমশ্নুতে নাকমেতি জ্ঞানবিধূতপাপ্মা ॥
[ নিরুক্ত নৈগম কাণ্ড ১।১৮ ]
অর্থাৎ- যে বেদ পড়ে তার অর্থ বোঝে না সে শুধু ভারবহনকারীই হয় , কিন্তু যে বেদের অর্থ বুঝতে পারে, সে সমস্ত সুখ আর কল্যাণ প্রাপ্ত হয় । সে ওই পবিত্র জ্ঞানের দ্বারা পাপকে নষ্ট করে পরমানন্দরূপে মোক্ষ প্রাপ্ত করে নেয় ।
.
মহাভারতেও একই কথা বলা হয়েছে -

য়ো বেদে চ শাস্ত্রে চ, গ্রন্থধারণতপ্তরঃ । ন চ গ্রন্থার্থতত্বজ্ঞঃ, তস্য তদধারণংবৃথা ॥ ভারং স বহতে তস্য, গ্রন্থস্যার্থ ন বেক্তি য়ঃ । য়স্তু গ্রন্থার্থতত্বজ্ঞো , নাস্য গ্রন্থাগমোবৃথা ॥
[ মহাঃভারত শান্তিপর্ব অঃ ৩০৫।১৩-১৪ ]
অর্থাৎ - যে বেদ এবং শাস্ত্রীয় গ্রন্থকে ধারণ করতে তৎপর , কিন্তু তার যথার্থ তত্ত্বকে না বোঝে তার এ ধারণ করা বৃথা । যে গ্রন্থের অর্থকে না বোঝে সে কেবল উক্ত গ্রন্থের ভারই বহন করে । কিন্তু যে গ্রন্থের অর্থ বুঝতে পারে তার জন্য সেই গ্রন্থের অধ্যয়ন ব্যর্থ নয় ।
.
অতঃ নিষ্কর্ষ এই যে , বেদ অপরা বিদ্যার সাথে সাথে পরাবিদ্যারও গ্রন্থ । মধ্যকালে কিছু সাম্প্রদায়িক লোক প্রচার করেছে বেদে পরা বিদ্যা নেই । কিন্তু আমরা দেখিয়েছি বেদেও পরাবিদ্যার সমাহার রয়েছে , অপরদিকে উপনিষদ শুধুমাত্র পরা অথবা অধ্যাত্মবিদ্যারই গ্রন্থ , এতে লৌকিক জীবনের বর্ণনা নেই । কিন্তু সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাণ্ডার যে বেদ তা কেবল পরা বিদ্যার গ্রন্থ না হয়ে অপরাবিদ্যারও গ্রন্থ । বেদ যেখানে ব্রহ্মবিদ্যার মূল , তদ্রুপভাবে মানুষের লৌকিক অথবা ভৌতিক জীবনের জন্য অপেক্ষিত অনান্য জ্ঞানেরও আদিমূল ।
অবার অনেকেই বেদের চাইতে গীতাকে প্রাধান্য দেয় বেশি । এবং তাদের দাবি কলি যুগে বেদ চলে না গীতাই প্রধান । এরকম অহেতুক প্রলাব বলে যা হাস্যকর ।প্রধান হতে গেলে ভিত্তি হতে হয় । আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক , আধিভৌতিক আলোচনা থাকতে হয় । সামগ্রিক ভাবে মূল জীবন বিধান থাকতে হয় । তবেই সে প্রধান হতে পারে । এই সমস্ত গুণাবলী গীতার নেই । গীতায় সহজ ভাবে উপনিষদ , দর্শন এবং অন্যান্য কিছু শাস্ত্রের খুবই অল্প আলোচনা আছে । যা দিয়ে সনাতন ধর্মের জাস্টিফাই করা সম্ভব হয়না । কিন্তু বেদ দিয়ে সম্ভব হয় । গীতা মোক্ষ প্রদান করতেই পারে কারণ গীতায় যে ব্রহ্মবিদ্যার দর্শন দেওয়া হয়েছে সেটিই বেদাদি শাস্ত্রে রয়েছে । কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বেদের ধারে-কাছেও গীতা নেই । যদি গীতাকে আমরা সনাতন ধর্মের ভিত্তি বলি তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন আসবে সৃষ্টির শুরুতে গীতা কোথায় ছিল ? যদি বলেন গীতার জ্ঞান সৃষ্টির শুরুতেই ছিল , তাহলে বলা হবে সেই জ্ঞান কীভাবে কোথায় ছিল ? উত্তর: বেদ । আর গীতা সম্পূর্ণটাই শ্রীকৃষ্ণের বানী নয় । গীতা ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্য হয়ে প্রদত্ত জ্ঞান । গীতায় ধৃতরাষ্ট্র , অর্জুন , সঞ্জয়ের প্রত্যক্ষ ভাবে কথাবার্তা আছে । পরোক্ষ ভাবে দুর্যোধনের কথাবার্তা আছে । ইতিহাস ভিত্তিক ঘটনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সহজ উপস্থাপনায় জ্ঞান গুলো মুখনিঃসৃত হয়েছে। সেজন্য সাধারণ ভাবে গীতা সহজে বোধগম্য । কিন্তু বেদের মর্মার্থ বুঝতে হলে সাধনার প্রয়োজন হয়, আধ্যাত্মিকার স্তরে উঠতে হয় । এছাড়া আরো হাজারও পার্থক্য রয়েছে ।
গীতা হল উপনিষদের সার । অনেক পণ্ডিত বলে থাকেন গীতা মূলত মূণ্ডকোপনিষদের প্রায় অবিকল প্রতিলিপি , বেদের ১ লক্ষ ভাগের ১ ভাগ তথ্যও এতে নেই । গীতা একটি দার্শনিক গ্রন্থ । এটাতে সনাতনের জীবন বিধি-সংবিধান সকল আচার আচরণের নিয়ম কানুন কিছুই নেই । আর মানবজীবন ও সমাজ চালনা করতে গেলে সেগুলোই আসল । একজন রিকশাওয়ালা বা দিনমজুর দার্শনিক ক্যাঁচক্যাঁচানি শুনবেনা , শুনবে জীবনঘনিষ্ঠ কথা যা একমাত্র বেদে রয়েছে । তাকে নিষ্কাম কর্মের অবাস্তব প্রেস্ক্রিপশন দিলে সে দৌড়ে পালাবে , বড় বড় মোটিভেশনাল স্পিকিং এ তার পেট ভরবে না । বাস্তব পৃথিবী , সমাজজীবন , ব্যক্তির দৈনন্দিন চাহিদা ও রাষ্ট্রের জন্য একমাত্র সংবিধান পবিত্র বেদ । বিয়ে , শিশুর জন্ম , অন্নপ্রাশন , ক্রিয়াকর্ম সবই বেদ থেকে হয় , গীতা থেকে নয় । অর্থাৎ , জীবনের সব বাস্তব কাজের নির্দেশিকা বেদ আমাদের দেয় , আধ্যাত্মিক কাজের নির্দেশিকাও বেদ দেয় । সোজা বাংলায় এক পরিপূর্ণ সংবিধান যা গীতা বা অন্য কোন বই নয় ।
আর তাই সকল শাস্ত্রে মুনিঋষিগণ বারবার বলে গেছেন সকল যুগে সকল কালে প্রত্যহ বেদ অধ্যয়ন করতে হবে । গীতা বা অন্যান্য সকল ছোটখাটো সেকেণ্ডারি গ্রন্থ কেবল পরবর্তীতে সময় পেলেই পড়া যায় আগ্রহের জন্য । বেদ পড়াই আসল এবং বেদ পড়লে গীতা বা অন্য কোন গ্রন্থই আর তেমন আবশ্যক থাকেনা ।
উপরন্তুঃ বেদের জ্ঞানের সাথে যদি গীতার জ্ঞানের তূলনা করি তাহলে দেখব বেদ যেখানে ব্রহ্মজ্ঞান , প্রকৃতি , জীবাত্মা , আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আইন , সমাজব্যবস্থা সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ এক সমৃদ্ধ জ্ঞান
ভাণ্ডার সেখানে সনাতনধর্ম বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই গীতা থেকে বা অন্য কোন গ্রন্থ থেকে উত্তর পাওয়া যায় না । পরমেশ্বর আমাদের বেদ বাণীর দান করেছে সমগ্রবিশ্বের জন্য , সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্য , বিশেষ কোন জাতি বা ধর্মের জন্য নয় । বেদপাঠে সবার অধিকার রয়েছে । আপনারা সত্যের পথে ধাবিত হন । বেদ অধ্যয়ন করুন , কুসংস্কার থেকে সমাজকে রক্ষা করুন ।