বেদমাতা আমাদের আহ্বান জানায়— যজ্ঞে বসে অগ্নিতে আহুতি নিবেদন করতে হবে, সেইসঙ্গে হৃদয়ভরা মন্ত্রোচ্চারণও আবশ্যক।
উপপ্রয়ন্তো অধ্বরং মন্ত্রং বোচেমাগ্নয়ে [ঋগ্বেদ ১।৭৪।১]অর্থাৎ, অহিংস অগ্নিহোত্রের সময় মন্ত্রোচ্চারণ করো।
ওহে ভক্তবৃন্দ ! যজ্ঞের অগ্নিসভায় বসে শুধু দেহে নয়, বাক্যে মন্ত্রধ্বনি জাগিয়ে এবং মনে তার অর্থধ্যান করে অর্ঘ্য দান করো। মন যেন প্রবাহিত হয় সেই অগ্নির দিকে, যেখানে জীবনের সকল তমসা দীপ্তিতে রূপান্তরিত হয়।
মন যেন সম্পূর্ণভাবে সেই মহৎ কর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়। কারণ, শুধু বাহ্যিক আহুতি নয়, মন ও বাক্যের পবিত্র সমন্বয়ে যজ্ঞ পরিপূর্ণ হয়। এজন্য বেদ বলছে,
অগ্নিমিন্ধানী মনসা ধিয়ং সচেত মর্ত্যঃ [ঋগ্বেদ ৮।১০২।২২]অর্থাৎ, শ্রদ্ধার সাথে যজ্ঞাগ্নিকে প্রদীপ্ত করতে করতে যজমান মানব যজ্ঞবিধিকেও সম্পন্ন করেন।
শুধু অগ্নিতে সামগ্রী অর্পণ করলেই বায়ুশুদ্ধি ও রোগনিবারণ হতে পারে। কিন্তু অগ্নিহোত্রের উদ্দেশ্য এতটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়।
মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে, তার গভীর অর্থ-চিন্তনের মাধ্যমে এবং বিধির অন্তর্নিহিত অনুভবকে হৃদয়ে ধারণ করে, যজ্ঞ আমাদের এক অনুপম আত্মিক আহার প্রদান করে। এ আহার দেহের নয়, আত্মার — যেখানে চেতনা জেগে ওঠে, হৃদয় প্রফুল্ল হয়, মন উদ্দীপ্ত হয় পূর্ণতার অভিমুখে।
যজ্ঞে বসে শুধু অগ্নিতে দায়মাত্রে আহুতি দান করলেই হয় না; প্রয়োজন হৃদয়ের স্ফুরণ, প্রয়োজন শব্দস্রোতে মন্ত্রোচ্চারণের পবিত্র ধ্বনি, প্রয়োজন মননভরা আরাধনা। মন, বাক্য ও কর্মের সম্মিলনেই সম্পূর্ণ হয় যজ্ঞের সাধনা।
কেবল ধূপগন্ধে বায়ুশুদ্ধি হতে পারে,
কেবল যজ্ঞাগ্নির ওষধীর প্রভাবে
দূর হতে পারে রোগের ছায়া;
কিন্তু অগ্নিহোত্রের গভীর উদ্দেশ্য
তার চেয়েও অনন্তগভীর।
এ এক আত্মিক অর্ঘ্য—
যেখানে মন্ত্রের প্রতিটি উচ্চারণে
জেগে ওঠে অন্তঃচেতনার দীপ্তি,
আহুতির প্রতিটি অঙ্গুলিতে
প্রস্ফুটিত হয় অন্তরের পুষ্পাঞ্জলি।
এ তো আত্মার এক মহোৎসব, যেখানে মন্ত্রোচ্চারণের ধ্বনিতে, অন্তর্চিন্তনের দীপ্তিতে এবং বিধিবদ্ধ আচরণের শুদ্ধতায়, আমরা পান করি এক অনির্বচনীয় আধ্যাত্মিক আহার।
এই আহার হৃদয়ের, এই আহার চেতনার — যেখানে ক্ষুদ্রতা লুপ্ত হয়ে, আমরা অনুভব করি অনন্তের স্পর্শ।
মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে এবং মন্ত্রগুলির অর্থ নিয়ে চেতনায় ভাবতে ভাবতে ও বিধিবদ্ধ নিয়মগুলির উদ্দেশ্য হৃদয়ে অনুভব করতে করতে আমরা যে আত্মিক আহার লাভ করি, সেটাও অগ্নিহোত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দান। ভক্তরা দেখবেন, এই বিধি ও মন্ত্রগুলিতে কত গভীর বিস্ময় নিহিত আছে। যেখানে ভক্ত আবিষ্কার করবেন— কত রহস্য, কত গভীর শক্তি নিহিত রয়েছে প্রতিটি ধ্বনিতে, প্রতিটি অনুশাসনে। যখন আমরা মন্ত্রের অনুরণনে হৃদয় ভরিয়ে আহুতি প্রদান করি, তখন অল্প সময়ের মধ্যেই অনুভব করি— এক অনির্বচনীয় অর্জন, এক নবচেতনার আলোকস্নান।
প্রতিটি বিধি, প্রতিটি মন্ত্র যেন এক রহস্যময় প্রদীপ,
যা আলোকিত করে জীবনের দিকপথ।
মন্ত্রোচ্চারণের আবেশে এবং হৃদয়ের নিঃশব্দ আরতিতে
হোমের কয়েকটি মুহূর্তই রূপ নেয় এক বিশাল আত্মার উল্লাসে।
মন প্রসন্ন হয়, চেতনা উদ্দীপ্ত হয়,
পথ খোলে পূর্ণতার অমল সূর্যের দিকে।
আমরা যখন মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে এবং সেই মন্ত্রসমূহের অন্তর্নিহিত ভাবনায় আমাদের হৃদয়কে পূর্ণ করে হোম করবো, তখন অনুভব করবো যে মাত্র অর্ধঘণ্টার অগ্নিহোত্রের মধ্যেই আমরা কত বড় এক অর্জন করেছি, আমাদের মন কতটা প্রফুল্ল, উদ্যমী এবং পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গেছে।
আর যারা প্রশ্ন করেন— "শুধু হোমেই যদি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তবে মন্ত্রপাঠ কেন?"
মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী 'ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা'-তে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেন—
মন্ত্রপাঠ বেদসমূহের রক্ষা করে, ইন্ধনের প্রতি স্তুতি, প্রার্থনা ও উপাসনা প্রকাশ করে। হোমের ফলশ্রুতিও স্মরণ করায়। মন্ত্রের পুনরাবৃত্তিতে তারা কণ্ঠস্থ হয়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্পষ্টতর হয়ে ওঠে, এবং প্রতিটি কর্ম ঈশ্বরকে স্মরণ করেই আরম্ভ হয়। যজ্ঞের প্রতিটি পরতে পরতে তখন ঈশ্বরপ্রেমের সুর ধ্বনিত হতে থাকে।
মন্ত্রে রয়েছে সেই ব্যাখ্যা, যা হোমের অন্তর্নিহিত ফলাফল প্রকাশ করে। তাদের পাঠের মধ্য দিয়ে বেদপাঠ ও সংরক্ষণও সাধিত হয়।
[সূত্র: ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, বেদবিষয়বিচার, কর্মকাণ্ড প্রকরণ]
মন্ত্রপাঠ বেদের রক্ষক, বেদের ধারক;
ইন্ধনের বন্দনা, ঈশ্বরের প্রার্থনা ও উপাসনার বহিঃপ্রকাশ। মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি কণ্ঠস্থ করে আমাদের স্মৃতি,
সতত স্মরণ করায় ঈশ্বরের সর্বব্যাপী উপস্থিতি।
প্রত্যেক যজ্ঞ, প্রত্যেক কর্মের সূচনা হয়—
ঈশ্বরের প্রতি প্রণত হৃদয় নিয়ে।
মন্ত্রই ব্যাখ্যা করে হোমের অন্তর্নিহিত মহিমা,
পাঠ করে আমরা সংরক্ষণ করি বেদের চিরন্তন ধারা।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর