বৈদিক পরিবার সূত্র
(পারিবারিক আচরণবিধি)
বৈদিক সনাতন ধর্মে পরিবার ছিল ধর্ম, প্রেম ও ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু। বেদমন্ত্রসমূহে গৃহস্থাশ্রমকে কেবল পার্থিব নয়, দেবোন্মুখ এক আধ্যাত্মিক সাধনা হিসেবে দেখা হয়েছে, যেখানে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, সন্তান ও কুটুম্ববর্গ পরস্পরের প্রেম, দায়িত্ব ও ভক্তির মাধ্যমে এক দৈবী পরিবাররূপে গঠিত হয়। এই মন্ত্রগুলো সেই ঐক্য, শুচিতা ও আত্মিক মিলনেরই চিরন্তন নির্দেশ।
সং ত্বা নহ্যামি পয়সা পৃথিব্যাঃ সং ত্বা নহ্যামি পয়সৌষধীনাম্ ।
সং ত্বা নহ্যামি প্রজয়া ধনেন সা সংনদ্ধা সনুহি বাজমেমম্ ॥
অমোঽহমস্মি সা ত্বং সামাহমস্ম্যৃক্ত্বং দ্যৌরহং পৃথিবী ত্বম্ ।
তাবিহ সং ভবাব প্রজামা জনয়াবহৈ ॥
অথর্ববেদ ১৪.২.৭০-৭১
ভাবানুবাদ: হে নববধূ, হে নববর, হে দম্পতি! আমি তোমাদের যুক্ত করছি, দৃঢ় করছি এবং পৃথিবীর পুষ্টিদুগ্ধরূপী বর্মে তোমাদের রক্ষা করছি। আমি তোমাদের যুক্ত করছি, দৃঢ় করছি এবং ঔষধি ও উদ্ভিদের পুষ্টিসুধা দিয়ে তোমাদের রক্ষা করছি। আমি তোমাদের যুক্ত করছি, দৃঢ় করছি এবং সন্তান-সৌভাগ্য ও ঐশ্বর্য-সমৃদ্ধির আশীর্বাদ দিচ্ছি। হে নববধূ, এইভাবে সংযুক্ত, দৃঢ় ও সুরক্ষিত হয়ে তুমি এই বল, ঐশ্বর্য ও জীবনের সিদ্ধিলাভ উপভোগ করো।
[এবার বর-বধূর ভগবদ্ভক্তিপূর্ণ উদ্গার]
আমি [বর] সেই, পুরুষরূপী পরম পুরুষ; তুমি [বধূ] সেই, প্রকৃতির মানবরূপা শক্তি। আমি সাম, তুমি ঋক্। আমি দ্যুলোক, তুমি পৃথিবী। এসো, আমরা দুজনে একত্র হয়ে এক হই, এবং একসাথে সৃষ্টি করি সন্তানসম্ভব ভবিষ্যৎ।
সহৃদয়ং সাংমনস্যমবিদ্বেষং কৃণোমি বঃ ।
অন্যো অন্যমভি হর্যত বৎসং জাতমিবাঘ্ন্যা ॥
অথর্ববেদ ৩.৩০.১
ভাবানুবাদ: আমি [ব্রহ্ম] - তোমাদের প্রেমপূর্ণ হৃদয়, ঐক্যবদ্ধ মন ও হিংসা-ঈর্ষামুক্ত চিত্ত নিয়ে এক গোষ্ঠীরূপে সৃষ্টি করেছি। তোমরা সকলে পরস্পরকে ভালোবাসো, যেমন পবিত্র ও অব্যাহত মাতৃগাভী তার নবজাত বাছুরকে স্নেহভরে চুম্বন ও আদর করে, তেমনি সকলেই সকলকে স্নেহ ও মমতায় ভালোবাসো।
অনুব্রতঃ পিতুঃ পুত্রো মাত্রা ভবতু সংমনাঃ ।
জায়া পত্যে মধুমতীং বাচং বদতু শন্তিবাম্ ॥
অথর্ববেদ ৩.৩০.২
ভাবানুবাদ: [পরমাত্মার উপদেশ] পুত্র যেন পিতার প্রতি নিবেদিত হয়, হৃদয়ে ও মনে একাকার হয়ে এবং মাতার সঙ্গে প্রেম, ভক্তি ও পারিবারিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্যে অবিচল থাকে। পত্নী যেন স্বামীর সঙ্গে এমন মধুর বাক্যে কথা বলে, যা পারিবারিক প্রেম, সৌহার্দ্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।
মা ভ্রাতা ভ্রাতরং দ্বিক্ষন্মা স্বসারমুত স্বসা ।
সম্যঞ্চঃ সব্রতা ভূত্বা বাচং বদত ভদ্রয়া ॥
অথর্ববেদ ৩.৩০.৩
ভাবানুবাদ: [পরমাত্মার শিক্ষা] ভাই যেন ভাইকে ঘৃণা না করে, বোন যেন বোনের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে। সকলেই প্রেম ও সহযোগিতায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে, অভিন্ন মূল্যবোধ ও সমজাত আদর্শে নিবেদিত থেকে, এমন বাক্যে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলুক যা সর্বজনীন মঙ্গল ও সাধারণ কল্যাণসাধনে সহায়ক হয়।
সমানী প্রপা সহ বোঽন্নভাগঃ সমানে যোক্ত্রে সহ বো যুনজ্মি ।
সম্যঞ্চোঽগ্নিং সপর্যতারা নাভিমিবাভিতঃ ॥
অথর্ববেদ ৩.৩০.৬
ভাবানুবাদ: [পরমাত্মার আদেশ] তোমাদের জলের কেন্দ্র হোক এক ও অভিন্ন, তোমাদের আহার হোক এক ও সবার মাঝে সমভাবে ভাগ্য। আমি তোমাদের সকলকে এক সাধারণ, সর্বব্যাপী আত্মিক বন্ধনে যুক্ত করি। তোমরা সকলে এক জ্ঞানপ্রকাশস্বরূপ পরমাত্মারই উপাসনা করো, একই যজ্ঞে, যেমন চাকার সব অর এক কেন্দ্রীয় অক্ষকে ঘিরে আবর্তিত হয় তেমনি ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন-সমাজ পরিক্রমা করো।
সধ্রীচীনান্ বঃ সংমনসস্কৃণোম্যেকশ্নুষ্টীন্ত্সংবননেন সর্বান্ ।
দেবা ইবামৃতং রক্ষমাণাঃ সায়ম্প্রাতঃ সৌমনসো বো অস্তু ॥
অথর্ববেদ ৩.৩০.৭
ভাবানুবাদ: [পরমাত্মার আশীর্বাদ] আমি তোমাদের সকলকে এক অভিন্ন প্রেমে, এক অভিন্ন আনুগত্যে, এক আদেশের অধীন এক সম্প্রদায় হিসেবে যুক্ত করছি, যেন তোমরা এক হৃদয় ও এক মন নিয়ে ঐক্যে কাজ করো। তোমরা সকলেই হও উজ্জ্বল, জ্ঞানদীপ্ত, উদার ও সৃষ্টিশীল দৈবীসম্পদশালীর মতো, যারা জীবনের আনন্দরসকে রক্ষা ও বিকশিত করে। তোমাদের হৃদয় দিনরাত আনন্দে ভরে উঠুক, জীবনের ঐক্যময় উল্লাসের উৎসবে মগ্ন হয়ে।
পুনন্তু মা দেবজনাঃ পুনন্তু মনসা ধিয়ঃ ।
পুনন্তু বিশ্বা ভূতানি জাতবেদঃ পুনীহি মা ॥
যজুর্বেদ ১৯.৩৯
ভাবানুবাদ: হে জন্মগ্রহণকারীদের মধ্যে জ্ঞানীজন! যেমন প্রাজ্ঞগণ জ্ঞান ও প্রেম দ্বারা আমাকে পরিশুদ্ধ করেন, যেমন তাঁরা আমাদের বুদ্ধিকে নির্মল করেন, এবং যেমন সমস্ত ভৌতিক বস্তু আমাকে বিশুদ্ধ করে তেমনি তুমিও আমায় পরিশুদ্ধ করো।
পুনন্তু মা পিতরঃ সোম্যাসঃ পুনন্তু মা পিতামহাঃ । পুনন্তু প্রপিতামহাঃ পবিত্রেণ শতায়ুষা । পুনন্তু মা পিতামহাঃ সোম্যাসঃ পুনন্তু প্রপিতামহাঃ । পবিত্রেণ শতায়ুষা বিশ্বমায়ুর্ব্যশ্নবৈ ॥
যজুর্বেদ ১৯.৩৭
ভাবানুবাদ: [ভক্তের হৃদয়াকাঙ্ক্ষা] আমার পিতা-মাতা, পিতামহ-মাতামহ ও প্রপিতামহ-প্রমাতামহ, যাঁরা দয়ালু, কল্যাণময় ও শ্রদ্ধেয়, তাঁরা যেন শাসন ও শিক্ষার পবিত্রতায় আমাকে শুদ্ধ ও পবিত্র করেন শতবর্ষব্যাপী জীবনের জন্য। আমার পিতামহ-মাতামহ ও প্রপিতামহ-প্রমাতামহ যেন নৈতিক জীবন ও বিদ্যার নির্মলতায় আমাকে শুদ্ধ ও পবিত্র করেন, যাতে তাঁদের আশীর্বাদে আমি পূর্ণ আয়ুর শতবর্ষজীবন লাভ করি।
জ্যায়স্বন্তশ্চিত্তিনো মা বি যৌষ্ট সংরাধয়ন্তঃ সধুরাশ্চরন্তঃ ।
অন্যো অন্যস্মৈ বল্গু বদন্ত এত সধ্রীচীনান্ বঃ সংমনসস্ক্র্ণোমি ॥
অথর্ববেদ ৩.৩০.৫
ভাবানুবাদ: তোমরা সকলে, পরস্পরকে অতিক্রম করেও, হৃদয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকো, চিত্তে সমান ও অভিন্ন হও। কখনো বিভক্ত হয়ো না, বিচ্ছিন্ন হয়ো না, সমাজের দায়িত্ব একত্রে বহন করে, যেমন চাকার দণ্ডগুলো কেন্দ্রীয় অক্ষকে ঘিরে একত্রে ঘুরে চলে, তেমনি লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলো। পরস্পরকে স্নেহমিশ্রিত আহ্বানে ও উৎসাহের বাণীতে ডাকো ও উদ্বুদ্ধ করো। আমি [পরমেশ্বর] তোমাদের সকলকে সৃষ্টি করেছি, এবং তোমাদের এক হৃদয়, এক মন, এক পরিবার, এক জাতি - এভাবে এক গোষ্ঠীরূপে যুক্ত করেছি।
সস্তু মাতা সস্তু পিতা সস্তু শ্বা সস্তু বিশ্পতিঃ ।
সসন্তু সর্বে জ্ঞাতয়ঃ সস্ত্বয়মভিতো জনঃ ॥
ঋগ্বেদ ৭.৫৫.৫
ভাবানুবাদ: সুশৃঙ্খল আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থায় জননী যেন শান্তিতে নিদ্রা যায়, জনক যেন শান্তিতে বিশ্রাম নেন, প্রহরী যেন নিরাপত্তা ও শান্তির নিশ্চয়তা অনুভব করে, সমাজনেতা যেন প্রশান্তচিত্তে বিশ্রাম নেন এবং মানবসমাজের এই জাতি যেন সর্বদিক থেকে, সর্বপ্রকারে শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৈদিক পরিবারবোধ কোনো সংকীর্ণ গৃহনীতি নয়, বরং বিশ্ব-ঐক্যের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। যেখানে হৃদয় ভক্তিতে, বাক্য মধুরতায়, মন ঐক্যে ও জীবন ধর্মে নিবেদিত-সেই পরিবারই “গৃহ” থেকে “গৃহাশ্রম” হয়ে ওঠে। এই আচরণবিধি মানুষকে শিখায়-ঐক্যেই ধর্ম, প্রেমেই শক্তি, এবং পরিবারেই ঈশ্বরের বাস।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর
