প্রশ্ন: সবাই ভুল আর আমিই একমাত্র ঠিক কীভাবে ? এটা কি অহংকার না ?
উত্তর: নমস্তে!
সুপ্রিয় প্রশ্নকর্তা, আপনি ও আমি সবাই জানি কোনটি সঠিক ও কোনটি ভুল তার একটি মানদণ্ড থাকতে হবে। পৃথিবীতে সব ব্যক্তিই আলাদা এবং প্রত্যেকের নিজ নিজ চিন্তাধারা আছে। সবাই মনে করে তার পক্ষই ঠিক এবং অন্যের পক্ষ ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু আমরা যদি ভেবে দেখি, একই সাথে সব ঠিক হতেও পারে না, আবার একই সাথে সব ভুলও হতে পারেনা। কেন ? কারণ পরস্পরবিরোধী দুইটি সিদ্ধান্ত ঠিক হওয়া অসম্ভব। আবার যদি আমি কাউকে ভুল বলি তাহলে আমাকে এটাও বলতে হবে কেন ও কোন যুক্তিতে আমি সেটিকে ভুল বলছি। অর্থাৎ যদি আমি না জানি সঠিক কোনটি তাহলে দ্ব্যর্থহীনভাবে বাকি সব বিষয়কে ভুল বা সবই সঠিক বলা খুবই কঠিন।
কেউ কেউ বলেন, 'এত মানুষ যা মানে তা ভুল কীভাবে হয় ?'। আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে,
❝ যা ধর্ম তা সত্য। সত্য বা ধর্ম কোনো গণতান্ত্রিক বিষয় নয়। যা সত্য তা ১জন মানুষও যদি মানে বা কেউ যদি না মানে তারপরেও সত্যই থাকবে। যা মিথ্যা তা যদি সবাই মানে তাও সেটা মিথ্যাই থাকবে।❞
প্রিয় পাঠক! আসুন, একটি উদাহরণ দিয়ে আপনাকে বিষয়টি বোঝাই। দেখুন, বর্তমান পৃথিবীতে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মতবাদের উপর ভিত্তি করে জনসংখ্যা বিবেচনায় অধঃক্রমানুসারে রয়েছে-
১। খ্রিস্টমত
২। ইসলাম মত
৩। অজ্ঞেয়বাদ
৪। সনাতন ধর্ম
৫। বৌদ্ধ মত
সূত্র: Religious Composition by Country, 2010-2050". Pew Research Center. 2 April 2015. Archived from the original on 28 January 2023. Retrieved 28 January 2023
লক্ষ্যণীয়, যদি আমরা 'এত মানুষ মানে তাহলে অবশ্যই সত্য' এই দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে খ্রিস্ট মত সর্বাধিক সত্য, তারপর আসে ইসলাম, তারপর অজ্ঞেয়বাদ বা ধর্মীয় পরিচয়হীন এবং তারপর আসে চতুর্থ স্থানে সনাতন ধর্ম। এখন যদি আপনি অজ্ঞেয়বাদ বা ধর্মহীনতাকে এখানে গণনা নাও করতে চান তারপরেও কিন্তু আপনার চেয়ে ইসলাম ও খ্রিস্ট মতের অনুসারীরা জনসংখ্যায় এগিয়ে। তাহলে এখন যদি কেউ বলে যেহেতু সব থেকে বেশি মানুষ খ্রিস্টমত মানে তাহলে কি আপনি মেনে নেবেন ? ইসলাম মত অনুযায়ী তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ব্যতীত বাকি সব অগ্রহণযোগ্য। তাহলে তারাও জনসংখ্যা তত্ত্ব স্বীকার করছে না। অর্থাৎ আপনি জনসংখ্যা বা 'বেশি মানুষ মানে' এই যুক্তিতে কখনোই ইসলাম ও খ্রিস্ট মতকে অধিকতর সত্য বলে মেনে নেবেন না, বরং যুক্তিতর্ক ও প্রমাণ দিয়ে দেখাতে চাইবেন কেন আপনারটাই একমাত্র কিংবা অধিকতর সঠিক। সুতরাং আপনাকেও কিন্তু যুক্তি-প্রমাণ-সত্যে আসতে হচ্ছেই। তাহলে নিঃসন্দেহে 'আমার মতই সত্য' এটা বলার ও প্রমাণ করার অধিকার ও যৌক্তিকতাও আমার আছে। কারণ, সত্য কখনোই পরিমাণগত নয়।
যারা এই জাতীয় সত্যান্বেষণ করতে চান না তাদের দুইটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। (১) ইনারা 'উদার' এমন একটা পরিচয় তৈরি করতে চান (২) ইনারা অলস। দুইটি দলই একটি দোষে দুষ্ট। তা হলো, তারা মিথ্যা বা অবিদ্যার প্রচারের সুযোগ দিচ্ছেন। আপনি যদি সত্য জানেন তবে মিথ্যাকে দূর করাও আপনার কর্তব্য। 'মনুষ্য' শব্দটি এসেছে মননশীলতা থেকে। আপনি যদি নিজেকে সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান প্রজাতির একজন সদস্য বলে আখ্যায়িত করে সমাজে মিথ্যার বিস্তার হতে সাহায্য করেন বা নীরব থাকেন তবে আপনিও সেই একই দোষে অপরাধী। অবিদ্যার বিস্তারে নীরব থাকে উদারতা বলে না। অন্যায় যে করে তার সমান অপরাধী অন্যায়কে যারা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। আপনি বলতেই পারেন 'অমুক তার মত প্রচার করছে তো না এতে সমাজের ক্ষতি হচ্ছে না সে জোর করছে অন্যদের' - এই কথাটি যুক্তিহীন। একজন ব্যক্তি সমাজে, ধরা যাক, প্রচার করছে যে, 'ঘোড়ার ডিম হয়' এবং যারা এটা বিশ্বাস করে না তারা চূড়ান্ত পাপী ও পরকালে দুঃখভাগী হবে। এখন সেই ব্যক্তি যদি কাউকে জোর নাও করে তাও সে অবিদ্যার প্রচারে দুষ্ট এবং অন্যদের প্রতি অযাচিত বিদ্বেষ প্রসারে দায়ী। তাহলে অবশ্যই তার নিবারণ আবশ্যক ও সত্যের প্রচার জরুরী। এজন্য তথাকথিত 'উদার' হওয়ার আড়ালে হয় একটি স্বার্থান্বেষী চরিত্র লুকায়িত আছে কিংবা নিজের বিদ্যার অপব্যবহার বা অব্যবহার রয়েছে। প্রকৃত শিক্ষিত ও বিচক্ষণ ব্যক্তি এবং যারা দেশ ও সমাজের উপকার করতে ইচ্ছুক তারা কখনোই অবিদ্যার বিস্তার মেনে নেয় না।
পৃথিবীতে দরিদ্রের সংখ্যা ধনী থেকে বেশি, তাই বলে দারিদ্র্য ভালো নয়। আমরা সমাজে বুদ্ধিমান মানুষ কম, বোকা মানুষদের বেশি দেখি, তাতে বুদ্ধির মূল্য ও গুরুত্ব কমে যায় না। আদিকাল থেকেই বিজ্ঞানী, গবেষক, সাহিত্যিক প্রভৃতি প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা সংখ্যায় কমই হন, তাই বলে কি তারা মূল্যহীন? সমাজের অধিকাংশ মানুষই স্বার্থপরায়ণ, তাই বলে মানবতা কি জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হবে না ?
গুণগতভাবে যা উত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ তা সর্বকালীন ও সর্বজনীন। এটি অহংকার নয়। মিথ্যা সর্বদা সত্যের ভয়ে ভীত থাকে। যদি সূর্যের আলোকে আমার চোখ সহ্য করতে না পারে তবে তা আমার চোখের সীমাবদ্ধতা। যদি ১০ লিটারের পাত্রে ১০০ লিটার জল না আঁটে তবে তা পাত্রের সীমাবদ্ধতা। এতে না সূর্যের দোষ, না জলের পরিমাণের দোষ। আমাদের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা দিয়ে আমরা যদি ভুল ও ঠিক ধর্ম-ধর্মমত বিচার করতে যাই তবে তা হবে অজ্ঞতা। একইভাবে আমাদের জীবনে ধর্মাচারণের ঐশ্বরিকবিধিবিধান আছে, শ্রুত্যাদি গ্রন্থ বিদ্যমান। আমাদের সমগ্র শাস্ত্র মুহুর্মুহু বেদকে অগ্রাধিকারদানপূর্বক বেদানুকূল শাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যার প্রয়োগের মাধ্যমে সত্য নির্ণয় করতে উৎসাহিত করছে। এটি অহংকার নয়, সত্য বলা কখনো ভ্রান্তি নয়, সত্যের প্রচার করা কখনো দুষ্কর্ম নয় বরং মহাপুণ্যকাজ। সত্যের ডঙ্কানিনাদই পারে অজ্ঞানকে দূর করতে। সত্যের আলোকই পারে অবিদ্যার অন্ধকারকে দূর করে নতুন প্রভাত আনতে। কারণ,
সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম
[তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ব্রহ্মানন্দবল্লী প্রথমোঽনুবাক]
ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞানস্বরূপ, অনন্ত।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর