দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







বিয়ে কি ৭ জন্মের বন্ধন ?

সত্যান্বেষী
0

 


প্রশ্নঃ বিয়ে কি ৭ জন্মের বন্ধন  ? যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে তাঁর সাথেই কি অগ্নিসাক্ষী করে করা বিয়ে পরের জন্মেও থাকবে  ?

উত্তরঃ না , বিয়ে ৭ জন্মের নয় বরং বর্তমান জন্মেরই বন্ধন । যারা আজীবন ব্রহ্মচারী থাকেন বা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তারা কী তবে পূর্বের জন্মগুলোতে বিয়ে করেননি  ? কিংবা যারা এই জন্মে অবিবাহিত থাকবেন তারা কী তাহলে পরের জন্মেও অবিবাহিত থাকবেন  ? যেখানে আমি এই জন্মের কর্মের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে মোক্ষ লাভ দূরের কথা মানবজন্মই লাভ করব কিনা তার নিশ্চয়তা নেই তবে বিয়ে ৭ জন্মের বা জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধন কীভাবে সত্য হতে পারে  ? 

জীবাত্মাকে লিঙ্গ-রহিত —


নৈব স্ত্রী ন পুমানেষ ন চৈবায়ং নপুংসকঃ।
য়দ্ য়চ্ছরীরমাদত্তে তেন তেন স রক্ষ্যতে॥

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্‌ ৫.১০                              

সরলার্থঃ
এই জীবাত্মা স্ত্রী নন, পুরুষও নন আবার নপুংসকও নন। যে যে শরীরকে ইনি গ্রহণ করেন, সেই সেই শরীর দ্বারা তিনি সংরক্ষিত হন। 

জীবাত্মায় ‘পুরুষভাব’ অথবা ‘স্ত্রীভাব’ ইত্যাদির কোনো লক্ষণ নেই, বরং এই লক্ষণ জীবদেহে দেখা যায়। আত্মা যে শরীর ধারণ করেন, সেই শরীরের গুণ, কর্ম ও স্বভাবের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হন। যে জীবাত্মা বর্তমান জন্মে পুরুষদেহ ধারণ করেছেন, তিনিই অন্য কোনো জন্মে স্ত্রীদেহ লাভ করতেই পারেন। অর্থাৎ পার্থিব শরীরের জন্যই স্ত্রী, পুরুষ এবং নপুংসক ইত্যাদি ভেদ পরিলক্ষিত হয়। একইভাবে পিতা-পুত্রাদির সম্বন্ধও এই শরীরের সংযোগের কারণেই হয়। আমরা অবিদ্যায় লিপ্ত হয়ে, স্বয়ং শুদ্ধ জীবাত্মায় শরীরের গুণ বা স্বভাবকে আরোপ করি, এটিই দুঃখের মূল কারণ। যখন তত্ত্বজ্ঞানরূপ ‘বিদ্যা’ নামক সূর্যের উদয় ঘটে এবং‌ ‘অবিদ্যা’ নামক আঁধারের নাশ হয়, তখন অধ্যাত্ম বিচারে তৎপর (পুরুষ অথবা স্ত্রী দেহধারী) জীবাত্মা স্ত্রী-পুরুষ ভাব রহিত হয়ে নিজের শুদ্ধ স্বরূপকে জেনে দুঃখ থেকে মুক্ত হন।  


জীবাত্মার বিভিন্ন শরীর ধারণের কারণ উপনিষদ্‌ বলছেন— 


সংকল্পনস্পর্শনদৃষ্টিমোহৈঃ গ্রাসাম্বুবৃষ্ট্যা চাত্মবিবৃদ্ধিজন্ম।
কর্মানুগান্যনুক্রমেণ দেহী স্থানেষু রূপাণ্যভিসম্প্রপদ্যতে॥

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্‌ ৫.১১

সরলার্থঃ
জীবাত্মা সংকল্প, স্পর্শ ও দৃষ্টির মোহ দ্বারা ভোগস্থানসমূহে (মনুষ্যাদি যোনিতে) নিজ কর্মানুসারে ভিন্ন-ভিন্ন শরীর প্রাপ্ত হয়। ক্রমানুসারে অন্ন-পানাদি ভোজন দ্বারা জীবের শরীরের বৃদ্ধি এবং জন্ম হয়। 

সংকল্প, স্পর্শ ও দৃষ্টির মোহ দ্বারা বশীভূত জীবাত্মা বিভিন্ন যোনিতে শরীর ধারণ করে। সংকল্প-স্পর্শ-দৃষ্টি এর মোহ দ্বারা মনের প্রপঞ্চ কীভাবে বৃদ্ধি পায়? ‘সংকল্প’ এর সম্বন্ধ মনের সঙ্গে; ‘স্পর্শ’ ও ‘দৃষ্টি’ এর সম্বন্ধ মনের সাধন ত্বক্ ও চক্ষুর সঙ্গে। ত্বক্ ও চক্ষু দুটোই একে অন্যের কার্য চালাতে পারে। চক্ষু দর্শনে অসমর্থ হলে, ত্বক্‌ দ্বারা স্পর্শ করেই কার্যসিদ্ধি করা হয়। অতএব, মনের প্রপঞ্চের বৃদ্ধি ‘সংকল্প’ ও ‘দৃষ্টি’ দ্বারা হয়। মনের চক্ষু ‘সংকল্প’, শরীরের চক্ষু ‘স্পর্শ’ ও ‘দৃষ্টি’। যখন যথার্থ দৃষ্টি এসে যায়, তখনই তো মুক্তি লাভ হয়; আর দৃষ্টিতে মোহ এসে পড়লে, তখন সংসারে জন্ম-মৃত্যুর চক্র চলতে থাকে। এজন্য উপনিষৎকার ঋষি বলছেন— জীবের স্থূল-শরীরের বৃদ্ধি তো খাদ্য ও পানীয়ের সম্যক্ সেচন অর্থাৎ ভোজন দ্বারা হয়, কিন্তু মনের মধ্যে প্রপঞ্চ ততক্ষণ চলে, যতক্ষণ ‘যথার্থ দৃষ্টি’ থাকে না, যখন সংকল্প-স্পর্শ-দৃষ্টি এর মোহ জীবকে ঘিরে ফেলে। ‘যথার্থ দৃষ্টি’ উৎপন্ন হওয়ার ফলে জীব মনের বন্ধন (বিষয়-বাসনা) থেকে মুক্ত হয়ে যায়।


জীবাত্মার নানা যোনিতে গমনাগমনের কারণ শ্রুতি বলছেন—


স্থূলানি সূক্ষ্মাণি বহূনি চৈব রূপাণি দেহী স্বগুণৈর্বৃণোতি।
ক্রিয়াগুণৈরাত্মগুণৈশ্চ তেষাং সংয়োগহেতুরপরোঽপি দৃষ্টঃ॥

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্‌ ৫.১২

সরলার্থঃ
জীবাত্মা নিজের পুণ্য ও পাপময় গুণ অনুসারে স্থূল, সূক্ষ্ম অনেক প্রকার শরীর ধারণ করেন। আত্মার নিজের কর্মের গুণ ও নিজের স্বাভাবিক গুণের দ্বারা শরীরের সাথে সেই জীবাত্মার সংযোগের কারণ পরমাত্মাকেও সম্যক্ জানা যায়। 

জীবাত্মা নিজের কৃত শুভ-অশুভ কর্মের কারণে স্থূল ও সূক্ষ্ম অনেক প্রকারের শরীর প্রাপ্ত হন। দেহের সাথে আত্মার সম্বন্ধ কী কারণে হয়েছে? এর উত্তরে ঋষি বলছেন, আত্মায় নিজের ক্রিয়া বা কর্মের যে গুণ এবং ক্রিয়ার অতিরিক্ত তার নিজের যে স্বাভাবিক আত্মগুণ থাকে, সেটিই শরীরের সাথে সংযোগের কারণ। যদিও জীবের শরীর ধারণের মূল কারণ পরমাত্মা; কেননা জীব কর্মে স্বতন্ত্র, কিন্তু কর্মফল ভোগের ক্ষেত্রে পরতন্ত্র অর্থাৎ ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণাধীন। যদি জীব নিজের কর্মে স্বাধীন না হতো এবং তার নিজস্ব ইচ্ছা, দ্বেষ না থাকতো, তবে কী অপরাধে জীব বিভিন্ন যোনিতে জন্মগ্রহণ করতো? তাই যদিও ঈশ্বরের দ্বারা নির্ধারিত নিয়মানুসারে জীব জন্মগ্রহণ করে, তবুও নিজের পাপ ও পুণ্যরূপ কর্মের প্রভাবে বিভিন্ন যোনিতে শরীর ধারণের কারণ জীবাত্মা নিজেই।

প্রকৃতপক্ষে এই কথাটি মূলত বিয়ের গুরুত্ব, বৈবাহিক সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশে আতিশায্য । বিবাহ সাতটি জন্মের বন্ধন নয়, এটি আসলে দুটি হৃদয়ের মধুর আবেগের এক চিরন্তন গল্প। এটি কোনো শর্তের বা সময়ের বাঁধনে বাঁধা নয়, বরং এটি এক অমোঘ সম্পর্ক, যা অনুভূতির গভীরতা থেকে জন্ম নেয়। দুই জনের একে অপরের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, যে ভালোবাসা কোনো সীমা বা সময়ের গণ্ডি জানে না। বিবাহ মানে শুধু একটি আইনি বা সামাজিক বন্ধন নয়, এটি হলো অনুভূতির এক অসীম স্রোত, যেখানে আবেগের তীব্রতা একে অপরকে অনুভব করতে শেখায়, একে অপরের কষ্টে বা আনন্দে শামিল হতে শেখায়। তাই, বিবাহ আসলে একটি জীবনের সবচেয়ে সূক্ষ্ম এবং সুন্দর অনুভূতির চিত্র, যা জন্ম নেয় শুধুমাত্র প্রেম ও বিশ্বাসের ভিতর।

 বিবাহ সাতটি জন্মের বন্ধন নয়,
এটি তো একটি আবেগের স্নিগ্ধ নদী,
যার তরঙ্গে মিশে থাকে দু’টি প্রাণের সুর,
যারা একে অপরকে ভালোবাসে,
কেবল এই মুহূর্তে,
কেবল এই জীবনে।
বন্ধন নয়, এটি তীব্র অনুভূতির রাগ,
যা হৃদয়ে বেজে ওঠে,
যেখানে কোনো সময় নেই,
কেবল একে অপরের পাশে থাকা,
কেবল প্রেমের গভীরতা।

অনেকে বলতে পারেন, এই কথা বলা উচিত নয়  কেননা এতে বৈবাহিক সম্পর্কের মাহাত্ম্য হ্রাস পাবে । প্রকৃতপক্ষে ধারণাটি ভুল, কেননা বিবাহের ন্যায় পবিত্র সংস্কার বিষয়ে কোন ভ্রান্ত ধারণা থাকা উচিত নয় । আর যদি বিবাহিত নারী-পুরুষরাই ধর্মীয় ভিত্তিস্বরূপ বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী থাকেন তবে ভবিষ্যত প্রজন্ম কী শিখবে ? তাই আমাদের উচিত ধর্মীয় ভিত্তিগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়া  । 

📍 শিক্ষা ও শাস্ত্রার্থ বিভাগ 

© বাংলাদেশ অগ্নিবীর

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)